একজন অসাধারণ
মণিষীর কথার মতই কথা। কথার জালে লোককে মুগ্ধ করা
নয়, মানুষ গড়া ও তাদেরকে সর্বতোভাবে সমাজের উপকারের
জন্য তৈরী করাই ছিল তাঁর ব্রত। একজন পশ্চিমী অনুরাগী
একসময়ে তাঁর সম্বন্ধে উক্তি করেছিলেন যে-- স্বামী
বিবেকানন্দ বয়সে নবীন কিন্তু জ্ঞানে প্রাচীন এবং
শাশ্বত তাঁর জ্ঞান- 'young in age- but eternal
in wisdom'. স্বামী লোকেশ্বরানন্দ বলেছিলেন, যদি
আমরা এই স্বর্গীয় আনন্দময় উক্তিটির আক্ষরিক অর্থও
ধরি, তাহলেও স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শনের প্রাসঙ্গিকতা
আজও বর্তমান। তাঁর জীবন ছিল খুবই স্বল্প, ৪০ বত্সরেরও
কম তিনি বেঁচে ছিলেন। তিনি মহাসমাধিতে চলে গেলেন
বিংশ শতাব্দীর একেবারে গোড়াতে, ৪-ঠা জুলাই ১৯০২
সালে। তার পরে দুটো বিশ্বযুদ্ধ ঘটে গেছে, বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রভূত উন্নতি ঘটেছে। তার ফলস্বরূপ
সারা পৃথিবীতে আসে এক নতুন পরিবর্তন, মানুষের সামগ্রিক
চরিত্রেরও বদল হয়-- তাদের জীবনযাপনের ধারা, জীবনের
আদর্শের দৃষ্টিভঙ্গীর মধ্যেও আসে পরিবর্তন। বিবেকানন্দ
ভারতের ভবিষ্যতের কথা তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধি দিয়ে
বুঝেছিলেন। তিনি বলেছিলেন আগামী পঞ্চাশ বত্সরের
মধ্যেই ভারত এক অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা
লাভ করবে। সত্যিই তা হয়েছিল। এই সঙ্গে তিনি সতর্ক
করেও দিয়েছিলেন যে পৃথিবীর আর পাঁচটা দেশের মত ভারতও
অনেক সমস্যার সাম্মুখীন হবে তখন। তাঁর এই দূরদর্শিতার
শক্তি আমাদের অবাক করে বৈ কী।
তাঁর শিক্ষা, বাণীর প্রাসঙ্গিকতা শুধু ভারত কি সমস্যার
সম্মুখীন হবে তার ভবিষ্যদ্বাণীতেই সীমাবদ্ধ নয়,
তিনি কী ভাবে সেই সব সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে
তাও বলেছিলেন। তিনি জোর দিয়েছিলেন-- মানুষের আত্মবিশ্বারের
উপর। সঠিক আত্মবিশ্বাসী মানুষ সব বাধাই জয় করতে
পারে। এই বাণী কি আজও কাজ করছে না? মানুষ আত্মবিশ্বাসের
জোরেই সঠিক পথে পদচারণা করে জয়ের পথে অগ্রসর হয়,
তা তাঁর কালে যেমন সত্য ছিল, আজও তা সত্য -- কারণ
এটাই চিরন্তন সত্য।
'Man making is my mission', তিনি বলতেন। সত্যিই
একটি দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার জনসাধারণের উপর--
তারা কতটা ভালো করে গড়তে পারে নিজেদের, কতটা বুদ্ধি
ও কার্যক্ষমতার অধিকারী তারা, কতটা সচেতন তারা দেশের
ও দশের ব্যাপারে-- এ সবই বলে দেয় একটি দেশ কতটা
উন্নত। একটি দেশ দু-চারজন মণিষীর জন্ম দিতেই পারে,
কিন্তু তাতে দেশটির সমগ্র জনসাধারণ সম্পর্কে কোন
ধারণাই করা যায় না এবং তাতে দেশটির সামগ্রিক উন্নতি
বা কল্যাণও হয় না। স্বামীজি তাই বলতেন একটি দেশের
সাধারণ মানুষের মান উন্নত না হলে সে দেশকে মহৎ বা
সর্বোন্নত বলা চলে না। তিনি বলতেন একজন বুদ্ধদেব
বা একজন যীশুখ্রীষ্ট দেশের ভাগ্য বদলে দিতে পারে
না। ইতিহাস বলে সাধারণ মানুষই পৃথিবীর সর্বত্র দেশের
ভাগ্যনিয়ন্তা। এই সাধারণ মানুষকে অবজ্ঞা করা, তাদের
বঞ্চিত করা যা প্রাপ্য তা থেকে, তাদের অশিক্ষার
অন্ধকারে রাখা একটি জাতীয় মহাপাপ-- স্বামীজির মতে।
একটি দেশের যত দুঃখ, দুর্দশা সব এই কারণেই ঘটে।
তিনি বলতেন এই জনসাধারণ অসীম ক্ষমতার অধিকারী, কিন্তু
কখনই তাদের সুযোগ দেওয়া হয় নি (বা হচ্ছেনা এখনও)
এই ক্ষমতা ব্যবহার করে জাতীয় সমস্যা (national problem)
দূর করতে। ভারতবর্ষের ইতিহাস তার সাক্ষ্য।
সাধারণ মানুষকে শুধুই বোবা দর্শক করে রাখা হয়েছে,
দেশের যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গুটিকয় বিশ্ববিদ্যালয়ের
ডিগ্রীধারী বিদ্বজনেরা (intelligensia)-- যাদের
কোন যোগাযোগই ছিল না সাধারণ মানুষদের সাথে, তাদের
সমস্যার সাথে।বড়ই আক্ষেপ ছিল স্বামীজির। আজও কি
সেই আক্ষেপ নেই স্বাধীনতার পঁয়ষট্টি বৎসর পরেও।
জানিনা তিনি যদি থাকতেন কি বলতেন। আজও তো সেই চিত্রই
আমরা দেখি। নেতারা শুধু তাঁদের ক্ষমতার লড়াইয়ে ব্যস্ত--
জনতা কী ভাবে বাঁচছে তা তাঁদের দেখার দরকার নেই।
সমাজে তো এখনও সেই উচ্চ শ্রেণীর দাপটই চলে, কখনও
খোলামেলা, কখনও ঢেকেঢুকে। স্বামীজি তাঁর সময়ে এই
শ্রেণীর লোকেদের 'mummies' বলে অভিহিত করেছেন। আমজনতার
কোন বক্তব্যই থাকেনা জাতীয় নীতি নির্ধারণে, বা জাতির
উন্নতি সাধনে। তাই আজও, ভারত কিছু ব্যাপারে এগিয়ে
গেলেও-- অনেক অসাম্য রয়ে গেছে-- দারিদ্র, অশিক্ষা,
কুসংস্কার সর্বত্র যায়নি। স্বামীজির সময়ে এই অসাম্য
আরও বেশী ছিল-- তাই তাঁর দুশ্চিন্তাও ছিল। নতুন
ভারতের যে স্বপ্ন তিনি দেখতেন-- তাতে শ্রমিক শ্রেণী
(working class) সবার উপরে থাকবে এই ছিল তাঁর মত।
তাদের তিনি শুদ্র বলে অভিহিত করেছেন। তিনি নিজেকে
একজন সমাজবাদী বলে ব্যক্ত করতেন, এবং সঙ্গে এটাও
বলতেন যে সমাজবাদ একেবারে ত্রুটিহীন তা নয়, কিন্তু
আর্ধেক পাঁউরুটী পাওয়া ভালো কিছুই না পাওয়ার থেকে।
তাঁর ইতিহাসজ্ঞান তাঁর মধ্যে নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মিয়েছিল
যে বিপ্লব আসবেই পৃথিবীতে সর্বত্র সব জমানো আবর্জনা
সরাতে। তিনি দুটি দেশের নামও করেছিলেন-- রাশিয়া
ও চীন, যেখানে সবার আগে বিপ্লব এসে সব ধুইয়ে দেবে।
তা উত্তরকালে এসেছিল-- কী করে তাঁর মনে এই কথার
উদয় হয়েছিল তার উত্তর একমাত্র তিনিই দিতে পারতেন।
কিন্তু ভারতের জন্য তিনি বিপ্লব থেকেও বেশী জোর
দিয়েছিলেন ক্রমবিকাশের উপর। তিনি মনে মনে জানতেন
বিপ্লবের জন্য মানুষ বা একটি দেশকে কী মূল্য দিতে
হয়। তাই তিনি ভারতের অবস্থার উন্নতির জন্য কোন হিংসাত্মক
বিপ্লব চাইতেন না। তিনি চেয়েছিলেন ক্রমপরিবর্তনের
মাধ্যমে সাম্যাবস্থা আসুক সমাজে-- তিনি বলতেন--
'a process of levelling up' এবং 'no levelling
down'। তাঁর মত-- শ্রমিকশ্রেণী সব রকম সুযোগ সুবিধা
পাক ও নিজেদের উন্নত করে দেশের উঁচু শ্রেণীর বা
বিদ্বজনদের সমকক্ষ হয়ে উঠে জাতির চরিত্র গঠনকে শক্ত
করে তুলুক ও জাতিকে, দেশকে ক্রমঃ উন্নতির পথে নিয়ে
যাক। তাতে অবশ্যই বিদ্বজনদের নীচে নামতে হবে না।
এই উপেক্ষিত অবহেলিত শ্রেণীকে যত শীঘ্র সম্ভব শিক্ষার
আলো দিতে হবে তাদের অপূর্ণতা দূর করতে। স্বামীজি
বলতেন শিক্ষা তাদের দরজায় পৌঁছবে, তারা আসবে না
শিক্ষার দুয়ারে। তিনি একটি সার কথা বুঝেছিলেন যে
শিক্ষা শুধু বিনা পয়সায় পাওয়াটাই যথেষ্ট নয়, তার
সাথে আরও উত্সাহবর্দ্ধক উপকরণ থাকতে হবে; যেমন
একটি শ্রমিকের শিশুর একজন শিক্ষকের পরিবর্ত্তে পাঁচজন
শিক্ষক পাওয়া প্রয়োজন, ধনীর শিশুরা যেমন পায়। তিনি
মহীসুরের মহারাজাকে এরকমটাই বলেছিলেন, যখন মহারাজা
একটি অবৈতনিক স্কুল শুরু করার পরিকল্পনা করছিলেন
তাঁর রাজ্যে।
শিক্ষাই একমাত্র পারে সব রকম দুরবস্থা, অমঙ্গল ও
দুঃখকে দূর করতে। তাই তিনি শিক্ষার উপর এত জোর দিয়ে
বলেছিলেন-- শিক্ষা শুধু বই মুখস্থ-বিদ্যা নয়, পরীক্ষায়
কৃতকার্য হওয়া নয়, কতগুলি সার্টিফিকেট বা ডিগ্রী
পাওয়া নয়, শিক্ষা মানে সর্বোন্নতি, চরিত্রগঠন, সু-মানুষ
হওয়া। তার সাথে কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করা যাতে
কিছু উত্পাদন করে নিজের ও দশের ভালো করা যায়।
তিনি দুঃখ করতেন-- যে শিক্ষাব্যবস্থা তাঁর সময়ে
চালু ছিল তা নিয়ে। তিনি বলতেন এই শিক্ষা মানুষকে
স্বাবলম্বী হতে শেখায় না, তার মধ্যে আত্মসম্মানবোধ
জাগরিত করে না, মানুষকে দৃঢ়চিত্ত হতেও সাহায্য করে
না।
আজও কি সেই ব্যবস্থার পুরো বদল বা উন্নতি ঘটেছে?
বিবেকানন্দের দুঃখ কি দূর করতে পেরেছি আমরা?
তিনি চাইতেন ভারতের সনাতন আদর্শের সঙ্গে পশ্চিমের
কার্যদক্ষতা যোগ হোক। বড় বড় চিন্তানায়ক ও তাঁদের
বক্তব্য ভারত অনেক পেয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তা কতটা
কার্যকরী হয়েছে? ভারতবর্ষের সব নেতিবাচক দিকগুলি
জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগের অভাবেই ঘটেছে বলে তাঁর
ধারণা ছিল। জাতপাতের (caste system) নিয়ম এরকম জ্ঞানের
অভাবেই তৈরী হয়ে ভারতকে অনেক পিছনে ঠেলে দিয়েছে।
তাঁর মতে শ্রম অনুযায়ী সমাজে বিভাজনটাই সঠিক ও সঙ্গত।
তাতে প্রত্যেকেই নিজের ক্ষমতা, বুদ্ধি অনুযায়ী নিজেকে
গড়তে পারে। সেই সময়ে একমাত্র তিনিই জাতপাতের নিয়মকে
তীব্রভাবে নিন্দা করেছেন।
তিনি আশা করতেন সমাজের উঁচুতলার লোকেরাই পরিবর্ত্তন
আনবে সমাজের অবহেলিত শ্রেণীর উন্নতি সাধনের জন্য।
এটাকেই তিনি ভারতের জাতীয় আদর্শ হওয়া উচিত বলে মনে
করতেন। উঁচু শ্রেণী তাদের আত্মসুখ, ভোগ ত্যাগ করে
কাজ করবেন, শিক্ষার আলো জ্বালবেন ঘরে ঘরে, দুঃখীর
পাশে দাঁড়াবেন, নিরন্নকে অন্ন দেবেন-- এই ছিল তাঁর
আশা-- এই আশা বুকে নিয়েই তিনি গড়ে তুলেছিলেন রামকৃষ্ণ
মঠ ও মিশন। এই মঠ ও মিশন আজও বিবেকানন্দ নির্দেশিত
পথে সেবার কাজ করে চলেছে অক্লান্তভাবে পৃথিবীর সর্বত্র।
কিন্তু মঠের বাইরে আমরা যারা রয়েছি-- আমরা কি করছি
সেবার কাজ, শিক্ষার আলো দেবার কাজ, লোকের পাশে তাদের
অসময়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার কাজ? আমরা না
পারলে আমাদেরই দুর্দিন-- বিবেকানন্দ সাবধান বাণী
উচ্চারণ করেছেন বারবার। ইতিহাসই সাক্ষ্য এই সাবধান
বাণী কতটা ঠিক ছিল। ভারত বারবার ভিতর ও বাইরে থেকে
আক্রমণের মুখোমুখী হয়েছে কিন্তু কখনই হার স্বীকার
করেনি। ভারত তার নমনীয়তা দিয়ে ভালকে গ্রহণ করে,
খারাপকে বর্জন করে নিজ অস্তিত্ব বজায় রেখেছে, স্বতন্ত্রতাকে
না হারিয়ে। এই ভাবেই ভারত বহু শতাব্দীর পর শতাব্দী
একনিষ্ঠ থেকেছে নিজের আদর্শের প্রতি, ভারত ও তার
জনগণ নতুন চিন্তাকে গ্রহণ করে নিজের স্বত্তার অংশ
করে নিয়েছে, নতুন পরিবেশ, নতুন জ্ঞানকে সাগ্রহে
বরণ করেছে এবং কোন ভয়ানক ক্ষয়ক্ষতি বা সর্বনাশ ঘটতে
দেয়নি।
স্বামীজি তাঁর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তা থেকে ভবিষ্যৎ
ভারতের চিত্রটি দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন,
শ্রমিক শ্রেণীর উন্নতি শুধু হলেই হবেনা, সংগে তাদের
জানতে হবে ভারতীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতির ইতিহাস, তা
না হলে সাংস্কৃতিক দিকটির অবক্ষয় ঘটবে। তিনি তাই
চেয়েছিলেন ভারতের সাধারণ জনগণ শিক্ষার আলোয় সর্ব
চেতনাসম্পন্ন হবার সাথে সাথে ভারতের আধ্যাত্মিক
সাধনার ধারাটিকেও জানুক। তাই ডাক দিয়েছিলেন তিনি,
'Deluge the country with spiritual ideas'। সত্য,
ন্যায়নিষ্ঠতা, ভালোবাসা, শান্তি ও ঐক্য ভারতীয় সনাতন
আদর্শের পরিচায়ক এবং এই গুণগুলিই ভারতকে হিংসাত্মক
আন্দোলনের পথে এগোতে দেয় নি। ভবিষ্যতের ভারত এই
গুণগুলিকে অবলম্বন করে উন্নতির পথে এগোবে, এই ছিল
তাঁর মনোনীত পথ। ভারতের শক্তি এই গুণগুলিতেই নিহিত
আছে। তিনি মনে করতেন যতদিন ভারত এই গুণগুলিকে ধরে
রাখতে পারবে, ততদিন ভারত নিরাপদ, শুধু নিজের জন্য
নয়, সমগ্র পৃথিবীর জন্য। পৃথিবীর আর কোন দেশ এতগুলি
গুণের অধিকারী নয়। যুগের পর যুগ ধরে ভারত এই আদর্শকে
লালন করেছে ও যত্নে আগলে রেখেছে।
তখনকার সময়ে ভারতবর্ষের দারিদ্র তাঁকে দুঃখ দিত।
পরিব্রাজক হিসেবে তিনি যখন ভারতের প্রতিটি প্রদেশে,
গ্রামে গেছেন, তিনি জনগণের দুঃখ, দুর্দশা দেখে বড়ই
কাতর হয়ে পড়তেন। কী ভাবে এই সমস্যার সমাধান-- এই
ছিল তাঁর চিন্তা। তিনি পথ খুঁজে পেয়েছিলেন-- বিজ্ঞান
ও প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নতি ও ব্যবহারই একমাত্র পথ
গরিবী সমস্যা দূরীকরণে। পশ্চিম থেকে বিজ্ঞান ও কারিগরী
শিক্ষা নিতে হবে এবং তা প্রয়োগ করে মানুষকে এই অর্থাভাব
দূর করে নিজের ও সমাজের উন্নতি করতে হবে। শিল্প
বিপ্লবই আনতে পারে সমাধান-- এই ছিল তাঁর অটুট বিশ্বাস।
কতটা শিল্প বিপ্লব ঘটেছে সারা ভারতে বা তাঁর বাংলায়?
আমরা কতটুকু এগিয়েছি, দরিদ্রের মুখে অন্ন দিতে,
তাদেরকে বাসস্থান দিতে, শিক্ষার আলো দিতে, জানিনা!
'দারিদ্র দূর করতে পশ্চিমকে অনুসরণ কর, কিন্তু তার
আর কিছু নকল কোরো না'-- বিবেকানন্দর এই সাবধান বাণী
আজ কতটা সফল?
নারীদের প্রতি
তাঁর ছিল অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা। তিনি প্রশ্ন করতেন, 'শক্তির
পূজারী কে?'-- জানো কি তোমরা? সর্বত্র বিরাজমান ঈশ্বরের
শক্তি স্ফুরিত হয় স্ত্রীশক্তির মাধ্যমে-- এই সত্য
যে জানে সেই শক্তির পূজারী। মনু বলেছেন, ভগবান আশীর্বাদ
করেন সেই পরিবারকে যেখানে স্ত্রীলোক সম্মানে ও সুখে
থাকেন। এই স্ত্রীশক্তিকে অমর্যাদা করাকেই তিনি ভারতের
অধোগতির কারণ হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন। শক্তিকে ছাড়া
কোন নতুন কিছুর জন্ম হয় না। তাই নারীদের সম্মান করা,
তাদের শিক্ষিত করে তোলা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য--
এই হওয়া উচিত। বেদীতে বসিয়ে মৃণ্ময়ী মুর্ত্তিকে পূজো
নয়, তাঁদেরকেও দাও সব শিক্ষা অর্জনের অধিকার, ন্যায়
বিধানের অধিকার, পুরুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পথ
চলার অধিকার-- তবেই সমাজ ও দেশ হবে উন্নত। তাদের নিয়মের
শৃঙ্খলে বেঁধে ঘরে দোর দিয়ে রাখলে সনাতন ভারতের আদর্শকে
ব্যঙ্গই করা হবে। গার্গী, মৈত্রেয়ীর দেশ এই ভারত।
এখানে পুরুষ ও নারীর ভেদাভেদ কেন থাকবে? বিবেকানন্দ
বলতেন,
'When
I look about me and see what you call gallantry,
my soul, is filled with disgust. Not until you learn
to ignore the question of sex and to meet on a ground
of common humanity will your women really develop.
Until then they are playthings, nothing more.
We should not think that we are men and women, but
only that we are human beings, born to cherish and
to help one another.'
(সমাজে নারীদের
ব্যাপারে চিত্র কি পাল্টেছে? না! তাহলে আজও পণপ্রথা
ও তত্জনিত কারণে হত্যা বা আত্মহত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি
ঘটনা ঘটত না।)
বিবেকানন্দ ভারতের পুরুষকে তার পুরুষতান্ত্রিকতা থেকে
বেরিয়ে আসতে বলেছেন--
'Men!
Hands off. Educate your women first and leave them
to themselves, then they will tell you what reforms
are necessary for them. Women must be put in a position
to solve their own problems in their own way. No
one can or ought to do this for them. And our Indian
women are as capable of doing it as any in the world.
I am asked again and again, what I think of the
widow problem and what I think of the woman question.
Let me answer once for all-- am I a widow that you
ask me the nonsense? Am I a woman that you ask me
that question again and again? Who are you to solve
the women's problems? Are you the Lord God that
you should rule over every widow and every woman?
Hands off! They will solve their own problem.'
ভারতের নারীদের
উদ্দেশ্যেও তিনি একই কথা বলেছেন, যা পুরুষদের উদ্দেশ্যে
বলেছেন। ভারতীয় সংস্কৃতির, ভারতের সনাতন ধর্মের প্রতিবিশ্বাস
রাখতে বলেছেন তিনি পুরুষ ও নারী উভয়কেই। 'শরীরের ও
মনের শক্তিকে জাগাও, আশাবাদী হও, লজ্জা ত্যাগ করে
সব কর্ম করতে প্রস্তুত হও। জেনো ভারতবাসী নেবার থেকে
দিয়েছে বেশী, পৃথিবীর আর যে কোন দেশের অধিবাসীদের
তুলনায়।
ভারত একজন
পুরুষকে চায় না, চায় একজন শক্তিময়ী নারীকে যিনি
হবেন প্রকৃতিতে এক সিংহিনীর মতই-- ভারতীয়দের জন্য
যিনি সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করবেন-- আত্মার কোন পুরুষ-
নারী ভেদাভেদ নেই। ভারতের সর্বাঙ্গীন প্রগতির জন্য
চাই হাজার হাজার পুরুষ ও হাজার হাজার নারী, যারা
উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারী পর্যন্ত,
নর্থ পোল থেকে সাউথ পোল-- সারা পৃথিবীময় আগুনের
মত ছড়িয়ে পড়বে স্বার্থহীন ভাবে সেবামূলক কাজ, দেশ
গঠন, চরিত্র গঠনের কাজে। অলসতার কোন স্থান নেই,
সময় নষ্ট করারও সময় নেই। পৃথিবী চায় sPFð কর্মনিষ্ঠ
চরিত্রবান লোকেদের যারা জ্ঞানের আলো দিয়ে কুসংস্কার,
ধর্মান্ধতা, অশিক্ষা ও দারিদ্রকে দূর করবে। সাহসী
কাজ, সাহসী কথা, সাহসী মানুষের প্রয়োজন। জাগো সবাই,
পৃথিবীর মানুষ দুঃখের আগুনে জ্বলছে। এখনও কি তোমরা
ঘুমিয়ে থাকবে?'
এই রকম বোধসম্পন্ন ডাক একমাত্র তিনিই দিয়েছেন ভারতবাসীকে,
পৃথিবীবাসীকে।
ধর্ম বা religion
সম্বন্ধে তিনি বলেছেন-- ধর্ম হচ্ছে সেই ধারণা যা পশুসুলভ
মনোভাবকে মানবিক বোধে উন্নীত করে, প্রকৃত মানুষ তৈরী
করে, এবং মানুষকেই ভগবানরূপে প্রতিভাত করে। 'Religion
is the idea which is raising the brute unto man
and man unto God.'
প্রতিটি আত্মাই স্বর্গীয়, কিন্তু তা সুপ্ত হয়ে আছে,
উদ্দেশ্য হচ্ছে সেই পবিত্র স্বর্গীয় ভাবকে প্রকাশ
করা-- ভিতরে ও বাইরে নিজ প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করে--
তা কাজের মাধ্যমেই হোক বা পূজোর ভক্তির মাধ্যমে, বা
মানসিক বলের সাহায্যে, বা দর্শন জ্ঞানের মাধ্যমে হোক--
একটি পথ বা একটির বেশী পথ অবলম্বন করে মুক্ত হওয়া
মূল উদ্দেশ্য। এটাই হচ্ছে যে কোন ধর্মের সার কথা।
ধর্মের সংস্কার, রীতি নীতি, ধর্মগ্রন্থ, এ সবই গৌণ।
"Religion
is the manifestation of the Divinity already in
man. Try to be pure and unselfish-- that is the
whole of religion. The secret of religion lies not
in theories but in practice. To be good and to do
good-- that is the whole of religion."
এই ছিল তাঁর
বাণী।
স্বামী বিবেকানন্দ ও তাঁর গুরু শ্রী রামকৃষ্ণ অনেক
ব্যাপারেই আলাদা ছিলেন এবং তাঁদের আচার ও আচরণও অবিশ্বাস্য।
সব ধরা আছে বিখ্যত লেখক শংকরের গ্রন্থে ও বহু আগে
শ্রীম লিখিত 'শ্রী কথামৃত'- তে।
এই দুই মহাপুরুষের মিলনই গড়ে তুলেছিল এক অবিশ্বাস্য
আন্দোলন। যুগাবতার শ্রী রামকৃষ্ণ দিব্যচোখে খুঁজে
পেলেন নরেন্দ্রের মধ্যে তাঁর মন্ত্রশিষ্যকে যে ঘরে
ঘরে, দেশে দেশে "যত মত তত পথ" বাণী, ভালোবাসার
বাণী, সেবাব্রতের কথা প্রচার করবে। বেদান্তের কথা
ও আদর্শকে পাশ্চাত্ত সমাজে তুলে ধরে, ভারতীয় সংস্কৃতি
ও ধর্ম সম্পর্কে ধারণাকে তার হৃত গৌরব ফিরিয়ে দেবে।
আর্যদের বংশধররা
সদাচারভ্রষ্ট হয়ে, ক্ষুরধার বুদ্ধি হারিয়ে, লোকাচার
ভক্ত হয়ে ওঠে এবং সনাতন ধর্মকে বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত
করে-- সাম্প্রদায়িক ঈর্ষা ও ক্রোধের আগুনে পরস্পরকে
ঠেলে দিতে আরম্ভ করে এবং আর্যভূমি ভারতবর্ষকে প্রায়
নরকে পরিণত করে-- সেই যুগসন্ধিক্ষণে শ্রী রামকৃষ্ণ
অবতীর্ণ হন এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অন্তর্নিহিত ঐক্যের
সন্ধান দেন ভারতবাসীকে। আচারবন্দী সনাতন ধর্মের অধঃপতনকে
রোধ করেন এবং লোকহিতের জন্য নিজেকে প্রকাশ করেন, সর্বভাবের
সমন্বয় বাণী প্রচার করেন। একাধারে তাঁর ছিল শংকরাচার্যের
উজ্জ্বল মেধা ও শ্রীচৈতন্যের মহৎ হৃদয়ের মহৎ ভাব।
যিনি বললেন-- প্রত্যেক প্রাণীতে ঈশ্বর আছেন। তাঁর
হৃদয় ভারতের ও ভারতের বাইরের প্রতিটি দরিদ্র দুর্বল
পতিতের জন্য কেঁদেছে। তাঁর বিশাল মেধা ভারত ও তার
বাইরেও বিরোধী সম্প্রদায়গুলির মধ্যে এক বিষ্ময়কর সমন্বয়
সাধনের মাধ্যমে এক সার্বভৌম ধর্ম স্থাপন করতে সাহায্য
করে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন-- "এই রকম একজন
মানুষ সত্যিই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং আমি কয়েক বছর
তাঁর চরণতলে বসে শিক্ষা পাবার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম।
"আমি যা শিক্ষা দিই, তা আমার গুরুর শিক্ষা অনুযায়ী।
তাঁর উপদেশের অনুগামী হয়ে আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রসমূহ
আমি নিজে যে রকম বুঝেছি, তাই ব্যাখ্যা করে থাকি।
"সকল ধর্মেরই লক্ষ্য-- কোন বিশেষ মানবজীবনকে
আদর্শস্বরূপ ধরে স্থূলভাবে ভক্তি, জ্ঞান বা যোগ শিক্ষা
দেওয়া। ওই সব আদর্শগুলিকে অবলম্বন করে ভক্তি, জ্ঞান
ও যোগ বিষয়ক যে সাধারণ ভাব ও সাধনপ্রণালী রয়েছে, বেদান্ত
তারই বিজ্ঞানস্বরূপ।
"১৮৯৩ খ্রীষ্টাব্দে চিকাগোতে যে ধর্ম মহাসভা
হয়েছিল, আমি তাতে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি ছিলাম। সেই
অবধি আমি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রমণ করে বক্তৃতা
দিচ্ছি। মার্কিন জাতি পরম আগ্রহ সহকারে আমার বক্তৃতা
শুনছে এবং আমার সঙ্গে বন্ধুবৎ আচরণ করে যাচ্ছে।
"আমি এমন একটি দর্শন প্রচার করে থাকি, যা জগতে
যত রকম ধর্ম থাকা সম্ভব, সে সমুদয়েরই ভিত্তিস্বরূপ
হতে পারে, আর আমার সব ধর্মের উপরই সম্পূর্ণ সহানুভূতি
আছে, আমার উপদেশ কোন ধর্মেরই বিরোধী নয়। ব্যক্তিগত
জীবনের উন্নতিসাধনেই আমি বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখি, ব্যক্তিকেই
তেজস্বী করবার চেষ্টা করি। প্রত্যেক ব্যক্তিই ঈশ্বরাংশ
বা ব্রহ্ম-- এ কথাই শিক্ষা দিই, আর সর্বসাধারণকে তাদের
অন্তর্নিহিত এই ব্রহ্মভাব সম্বন্ধে সচেতন হতেই আহ্বান
করে থাকি। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে এটাই প্রকৃত পক্ষে
সকল ধর্মের আদর্শ।"
পথপ্রদর্শক দেব মানব গুরু শ্রী রামকৃষ্ণের শিষ্যের
মতই উপযুক্ত কথা।
"হিসেবের অভাবে আমি যেন জোচ্চর না বনি"--
উদ্বিগ্ন স্বামী বিবেকানন্দ একবার এ কথা প্রিয়জনদের
বলেছিলেন। রমকৃষ্ণ সঙ্ঘ গড়া ও তার কাজ পরিচালনার জন্য
অর্থ প্রয়োজন। সেই অর্থ যোগাড়ের জন্য স্বামীজির বিদেশগমন
এবং বেশীর ভাগ অর্থসাহায্য তিনি পেয়েছিলেন আমেরিকাবাসী
তাঁর শিষ্য বা অনুরাগীদের কাছ থেকেই।
তাঁর গুরু বলতেন, 'টাকা মাটি মাটি টাকা'-- এ কথা যেমন
সত্য, আবার তিনি যখন বলতেন টাকা হচ্ছে গৃহস্থের রক্ত,
টাকার সম্মান না থাকলে গৃহস্থ বিপন্ন তাও সত্য| আরও
কঠিন কথাও তাঁকে বলতে হয়েছে, শিক্ষা দেবার প্রয়োজনে।
"অর্থ যার দাস, সেই মানুষ। যারা অর্থের ব্যবহার
জানে না, তারা মানুষ হয়েও মানুষ নয়"। আরও বলেছেন:
"আকৃতি মানুষের কিন্তু পশুর ব্যবহার"।
এই যে অর্থ সম্পর্কে গুরুর নীতি তা থেকে শিক্ষা নিয়ে
এবং দেশ বিদেশ থেকে নানা অর্থিক ধাক্কা খেয়ে স্বামীজি
তাঁর প্রতিষ্ঠিত সঙ্ঘের জন্য যে ইকনমিকস্ সৃষ্টি করলেন
তাকে ইদানীং গবেষকরা বিবেকানন্দনমিকস্ বলছেন।
গুরু শিষ্যের অর্থ সম্পর্কিত চিন্তার বিবর্তনটা বেশ
কৌতুহল জাগায়। প্রথম ধারণা অর্থ মানেই অনর্থ। দ্বিতীয়
চিন্তা, অর্থ গৃহস্থের রক্ত এবং এই অর্থ দিয়েই তাঁরা
সন্ন্যাসীকে সাহায্য করেন, এই সাহায্য ছাড়া সন্ন্যাসীর
জীবনধারণ হয় না। তবে অর্থের সঙ্গে সন্ন্যাসীর অত্যধিক
সম্পর্ক অভিপ্রেত নয়।
পয়সায় গুরুর বিন্দুমাত্র টান ছিল না, কিন্তু অপচয়ে
ছিল প্রবল আপত্তি। দরদাম যাচাই না করে এবং অপরে পয়সা
দিচ্ছে বলে অযথা বেশী দামী জিনিষ কেনা অবশ্যই নয়।
শিষ্য স্বামীজির তাই ধারণা, অন্যের টাকা হলে অবশ্যই
তা খুব ভেবচিন্তে সৎপথে খরচ হবে, তবে হিসেব দাখিল
কেন করতে হবে? হিসেবের ব্যাপারটা প্রথমদিকে তিনি মানতে
চাইতেন না। ভক্তরা চাঁদা তুলে অসুস্থ রামকৃষ্ণের খরচাপাতি
চালাচ্ছেন, অন্যেরা পয়সা না দিলেও দিনরাত সেবা করছেন,
তাঁদের জন্য খরচ হচ্ছে, সাহায্যকারী ভক্তরা খরচের
লাগাম টানার জন্য হিসেব চাইছেন, তা শুনে নরেন্দ্রনাথ
রেগেমেগে খাতা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন, তিনি কারও কাছে জবাবদিহি
করবেন না। যে তাঁকে বিশ্বাস করে না, তার টাকা নেবার
প্রয়োজন নেই।
পরবর্তী পর্বে স্বামীজির মতের বিশাল পরিবর্তন হয়।
হিসেবকে তিনি প্রায় পূজার বেদীতে বসাতে চেয়েছিলেন,
তাই তাঁর সঙ্ঘের হিসেব-নীতিতে কঠিন নিয়মের শাসন, সেখানে
ভুলের ক্ষমা নেই। দানের টাকার অনেক অদৃশ্য বন্ধন থাকে,
তার একটি হল হিসেব। সেটা অভিজ্ঞ স্বামীজি যথাসময়ে
ভালোভাবেই বুঝেছিলেন।
বিদেশের আর্থিক সংস্থায় নানা ডিসিপ্লিন দেখে স্বামীজি
অপরের দেওয়া অর্থ সম্বন্ধে একটা কঠিন নিয়মানুবর্তিতার
প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন এবং সঙ্ঘের শুরু থেকে আর্থিক
সংযমকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। অন্যকে উপদেশ দিয়ে নিজে
খুশীমত খরচ করাটা স্বামীজির স্বভাবে ছিল না। একবার
মঠ থেকে ধার করেছিলেন এবং তা সুদ সহ পরিশোধ করেছিলেন।
স্বামীজির মতে অর্থে নিরাসক্তি, কিন্তু সঙ্ঘের অর্থে
অতিমাত্রায় সাবধানতা দুটি পরস্পর বিরোধী মানসিকতা
নয়। হিসেবের নাগপাশ ছাড়া এ যুগের সন্ন্যাসী মানবসেবী
হয়ে উঠতে পারে না, এটাই শিক্ষা।
১৬-ই আগাষ্ট
১৮৮৬ সালে, মধ্যরাতে কাশীপুর উদ্যানবাটিতে যখন গুরু
রামকৃষ্ণের জীবনলীলা শেষ হল-- তখন তাঁর প্রধান শিষ্যের
বয়স মাত্র তেইশ। প্রবল প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে সেই
তরুন শিষ্য এক নবীন সন্ন্যাসীকূলের সৃষ্টি করলেন,
তারপর ভাগ্যসন্ধানে বিশ্বপরিক্রমা এবং অবশেষে কয়েক
হাজার বছরের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার আলোকে তুলনাহীন এক
সন্ন্যাসীসঙ্ঘের সৃষ্টি যার নাম রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন।
রামকৃষ্ণ আন্দোলনের আর একটি বৈশিষ্ট্য সন্ন্যাসী ও
গৃহী উভয়েরই সগৌরব উপস্থিতি। মূল মঠ ও মিশনে ত্যাগী
সন্ন্যাসীদের ওপর নির্ভরতা, কিন্তু গৃহীদের সমর্থন
ছাড়া যে এই ধরণের প্রতিষ্ঠান নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে পারে,
সে ধারণাও মূল্য পেয়েছে।
তবে সন্ন্যাসী হয়ে জীবসেবার কাজে যে দুর্গম পথ অতিক্রম
করতে হয়েছে স্বামীজিকে, যত নিন্দা সমালোচনার সম্মুখীন
হতে হয়েছে তত্কালীন দেশী ও কিছু বিদেশী সমাজের কাছে,
অনাহার, দুশ্চিন্তা, অসুস্থতা যত রকম ব্যাধির সঙ্গে
তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে-- তা সবই তিনি করেছেন একটিমাত্র
মন্ত্র জপ করতে করতে--