জ্যোতিষশাস্ত্র
প্রবেশিকা (অন্যান্য
অনুচ্ছেদ)
এই
বিভাগ এখনও
UNICODE ফণ্ট-এ অসম্পূর্ণ। বাংলা হরফ ফণ্টে দেখতে এইখানে
ক্লিক করুন।
অনুচ্ছেদ ১৫
কয়েকটি জন্মকুণ্ডলীর বিশ্লেষণ
৭.
উত্তম কুমার ( অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় )
জন্ম
বিবরণ : ৩রা সেপ্টেম্বর , ১৯২৬; সময় : সকাল ১০ - ২০ মিঃ;
স্থান : কোলকাতা, ভারতবর্ষ; অক্ষাংশ : ২২ ডিঃ ৩৫ মিঃ উত্তর;
দ্রাঘিমাংশ : ৮৮ ডিঃ ২৩ মিঃ পূর্ব। লাহিড়ী অয়নাংশ। ভোগ্য
দশা ( balance of dasha ) : বৃহস্পতি ৩ মাস ১৬ দিন।
বিঃ দ্রঃ : উত্তম কুমারের
জন্ম সময় যেটা পাওয়া গিয়েছে, সেটা কতটা নির্ভুল তা বলা কঠিন।
তবে এই সময় অনুযায়ী কুণ্ডলী প্রস্তুত করলে যেটা পাওয়া যায়
সেটা যে অত্যন্ত খ্যাতি সম্পন্ন কোন ব্যক্তির তাতে কোন সন্দেহ
নেই। অসুবিধা হল, উত্তম কুমারের জীবনের বিভিন্ন ঘটনার সময়
এবং তারিখ সহজ লভ্য নয়; যে কারণে ঘটনার সঙ্গে কুণ্ডলী বিশদ
ভাবে মিলিয়ে দেখা সম্ভব হয় নি। তবে সাল তারিখ জানা না থাকলেও
উত্তম কুমারের জীবনে কয়েকটি ঘটনা যা ঘটেছিল বলে জানা যায়
তার সমর্থন অবশ্যই কুণ্ডলী থেকে পাওয়া যায়। এই প্রবাদ প্রতিম
অভিনেতার মৃত্যুর ৩০ বছর পরেও তার নামে যে উন্মাদনা লক্ষ্য
করা যায়, জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে সেটা কতটা সমর্থিত সেটা পরীক্ষা
করার জন্যই এই ছকটি বেছে নেওয়া হয়েছে।
জীবনের
কিছু ঘটনা
১৯২৬ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর উত্তর কোলকাতার আহিরিটোলায় জন্ম।
তার ছোটবেলায় নাম ছিল অরুণ; শোনা যায় তার দিদিমা তাকে উত্তম
নামে ডাকতেন এবং পরে সেই নামেই তিনি পরিচিতি লাভ করেন। শৈশবেই
তিনি ভবানীপুরে গিরিশ মুখার্জী রোডের পৈতৃক বাড়িতে চলে আসেন।
South Subarban School-এ পড়াশুনা শেষ করে বাণিজ্য নিয়ে পড়তে
Goenka College-এ ভর্তি হন। কিন্তু আর্থিক অসুবিধার জন্য
কলেজের পাঠ শেষ না করেই তিনি Calcutta Port-এ কেরাণীর চাকরী
নিয়ে কর্ম জীবনে প্রবেশ করেন। বিশাল যৌথ পরিবারে 'সুহৃদ
সমাজ' নামে একটি থিয়েটার গ্রুপ ছিল, সেখানে তিনি ছেলে বেলা
থেকেই অভিনয় করতেন। অভিনয় ছাড়াও শরীর চর্চাতেও তার খুব ঝোঁক
ছিল। কুস্তি, সাঁতার, লাঠি খেলা, টেনিস ইত্যাদিতে তার উৎসাহ
ছিল সমধিক। পর পর তিন বছর তিনি সাঁতারে Bhowanipur Swimming
Association-এ সেরা বলে বিবেচিত হন।
১৯৪৭ সালে অরুণ কুমার
চট্টোপাধ্যায়ের চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ। ঐ বছরেই 'মায়াডোর'
নামক চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করলেও ছবিটি কখনও মুক্তি পায়
নি। প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি নীতিন বোস পরিচালিত 'দৃষ্টিদান'
মুক্তি পায় ১৯৪৮ সালে। তবে এই ছবিতে তিনি নায়কের ভূমিকায়
অভিনয় করেন নি। তার সঙ্গে প্রথম অভিনেত্রী ছবি রায়। পরিচালক
নবেন্দুসুন্দর বললেন অরুণ নাম চলবেনা, পাল্টাতে হবে। অরুণ
কুমার নিজেই প্রস্তাব করেন উত্তম নামের। কিন্তু ছবি রায়ের
শুধু উত্তম পছন্দ নয়, তিনি বলেন নাম হোক উত্তমকুমার। 'কামনা'
ছবিতে উত্তমকুমার নাম হলেও পরের ছবি 'মর্যাদা' ছবিতে একবার
অরূপকুমার নামে অভিনয় করেন, কিন্তু পরের ছবি 'ওরে যাত্রী'
থেকেই অরুণ কুমার চট্টোপাধ্যায় বাকি জীবনের জন্য উত্তমকুমার
হয়ে গেলেন। ১৮৫১ সালে পোর্ট কমিশনার্সের চাকরি ছেড়ে তিনি
পুরোপুরি চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৪
সালের মধ্যে 'অগ্নি পরীক্ষা' ছবির আগে তার ১৯ টি ছবি মুক্তি
পায় ( 'মায়াডোর', 'দৃষ্টিদান', 'কামনা', 'মর্যাদা', 'ওরে
যাত্রী', 'সহযাত্রী', 'নষ্টনীড়', 'সঞ্জীবনী', 'বসু পরিবার',
'কার পাপে', 'সাড়ে চুয়াত্তর', 'লাখ টাকা', 'নবীন যাত্রা',
'বউঠাকুরাণীর হাট', 'ওরা থাকে ওধারে', 'চাপাডাঙার বউ', 'কল্যাণী',
'সদানন্দের মেলা' ও 'অন্নপূর্ণার মন্দির' ) । এর মধ্যে 'সাড়ে
চুয়াত্তর', 'কার পাপে' ইত্যাদি ছবি বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ
করলেও তার কারণ উত্তমকুমার ঠিক নন। 'সাড়ে চুয়াত্তর' ছবিতে
তার সঙ্গে অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন অভিনয় করেন; কিন্তু অসম্ভব
জনপ্রিয় এই ছবিটিরও সাফল্যের কারণ উত্তমকুমার বা সুচিত্রা
সেন নন। তুলসী চক্রবর্তীর অসাধারণ অভিনয় ও অন্যান্যদের ভূমিকাই
এর সাফল্যের কারণ। তার প্রথম হিট ছবি ১৯৫৪ সালে মুক্তি প্রাপ্ত
'অগ্নি পরীক্ষা', সঙ্গে সুচিত্রা সেন। এর পরে আর তাকে কখনও
ফিরে তাকাতে হয় নি। উত্তম কুমার প্রথম নায়কের চরিত্রে অভিনয়
করেন ১৯৫০ সালের ১৫ই ডিসেম্বর মুক্তিপ্রাপ্ত 'মর্যাদা' ছবিতে;
নাযিকা ছিলেন স্মৃতিরেখা বিশ্বাস। এই ছবিতেই প্রথম উত্তম
কুমারের ( তখন নাম ছিল অরূপ কুমার ) ওষ্ঠে গান ব্যবহার করা
হয়েছিল; শিল্পী ছিলেন তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা
হিসাবে BFJA(Bengal Film Journalists' Association ) পুরষ্কার
পান ১৯৫৫ সালে। এর পর দুই একটি ক্ষেত্র ছাড়া মৃত্যুর পূর্ব
পর্যন্ত তার জয় যাত্রা অক্ষুন্ন ছিল।
উত্তম কুমারের বরুণ ও তরুণ নামে আরও দুই ভাই ছিল। বরুণ আয়ু
খুব বেশী পান নি। সর্বকনিষ্ঠ তরুণকুমার বাংলা চলচ্চিত্রে
একটি পরিচিত নাম। শোনা যায় বিখ্যাত গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
ছিলেন সম্পর্কে উত্তম কুমারের কাকা।
উত্তমের প্রযোজিত ঐহারানো
সুরঐ ছবিটি ভারত সরকারের সার্টিফিকেট অফ মেরিট পায়। ঐচিড়িয়াখানাঐ
ও ঐ্যান্টনি ফিরিঙ্গিঐ ছবি দুটিতে শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের জন্য
ভারত সরকার তাঁকে ভরত পুরষ্কার দেন।
১৯৪৮ সালে উত্তম কুমার বিয়ে করেছিলেন তার ছেলেবেলার বন্ধু
ও প্রণয়িনী গৌরী দেবীকে। অনেক দিন সুখে সংসার করেছিলেন।
তাদের এক পুত্র গৌতমের জন্ম হয় ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৫০ সালে।
কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরী হয়। সুপ্রিয়া
দেবীকে উত্তম চিনতেন বহু দিন ধরে; কিন্তু ১৯৫৯ সালে ঐশুন
বরনারীঐ ছবিতে অভিনয় করার সময় থেকেই নায়িকা সুপ্রিয়া দেবীর
সঙ্গে তিনি ভালবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৩ সালে গৌরী
দেবীর সঙ্গে উত্তম কুমারের মনোমালিন্য চরম আকার নেয় এবং
ঐ বছরেই ২৭শে সেপ্টেম্বর উত্তম গৃহত্যাগ করেন। জীবনের শেষ
দিন পর্যন্ত তিনি সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে তার ময়রা স্ট্রীটের
বাড়িতেই ছিলেন।
১৯৮০ সালের ২৪শে জুলাই
হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে উত্তম কুমারের মৃত্যু হয়। তার মরদেহ
নিয়ে যখন যাত্রা শুরু হয় তখন কোলকাতার পথে জনজোয়ার; পরিবহন
ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। মৃত্যুর পর ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে; এখনও
তার নামে মানুষের উন্মাদনার ঘাটতি নেই। বহু ছবিতে উত্তম-সুচিত্রার
নায়ক-নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় এবং হেমন্ত ও সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের
স্বর্ণকণ্ঠে পরিবেশিত সঙ্গীতের সঙ্গে তাদের ওষ্ঠ মেলান বছরের
পর বছর ধরে মানুষকে মোহময় রোম্যান্টিসিজ্মে আচ্ছন্ন করে
রেখেছে।
কোন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির
সফলতার দিকটা এতটাই সামনে চলে আসে যে খ্যাতি লাভ করবার আগে
হতাশা ও দুঃসময়ের দিনগুলি তখন আর মনে আসে না। উত্তম কুমারের
খ্যাতি খুব সহজে আসে নি। অনেক জায়গা থেকে তিনি প্রত্যাখ্যাত
হয়েছেন এবং অনেকের রূঢ় ব্যবহার তাকে আঘাত দিয়েছে যথেষ্ট।
কিন্তু তার ছিল অসামান্য নিষ্ঠা ও ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা।
অধ্যাবসায়, আত্মবিশ্বাস ও একনিষ্ঠ সঙ্কল্প মানুষকে যে সাফল্যের
কোন সীমায় পৌঁছে দেয় উত্তম কুমারের জীবন তার একটা জ্বলন্ত
উদাহরণ।
কুন্ডলীর বিশ্লেষণ
উত্তম
কুমারের রাশিচক্রটি ১৫(৭)ক চিত্রে এবং নবাংশ ১৫(৭)খ চিত্রে
দেখান হয়েছে।
(১) লগ্ন তুলা, রাশি
কর্কট। শনি, বৃহস্পতি, মঙ্গল ও শুক্র লগ্নের মত কাছাকাছি
ডিগ্রিতে অবস্থানের জন্য এই গ্রহ গুলি ফল দেবার ক্ষেত্রে
খুবই কার্যকরী হবার সম্ভাবনা বলে অনেক জ্যোতিষী মনে করেন।
তুলা লগ্নের অধিপতি এবং ৮ম পতি শুক্র ১০ম কেন্দ্র কর্কটে
১০ম পতি বর্গোত্তম চন্দ্রের সঙ্গে অবস্থিত হওয়ায় ১০ম স্থান
ও লগ্ন দুইই শক্তিশালী হয়েছে। চন্দ্র এবং শুক্র, শনি ( ৪র্থ
ও ৫ম পতি ), বক্রী বৃহস্পতি ( ৩য় ও ৬ষ্ঠ পতি ), এবং মঙ্গল
( ২য় ও ৭ম পতি ) দ্বারা দৃষ্ট। অতএব লগ্নপতি, চন্দ্র লগ্ন
ও ১০ম পতির উপর ৪টি মূল গ্রহের প্রভাব থাকায় ব্যক্তিত্বে,
চরিত্রে এবং কর্মক্ষেত্রে নানা বৈচিত্রময় গুণের প্রকাশ ঘটেছে।
লগ্নপতি শুক্র ( শুক্র নবাংশ লগ্ন বৃষেরও অধিপতি ) চন্দ্রের
সঙ্গে যুক্ত এবং নবাংশে তুঙ্গী। এতে উত্তম কুমারের সুশ্রী
গঠন হয়েছে এবং
তিনি অসামান্য শারীরিক সৌন্দর্যের অধিকারী হয়েছেন।
(২) উত্তম কুমারের
কুণ্ডলীতে উল্লেখযোগ্য কি কি গ্রহের অবস্থান ও যোগ রয়েছে
সেটা দেখে নেওয়া যাক।
(ক) ১০ম পতি চন্দ্র স্বক্ষেত্রস্থ ও বর্গোত্তম।
(খ) ৪র্থ ও ৫ম পতি রাজযোগকারী গ্রহ শনি লগ্নে তুঙ্গ ক্ষেত্রে
অবস্থিত হয়ে লগ্নপতি শুক্র ও ১০ম পতি চন্দ্রকে দৃষ্টি দিচ্ছে।
(গ) চন্দ্র লগ্ন থেকে ৫ম ও ১০ম পতি মঙ্গল রাজযোগকারী গ্রহ
হয়ে ১০মে মূলত্রিকোণে অবস্থিত।
(ঘ) চন্দ্র লগ্নের ৫ম পতি মঙ্গল ৪র্থ পতি শুক্রকে দৃষ্টি
দিচ্ছে এবং পরস্পরের কেন্দ্রে অবস্থিত।
(ঙ) বৃহস্পতি চন্দ্র থেকে কেন্দ্রে থাকায় গজকেশরী যোগ হয়েছে।
(চ) রাজযোগকারী গ্রহ শনি লগ্ন কেন্দ্রে তুঙ্গী হওয়ায় শশ
যোগ হয়েছে ( পঞ্চ মহাপুরুষ যোগের একটি )।
(ছ) চন্দ্র লগ্ন থেকে রাজযোগকারী গ্রহ মঙ্গল চন্দ্রের লগ্নের
১০মে এবং লগ্নের ৭মে মূলত্রিকোণে থাকায় রুচক যোগ হয়েছে (
এটিও পঞ্চ মহাপুরুষ যোগের অন্যতম )।
(জ) ৩য় ও ৬ষ্ঠ পতি বৃহস্পতি নীচস্থ হয়ে লগ্নপতি শুক্রকে
দৃষ্টি দিচ্ছে। এটিও একটি রাজযোগ। তবে বৃহস্পতির দুভাবে
নীচভঙ্গ হয়েছে। প্রথমতঃ রাশিপতি (sign dispositor) শনি লগ্ন
কেন্দ্রে এবং চন্দ্রের ৪র্থে থাকায় এবং দ্বিতীয়তঃ মকর রাশি
( যেখানে বৃহস্পতির অবস্থান ) মঙ্গলের তুঙ্গী ক্ষেত্র হওয়ায়
এবং মঙ্গল লগ্ন ( ও চন্দ্র ) থেকে কেন্দ্রে স্বক্ষেত্রস্থ
হওয়ায় বৃহস্পতির নীচভঙ্গ হয়েছে।
(ঝ) রবি ও বুধ রবির ক্ষেত্র সিংহ রাশিতে ১১শে অবস্থিত হয়ে
বুধাদিত্য যোগ তৈরী করেছে।
(ঞ) লগ্নপতি, শুক্র এবং বৃহস্পতি পরস্পরের কেন্দ্রে অবস্থিত
হলে ভেরী যোগ হয়। এখানে শুক্র নিজেই লগ্নপতি। শুক্র ও বৃহস্পতি
পরস্পরের কেন্দ্রে অবস্থিত; অতএব ভেরী যোগ হয়েছে।
(ট) ৬ষ্ঠ পতি বৃহস্পতি নীচস্থ হওয়ায় ( নীচভঙ্গ না ধরলে )
এবং ১০ম পতি চন্দ্র বর্গোত্তম হয়ে স্বক্ষেত্রস্থ হওয়ায় (
যদিও তুঙ্গী নয় ) জয় যোগ হয়েছে ধরে নেওয়া যায়।
(ঠ) লগ্ন থেকে ১০মে শুভ গ্রহ শুক্র থাকায় অমলা যোগও হয়েছে।
এতগুলি গ্রহের বিশেষ শুভ অবস্থান ও পারস্পরিক সম্পর্কের
জন্য বিভিন্ন যোগ তৈরী হওয়ায় কুণ্ডলীটি একটি বিশিষ্টতা দাবী
করতে পারে অবশ্যই।
(৩) লগ্নপতি শুক্রের
মতই মনের কারক গ্রহ চন্দ্রও বিভিন্ন গ্রহের দ্বারা দৃষ্ট
ও প্রভাবিত। মনও বিভিন্ন সময়ে ( দশা, অন্তর্দশা ইত্যাদির
উপর নির্ভর করে ) বিভিন্ন চিন্তায় আলোড়িত হয়েছে। লগ্নপতি
ও ১০ম পতি ( এখানে মনের কারক চন্দ্রই ১০ম পতি ) যুক্ত ভাবে
১০মে থাকায় উত্তম কুমারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কাজের
মধ্যে অস্থিরতা ( শনি ও মঙ্গলের প্রভাব ) এবং সময়ে সময়ে
বিপরীত ধর্মী মনোভাবের প্রকাশ থাকা সম্ভব।
(৪) মঙ্গল ২য় ও ৭ম
পতি; অতএব সাধারণভাবে মারক হবার কথা। তবে ভাবার্থ রত্নাকর
গ্রন্থে তুলা লগ্নের মঙ্গলকে মারক বলা হয় নি; কিন্তু পরাশর
মারক বলেছেন। যেখানে এই ধরণের বিভ্রান্তি হয় সেখানে পরাশরের
মতই গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়। তবে নৈসর্গিক অশুভ গ্রহ হয়ে
৭ম কেন্দ্রের অধিপতি হওয়ায় মঙ্গলের কিছুটা শুভত্ব থাকলেও
২য় পতি হিসাবে মারক নিশ্চয়ই। ৪র্থ স্থান থেকে পড়াশোনার বিচার
হয়। ৪র্থে ৩য় ও ৬ষ্ঠ পতি বক্রী বৃহস্পতি ২৩নং ধনিষ্ঠা নক্ষত্রে
( অধিপতি মঙ্গল ) অবস্থিত। আবার চন্দ্র থেকে বিচারেও ৪র্থে
৭ম ও ৮ম পতি শনি রয়েছে এবং ৪র্থ পতি শুক্রও শনির দ্বারা
দৃষ্ট। উত্তম কুমারের জন্মের ৩/৪ মাস পরেই শনির দশা শুরু
হয়। শনির দশা ১৯ বছরের। অতএব তার লেখাপড়া খুব বেশী এগোয়
নি। শনির দশার শেষেই তার লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে বলে মনে হয়।
(৫) শরীর চর্চা এবং
খেলাধূলার ( sports ) কারক গ্রহ মঙ্গল। মঙ্গল লগ্ন, লগ্নপতি
শুক্র, চন্দ্র লগ্ন ও ১০ম পতিকে ( চন্দ্রই ১০ম পতি ) দৃষ্টি
দেওয়ায় উত্তম কুমারের খেলাধূলা ও শরীর চর্চায় ঝোঁক ছিল।
শক্তিশালী রুচক যোগও ( পূর্বে বর্ণিত ) এটাকে ফলপ্রসূ করতে
সাহায্য করেছে। তবে মঙ্গল ২নং ভরণী নক্ষত্রে ( অধিপতি শুক্র
) অবস্থান করায়, উত্তম কুমারের খেলাধূলা ও অঙ্গ সঞ্চালনে
নিছক দক্ষতার প্রকাশ ছাড়াও একটা শৈল্পিক দিক ছিল বলে মনে
হয়।
(৬) ৫ম স্থান থেকে
বুদ্ধি, আবেগ, অনুভূতি, সূক্ষ্ম বাসনা ইত্যাদি বিবেচিত হয়।
উত্তম কুমারের লগ্ন থেকে ৫ম পতি শনি, ৭মে ( জায়া, প্রেমজ
বিষয় নির্দেশ করে ) অবস্থিত ৭ম পতি মঙ্গলকে এবং শুক্রকে
( প্রেম, ভালবাসা ইত্যাদির কারক গ্রহ ) দৃষ্টি দিচ্ছে। একই
যোগ হয়েছে চন্দ্র লগ্ন থেকেও। চন্দ্র থেকে ৫ম পতি মঙ্গল,
৭ম পতি শনিকে এবং কারক গ্রহ শুক্রকেও দৃষ্টি দিচ্ছে। শুক্র
নিজেই লগ্নপতি হয়ে চন্দ্রের ( মনের কারক গ্রহ ) সঙ্গে যুক্ত।
এই অভিনেতার সমস্ত জীবন, মন ও কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়েছে আবেগ
ও কল্পনা প্রসূত রোম্যান্টিসিজ্মকে কেন্দ্র করে। প্রেম,
প্রীতি, ভালবাসা, স্নেহই এই মহানায়কের মুখ্য চালক শক্তি।
এমন কি নবাংশেও ৫ম পতি বুধ ও ৭ম পতি মঙ্গল পরস্পরকে দৃষ্টি
দিচ্ছে। এই যোগেরই ফল হিসাবে তিনি ১৯৪৮ সালের ১লা জুন বুধ-কেতুর
দশা-অন্তর্দশায় প্রণয়িনী গৌরী গাঙ্গুলিকে ভালবেসে বিয়ে করেন।
কেতু বৃহস্পতির ক্ষেত্রে এবং ২০ নং পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্রে
( অধিপতি শুক্র ) অবস্থিত। অতএব কেতু বৃহস্পতি ও শুক্রের
ফল দেবে। বৃহস্পতি চন্দ্রের ৭মে ( জায়াস্থান ) অবস্থান করছে
এবং শুক্র জায়া কারক গ্রহ। বুধ ১১শ পতি রবির সঙ্গে ১১শে
( ইচ্ছা পূরণ ) কেতুর মঘা নক্ষত্রে অবস্থিত। রবি ১১নং পূর্বফাল্গুনী
( অধিপতি শুক্র ) নক্ষত্রে অবস্থিত। বুধ সহজেই অন্য গ্রহের
দ্বারা প্রভাবিত হয়; অতএব শক্তিশালী রবির দ্বারা বুধ প্রভাবিত
হতেই পারে এবং রবির আংশিক ফল দিতে পারে। এ ছাড়াও বুধ চন্দ্র
লগ্নের ২য়ে ( পরিবার ) অবস্থিত হওয়ায় বিয়ের অনুকূল হয়েছে।
(৭) ৪র্থ স্থান থেকে
গৃহসুখের বিচার হয়। লগ্নের ৪র্থে ৩য় ও ৬ষ্ঠ পতি নীচস্থ বক্রী
বৃহস্পতির অবস্থান। ৪র্থ পতি শনি ২য় ও ৭ম পতি মঙ্গলের দ্বারা
দৃষ্ট। চন্দ্র থেকে ৪র্থে ৭ম ও ৮ম পতি শনির অবস্থান এবং
পাপগ্রহ মঙ্গল দ্বারা দৃষ্ট। এমন কি ভ-চক্রের ( natural
zodiac - অনুচ্ছেদ ৩ ) ৪র্থ স্থান কর্কট রাশি ও তার অধিপতি
চন্দ্র শনি ও মঙ্গলের দ্বারা পীড়িত। এটা নিশ্চিত করে বলা
যায়, গৃহসুখ (domestic peace ) বলতে যা বোঝায়, উত্তম কুমারের
কাছে তা চিরকাল অধরাই ছিল। চন্দ্র শনি ও মঙ্গলের দ্বারা
দৃষ্ট হওয়ায় তিনি নিরন্তর মানসিক যন্ত্রণা ও অস্থিরতায় কষ্ট
পেয়েছেন।
(৮) শোনা যায় উত্তমকুমারের
ভাই বরুণকুমার স্বল্পায়ু ছিলেন। লগ্নের ৩য়ে ( অনুজ ) কেতুর
অবস্থান এবং শনির দৃষ্টি এই ঘটনা ঘটাতে পারে।
(৯) শুক্র কলা, শিল্প,
সঙ্গীত ইত্যাদির কারক গ্রহ। শুক্র লগ্নপতি হয়ে ১০মে ১০ম
পতি বর্গোত্তম চন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় অভিনয় প্রতিভা
ছিল তার সহজাত। উত্তম কুমারের শনির দশা শেষ হয় তার ১৯ বছর
বয়সে। এর পর ১৭ বছরের বুধের দশা। ১৯৫৩ সালে বুধ-চন্দ্রের
দশা-অন্তর্দশায় সাড়ে চুয়াত্তর ছায়াছবিটি মুক্তি পায় এবং
অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। বুধ ৯ম পতি ও ১১শে অবস্থিত। চন্দ্র
১০ম পতি ও শুক্রের সঙ্গে যুক্ত। বুধের ১২শ পতিত্ব দোষও রয়েছে।
সফলতা লাভের আগে উত্তম কুমারকে নানান ব্যর্থতা ও প্রত্যাখ্যানের
শিকার হতে হয়। বুধ ১২শ পতি হলেও ১১শে ( ১২শের ১২শে ) অবস্থিত
হওয়ায় ১২শ পতিত্ব দোষ কিছুটা লঘু হয়ে গেছে। বুধের বাকী দশায়
তার জয়যাত্রা ছিল অব্যাহত। বুধের পর কেতুর দশাতেও তার সাফল্যের
খুব ঘাটতি ছিল না। কেতু ৩য়ে শুক্রের নক্ষত্রে অবস্থিত এবং
রাজযোগকারী গ্রহ শনির দ্বারাদৃষ্ট। কিন্তু কেতুর দশাতে অভিনেতা
হিসাবে তার খ্যাতি অক্ষুণ্ণ থাকলেও তার দুর্ভাগ্যের সূচনা
হয় অন্য ভাবে।
(১০) গৌরী দেবীর সঙ্গে
তার মনোমালিন্য চূড়ান্ত আকার ধারণ করে ১৯৬৩ সালে। অবশেষে
ঐ বছরেই ২৭শে সেপ্টেম্বর তিনি স্ত্রী গৌরী দেবীকে ত্যাগ
করে সুপ্রিয়া দেবীর সঙ্গে বাস করতে শুরু করেন। ঘটনাটি ঘটে
কেতু-শুক্রর দশা-অন্তর্দশায়। কেতু মঙ্গলের মতই ফল দেয় (
কুজবৎ কেতু )। কেতু স্ত্রী কারক গ্রহ শুক্রের নক্ষত্রে অবস্থিত।
মঙ্গল লগ্নের ৭মে অবস্থিত হয়ে শনিদৃষ্ট হওয়ায় স্ত্রীর সঙ্গে
বিচ্ছেদ ঘটাতে পারে। দশা পতি কেতু থেকে অন্তর্দশা পতি শুক্রের
অবস্থান ৮মে; এটা শুভ নয়। চন্দ্র লগ্ন থেকেও ৭ম পতি শনি
মঙ্গলের দ্বারা দৃষ্ট। শুক্র রয়েছে ৯নং অশ্লেষা নক্ষত্রে;
অধিপতি ৩য় ও ১২শ পতি বুধ। শুক্র রবি ও রাহুর মধ্যবর্তী হয়ে
পাপ কর্তরী যোগেও আক্রান্ত। আগেও বলা হয়েছে একই গ্রহ জীবনে
শুভ ও অশুভ দু রকম ফলই দিতে পারে। যে সব গ্রহ উত্তম কুমারের
খ্যাতি, নাম যশ পেতে সাহায্য করেছে, তারাই তাকে গৃহসুখ থেকেও
বঞ্চিত করেছে।
(১১) উত্তম কুমারের
ছেলে গৌতমের ক্যান্সারে মৃত্যু হয়। লগ্ন থেকে ৫ম পতি শনি
মঙ্গলের দ্বারা দৃষ্ট। কারক গ্রহ বৃহস্পতি ২৩ নং ধনিষ্ঠা
নক্ষত্রে ( অধিপতি মঙ্গল ) শনির ঘরে অবস্থিত। চন্দ্র লগ্ন
থেকেও ৫ম স্থান বৃশ্চিক রাশি পাপকর্তরী যোগে দুষ্ট এবং ৫ম
পতি মঙ্গল শনির দ্বারা দৃষ্ট।
(১২) উত্তম কুমারের
নিজের মৃত্যু হয় ২৪শে জুলাই ১৯৮০ সালে, শুক্র-বৃহস্পতি-বৃহস্পতি
দশা-অন্তর্দশা-প্রত্যন্তর্দশায়। লগ্ন দুটি অশুভ গ্রহ শনি
ও মঙ্গলের দ্বারা ক্লীষ্ট; কোন শুভ গ্রহের দৃষ্টি লগ্নে
নেই। লগ্নপতি শুক্র শনি এবং মঙ্গলের দ্বারা দৃষ্ট হয়ে অশুভত্ব
প্রাপ্ত হয়েছে। ৮ম স্থান থেকে আয়ু বিচার হয়। ৮ম রাশি বৃষ
রাহু ও মঙ্গলের দ্বারা পাপ কর্তরী যোগে আক্রান্ত। ৮ম পতি
শুক্রও শনি এবং মঙ্গলের দ্বারা দৃষ্ট। এ সব কারণে পরমায়ু
বেশী হয় নি। বৃহস্পতি ৩য় ও ৬ষ্ঠ পতি হয়ে চন্দ্রের ৭মে (
মারক স্থান ), শনির ক্ষেত্রে এবং মঙ্গলের ( লগ্ন থেকে ৭ম
পতি ) নক্ষত্রে থাকায় মারক হয়েছে। অতএব উপরোক্ত সময়ে উত্তম
কুমারের জীবনাবসান।
উত্তম কুমারের ছকে শনি ও মঙ্গলের প্রভাব স্পষ্ট। লগ্ন, চন্দ্রলগ্ন
ও লগ্নধিপতি শুক্র প্রত্যেকটিই শনি ও মঙ্গলের দ্বারা হয়
দৃষ্ট না হয় তাদের সঙ্গে যুক্ত। শনি তুলা লগ্নের রাজযোগকারী
গ্রহ কিন্তু চন্দ্র থেকে ৭ম ও ৮ম পতি। মঙ্গল তুলা লগ্নের
রাজযোগকারী গ্রহ কিন্তু লগ্ন থেকে ২য় ও ৭ম পতি। শনি ও মঙ্গলের
অবস্থান পরস্পরের মুখোমুখি। শুভ এবং অশুভের বিচিত্র সহাবস্থান।
জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে শুভ এবং অশুভ ফল কাটাকাটি হয়ে অবশিষ্ট
কিছু শুভ বা কিছু অশুভ ফল ফলবে এ রকম হয় না। শুভ এবং অশুভ
ফল দুইই আলাদা ভাবে ভোগ করতে হবে। " অবশ্যমেব ভোক্তব্যং
কৃতকর্মং শুভাশুভং। "