জ্যোতিষশাস্ত্র
প্রবেশিকা (অন্যান্য
অনুচ্ছেদ)
অনুচ্ছেদ ১৫
কয়েকটি জন্মকুণ্ডলীর বিশ্লেষণ
গোড়ার
কথা
তাত্বিক আলোচনা ক্রমাগত
চলতে থাকলে একঘেয়েমি ছাড়াও বাস্তব দিকটা উপেক্ষিত হবার সম্ভাবনা
থাকে। এই অনুচ্ছেদে কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্মকুণ্ডলী
সম্বন্ধে আলোচনা করা হবে। যে সব নিয়ম আগেই ব্যাখ্যা করা
হয়েছে সেই সূত্র ধরেই বিচার বিশ্লেষণ অনেকটাই সম্ভব। জ্যোতিষ
শাস্ত্রকে যারা গভীর ভাবে ভালবাসেন বা এটাকে যারা পেশা হিসাবে
বেছে নিয়েছেন তাদের অনেকেরই শত শত শ্লোক মুখস্থ থাকে এবং
প্রয়োজন মত সেগুলি তারা প্রয়োগ করেন। এর জন্য বিষয় বস্তু
সম্বন্ধে গভীর অনুরাগ ছাড়াও, সময়, অধ্যবসায় ও মনঃসংযোগ প্রয়োজন।
এটা না হলেও প্রাথমিক ভাবে কয়েকটি সাধারণ নিয়ম আয়ত্ব করে
বেশ কিছু ফল বলা সম্ভব এবং সেই চেষ্টাকে ফলপ্রসূ করাই এই
ধারাবাহিক লেখার উদ্দেশ্য।
যে কোন কুণ্ডলী নির্ভুল
বিচারের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন সঠিক জন্ম সময়ের। অনেক ক্ষেত্রেই
এটা পাওয়া খুব দুষ্কর। মনে রাখতে হবে ৪ মিনিট সময় হেরফের
হলে লগ্নের ১ ডিগ্রি পরিবর্তন হতে পারে। অনেক বিখ্যাত লোকের
জন্মকুণ্ডলী যা বিভিন্ন বইতে বা অন্যত্র প্রকাশ করা হয়েছে
তাতে জন্ম সময়ের অনেক তারতম্য দেখা যায়। এর ফলে অনেক সময়
গ্রহের অবস্থান এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে সরে যেতে পারে।
আরও সূক্ষ্ম ভাগে বিভিন্ন বর্গ বিচার করলে ত এর সম্ভাবনা
আরও বেশী। এই তারতম্যের জন্য জাতকের চরিত্রগত মূল বৈশিষ্ট্য
কিছুটা বিশ্লেষণ করা সম্ভব হলেও কোন ঘটনা সম্বন্ধে নির্দ্দিষ্ট
ভাবে কিছু বলা শক্ত। যে কয়েক জন বিখ্যাত ব্যক্তির জন্ম কুণ্ডলী
এই অনুচ্ছেদে বিশ্লেষণ করা হবে এরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে জীবনে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন অথবা তাদের বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
বা কর্মকাণ্ডের জন্য ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন। প্রতিটি কুণ্ডলী
বিশ্লেষণের আগে এদের জীবনের কিছু বিশেষ দিক বা ঘটনা তুলে
ধরা হবে যা কুণ্ডলীর বিচার বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন।
কোন কুণ্ডলীতে গ্রহদের
অবস্থান জন্মের সময়েই নির্দিষ্ট হয়ে যায়; জাতকের জীবদ্দশায়
সেটা আর বদলায় না। কিন্তু গ্রহ ত ঘুরেই চলেছে; ঘুরতে ঘুরতে
সেগুলি জাতকের মূল রাশিচক্রের বিভিন্ন স্থান অতিক্রম করে
এবং এতে বিভিন্ন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয়। একে বলা হয়
গোচর ফল। এটা এখনও আলোচনা করা হয় নি। বিভিন্ন বর্গ সম্বন্ধে
প্রাথমিক ভাবে আলোচনা করা হলেও (অনুচ্ছেদ ৬), সেগুলি নির্ণয়
করার নিয়ম বা তার ব্যবহারের পদ্ধতিও আলোচিত হয় নি। অতএব
এগুলি বাদ দিয়েই এই অনুচ্ছেদে বর্ণিত কুণ্ডলী গুলির বিচার
বিশ্লেষণ করা হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভোগ্য দশা দেওয়া হয়েছে
(এটা কি করে বের করতে হয় সেটা খুব বিশদ ভাবে ৯ম অনুচ্ছেদে
বলা হয়েছে); সেটা থেকে যে কোন সময়ের দশা অন্তর্দশা বের করে
নেওয়া যেতে পারে।
১.
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী
জন্ম
বিবরণ : ২রা অক্টোবর, ১৮৬৯; সময় : সকাল ৭ - ১২ মিঃ; স্থান
: পোরবন্দর, গুজরাট, ভারতবর্ষ; অক্ষাংশ ২১ ডিঃ ৩৮ মিঃ উত্তর;
দ্রাঘিমাংশ ৬৯ ডিঃ ৩৬ মিঃ পূর্ব। লাহিড়ী অয়নাংশ। ভোগ্য দশা
(balance of dasha) : বুধ ২ বছর ৭ মাস ৮ দিন।
বিখ্যাত জ্যোতিষী প্রয়াত
বি. ভি. রমন তার Notable Horoscopes বইতে জন্ম সময় সকাল
৭ - ৪৫ মিঃ ধরেছেন। তবে প্রত্যয়িত তথ্য ভাণ্ডার (Rodden's
Astro-Databank) থেকে সংগৃহীত জন্ম সময় সকাল ৭ - ১২ মিঃ
ব্যবহার করেই বর্তমান কুণ্ডলীটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
জীবনের কিছু ঘটনা :
লণ্ডনে ইউনিভার্সিটি
কলেজে আইন নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৮৯১ খৃষ্টাব্দে ভারতে ফিরে
বম্বেতে আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন, কিন্তু সফল হন নি।
এরপর তিনি একটি কোম্পানির চাকরী নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় ডারবানে
যান। সেখানে ভারতীয়দের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য
হতে দেখে তাদের মানবাধিকারের দাবীতে সোচ্চার হন। ২০ বছর
তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় ছিলেন এবং জীবনে অনেকবার কারাদণ্ড
ভোগ করেছেন। সত্যের প্রতি তার ছিল অবিচল নিষ্ঠা। তার আন্দোলন
সত্যাগ্রহ নামে অভিহিত হয়। ১৯২০ সালে আন্দোলন দমনে ভারত
সরকারের নিগ্রহ ও আটক আইন চালু করার প্রতিবাদে গান্ধীজী
অসহযোগ আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৩২ সালে অস্পৃশ্যতা নীতির প্রতিবাদে
তিনি আমরণ অনশনের কর্মসূচী গ্রহণ করেন। ১৯৪২ সালে তিনি কারারুদ্ধ
হন কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরাধীনতার
গ্লানি থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য তার অহিংস আন্দোলন দেশব্যাপী
সাড়া ফেলে এবং বহু লোক এতে যোগদান করেন।
তার কিছু নিজস্ব চিন্তাধারা ও মতামত অন্যের উপর চাপিয়ে দেবার
জন্য ব্যক্তিগত জীবনে তাকে অনেকবার সমস্যায় পড়তে হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বাস করার সময় তিনি নিজে পায়খানা পরিষ্কার
করতেন এবং নিজের স্ত্রীকেও সেটা করতে বাধ্য করার জন্য তার
স্ত্রী মনে খুব আঘাত পান। তিনি নিজের সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা
লাভে উৎসাহিত করেন নি কারণ দেশের বহু ছেলে মেয়ে সেই সুযোগ
থেকে বঞ্চিত। তার এই "সাম্যবাদের" ফলে ক্ষোভ ও
দুঃখে তার বড় ছেলে হরিলাল মদ্যপানে আসক্ত হন এবং মুসলমান
ধর্ম গ্রহণ করেন। তবে তার অপর পুত্র দেবদাস বাবার পাশেই
ছিলেন এবং তাকে বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেছেন।
দেশপ্রেম, মানবিক মূল্যবোধ, আত্মত্যাগ, আধ্যাত্মিকতা, অহিংস
নীতিতে অবিচল বিশ্বাস ও মানুষকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসার
জন্য তিনি মহাত্মা (great soul) নামে পরিচিত হন। ১৯৪৮ সালের
৩০শে জানুয়ারী আততায়ীর গুলিতে তার মৃত্যু হয়। তার সম্বন্ধে
১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন
মন্তব্য করেছিলেন, " ভবিষ্যতের মানুষ হয়ত বিশ্বাসই
করবে না যে রক্ত মাংসের এ রকম এক জন মানুষ সত্যিই একদিন
এই পৃথিবীতে বিচরণ করেছিলেন। "
কুণ্ডলীর বিশ্লেষণ
মহাত্মা গান্ধীর রাশিচক্রটি ১৫(১)ক চিত্রে এবং নবাংশটি ১৫(১)খ
চিত্রে দেখান হয়েছে।
(১) লগ্ন তুলা এবং
লগ্নপতি (ও ৮ম পতি) শুক্র লগ্নে থাকায় লগ্ন শক্তিশালী হয়েছে।
কিন্তু নৈসর্গিক অশুভ গ্রহ মঙ্গল (২য় ও ৭ম পতি) লগ্নপতির
খুব কাছে রয়েছে, জীবনী শক্তির কারক গ্রহ রবি ১২শে অবস্থিত
এবং লগ্ন ও লগ্নপতি পাপ কর্তরী যোগে (অনুচ্ছেদ ১৩-নিয়ম ১৪)
ক্লীষ্ট। এ সব কারণে জাতকের শরীর খুব সবল হবার কথা নয়। অন্যান্য
শারীরীক সমস্যাও হয় ত ছিল।
(২) চন্দ্র ১০পতি হয়ে
১০মে অবস্থান করার জন্য গান্ধিজী পবিত্রমনা এবং সৎকার্যে
নিরত ছিলেন। রাহু চন্দ্রের সঙ্গে এক রাশিতে থাকলেও তাদের
দূরত্ব প্রায় ১৪ ডিগ্রি। তা হলেও মন মাঝে মাঝে সংশয়াচ্ছন্ন
ও বিভ্রান্ত হতে পারে। ১০মে রাহুর অবস্থান সাধারণতঃ নতুন
কিছু (innovative) কর্মে প্রবৃত্ত করায়। দূরত্ব থাকলেও চন্দ্রের
সঙ্গে রাহুর একই রাশিতে ১০মে অবস্থানের জন্য চিন্তাধারা
একটু অপ্রচলিত ধরণের ছিল এবং অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষাও তিনি
করেছেন।
(৩) লগ্ন বা চন্দ্র
থেকে কেন্দ্রে অনেক গ্রহ রয়েছে। লগ্নে শুভ গ্রহ বুধ ও শুক্র,
৭মে বৃহস্পতি ও ১০মে চন্দ্র (যদিও চন্দ্র পক্ষবলে বলী নয়
অর্থাৎ শুক্ল পক্ষের চন্দ্র নয়) অবস্থিত হওয়ায় কুণ্ডলীটি
সামগ্রিক ভাবে অনেক শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময়।
(৪) মঙ্গল স্বাধীনতা,
ক্ষীপ্রতা, ক্রোধ, স্বার্থপরতা ইত্যাদির কারক গ্রহ; কিন্তু
মঙ্গলের তুলা লগ্নে ( sign of balance ) ও ১৬ নং বিশাখা
নক্ষত্রে (অধিপতি বৃহস্পতি) অবস্থান এবং বৃহস্পতির দ্বারা
দৃষ্ট হবার জন্য মঙ্গলের তীব্রতা অনেক হ্রাস পেয়েছে। তার
কাজের মধ্যে অনেক সময় একটু আগ্রাসী ও প্রভুত্ব করার মনোভাব
থাকলেও কখনই সেটা মাত্রা ছাড়ায় নি এবং অভিমুখ কল্যাণকর হয়েছে।
(৫) 'জাতক ‘জাতক পারিজাত’
গ্রন্থের ৯ম পরিচ্ছেদের ১০ নং শ্লোকে বলা হয়েছে 'বুধ গ্রহ
১০মে অবস্থিত হলে, জাতক নিঃস্বার্থ ভাবে এবং ত্যাগের সঙ্গে
কাজ করবে।' ১০ম কর্মস্থান। সেখানে বুধের অবস্থান যদি নিঃস্বার্থভাবে
কর্মে প্রবৃত্ত করায়, তবে অবশ্যই বুধের একটি কারকতা হল উদারতা,
দয়া, পরোপকার এবং আত্মত্যাগ। এখানে বুধ লগ্ন কেন্দ্রে এবং
১০ম কেন্দ্র ও ১০ম পতি চন্দ্র থেকে ৪র্থ কেন্দ্রে অবস্থিত
হয়ে বৃহস্পতি দ্বারা দৃষ্ট হওয়ায় গান্ধীজী জনকল্যাণ মূলক
কাজ করে গেছেন।
(৬) গান্ধীজীর ছকে
কয়েকটি শক্তিশালী যোগ রয়েছে। প্রথমতঃ লগ্নপতি শুক্র ও ৯ম
পতি বুধ যুক্ত ভাবে লগ্নে রয়েছে ; এটা একটা রাজযোগ। দ্বিতীয়তঃ
লগ্নপতি শুক্র লগ্ন কেন্দ্রে স্বক্ষেত্রে থাকায় মালব্য যোগ
হয়েছে এবং তৃতীয়তঃ বৃহস্পতি ও চন্দ্র পরস্পরের কেন্দ্রে
থাকায় গজকেশরী যোগ হয়েছে (অনুচ্ছেদ ১৪)। ৯ম ধর্মস্থান। লগ্নপতি
শুক্র ও ৯ম পতি একত্রে লগ্নে থাকায় জাতকের আধ্যাত্মিক মনোভাব
ছিল। মালব্য যোগের ফলে এবং বিশেষ করে শুক্র মঙ্গলের সঙ্গে
যুক্ত থাকায় জাতকের মনে কখনও কখনও ঈর্ষা, ভোগ বাসনার উদয়
এবং প্রভুত্ব করার ইচ্ছা হয় ত হয়েছে কিন্তু বৃহস্পতির জোরাল
দৃষ্টি এই দুই গ্রহের উপর থাকায় কখনই এই চিন্তা তেমন ভাবে
কার্যে পরিণত হয় নি। নবাংশ চক্রে লগ্নের ৭মে বৃষ লগ্নে মঙ্গল,
শুক্র ও কেতুর অবস্থান সাধারণ ভাবে যৌন বিকৃতি নির্দেশ করে।
রাশি চক্রে বৃহস্পতির দৃষ্টি মঙ্গল ও শুক্রের উপর না পড়লে
বা গজকেশরী যোগের প্রভাব না থাকলে ফল অন্য রকম হতেও পারত।
তার জীবনী যারা বিশদ ভাবে পড়েছেন তারা ৭মে এই গ্রহ সমাবেশের
আংশিক প্রভাব কিছুটা বুঝতে পারবেন।
চন্দ্র ১০ম কেন্দ্রে স্বক্ষেত্রে থেকে বৃহস্পতির সঙ্গে গজকেশরী
যোগ তৈরী হওয়ায় জাতক অসামান্য সম্মান ও স্বীকৃতি পেয়েছেন।
তবে খেয়াল রাখতে হবে বৃহস্পতি নৈসর্গিক শুভ গ্রহ হলেও তুলা
লগ্নের পক্ষে ৩য় ও ৬ষ্ঠ পতি এবং এক্ষেত্রে বক্রী; মাঝে মাঝেই
তিনি শত্রুতা, বাধা বিপত্তি ও সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন।
মঙ্গলের ক্ষেত্রে (এখানে মেষ রাশিতে) বৃহস্পতির অবস্থান
এবং তার উপর মঙ্গলের দৃষ্টি মনে অহং বোধের জন্ম দিতে পারে।
(৭) গান্ধীজীর বাবা
একটি ছোট রাজ্যের রাজার প্রধান উপদেষ্টা (prime minister)
ছিলেন। ৯ম (পিতৃস্থান) ভাবের অধিপতি বুধ জাতকের ২য় ভাবের
অধিপতি (সঞ্চয়) মঙ্গল ও লগ্নপতি শুক্রের সঙ্গে লগ্নে রয়েছে।
কিন্তু পিতৃকারক গ্রহ রবি ১১শ পতি (আয় স্থান) হয়ে লগ্নের
১২শে (ব্যয় স্থান) অবস্থিত হওয়ায় পিতার মৃত্যুর সঙ্গে জাতকের
আর্থিক ক্ষতির সূচনা করে।
পিতার মৃত্যু হয় ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে শুক্রের দশা ও মঙ্গলের
অন্তর্দশায়। শুক্র পিতৃস্থান ৯ম ঘরের ১২শ স্থানের অধিপতি।
চন্দ্র থেকে ৯ম স্থানের ২য় (মারক) স্থানের অধিপতি মঙ্গল।
আবার মঙ্গল ও শুক্র পিতৃকারক গ্রহ রবির ২য় স্থানে (মারক
স্থান) অবস্থিত। অতএব শুক্র - মঙ্গলে পিতার মৃত্যু অপ্রত্যাশিত
নয়।
(৮) গান্ধীজী বিয়ে
করেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে শুক্র-শুক্র দশা অন্তর্দশায়। ৭ম
পতি মঙ্গল এবং বিবাহের কারক গ্রহ শুক্র (ও লগ্ন পতি) একত্রে
লগ্নে অবস্থান করে ৭মে দৃষ্টি দিচ্ছে - ফল অল্প বয়সে বিয়ে।
তবে এখনকার দিনে এই যোগে এত অল্প বয়সে হয় ত কারোর বিয়ে হত
না। দেশ, কাল, পাত্রের প্রভাব মানতে হবে (অনুচ্ছেদ ১৩-২৬
নং নিয়ম)। অতএব শুক্র-শুক্র দশা-অন্তর্দশায় বিয়ে হওয়াটা
খুব স্বাভাবিক।
(৯) উপরে পিতৃকারক
গ্রহ হিসাবে রবির ১২শে (ব্যয় স্থান) অবস্থান ব্যাখ্যা করা
হয়েছে। কিন্তু রবির এই অবস্থানের অন্য একটি ব্যাখ্যা রয়েছে।
রবি অহংকার, আত্মাভিমান ইত্যাদিরও কারক। তার ১২শে অবস্থানের
অর্থ হল জাতকের অহং বোধ (ego) সে ভাবে কখনও মাথা তুলতে পারে
নি। ১২শে রবির অবস্থান আধ্যাত্মিকতা নির্দেশ করে কারন অহং
বোধের হ্রাসই আধ্যাত্মিক জ্ঞানের জন্ম দেয়। ১১শ পতি ১২শে
থাকার অর্থ তিনি চহিদাকে যথেষ্ট ছেঁটে ফেলতে পেরেছেন। রবি
রাজনীতিরও কারক গ্রহ। তার সম্বন্ধে যাই প্রচার থাক, গ্রহের
অবস্থান থেকে এটা মোটামুটি স্পষ্ট যে তিনি মাঝে মাঝে রাজনীতিতে
জড়িয়ে পড়েছেন ঠিকই কিন্তু মন থেকে তিনি কখনও রাজনীতির মাধ্যমে
ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করেন নি।
(১০) ১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে
গান্ধীজীর প্রথম পুত্র হরিলালের জন্ম হয়। এই সময় তার শুক্র-রাহুর
দশা-অন্তর্দশা চলছিল। ৫ম স্থান থেকে এবং কারক গ্রহ বৃহস্পতির
থেকে সন্তানের বিচার হয়। চন্দ্র থেকে ৫ম পতি মঙ্গল ১৬ নং
বিশাখা নক্ষত্রে (অধিপতি বৃহস্পতি - অনুচ্ছেদ ৯) রয়েছে।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে লগ্নে অবস্থিত মঙ্গল, বুধ ও শুক্র
তিনটি গ্রহই বৃহস্পতির (পুত্র কারক গ্রহ) নক্ষত্রে অবস্থিত
এবং তিনটি গ্রহই বৃহস্পতির দ্বারা দৃষ্ট। আগেই বলা হয়েছে
(অনুচ্ছেদ ৫) যে রাহুর বৈশিষ্ট্য ঠিক শনির মত, 'শনিবৎ রাহু'।
চন্দ্রের ৫মে শনি অবস্থিত অতএব শুক্র - রাহুর দশা-অন্তর্দশায়
সন্তানের জন্ম সম্ভব।
শুক্র-রাহুর দশা-অন্তর্দশাতেই গান্ধীজী বৃটেনে যান আইন নিয়ে
পড়াশোনা করতে। ৪র্থ স্থান থেকে বিদ্যা লাভের বিচার হয় (এ
সম্বন্ধে পরে বিশদ ভাবে আলোচনা করা হবে)। চন্দ্র থেকে ৪র্থের
অধিপতি শুক্র স্বক্ষেত্রে ৪র্থে অবস্থিত। আইনের কারক গ্রহ
বৃহস্পতি শুক্রকে দৃষ্টি দিচ্ছে। লগ্ন থেকে ৪র্থে মকর রাশিকে
রাহু দৃষ্টি দিচ্ছে। রাহু ৮ম নক্ষত্র পুষ্যাতে (অধিপতি শনি)
অবস্থিত। ৭ম ও ৯ম স্থান সাধারণতঃ দূর দেশ ভ্রমণ বা বিদেশ
যাত্রা নির্দেশ করে। ৭মে বৃহস্পতি অবস্থিত এবং ৪র্থ পতি
শুক্রকে দৃষ্টি দিচ্ছে। ৯ম পতি বুধ বৃহস্পতির নক্ষত্রে এবং
শুক্রের সঙ্গে লগ্নে অবস্থিত। রাহু বিদেশ যাত্রার কারক গ্রহ
(অনুচ্ছেদ ৫)। অতএব শুক্র-রাহুর দশা-অন্তর্দশায় আইন শিক্ষা
লাভের জন্য বিদেশ যাত্রা সম্ভব। অন্য একটি বিষয়ে দৃষ্ট রাখা
দরকার। রাহু বৃহস্পতি, বুধ ও শুক্রের কেন্দ্রে অবস্থিত।
কেন্দ্রে অবস্থিত সব গ্রহই একে অন্যকে প্রভাবিত করে। এখানে
অন্য একটি ব্যাখ্যাও সম্ভব। ৪র্থ স্থান (এখানে মকর রাশি)
যেমন বিদ্যালাভ বোঝায় তেমনি ৪র্থ স্থান থেকে গৃহ ও বাসস্থানেরও
বিচার হয়। রাহু ও শনি বিচ্ছেদকারক গ্রহ (separative planet)
হিসাবে চিহ্ণিত। ৪র্থ স্থানকে রাহু দৃষ্টি দেওয়ায় রাহুর
দশা বা অন্তর্দশায় গৃহ থেকে বিচ্ছেদ বা বিদেশ যাত্রা বোঝাতে
পারে।
(১১) ১৮৯২ খৃষ্টাব্দের
অক্টোবর মাসে শুক্র-শনি দশা-অন্তর্দশায় গান্ধীজীর ২য় পুত্র
মণিলাল এবং ১৮৯৭ সালে শুক্র-বুধে ৩য় পুত্র রামদাস জন্ম গ্রহণ
করে। চন্দ্র থেকে ৫ম পতি মঙ্গল ও বুধের সঙ্গে যুক্ত। মঙ্গল,
বুধ ও শুক্র তিনটি গ্রহই পুত্রকারক বৃহস্পতির নক্ষত্রে স্থিত
এবং বৃহস্পতির দ্বারা দৃষ্ট। এ ছাড়া চন্দ্রের ৫মে শনি অবস্থিত।
অতএব উক্ত দশা-অন্তর্দশায় পুত্রের জন্ম সম্ভব।
(১২) গান্ধীজী একজন
সুলেখক ছিলেন। কিছু পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করেছেন; গ্রন্থও
প্রকাশ করেছেন। ৩য় স্থান বা ভাব থেকে ছাপার অক্ষরে কিছু
প্রকাশ করা বোঝায়; বুধ হল এর কারক গ্রহ। এখানে ৩য় পতি বৃহস্পতি
৭ম কেন্দ্র থেকে ৩য়ে দৃষ্টি দেওয়ায় ৩য় ভাবটি শক্তিশালী হয়েছে।
আবার বৃহস্পতি লগ্নের ৭মে অবস্থিত হয়ে বুধকেও দৃষ্টি দিচ্ছে।
চন্দ্র থেকে বিচার করলেও ৩য় পতি বুধ নিজেই চন্দ্র থেকে ৪র্থ
কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
(১৩) গান্ধিজী অনেকবার
কারাবরণ করেছেন। দেখা গেছে যে, লগ্ন বা লগ্নপতির সঙ্গে ৬ষ্ঠ
ও ৮ম পতির যোগ জাতককে কারাগারে রুদ্ধ করে। এখানে লগ্ন পতি
(ও ৮ম পতি) শুক্র লগ্নে অবস্থিত এবং ৬ষ্ঠ পতি বৃহস্পতির
দ্বারা দৃষ্ট হওয়ায় এই কারাবরণ যোগটি হয়েছে। এটাও লক্ষ্য
করার মত যে, লগ্ন ও লগ্নপতি একদিকে রবি এবং অন্য দিকে শনির
দ্বারা পাপকর্তরী যোগে আবদ্ধ।
(১৪) মহাত্মা গান্ধী
নিহত হন ১৯৪৮ খৃষ্টাব্দের ৩০ শে জানুয়ারী আততায়ীর গুলিতে।
তখন বৃহস্পতি-কেতুর দশা-অন্তর্দশা চলছিল। বৃহস্পতি লগ্নের
৭মে (মারক স্থান) অবস্থিত এবং ২য় ও ৭ম পতি (দুই মারকাধিপতি
) মঙ্গল দ্বারা দৃষ্ট। আবার চন্দ্র লগ্ন থেকে কেতু ৭মে অবস্থিত
এবং ৭ম ও ৮ম পতি ( চন্দ্র থেকে ) শনির দ্বারা দৃষ্ট। ‘কুজবৎ
কেতু’ (অনুচ্ছেদ ৫) অনুসারে কেতুর বৈশিষ্ট্য মঙ্গলের মতই।
মঙ্গল রক্তপাত ও হিংসাত্মক ঘটনা নির্দেশ করে। চন্দ্র থেকে
৭ম স্থানে ৩টি অশুভ শক্তির সমাবেশ হয়েছে - কেতুর অবস্থান,
শনি ও মঙ্গলের দৃষ্টি। চন্দ্র থেকে ২য় (মারক স্থান) পতি
রবির নক্ষত্রে অবস্থিত হওয়ায় বৃহস্পতির মারকত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে
(বৃহস্পতি ৩ নং নক্ষত্র কৃত্তিকায় অবস্থিত, কৃত্তিকার অধিপতি
বৃহস্পতি)। বৃহস্পতি-কেতুর দশা-অন্তর্দশায় তাই আততায়ীর গুলিতে
প্রাণত্যাগ করা অস্বাভাবিক নয়।
দীপক
সেনগুপ্ত
ফেব্রুয়ারী ৭, ২০১১