জ্যোতিষশাস্ত্র
প্রবেশিকা (অন্যান্য
অনুচ্ছেদ)
স্বক্ষেত্র
আগেই বলা হয়েছে ( ৩য় অনুচ্ছেদ
), রবি ও চন্দ্র ছাড়া প্রত্যেকটি গ্রহই দু'টি করে রাশির অধিপতি
(lord)। ঐ রাশিগুলিকে ঐ সব গ্রহের স্বক্ষেত্র বলা হয়। যেমন,
মঙ্গলের স্বক্ষেত্র মেষ ও বৃশ্চিক; বৃহস্পতির স্বক্ষেত্র ধনু
ও মীন; রবির স্বক্ষেত্র সিংহ; চন্দ্রের স্বক্ষেত্র কর্কট ইত্যাদি।
রাহুর স্বক্ষেত্র কন্যা ও কেতুর স্বক্ষেত্র মীন। যদিও এই দু'টি
গ্রহ সম্বন্ধে মতভেদ আছে।
মূলত্রিকোণ
কোনো কোনো রাশির কিছু অংশকে
বিশেষ কিছু গ্রহের মূলত্রিকোণ বলা হয়। যেমন, রবির মূলত্রিকোণ
সিংহের প্রথম ২০ ডিগ্রি; চন্দ্রের মূলত্রিকোণ বৃষের ৪ থেকে ২০
ডিগ্রি; মঙ্গলের মূলত্রিকোণ মেষের প্রথম ১২ ডিগ্রি; বুধের মূলত্রিকোণ
কন্যার ১৬ ডিগ্রি থেকে ২০ ডিগ্রি; বৃহস্পতির মূলত্রিকোণ ধনুর
প্রথম ১০ ডিগ্রি; এইভাবে শুক্র - তুলার প্রথম ১৫ ডিগ্রি; শনি
- কুম্ভের প্রথম ২০ ডিগ্রি; রাহু - কুম্ভ রাশি এবং কেতু - সিংহ
রাশি। তবে বিভিন্ন মতে কয়েক ডিগ্রির তারতম্য দেখা যায়।
তুঙ্গস্থান
এ ছাড়াও প্রত্যেকটি গ্রহের
একটি করে উচ্চ (exalted) বা তুঙ্গক্ষেত্র আছে। রবির তুঙ্গস্থান
মেষরাশি; চন্দ্রের তুঙ্গস্থান বৃষরাশি; এইভাবে, মঙ্গলের - মকর;
বুধের - কন্যা; বৃহস্পতির - কর্কট; শুক্রের - মীন; শনির - তুলা;
রাহুর - মিথুন ও কেতুর - ধনু। পরাশরের মতে রাহুর তুঙ্গস্থান
বৃষ ও কেতুর তুঙ্গস্থান বৃশ্চিক। উপরি উক্ত রাশিগুলিতে গ্রহগুলি
একটি বিশেষ অবস্থানে সুতুঙ্গী (most exalted) হয়।
রবি মেষের ১০ ডিগ্রিতে;
চন্দ্র বৃষের ৩ ডিগ্রিতে; মঙ্গল মকরের ২৮ ডিগ্রিতে; বুধ কন্যার
১৫ ডিগ্রিতে; বৃহস্পতি কর্কটের ৫ ডিগ্রিতে; শুক্র মীনের ২৭ ডিগ্রিতে;
শনি তুলার ২০ ডিগ্রিতে; রাহু মিথুনের ২০ ডিগ্রিতে এবং কেতু ধনুর
২০ ডিগ্রিতে সুতুঙ্গী।
তুঙ্গক্ষেত্র অতিক্রম করার
পরেই গ্রহগুলির শক্তি ক্রমশঃ কমতে থাকে। এইসব গ্রহকে বলা হয়
অবরোহী। তুঙ্গস্থানের দিকে যখন কোনও গ্রহ এগিয়ে চলে তখন তাকে
বলা হয় আরোহী বা তুঙ্গাভিলাষী। এইসব গ্রহ যত তুঙ্গক্ষেত্রের
দিকে অগ্রসর হয় তত শক্তিশালী হয়। তবে প্রাথমিকভাবে ফল বিচারের
জন্য খুব বেশী সূক্ষবিচারে না গিয়ে মোটামুটি ভাবে সম্পূর্ণ রাশিকেই
গ্রহটির স্বক্ষেত্র, মূলত্রিকোণ ( মূলত্রিকোণকে আনন্দস্থানও
বলা হয় ) বা তুঙ্গস্থান বলা যায়। যে সব রাশিগুলি গ্রহের তুঙ্গস্থান,
ঠিক বিপরীতে অব্স্থিত রাশি সেই সব গ্রহের নীচস্থান। যেমন, মঙ্গল
মকর রাশিতে তুঙ্গী (exalted) এবং বিপরীত রাশি কর্কট মঙ্গলের
নীচস্থান (place of debilitation)। শুক্র মীনে তুঙ্গী এবং বিপরীত
রাশি কন্যা শুক্রের নীচস্থান। নীচস্থানে কোনও গ্রহ থাকলে, সেটা
দুর্বল হয় এবং সেটা সাধারণতঃ অশুভ ফল দেয়। কোনও গ্রহ স্বক্ষেত্রে
বলবান, মূলত্রিকোণে তার থেকেও বলবান এবং তুঙ্গস্থানে সবচেয়ে
বেশী শক্তিশালী|
সাধারাণভাবে শুভ গ্রহ শক্তিশালী
হলে শুভ ফলের আধিক্য হয় এবং অশুভ গ্রহ শক্তিশালী হলে অশুভ ফলের
হ্রাস হয়। অতএব জন্মকুণ্ডলীতে গ্রহরা যত শক্তিশালী হয় ততই ভাল।
অস্তগত গ্রহ
সব গ্রহের মধ্যে রবিই একমাত্র
দীপ্ত। রবির খুব কাছে কোনো গ্রহ এলে রবির রশ্মিতে সেটা নিস্প্রভ
হয়ে পড়ে। রবির দুই পাশে সাড়ে সাত ডিগ্রি করে মোট ১৫ ডিগ্রি অংশ
রবির দীপ্ত্যংশ। এই অংশের মধ্যে কোন গ্রহ অবস্থিত হলে সেটা অস্তগত
(combust) হয়। এই ধরণের গ্রহ সাধারণত শুভ ফল দেয় না। তবে কোন
কোন সময়ে বুধের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যতিক্রম দেখা যায় বলে জ্যোতিষীরা
মত প্রকাশ করেছেন।
গ্রহদের বল নির্ণয়
শুভগ্রহ কতটা ভাল ফল দেবে
সেটা নির্ভর করবে গ্রহটির অবস্থান ছাড়াও তার শক্তির উপর। এমন
কি অশুভ গ্রহও শক্তিশালী হলে অশুভ ফলের হ্রাস হয়। কোন গ্রহের
বল নির্ণয়ের জন্য ছয়টি বিভিন্ন শক্তির উৎস কাজে লাগিয়ে প্রত্যেকটি
গ্রহের জন্য আলাদা করে বল গণনা করতে হবে। এই ছয়টি নির্ণায়ককে
বলা হয় ষট্বল। কোন গ্রহের সামগ্রিক বল হবে এই ছয়টি বলের যোগফল।
এই ছয়টি হ'ল : - (১) স্থানবল (positional strength); (২) দিক্বল
(directional strength) ; (৩) কলাবল (temporal strength); (৪)
নৈসর্গিক বল (permanent strength); (৫) চেষ্টাবল (motional strength)
; (৬) দৃক্বল (aspect strength)। এর প্রত্যেকটির আবার বিভিন্ন
ভাগ আছে। এগুলি ধরে প্রতিটি গ্রহের বল সংখ্যার আকারে বের করা
যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ও শ্রমসাধ্য ব্যাপার। এই প্রসঙ্গে বি. ভি.
রমণ প্রণীত graha and bhava balas বইটি দেখা যেতে পারে। তবে
বিশদ ভাবে না হলেও এর প্রত্যেকটির সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা
করা যাক।
(১) স্থানবল - এটা বের
করার জন্য গ্রহটি রাশিচক্রে কোথায় অবস্থান করছে সেটা দেখতে হবে।
যদি কোন গ্রহ বন্ধুর ঘরে, স্বক্ষেত্রে, মূলত্রিকোণে বা তুঙ্গীক্ষেত্রে
অবস্থিত হয়, তবে তার বল বেশী হবে। বন্ধুর ঘরের চেয়ে স্বক্ষেত্রে,
স্বক্ষেত্রের থেকে মূলত্রিকোণে, মূলত্রিকোণের চেয়ে তুুঙ্গক্ষেত্রে
এবং সুতুঙ্গী অবস্থায় গ্রহটির বল সবচেয়ে বেশী। গ্রহটি কোন বর্গে
রয়েছে ( ৬ষ্ঠ অনুছেদ ) সেটাও দেখে নিতে হবে।
(২) দিক্বল - কিছু গ্রহ
লগ্ন থেকে কয়েকটি ঘরে বসলে তার দিক্বল বেশী হয়। যেমন বুধ ও
বৃহস্পতি লগ্নে, রবি ও মঙ্গল ১০ম ভাবে, চন্দ্র ও শুক্র ৪র্থ
ভাবে এবং শনি ৭ম ভাবে বলশালী।
(৩) কলাবল - চন্দ্র, মঙ্গল
ও শনি রাত্রি বেলা এবং রবি, বৃহস্পতি ও শুক্র দিনের বেলা বেশী
শক্তিশালী হয়। কলাবলের এ রকম আরও কারণ রয়েছে।
(৪) নৈসর্গিকবল - এই নিয়মে
বল বের করতে গেলে মনে রাখতে হবে যে, কিছু গ্রহ প্রকৃতিগত ভাবেই
অন্য কতকগুলি গ্রহ থেকে শক্তিশালী। যেমন রবি চন্দ্র থেকে এবং
শুক্র বৃহস্পতি থেকে বেশী বলশালী। এইভাবে বেশী থেকে কম বল অনুযায়ী
সাজালে দাঁড়ায় : - রবি, চন্দ্র, শুক্র, বৃহস্পতি, বুধ, মঙ্গল
এবং শনি। অর্থাৎ নৈসর্গিক বলের হিসাবে শনি সব থেকে কম শক্তিশালী।
(৫) চেষ্টাবল - রবি ও চন্দ্র
মকর, কুম্ভ, মীন, মেষ, বৃষ ও মিথুন রাশিতে চেষ্টা বলযুক্ত হয়।
মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র ও শনি বক্রী হলে বা পূর্ণচন্দ্রের
সঙ্গে অবস্থিত হলে চেষ্টা বলযুক্ত হয়।
(৬) দৃক্বল - কোন গ্রহ
শুভ গ্রহের দ্বারা দৃষ্ট হলে দৃক্বলে বলী হয় এবং অশুভ গ্রহের
দৃষ্টি দৃক্বল হ্রাস করে।
জন্মকুণ্ডলী মোটামুটি বিচারের
জন্য এত পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে প্রতিটি নিয়ম অনুযায়ী গ্রহের বল
বিচারের প্রয়োজন নেই। সাধারণতঃ কোনো গ্রহ রাশিচক্রে শত্রুর না
মিত্রের ঘরে কোথায় অবস্থিত, শুভ বা অশুভ কোন গ্রহের দ্বারা দৃষ্ট
কি না, অস্তগত কি না, নবাংশ বল কি রকম এবং চন্দ্রের ক্ষেত্রে
কৃষ্ণ না শুক্ল পক্ষের চন্দ্র ইত্যাদি দেখে নিলেই চলে। অনেক
ছক পরীক্ষা করতে করতে একটা সূক্ষদৃষ্টি (intuition) তৈরী হয়,
যাতে এক নজরেই কোন গ্রহের বল সম্বন্ধে অনেকটাই ধারণা করা সম্ভব।
দীপক
সেনগুপ্ত
ফেব্রুয়ারী ৭, ২০১১
(চলবে)