জ্যোতিষশাস্ত্র
প্রবেশিকা (অন্যান্য
অনুচ্ছেদ)
অনুচ্ছেদ
- ৮
রাশি ও ভাব
মেষ, বৃষ ইত্যাদি ১২ টি
রাশির কথা আগেই বলা হয়েছে ( ৩য় অনুচ্ছেদ )। কোনও জাতকের লগ্ন
নির্ণয়ের পদ্ধতিও আলোচিত হয়েছে ( ৪র্থ অনুচ্ছেদ )। লগ্ন যে রাশিতে
আছে সেই রাশিকে ১ নং ধরে নিয়ে বামাবর্তে (anti-clockwise) ঘুরলে,
২য়, ৩য়, ৪র্থ ইত্যাদি ১২ টি রাশি হয়। কিছু রাশিতে এক বা একাধিক
গ্রহ থাকতে পারে আবার কিছু রাশি ফাঁকা অর্থাৎ গ্রহহীনও হতে পারে।
জ্যোতিষীরা ২য় রাশি এবং ২য় ভাবের মধ্যে তফাৎ করে থাকেন। বিষয়টা
আর একটু পরিষ্কার করা যাক। ধরা যাক, কোনো ব্যক্তির লগ্ন মেষ
রাশির ২৮ ডিগ্রিতে। তা হলে, পরবর্তী রাশি অর্থাৎ বৃষতে কোনো
গ্রহ যদি ১ ডিগ্রিতে থাকে, তা হলে লগ্নের ২য় ভাবে গ্রহটি বসে
আছে বলটা ঠিক হবে না, কারণ লগ্নের মাত্র ৩ ডিগ্রির মধ্যেই গ্রহটি
বসে আছে। সেই জন্য বলা হয় গ্রহটি ২য় রাশিতে আছে ঠিকই কিন্তু
১ম ভাবে বসে আছে। অতএব লগ্ন থেকে শুরু করে এক একটি ভাব কতদূর
অবধি বিস্তৃত সেটা জানা দরকার। এটা কি ভাবে হবে তা নিয়ে জ্যোতিষীদের
মধ্যে মতভেদ আছে। উপরের উদাহরণটি ধরা যাক। লগ্ন মেষে ২৮ ডিগ্রিতে
হলে, লগ্নভাব বা তনু ভাবের মধ্যবিন্দু মেষের ২৮ ডিগ্রিতে হবে
এবং একটি পদ্ধতি অনুসারে, ২য় ভাবের মধ্যবিন্দু পড়বে পরবর্তী
রাশি বৃষের ২৮ ডিগ্রিতে। প্রত্যেক ভাবের মধ্যবিন্দু থেকে উভয়পার্শ্বে
১৫ ডিগ্রি করে সেই ভাবের সীমা। অর্থাৎ আলোচ্য ক্ষেত্রে, লগ্নভাব
মেষের ১৩ ডিগ্রি থেকে বৃষের ১৩ ডিগ্রি ( ২৮ ডিগ্রির দুই পাশে
১৫ ডিগ্রি করে ) অবধি বিস্তৃত। এইভাবে চলবে। কিন্তু আর একটি
পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতি ভাবের বিস্তৃতি সমান নয়। ভারতে এই পদ্ধতিতেই
ভাব ও ভাবের বিস্তৃতি নির্ণয় করা হয়। কিন্তু এর জন্য কিছু অঙ্ক
কষা দরকার। এখানে আপাততঃ প্রথম পদ্ধতিটিই অনুসৃত হবে। এটিকে
বলা হয় (equal house method, Ptolemic system or modus equalis)।
রাশি ও ভাবের মধ্যে তফাৎ
উপরে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যে নিয়মে কোন একটি ভাব নির্ণয়ের কথা
বলা হয়েছে, ভারতবর্ষে সাধারণতঃ সে ভাবে ভাব নির্ণীত হয় না। তবে
যে পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে, সেটা মেনে চলা খুব সহজ এবং আজকাল
অনেক জ্যোতিষীই এই নিয়মে ভাব নির্ণয় করেন। আর একটু ব্যাখ্যা
করা যাক। ধরা যাক কোন ব্যক্তির লগ্ন তুলা রাশিতে ২৭ ডিগ্রি।
তা হলে আলোচ্য নিয়ম অনুসারে ২য় ভাবের মধ্যবিন্দু তুলার পরের
রাশি বা বৃশ্চিকের ২৭ ডিগ্রিতে পড়বে। এর দু'পাশে ১৫ ডিগ্রির
মধ্যে যে সব গ্রহ আছে, ধরে নিতে হবে তারা ২য় ভাবে আছে। উদাহরণস্বরূপ
ধরা যাক রবি বৃশ্চিকের ২ ডিগ্রিতে আছে। যেহেতু ২য় ভাবের মধ্যবিন্দু
বৃশ্চিকের ২৭ ডিগ্রি অতএব ২য় ভাবের বিস্তার বৃশ্চিকের ১২ ডিগ্রি
থেকে ধনুর ১২ ডিগ্রি। তাই এ ক্ষেত্রে রবি ২য় রাশিতে আছে ঠিকই
কিন্তু ভাব হিসাবে ১ম ভাবে বা লগ্ন ভাবে আছে। ধনুর ৩ ডিগ্রিতে
যদি শুক্র বসে থাকে, তবে শুক্র ৩য় রাশিতে কিন্তু ২য় বা ধনভাবে
রয়েছে ধরতে হবে। তবে এখানে একটা প্রশ্ন উঠতেই পরে। যদি একটি
ভাবের কিছু অংশ দুটি রাশিতে পড়ে, তবে সেই ভাবের অধিপতি কে হবে
? এ ক্ষেত্রে ঐ ভাবের মধ্যবিন্দু যে রাশিতে পড়বে সেই রাশির অধিপতিই
আলোচ্য ভাবের অধিপতি হিসাবে ধরতে হবে।
সাধারণতঃ জ্যোতিষীরা ভারতবর্ষে যে পদ্ধতিতে ভাব, ভাবমধ্য বা
ভাবসন্ধি বের করেন (Porphyrys system) এই আলোচনায় সেটা করা
হয় নি। এখানে অপেক্ষাকৃত সহজ পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। তবে এখন
অনেক জ্যোতিষীই এই উপায়ে ভাব নির্ণয় করেন এবং মনে করেন এটাই
সঠিক পদ্ধতি। তবে যে দুটি বিভিন্ন পদ্ধতির কথা উপরে উল্লেখ করা
হয়েছে, তাদের মধ্যে যা তফাৎ তা অনেকটাই তত্ত্বগত। সাধারণ ভাবে
জন্মকুণ্ডলী বিচারে এর প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে। অতএব এ নিয়ে
এখনিই মাথা ঘামাবার কোন প্রয়োজন নেই।
ভাবসন্ধি ও রাশিসন্ধি
কোন গ্রহ কোনো দুটি ভাবের
সন্ধিতে অথবা কোনো রাশির একেবারে প্রথমে বা শেষে অবস্থিত হ'লে
তার বলের হ্রাস হবে। ভাবসন্ধি ও রাশিসন্ধি বোঝার সুবিধার জন্য
একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ধরা যাক কোনো জাতকের লগ্ন কন্যারাশিতে
২৫ ডিগ্রিতে। তা হলে লগ্ন বা তনু ভাবের মধ্যবিন্দু কন্যারাশির
২৫ ডিগ্রি; ২য় বা ধনভাবের মধ্যবিন্দু তুলারাশির ২৫ ডিগ্রি, ৩য়
ভাবের মধ্যবিন্দু বৃশ্চিকরাশির ২৫ ডিগ্রি ইত্যাদি। প্রত্যেক
ভাবের বিস্তৃতি সেই ভাবের মধ্যবিন্দু থেকে দু'পাশে ১৫ ডিগ্রি
অবধি। অর্থাৎ ১ম বা তনু ভাব কন্যার ১০ ডিগ্রি থেকে শুরু করে
তুলার ১০ ডিগ্রি অবধি বিস্তৃত; ২য় বা ধনভাব তুলার ১০ ডিগ্রির
পর থেকে বৃশ্চিকের ১০ ডিগ্রি অবধি ইত্যাদি। এখন একটি গ্রহ, ধরা
যাক বৃহস্পতি, তুলারাশির ৯ ডিগ্রি ৩০ মিনিটে অবস্থিত। তা হ'লে
বৃহস্পতি তনুভাবের একেবারে শেষপ্রান্তে এবং ধনভাবের প্রায় শুরুতে
বসে আছে। এ ক্ষেত্রে ধরতে হবে বৃহস্পতি ভাবসন্ধিতে রয়েছে এবং
সেটা ভাবের ফল ঠিক সে ভাবে দিতে পারবে না। আগেই বলা হয়েছে এক্ষেত্রে
বৃহস্পতি ২য় রাশিতে কিন্তু ১ম ভাবের সন্ধিতে বসে আছে। আবার ধরা
যাক, বুধ কন্যারাশির ২৯ ডিগ্রিতে অবস্থিত। তা হ'লে বুধ কন্যা
ও তুলা রাশির সন্ধিতে ( এটা ভাবসন্ধি নয় রাশিসন্ধি ) বসে আছে।
এ ক্ষেত্রে স্বক্ষেত্রে অর্থাৎ কন্যা রাশিতে থাকলেও বুধের বল
কম হবে।
তবে রাশি ও ভাবসন্ধি নিয়ে
বিভিন্ন জ্যোতিষীর বিভিন্ন মত রয়েছে। রাশি ও ভাবের ফল সম্বন্ধে
সুনিদির্ষ্টভাবে শাস্ত্রে কোন বিচার পদ্ধতি আলোচিত হয় নি। রাশি
ও ভাব সম্বন্ধে প্রাচীন জ্যোতিষী কৈলাসচন্দ্র জ্যোতিষার্ণব তার
ঐ জ্যোতিষ প্রভাকর ঐ গ্রন্থে কি লিখেছেন দেখা যাক। "..........
গণিতের সাহায্যে ভাবসন্ধিগুলি স্থির করিয়া রাখিতে হইবে; কিন্তু
মনে রাখিতে হইবে, ইহাদের বাস্তবতা নাই। কেন না পূর্বসন্ধি হইতে
পরসন্ধি পর্যন্ত এক একটি ভাব প্রসারিত হইলে অধিকাংশ স্থলে দুইটি
রাশি একটি ভাব দ্বারা আক্রান্ত হইবে। ভাবাধিপতি লইয়া বিচার করিতে
হইলে, যে স্থলে ভাবাধিপতি দাঁড়াইবে দুইটি গ্রহ অথবা দুইটি ভাবের
অধিপতি হইবে একটি গ্রহ, সে স্থলে উক্ত দুইটি গ্রহ লইয়াই বিচার
করিব বা একটি গ্রহ লইয়া বা অন্য কোন উপায় অবলম্বন করিয়া, এরূপ
সন্দেহ স্বতঃই উদিত হইবে। ..........তাই বলিয়াছি লগ্নের পর পর
রাশিগুলি এক একটি ভাব এবং সেইরূপ বিচার করাই সমীচীন। .......
যে শাস্ত্রে ফলই প্রমাণ, সেই ফলিত শাস্ত্রে এইরূপ গোলযোগের মধ্যে
পড়িয়া যা-তা একটা স্ব-কপোলকল্পিত সিদ্ধান্ত করিয়া যা-তা ফল বলিলে
সত্যের অপলাপ করা হইবে, শাস্ত্রের অমর্যাদা করা হইবে এবং ঋষি-প্রদর্শিত
মার্গের অযথা নিন্দাবাদ করা হইবে। প্রোক্ত দোষ হইতে অব্যাহতি
পাইবার জন্যই বলিয়াছি, লগ্নের পর পর রাশি পর পর ভাব বলিয়া গণ্য
হইবে। "
সাধারণ ভাবে ফল বিচারের জন্য জ্যোতিষীরা এই নিয়মটিই মেনে চলেন
বলে মনে হয়।
বিভিন্ন ভাবের কারকতা ও
বৈশিষ্ট্য
কোনো জন্মকুণ্ডলী বিচার
করতে গেলে প্রতিটি ভাব কি কি বিষয়ের কারক বা প্রতিটি ভাব জাতকের
কি কি বৈশিষ্ট্যের নির্দেশক সেটা জানতে হবে।
১ম (লগ্নভাব বা তনুভাব ) - শরীর, সাধারণ স্বাস্থ্য, আকৃতি, বর্ণ,
আয়ু, মস্তিষ্ক, সম্মান ইত্যাদি।
২য় ( ধনভাব ) - ধনসঞ্চয়, খাদ্যাভ্যাস, চোখ (বিশেষতঃ ডান চোখ),
কবিত্ব, বাক্য, মুখ, বাঙ্মিতা, বিবাহসূত্রে প্রাপ্ত আত্মীয়বর্গ,
ঐশ্বর্য, শিক্ষা ইত্যাদি।
৩য় ( সহজভাব ) - কনিষ্ঠভ্রাতা, সাহস, পরাক্রম, ধৈর্য, হাত, শ্বাসনালী,
ফুসফুস, কান, আয়ু, স্বল্পদূরত্বের ভ্রমণ, প্রতিবেশী, যোগাযোগ
ব্যবস্থা, লেখালেখি ইত্যাদি।
৪র্থ ( সুখভাব ) - মাতা, বিদ্যালাভ, লোকজন, মন, ভূমি বা ভূ-সম্পত্তি,
গৃহ, গৃহসুখ, বন্ধুবর্গ, যানবাহন, বক্ষস্থল, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস,
ইত্যাদি।
৫ম ( পুত্রভাব ) - সন্তান, আবেগ, বুদ্ধি, ভক্তি, মন্ত্রদীক্ষা,
বিদ্যা, উদরদেশ, অন্ত্র, লটারি বা শেয়ার, উদ্ভাবন শক্তি ইত্যাদি।
৬ষ্ঠ ( শত্রুভাব ) - শত্রু, বাধাবিপত্তি, বিঘ্ন, ঋণ, রোগ, মামলা-মোকদ্দমা,
মাতুল, মাসি, নাভি ও কোমর, কিডনী, কোনো কিছুর স্বল্পতা ইত্যাদি।
৭ম ( জায়াভাব ) - স্বামী বা স্ত্রী, অংশীদার নিয়ে ব্যবসা, কাম
সম্পর্কিত বিষয়, মূত্রাশয়, বিদেশযাত্রা ইত্যাদি।
৮ম ( নিধনভাব ) - গোপনভাব, আয়ু, মৃত্যু, সম্মানহানি, বস্তিপ্রদেশ,
কুঁচকি, প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা, হঠাৎ পরিবর্তন, উত্তরাধিকারসূত্রে
ধনলাভ, স্ত্রী বা স্বামীর মৃত্যু ইত্যাদি।
৯ম ( ধর্মভাব ) - ধর্মভাব, তপস্যা, ভাগ্য, গুরু বা গুরুস্থানীয়
ব্যক্তি, পিতা, ঊরু, দূরভ্রমণ ও বিদেশযাত্রা, তীর্থযাত্রা, পূর্বজন্ম
ইত্যাদি।
১০ম ( কর্মভাব ) - কর্ম, জীবিকা, মানসম্মান, নামযশ, কোন কিছু
কার্যে পরিণত করা, সরকার, হাঁটু, শাসনক্ষমতা ইত্যাদি।
১১শ ( আয়ভাব ) - অর্থাগম, লাভ, আয়, অভাবপূরণ, অভীষ্টসিদ্ধি,
জঙ্ঘা, জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা বা ভগিনী ইত্যাদি।
১২শ ( ব্যয়ভাব ) - চক্ষু (বিশেষতঃ বামচক্ষু), দূরদেশ ভ্রমণ,
বিদেশে বাসস্থান, শয্যাসুখ, নিদ্রা, হাসপাতাল, ক্ষতি, পায়ের
পাতা, কৈবল্য, মোক্ষ ইত্যাদি।
কালপুরুষের অঙ্গবিভাগ
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে
, লগ্নভাব, ধনভাব প্রভৃতি দ্বাদশভাব শরীরের কোনো না কোনো অঙ্গের
সূচক। যেমন লগ্ন ভাব থেকে মাথা, আয়ভাব থেকে চোখ মুখ ইত্যাদি
বিচার করা হয়। তেমনি লগ্ন যে রাশিতেই হোক না কেন ভ-চক্রে (zodiac)
কল্পিত রাশিগুলি ধরলে, বারটি রাশি থেকেও মানুষের বিভিন্ন অঙ্গের
বিভাগ করা হয়। একে কালপুরুষের অঙ্গবিভাগ বলে। কোন কোন রাশি কোন
কোন অঙ্গ সূচিত করে দেখা যাক। মেষরাশি - মাথা; বৃষরাশি - চোখ,
মুখ, গলা; মিথুনরাশি - দুইহাত, হৃৎপিণ্ডের উপরের অংশ; কর্কটরাশি
- ফুসফুস, হৃৎপিণ্ড; সিংহরাশি - উদর, অন্ত্র; কন্যারাশি - কোমর;
তুলারাশি - বস্তি, প্রজনন যন্ত্র; বৃশ্চিকরাশি - গুহ্য বা তার
আশেপাশের জায়গা; ধনুরাশি - ঊরু; মকররাশি - হাঁটু; কুম্ভরাশি
- জঙ্ঘা; মীনরাশি - পদদ্বয় (feet)।
রোগ নির্ণয়ের সময় মূলতঃ লগ্ন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাব এবং
তাদের দ্বারা নির্দ্দেশিত অঙ্গ ধরেও যেমন বিচার করতে হবে তেমনি
উপরে লিখিত বিভিন্ন রাশির দ্বারা সূচিত অঙ্গের কথাও মনে রাখতে
হবে। বিভিন্ন জন্মকুণ্ডলী বিশ্লেষণ করার সময় এটা হয়ত আরও পরিষ্কার
হবে।
দীপক
সেনগুপ্ত
ফেব্রুয়ারী ৭, ২০১১
(চলবে)