জ্যোতিষশাস্ত্র
প্রবেশিকা (অন্যান্য
অনুচ্ছেদ)

এই
বিভাগ এখনও
UNICODE ফণ্ট-এ অসম্পূর্ণ। বাংলা হরফ ফণ্টে দেখতে এইখানে
ক্লিক করুন।
অনুচ্ছেদ ১৫
কয়েকটি জন্মকুণ্ডলীর বিশ্লেষণ
৮.
স্বামী বিবেকানন্দ
জন্ম
বিবরণ : ১২ই জানুয়ারী, ১৮৬৩ খৃষ্টাব্দ; সময় : সকাল ৬ - ৩৩
মিঃ ( স্থানীয় সময় ) ; স্থান : কোলকাতা, অক্ষাংশ : ২২ ডিঃ
৩৫ মিঃ উত্তর; দ্রাঘিমাংশ : ৮৮ ডিঃ ২৩ মিঃ পূর্ব, ভারতবর্ষ;
Time Zone : 5-53-30 East. লাহিড়ী অয়নাংশ. ভোগ্য দশা (balance
of dasha) : চন্দ্র ৪ বছর ৪ মাস ২৭ দিন।
( বিঃ দ্রঃ এখানে time
zone 5-53-30 East-এর অর্থ হল, স্থানীয় সময় ৬-৩৩ মিঃ থেকে
৫ ঘণ্টা ৫৩ মিনিট ৩০ সেকেণ্ড বিয়োগ করলে GMT পাওয়া যায় এবং
GMT-এর সঙ্গে ৫ ঘণ্টা ৩০ মিনিট যোগ করলে IST পাওয়া যায় অর্থাৎ
৬-৩৩ মিনিটের থেকে ২৩ মিঃ ৩০ সেঃ বিয়োগ করলে IST পাওয়া যায়।
৪র্থ অনুচ্ছেদে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, IST থেকে সব গ্রহের
স্ফূট এবং স্থানীয় সময় থেকে লগ্ন নির্ণয় করতে হবে)।
জীবনের
কিছু ঘটনা
ছোটবেলার নরেন্দ্রনাথ
দত্ত ( পরে বিশ্ব বিজয়ী বিবেকানন্দ ) জন্ম গ্রহণ করেন উত্তর
কোলকাতার একটি স্বচ্ছল পরিবারে। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত ছিলেন
একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী, যথেষ্ট উপার্জন ছিল তার। ভগবৎ
প্রেম ও ঈশ্বরে বিশ্বাস নরেন্দ্রনাথের ছিল সহজাত। এ ব্যাপারে
তিনি তার মা ভুবনেশ্বরী দেবীর কাছে ঋণী - একথা নরেন্দ্রনাথ
স্বীকার করেছেন। অল্প বয়সেই তিনি শিবের ধ্যানে বাহ্য জ্ঞান
শূন্য হয়ে পড়তেন।
১৮৭১ সালে নরেন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের Metropolitan
Institution-এ ভর্তি হন। স্কুলের পাঠ শেষ করে ১৮৭৯ সালে
প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রবেশ করেন কিন্তু এক বছর পরে তিনি
General Assemblys Institution-এ ( পরবর্তী কালে Scottish
Church College) চলে যান এবং ১৮৮৪ সালে B.A ডিগ্রী লাভ করেন।
১৮৮৪ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে
নরেন্দ্রনাথের পিতার মৃত্যু হয়। সংসারে দুর্যোগ ঘনিয়ে আসে
এর পরেই। যে সব পরিচিত জন এবং আত্মীয়রা পরম হিতৈষীর মত ব্যবহার
করত, তারা হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে নিল এবং অনেকে সম্পত্তির দাবী
নিয়ে নরেন্দ্রনাথ ও তার মাকে আইনের জালে জড়িয়ে ফেলল। মামলা
সংক্রান্ত নানা বিষয় স্বামীজীকে তার মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বেও
রেহাই দেয় নি। পিতার মৃত্যুর পর উপার্জন না থাকায় এবং মামলা
লড়তে গিয়ে নরেন্দ্রনাথের বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ হওয়ায় দারিদ্র
তাকে ক্রমশঃ গ্রাস করে ফেলে। মা এবং ছোট ভাইদের দুঃখ দূর
করার জন্য একটা সামান্য চাকরীও তিনি জোটাতে পারেন নি। কিছু
দিনের জন্য শিক্ষকতার কাজ পেলেও তাকে সেটা ছাড়তে হয়। এত
অসহনীয় অবস্থার মধ্যেও তার অবিচল ঈশ্বর অনুসন্ধিৎসা জাগ্রত
ছিল। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাৎকার
হয় ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে; তিনি তখন কলেজের ছাত্র এবং
ব্রাহ্ম সমাজে যাতায়াত করছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অসামান্য
ভালবাসা, অকৃত্রিম ভগবৎ প্রেম, ঐশ্বরিক সারল্য ও ঈশ্বর দর্শনের
সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতা তাকে সংসার বিমুখ করে তোলে। তিনি বুঝতে
পারেন যে প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন এখানেই তিনি
তা পাবেন। এর পরেই ঠাকুরের কাছে তার ঘন ঘন যাতায়াত শুরু
হয়। তার সঙ্গীতের কণ্ঠ ছিল অতি মধুর। শ্রীরামকৃষ্ণ ত বটেই,
অন্যেরাও তার গান শোনার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকতেন।
পরমহংস দেবের মৃত্যু হয় ১৮৮৬ সালের ১৬ই আগষ্ট। এর পর নরেন্দ্রনাথ
পাগলের মত আশ্রয়হীন অবস্থায় ঘুরে বেড়ান। একদিকে বাড়ীতে মা
অর্থকষ্টে জর্জড়িত আবার অন্যদিকে বৈরাগ্যের নির্মম হাতছানি।
কতিপয় সম মনোভাবাপন্ন ও ঠাকুরের আদর্শে উদ্বুদ্ধ যুবককে
সঙ্গে নিয়ে ঠাকুরের অনুসৃত ভাবধারাকে সম্বল করে এগিয়ে চলেন
তিনি।
১৮৯৩ সালের মে মাসে তিনি আমেরিকা যান এবং ঐ বছরেই সেপ্টেম্বরে
শিকাগোয় তার সেই সাড়া জাগান বক্তৃতা তাকে খ্যাতির আলোয় নিয়ে
আসে। এর পর তার নিরন্তর এগিয়ে চলা। সময় খুব কম; যে উদ্দেশ্য
নিয়ে তিনি পৃথিবীতে এসেছেন তাকে রূপদান করে যেতে হবে। তার
জীবনে আয়াস বা অযথা কালক্ষেপের কোন স্থান ছিল না। পরিব্রাজক
অবস্থায় বহু তীর্থে তিনি ঘুরেছেন, নির্জনে তপস্যা করেছেন,
সংসারে সবার মধ্যে থেকে কাজ করলেও মায়ার আবর্তে তিনি কখনও
পড়েন নি। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবধারাকে অক্ষুন্ন রাখতে এবং সংসার
জ্বালায় ক্লীষ্ট মানুষকে শান্তির পথ দেখাতে তিনি বেলুড় মঠ
নির্মানের পরিকল্পনা করেন। বর্তমান মঠের নির্মান কার্য ১৯৩৮
সালের ১৪ই জানুয়ারী শেষ হয়। স্বামীজী বর্তমান মঠ দেখে যেতে
পারেন নি। ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই তিনি মরদেহ ত্যাগ করেন।
কুণ্ডলীর
বিশ্লেষণ
(১)
লগ্ন ধনু, অগ্নিরাশি; লগ্নপতি ( এবং ৪র্থ পতি ) বৃহস্পতি
১১শে তুলায় ১৪নং চিত্রা নক্ষত্রে ( অধিপতি মঙ্গল ) অবস্থিত
এবং স্বক্ষেত্রস্থ মঙ্গল দ্বারা দৃষ্ট। মঙ্গল ( ৫ম ও ১২শ
পতি ) ১নং অশ্বিনী নক্ষত্রে ( অধিপতি কেতু ) রয়েছে। ৯ম পতি
রবি ( সিংহ রাশির অধিপতি ) লগ্নে ২১নং পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্রে
( অধিপতি রবি ) অবস্থিত। লগ্ন ও রবি বর্গোত্তম হওয়ায় অত্যন্ত
শক্তিশালী। এ থেকেই একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। লগ্ন একটি
অগ্নি রাশি ধনুতে, রবি অগ্নিরাশি সিংহের অধিপতি হয়ে বর্গোত্তম
এবং ৫ম পতি মঙ্গল ( ক্ষিপ্রতা, কর্মক্ষমতা, দৃপ্তভাব ইত্যাদির
কারক গ্রহ ) অপর একটি অগ্নিরাশি মেষে মূলত্রিকোণে অবস্থিত
হয়ে স্বনক্ষত্রে স্থিত লগ্নপতি বৃহস্পতিকে দৃষ্টি দিচ্ছে।
এ থেকে বোঝা যায়, জাতকের অসাধারণ রজগুণ, তেজ, কর্মক্ষমতা
ও সাহস ছিল।
(২) স্কুলে এবং কলেজে শিক্ষকেরা স্বামীজীকে অত্যন্ত প্রতিভাবান
বলে মনে করলেও পরীক্ষায় নম্বর কিন্তু তিনি আশানুরূপ পান
নি। ৪র্থ স্থান থেকে লেখাপড়ায় সফলতা বিচার্য। এখানে ৪র্থ
পতি বৃহস্পতি ১১শে
অবস্থিত
হলেও মঙ্গল দ্বারা দৃষ্ট এবং শনি ও রাহু দ্বারা শক্তিশালী
পাপ কর্তরী যোগে পীড়িত। চন্দ্র থেকেও ৪র্থ পতি বৃহস্পতি
একই কারণে অশুভ ভাবে আক্রান্ত এবং ৪র্থে ১২শ পতি রবি অবস্থিত।
অতএব পরীক্ষায় ফল ভাল হয় নি।
৪র্থ স্থান থেকে যেহেতু গৃহসুখ ও মা-এর অবস্থারও বিচার করা
হয় ; একই কারণে গৃহসুখ বলতে স্বামীজীর কিছু ছিল না। তিনি
প্রায় গৃহত্যাগীই ছিলেন; নিরন্তর ঘুরে বেড়িয়েছেন। ৪র্থ পতি
তুলা রাশিতে ( চর রাশি ) অবস্থিত হওয়ায় এটা আরও জোরালো হয়েছে।
স্বামী বিশ্বনাথ দত্তের মৃত্যুর পর স্বামীজীর মা ভুবনেশ্বরী
দেবী আর সুখের মুখ দেখেন নি। মাতৃকারক গ্রহ চন্দ্র দুঃখের
কারক গ্রহ শনির সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় এটা আরও নিশ্চিত ভাবে
বোঝা যায়। চন্দ্র লগ্ন থেকে ১২শ পতি রবি ( পিতৃকারক গ্রহ
) ৪র্থে অবস্থনের জন্য পিতার মৃত্যুর পরে সাংসারিক অবস্থার
অবনতি এবং আত্মীয় স্বজনের বিরূপ মনোভাব নির্দেশ করে।
(৩) স্বামীজীর ছকের তিনটি মূল বিষয় হল তার নিরবচ্ছিন্ন সাংসারিক
কষ্ট, আপোষহীন সংগ্রাম এবং জ্বলন্ত আধ্যাত্মিকতা। প্রথম
দু'টি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার আধ্যাত্মিক মনোভাবের কারণ
বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
(ক) ৫ম স্থান থেকে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে ভক্তি, মন্ত্রদীক্ষাও
বিবেচ্য। ১২শ স্থান মোক্ষ নির্দেশ করে। ৫ম ও ১২শ পতি মঙ্গল
মেষ রাশিতে মূলত্রিকোণে এবং কেতুর নক্ষত্রে অবস্থিত। কেতু
কৈবল্য কারক গ্রহ। মঙ্গল আবার লগ্নপতিকে দৃষ্টি দিচ্ছে।
বৃহস্পতি ( ধর্মের কারক গ্রহ ) মঙ্গলের নক্ষত্রে অবস্থিত।
অতএব গ্রহ ও নক্ষত্রের প্রতিটি অবস্থান আধ্যাত্মিকতা বিকাশে
সাহায্য করেছে।
(খ) শনিকে বৈরাগ্যের (detachment) কারক গ্রহ বলা হয়। চন্দ্র
মনের কারক গ্রহ। শনি চন্দ্রের সঙ্গে ১০মে (house of action)
যুক্ত হওয়ায় স্বামীজের মন জন্ম থেকেই বৈরাগ্যময় ছিল। সাংসারিক
বিষয়ে তিনি কখনও আকৃষ্ট হন নি। চন্দ্র ও শনির এই অবস্থান
একটি সন্ন্যাস যোগ।
(গ) ৯ম ভাব ধর্মকে নির্দেশ করে। ৯ম পতি রবি বর্গোত্তম হয়ে
লগ্নে অবস্থিত। রবি আত্মা (soul), আত্মসম্মান ইত্যাদির কারক
গ্রহ। অতএব স্বামীজীর শুধু ধর্মভাব নয়, সেই সঙ্গে আত্মসম্মান
(dignity) বোধ পূর্ণ মাত্রায় তার চরিত্রে বর্তমান ছিল। নীচতা,
ক্ষুদ্রতার সঙ্গে তিনি কখনও আপোষ করেন নি। স্বনক্ষত্রস্থ
বর্গোত্তম রবি লগ্নে ( লগ্নও বর্গোত্তম ) থাকায় ধর্মভাব
ছিল তার অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত। তিনি কখনও আদর্শচ্যুত হন
নি।
(ঘ) মঙ্গল যুক্তি ও তর্কের কারক গ্রহ। ৫ম স্থান সূক্ষবুদ্ধি,
ভালমন্দ সত্যাসত্য বিচার (discrimination) করার ক্ষমতা ইত্যাদি
নির্দেশ করে। ৫ম পতি মঙ্গল ৫মে অবস্থিত হওয়ায় ধর্ম ও ভক্তির
বিষয়ে তিনি কোথাও নিঃশর্ত আত্মসমর্পন করেন নি, যতক্ষণ না
তিনি বিচার্য বিষয়ের সত্যতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়েছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণকেও তিনি নানা ভাবে পরীক্ষা করে নিয়েছেন।
(ঙ) চন্দ্র লগ্ন থেকে দেখলেও ৫ম পতি ( ভক্তি ) শনি ( বৈরাগ্যের
কারক ) লগ্নে চন্দ্রের সঙ্গে ১৩নং হস্তা নক্ষত্রে ( অধিপতি
চন্দ্র নিজেই ) অবস্থিত। আবার ৯ম ( ধর্ম ) স্থানের অধিপতি
শুক্র ৫মে ( মকর রাশিতে ) লগ্ন ও ১০ম পতি বুধের সঙ্গে যুক্ত।
চন্দ্রের ৯মে কৈবল্য কারক কেতুর অবস্থান।
(চ) রাহু ১২শে ( মোক্ষ স্থান ) অবস্থিত হয়ে শনি দ্বারা দৃষ্ট।
৫ম পতি মঙ্গলও রাহুকে দৃষ্টি দিচ্ছে; অতএব রাহু পূর্ণ মাত্রায়
ভক্তি, বৈরাগ্য ও মোক্ষভাব প্রাপ্ত হয়েছে।
(ছ) অপর একটি গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় দৃষ্টি এড়িয়ে গেলে চলবে
না। শুক্র ( কাম ও পার্থিব বাসনা বিষয়ক গ্রহ ) সম্পূর্ণ
অশুভ দৃষ্টি বা সঙ্গ বর্জিত; অবস্থিত ২১নং উত্তরাষাঢ়া নক্ষত্রে
( অধিপতি ৯ম পতি রবি )। এই বৈশিষ্ট্য নবাংশেও দেখা যায়।
নবাংশে শুক্র তুঙ্গী এবং লগ্ন পতি বৃহস্পতি দ্বারা দৃষ্ট;
কিন্তু শুক্র কোন ভাবেই অশুভত্ব প্রাপ্ত হয় নি। এই গ্রহটি
সম্পূর্ণ মালিন্য বর্জিত হওয়ায় স্বামীজীর অটুট ব্রহ্মচর্য
বজায় ছিল। তিনি ছিলেন পবিত্রতার প্রতিমূর্তি। এদেশে এবং
বিদেশে অনেক প্রলোভন ও প্ররোচনা সত্বেও কোন বিষয় বাসনা বা
মোহ তাকে আকৃষ্ট করতে পারে নি। এই কুণ্ডলীটির প্রতিটি গ্রহই
কোন না কোনো ভাবে আধ্যাত্মিকতা ফুটিয়ে তুলেছে। এ ধরণের জন্ম
কুণ্ডলী অতি বিরল।
(৪) দুঃখকারক গ্রহ
শনি মনের কারক গ্রহ চন্দ্রের সঙ্গে ১০মে যুক্ত থাকায় স্বামীজী
তীব্র মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছেন এবং তিনি যা কিছুই
অর্জন করেছেন সেটা পেতে তাকে কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে প্রতি
পদে। এর একটি মূল কারণ হ'ল চন্দ্র ৮ম পতি হয়ে ১০মে অবস্থিত
হয়েছে। শনির এক একটি রাশি অতিক্রম করতে আড়াই বছর সময় লাগে।
চন্দ্র যে রাশিতে রয়েছে তার আগের রাশি, চন্দ্রের রাশি এবং
তার পরবর্তী রাশি - এই তিন রাশি অতিক্রম করতে শনির লাগে
সাড়ে সাত বছর। এই সময়টাকে শনির 'সাড়ে সাতি' বলা হয়। অনেকের
মতে এই সময়টা খুবই খারাপ ( এ সম্বন্ধে পরে আলোচনার ইচ্ছা
রইল )। এ ভাবে দেখলে স্বামীজীর জন্মের সময়েই শনি চন্দ্রের
সঙ্গে রয়েছে, অতএব সাড়ে সাতিতেই জন্ম বলা চলে; হয় ত সেই
জন্যই দুঃখ ও বঞ্চনা যেন জন্ম থেকেই তার সঙ্গ নিয়েছে।
(৫) লগ্নপতি ও ৪র্থ
পতি বৃহস্পতি, ৫ম পতি মঙ্গলের সঙ্গে দৃষ্টি বিনিময় করছে
- এটা একটা রাজযোগ। শনি ও বুধের স্থান বিনিময়ও হয়েছে। চন্দ্র
লগ্ন থেকে দেখলে লগ্নপতি ও ১০ম পতি বুধের সঙ্গে ৫ম পতি শনির
স্থান বিনিময় অপর একটি রাজযোগ।
(৬) চন্দ্রের ৭মে এবং
লগ্নের ৭মে শনির দৃষ্টি থাকায় বিয়ের ব্যাপারে তিনি ছিলেন
নিরাসক্ত।
লগ্নের ১০মে ( কর্ম ক্ষেত্র ) শনির অবস্থান এবং ১০ম পতি
বুধের সঙ্গে শনির ক্ষেত্র বিনিময় হয়েছে। আবার চন্দ্র থেকে
দেখলেও ১০মে ( মিথুন রাশিতে ) শনির দৃষ্টি এবং ১০ম পতি বুধের
সঙ্গে শনির স্থান বিনিময় হয়েছে। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে
গীতায় উক্ত কর্মযোগী। কর্মফলের আকাঙ্খা তার ছিলনা; আসক্তিহীন
ভাবে কাজ করে গেছেন।
(৭) স্বামীজীর চন্দ্রের
দশায় জন্ম। সাড়ে চার বছর বয়স থেকে মঙ্গলের দশা পেয়েছেন ৭
বছরের জন্য। মঙ্গল খেলাধূলা ও শরীর চর্চার কারক গ্রহ। মঙ্গল
লগ্নপতি বৃহস্পতিকে দৃষ্টি দেওয়ায় তার শরীর ছিল বলিষ্ঠ;
ছেলেবেলায় খেলাধূলা, ব্যায়াম ও কুস্তি তিনি নিয়মিত করেছেন।
তার রাহুর দশা শুরু হয় ১৮৭৪/১৯৭৫ সালে, ১৮ বছরের দশা। আলোচ্য
কুণ্ডলীতে রাহুর আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য আগেই ব্যাখ্যা করা
হয়েছে। ১৮৮১ সালের নভেম্বর মাসে রাহু-শনির দশায় তার সঙ্গে
শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম সাক্ষাৎ; সঠিক দশা-অন্তর্দশায় তার
প্রকৃত আধ্যাত্মিক জীবনের শুরু।
(৮) ১৮৮৪ সালের ২৪শে
ফেব্রুয়ারী রাহু-বুধের দশা-অন্তর্দশায় নরেন্দ্রনাথের পিতৃ
বিয়োগ হয়। রাহু পিতৃ কারক গ্রহ রবির ১২শে ( ব্যয় স্থান )
অবস্থিত। রাহু ১৮নং বুধের নক্ষত্রে থাকায় বুধের ফলও দেবে।
বুধ রবির ২য়ে ( মারক স্থান ) অবস্থিত এবং লগ্নের ৯ম থেকে
( পিতৃ স্থান ) ২য় স্থানের অধিপতি। আবার চন্দ্র লগ্নের ৯ম
থেকে ২য় স্থানের অধিপতিও বুধ; অতএব রাহু-বুধে পিতৃবিয়োগ।
পরমহংস দেবের মৃত্যু হয় ১৮৮৬ সালের ১৬ই আগষ্ট, স্বামীজীর
রাহু-শুক্রের দশা-অন্তর্দশায়। ৯ম পতি ( ৯ম স্থান গুরুকে
বোঝায় ) রবির ২য়ে ( মারক স্থান ) শুক্র এবং ৯ম পতি রবির
১২শে রাহু অবস্থিত। চন্দ্র লগ্ন থেকে ৯ম স্থানের ৭মে ( মারক
স্থান ) রাহুর অবস্থান।
(৯) লগ্নে বর্গোত্তম রবি ( নেত্র কারক - ৫ম অনুচ্ছেদ ) এবং
২য়ে ( চোখ, মুখ ইত্যাদি ) বুধ ও শুক্রের অবস্থানের জন্য
স্বামীজীর চোখ দুটি ছিল অপূর্ব সুন্দর, উজ্জ্বল ও বুদ্ধিদীপ্ত।
বুধ লিখন এবং প্রকাশনার কারক গ্রহ। বুধ ও শুক্রের যুক্তভাবে
অবস্থানের জন্য তার লেখার মধ্যে যুক্তি, বুদ্ধি ও কাব্যিক
ভাব সমান ভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ২য় বাকস্থান হওয়ায় তার বাঙ্মীতা
ছিল অসাধারণ। চন্দ্র লগ্ন থেকে ২য় পতি শুক্র রবির নক্ষত্রে
রয়েছে এবং ২য়ে বৃহস্পতির অবস্থান। তার কথার মধ্যে দৃঢ়তা,
আত্মপ্রত্যয়, দার্শনিকতা, বুদ্ধি ও সরসতা ( বুধ ) সমভাবে
বর্তমান ছিল। বুধ ও শুক্রের অবস্থান শনির ক্ষেত্রে এবং রাশিপতি
শনি (sign dispositor) চন্দ্রের ( জন সাধারণের কারক গ্রহ
) সঙ্গে ১০মে যুক্ত হওয়ায় তার বক্তৃতায় জনমোহিনী শক্তি ছিল
অসাধারণ। কিন্তু শুক্র ৬ষ্ঠ পতি ( শত্রু স্থান ) এবং চন্দ্র
৮ম পতি হওয়ায় তাকে প্রবল বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু
৪র্থ পতি ( ৪র্থ জনসাধারণকেও বোঝায় ) ও লগ্নপতি বৃহস্পতি
১১শে শুক্রের ক্ষেত্রে অবস্থিত হওয়ায় তিনি সম্মানের সঙ্গে
সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন।
শুক্র শিল্প, সঙ্গীত ও চারুকলার কারক গ্রহ। ছোটবেলায় খেলাধূলার
সঙ্গে তিনি নিয়মিত সঙ্গীত চর্চাও করেছেন। শুক্র লগ্নের ২য়ে
( কণ্ঠ ) বুধের সঙ্গে অবস্থিত হওয়ায় তার গানের গলা ছিল খুবই
সুন্দর। পরমহংস দেবের কাছে গেলে প্রায়শই তাকে গান গাইতে
অনুরোধ করা হত এবং তার ভক্তি মূলক গান শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ
হয়ে যেতেন।
(১০) স্বামীজের রাহুর
দশা শেষ হয়ে বৃহস্পতির দশা শুরু হয় ১৮৯২ সালের জুন মাসে।
শুরু হয় তার ধর্ম প্রচারাভিযান। ১৮৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে
বৃহস্পতি-বৃহস্পতি দশা-অন্তর্দশাতে Parliament of Religion-এ
তার সেই বিখ্যাত বক্তৃতা। বৃহস্পতি ধর্ম ও দর্শনের কারক
গ্রহ; চন্দ্রের ২য়ে ( বাক স্থান ) এবং লগ্নের ১১শে ( লাভ,
ইচ্ছাপূরণ ইত্যাদি ) অবস্থান। বৃহস্পতি ৫ম পতি মঙ্গলের নক্ষত্রে
রয়েছে এবং মঙ্গল দ্বারা দৃষ্ট। বৃহস্পতির অবস্থান শুক্রের
ক্ষেত্রে; শুক্র লগ্নের ২য়ে বুধের সঙ্গে এবং চন্দ্রের ৫মে
শনির ক্ষেত্রে বর্তমান। ধর্ম বিষয়ে তার বক্তৃতা ও প্রচারের
গ্রহণযোগ্যতা অবশ্যম্ভাবী। তবে শুক্রের ৬ষ্ঠ পতিত্ব দোষের
জন্য তার বক্তৃতায় এক দল লোক ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে তাকে নিন্দা
ও অবজ্ঞা করার চেষ্টা করে। ৬ষ্ঠে রাহুর দৃষ্টি থাকায় এবং
চন্দ্রের ৯মে কেতু অবস্থিত হওয়ায় তিনি সব বাধা কাটিয়ে উঠতে
পেরেছেন।
(১১) বৃহস্পতির দশাতে
তার জয়যাত্রা অক্ষুণ্ণ ছিল। তবে তিনি বেঁচেছিলেন মাত্র ৩৯
বছর। ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই বৃহস্পতি-শুক্রের দশা-অন্তর্দশায়
তার জীবনাবসান হয়। ইচ্ছামৃত্যুর কোন যোগ জ্যোতিষ শাস্ত্রে
আছে কি না জানা নেই। তবে ৮ম স্থান থেকে মৃত্যু বিচার করা
হয় এবং শনি হল আয়ুষ্কারক ( পক্ষান্তরে মৃত্যুর ) গ্রহ। এখানে
৮ম পতি চন্দ্র আবার ইচ্ছা ও মনের কারক গ্রহ। শনি চন্দ্রের
সঙ্গে চন্দ্রের নক্ষত্রে ১০মে (house of action) অবস্থিত।
আবার চন্দ্র লগ্ন থেকে ৮ম পতি মঙ্গল ৮মে থেকে ৪র্থ পতি (
মন ) বৃহস্পতিকে দৃষ্টি দিচ্ছে, বৃহস্পতির অবস্থান লগ্নের
১১শে। এর থেকে কি কিছু বোধগম্য হয় ?
যাই হোক, স্মামীজীর মৃত্যু হয় বৃহস্পতি-শুক্রের দশা-অন্তর্দশায়
। বৃহস্পতি চন্দ্র লগ্ন থেকে ৭মের ( মারক স্থান ) এবং শুক্র
২য়ের ( অপর একটি মারক স্থান ) অধিপতি। বৃহস্পতি চন্দ্রের
২য়ে এবং শুক্র লগ্নের ২য়ে অবস্থিত। মৃত্যু যোগ স্পষ্ট। তবে
একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। মৃত্যু যদি কোনো নির্দিষ্ট সময়ে
ঠিক হয়েই থাকে তবে ইচ্ছা মৃত্যুর প্রশ্ন আসে কি করে ? এ
ধরণের কার্য-কারণ সম্পর্কের গভীরতা ও ব্যাপ্তি এতটাই সুদূর
প্রসারী যে কোন খণ্ডিত নিয়ম বা অনুমানের উপর ভিত্তি করে
এটাকে গণ্ডিবদ্ধ করে বুদ্ধির সীমায় নিয়ে আসর চেষ্টা বাতুলতা
মাত্র। তবে "ইচ্ছা মৃত্যুর" অন্য ব্যাখ্যাও করা
যায়। স্বামীজী তার নিজের মৃত্যুর সময় আগেই অবগত ছিলেন। বিভিন্ন
সময়ে তিনি এর ইঙ্গিত দিয়েছেন। এ নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা বর্তমান
ধারাবাহিক রচনার ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নয়।
বিঃ দ্রঃ : কিছু জ্যোতিষী
মনে করেন স্বামীজীর যে মানসিক বৈশিষ্ট্য ও কর্মকাণ্ড সেটা
ধনু লগ্ন ধরে ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না; তাদের মতে স্বামীজীর
লগ্ন হবে মকর। কিন্তু জন্ম সময় যেটা ধরা হয়েছে, সেটা নির্ভুল
বলেই মনে হয় এবং তা হলে লগ্ন ধনুই হবে মকর নয়।