প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বেদ- উপনিষদ ও সনাতন হিন্দুধর্ম - (১) (অন্যান্য অনুচ্ছেদ)

হিন্দু ধর্ম সনাতন। এই ধর্ম কোন্ আদিযুগ থেকে এখনও পর্যন্ত এক শ্রেষ্ঠ ধর্মের আদর্শ হিসেবে পরিগণিত (গৃহীত) হয় তা বলা খুবই কঠিন। হয়ত সৃষ্টির শুরু থেকেই এই ধর্মেরও জন্ম ও বৃদ্ধি। ভেদাভেদহীন সাম্য, সত্য, সুন্দর ও শান্তির চারটি দৃঢ় ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে এই সনাতন হিন্দু ধর্ম। হিন্দুধর্মের মূল কথাগুলি আছে যে বইগুলিতে তাকে আমরা বলছি হিন্দুশাস্ত্র। এই হিন্দুশাস্ত্র অগাধ সমুদ্র- যত তার ব্যাখ্যার ব্যাপ্তি তত তার গভীরতা। এই হিন্দুশাস্ত্র পড়ে শেষ করার মত সময় খুব কম লোকের পক্ষেই সম্ভব হয়। কিন্তু যদি আমরা একে অন্যকে এই বিষয়ে কিছু বলার মত জ্ঞান যোগাড় করতে পারি তাহলে হয়তো কিছুটা হলেও এই সমুদ্রে নামা যাবে। সেই চেষ্টারই শুরু: হিন্দুশাস্ত্রের শিরোভাগে আছে বেদ এবং বেদই সর্বপ্রাচীন ও সব শাস্ত্র এই বেদ থেকেই জন্ম নিয়েছে বলে কথিত ও প্রসিদ্ধ। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপধ্যায় তাঁর দেবতত্ব ও হিন্দুধর্ম প্রবন্ধে বলেছেন বেদের অতিরিক্ত ও কিছু যা অন্য শাস্ত্রে আছে - বেদ বলে প্রচার পেয়েছে। যা বেদে নাই বা বেদবিরুদ্ধ তাও অনেক সময় বেদের অন্তর্ভূক্ত বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে বেদ যে হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির মূল উত্স এ কথা হিন্দুমাত্রেই জানেন ও স্বীকার করেন। কিন্তু অনেকে বেদের একটি সীমাবদ্ধ বা সঙ্কীর্ণ অর্থ করেন। প্রকৃতপক্ষে বেদ একটি গ্রন্থবিশেষের নাম নয়। বেদ বলতে বোঝায় সম্পূর্ণ একটি সাহিত্য। পণ্ডিতেরাও, যাঁরাই হিন্দুশাস্ত্রের সম্যক জ্ঞান লাভ করেছেন তাঁরা জেনেছেন বেদের সমগ্রতা।

বেদ চারটি সকলেই জানেন - ঋক, যজুঃ, সাম ও অথর্ব। তবে অনেক পুরনো বইতে বেদ তিনটি, যথা: ঋক, যজুঃ ও সাম - বলা হয়েছে। অথর্ব বেদের উল্লেখ নেই ঐ সব বইতে। অথর্ব বেদ ছিল কি ছিল না বা কবে যোগ হয়েছে বেদ হিসেবে তার আলোচনার খুব একটা প্রয়োজন পণ্ডিতেরা অনুভব করেন নি।
কথিত আছে যে, মহর্ষি কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস বেদকে চার ভাগে ভাগ করেন। এতে বোঝা যায় আগে চার বেদ ছিল না, একটিই ছিল। বস্তুত ঋকবেদের অনেক শ্লোক যজুর্বেদে ও সামবেদে পাওয়া যায়। অতেএব একই বেদকে তিনি চারটি ভাগ করেছেন বিশেষ কোন কারণে- এটাই যুক্তিগ্রাহ্য। তবে ঋক, যজুঃ ও সাম বলতে এক একটি মাত্র গ্রন্থ বোঝায় না। কারণ এক একখানি বেদ নিয়ে আলোচনা করলে বোঝা যাবে একটি বেদের ভিতর আছে অনেকগুলি বিভাগ বা সম্পূর্ণ গ্রন্থ। তাই বেদকে আমরা সম্পূর্ণ সাহিত্য বলে অভিহিত করতে পারি। এই সাহিত্যকে মোটামুটি তিনটি বিভাগে ভাগ করা যায় - মন্ত্র বা সংহিতা, ব্রাহ্মণ ও উপনিষত্।

(১) মন্ত্রগুলির সংগ্রহকে সংহিতা বলে, যেমন ঋকবেদ সংহিতা, যজুর্বেদ সংহিতা ইত্যাদি। সব বেদেরই একটি সংহিতা, কিন্তু ব্রাহ্মণ ও উপনিষত্ অনেক।

(২) যজ্ঞের জন্য প্রয়োজনীয় মন্ত্রগুলির ব্যাখ্যা সহ গদ্যগ্রন্থের নাম ব্রাহ্মণ। তাই সংহিতা ও ব্রাহ্মণে আমরা পাই যাগ যজ্ঞ প্রভৃতির অনুষ্ঠান ও তার প্রণালীর বিবরণ- কেন করব এই যজ্ঞ- সেই উদ্দেশ্যের ব্যাখ্যা, ফলস্বরূপ কী লাভ হবে তার সূষ্ঠ বিবরণ ও দার্শনিক ব্যাখ্যা, বিভিন্ন পণ্ডিতদের দ্বারা।

৩) কিন্তু উপনিষদে এ সব কিছুই নেই। যে উচ্চ অধ্যাত্মজ্ঞান হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য- তাই আলোচিত উপনিষদে। ব্রহ্ম সম্বন্ধীয় যাবতীয় জ্ঞানের আকর এই উপনিষদ। এই উপনিষদই ১০৮-খানি।

তবে উপনিষদের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন মহল বিভিন্ন মত পোষণ করেন। শ্রী শঙ্করাচার্য তাঁর বিভিন্ন ভাষ্যে ১৪-টি উপনিষদের কথা বলেছেন। সম্রাট সাজহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা শিকোহ্ ফারসীতে যে উপনিষদগুলির অনুবাদ করান, তাদের সংখ্যা পঞ্চাশ। আর মুক্তিক উপনিষদ থেকে ১১২-টি উপনিষদের সন্ধান পাওয়া যায়। শ্রী বাসুদেব লক্ষ্মণ শাস্ত্রী মুম্বাইয়ের 'নির্ণয় সাগর প্রেস' থেকে ১১২-টি উপনিষদের সঙ্কলন প্রকাশ করেছেন ১৯৮০ সাল নাগাদ। যত দিন যাচ্ছে, উপনিষদের সংখ্যা ততই বাড়ছে। মোগল আমলেও অনেকগুলি উপনিষদ রচিত হয়েছে। হয়ত ইতিমধ্যে উপনিষদের সংখ্যা ২০০ ছড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই উপনিষদগুলি বস্তুত: বৈদিক যুগের উপনিষদ নয় বলেই বিবেচিত হয়। যে উপনিষদগুলি চারটি বেদের কোন না কোন অংশের সঙ্গে যুক্ত, তাদের সংখ্যা ১২। এগুলি প্রাচীন ও বৈদিক উপনিষদ। যেমন: ঈষ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, তৈত্তিরীয়, ঐতরেয়, শ্বেতাশ্বতর, ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক এবং কৌষীতিকি উপনিষদ। কৌষীতিকি ছাড়া বাকী এগারোটি উপনিষদের ভাষ্য শ্রী শঙ্করাচার্য করে গেছেন।

উপনিষদগুলি নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোকপাত পরে করব। তবে এটুকু বলে রাখা শ্রেয় যে উপনিষদের রচনাকাল ও প্রাচীনত্ব সম্বন্ধে নিশ্চিত কিছু বলা যায় না। অনেক পণ্ডিতই এই বারোটি উপনিষদকেই প্রাচীন প্রামাণিক ধর্মগ্রন্থ বলে গ্রহণ করেছেন। পণ্ডিত রাণাডে 'মত্রী' উপনিষদকেও প্রাচীন বলে মনে করেন। প্রাচীনতম উপনিষদের তারিখ ডা: সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের মতে ১০০০ খ্রীষ্টপূর্ব, কিন্তু অন্যান্য অনেকের মতে ৭০০ খ্রী: পূ: । তাই এ বিষয়ে কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয় বলেই পণ্ডিতেরা মনে করেন।

ফিরে আসি মূল বেদ প্রসঙ্গে। বেদ কে রচনা করেন- এ বিষয়ে হিন্দুদের মধ্যে অনেক মতভেদ আছে।
(১) এক মত বলে বেদ মানুষ রচনা করে নি। বেদ অপৌরুষেয় এবং চিরকালই আছে। কতগুলি কথা বা দর্শন নিজ থেকেই চিরকালই আছে। সৃষ্টির আগে, মানুষ জন্মাবার আগে, মানুষের ভাষায় কতগুলি গদ্য, পদ্য আপনা থেকেই চিরকাল আছে- এ যুক্তি বুদ্ধি, বিবেচনাগ্রাহ্য নয় বলেই অনুমান করা হয়।
(২) আর একটা মত, বেদ ঈশ্বরসৃষ্ট। তবে ঈশ্বর নিজেই অগ্নিস্তব, ইন্দ্রস্তব ও নদীস্তব, অশ্বমেধ যজ্ঞ ইত্যাদি রচনা করেছেন এটাও ঠিক গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ সহজেই অনুমেয় - যিনি সর্বোপরি অবস্থান করেন, তাঁর তো স্তব করার কোন প্রয়োজন নেই- তিনি পুরুষোত্তম- সর্বদাতা।

তাই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমরাও একমত হতে দ্বিধা করবো না যে বেদ মানুষের দ্বারাই রচিত। বেদের আর একটু পরিচয় পেলেই আমরাও নিজবুদ্ধিতে এই সত্যটি বুঝতে পারবো।

বেদ যে ভাবেই রচিত হোক, কোনও একজন একে সঙ্কলন ও বিভাগ করেছেন, এটি সন্দেহাতীত। সেই বিভাজন হয়েছে মন্ত্রভেদে এবং মন্ত্রভেদ অনুসারে তিন বেদই দেখা যায়। ঋে±÷দের মন্ত্র ছন্দে নিবদ্ধ স্ত্রোত্র; যেমন ইন্দ্রস্ত্রোত্র, অগ্নিস্ত্রোত্র, বরুণস্ত্রোত্র । যজুর্বেদের মন্ত্র গদ্যে রচিত এবং যজ্ঞানুষ্ঠানই তার উদ্দেশ্য। সামবেদের মন্ত্র গান। ঋকবেদের মন্ত্রও গাওয়া হয়। গীত হলে তাকেও সাম বলে। অথর্ব বেদের মন্ত্রের উদ্দেশ্য মারণ, উচাটন, বশীকরণ ইত্যাদি।

হিন্দু মত অনুয়ায়ী সামবেদ উত্কৃষ্ট। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন 'বেদানাং সামবেদোহস্মি দেবানামিত্যাদি'। অর্থাত্ 'বেদের মধ্যে আমি সামবেদ'। কিন্তু ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মতে ঋে±÷দই প্রধান। কারণ বোধ হয় ঋগবেদের মন্ত্রগুলি সব চাইতে প্রাচীন বলে। ঋে±÷দের পরিচয় তাই প্রথমেই বলা হল।

ঋক বেদে দশটি মণ্ডল ও আটটি অষ্টক আছে। এক একটি মন্ত্রকে ঋচ্ বলে। এক ঋষির রচিত দেবতার স্তুতি সম্বন্ধে মন্ত্রগুলিকে একটি সূক্ত বলে। এই রকম বহুসংখক ঋষির দ্বারা রচিত সূক্ত সব একজন ঋষির দ্বারা সংগৃহীত হলে তাকে একটি মণ্ডল বলে। এ রকম দশটি মণ্ডল আছে ঋকবেদ সংহিতায়, এর প্রথম মণ্ডলের প্রথম অনুবাকের প্রথম সূক্তের প্রথম ঋকটি বলা হল উদাহরণ স্বরূপ এবং সংহিতার অর্থ পরিষ্কার করার জন্য আগে সূক্তটির শিরোনাম বিশ্লেষণ করি। 'ঋষির্বিশ্বামিত্রপুত্র মধুছন্দা অগ্নির্দেবতা গায়ত্রীচ্ছন্দ ব্রহ্মযজ্ঞান্তে বিনিয়োগ অগ্নিষ্টোমে চ'। এর চারটি অর্থ আছে-

(১) এই সূক্তের ঋষি, বিশ্বামিত্রের পুত্র মধুছন্দা ।
(২) এই সূক্তের দেবতা অগ্নি।
(৩) এই সূক্তের ছন্দ গায়ত্রী
(৪) এই সূক্তের প্রয়োগ ব্রহ্মযজ্ঞান্তে এবং অগ্নিষ্টোম যজ্ঞে।

এই রকম সব সূক্তেরই একটি ঋষি, একটি দেবতা, ছন্দ ও প্রয়োগ নিদ্র্দিষ্ট আছে। এর তাত্পর্য বিশ্লেষণ করি এবারে আমরা।

'ঋষি' শব্দ বলতে কি বোঝায়? সাধারণ অর্থে ঋষি বলতে আমরা বুঝি ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি। কিন্তু এখানে ঋষি কথার অন্য তাত্পর্য, সাধারণ অর্থ নয়। বেদের অর্থ বোঝানোর জন্য একটি আলাদা শাস্ত্র আছে- তার নাম 'নিরুক্ত'। এটি একটি বেদাঙ্গ। যাস্ক, স্থৌলষ্ঠিবী, শাকপুণি প্রভৃতি প্রাচীন মহর্ষিগণ নিরুক্তস্রষ্টা। বেদের কোন শব্দের যথার্থ অর্থ জানতে গেলে নিরুক্তের আশ্রয় নিতে হয়। নিরুক্তকার বলেন, 'যস্য বাক্যং স ঋষি', অর্থাত্ যাঁর কথা সেই ঋষি। তাহলে যখন কোন সূক্তের প্রথমে যে ঋষির নামোল্লেখ আছে, তিনিই বক্তা ঐ সূক্তের। এখন একটি প্রশ্ন ওঠে ঐ বক্তা অর্থে রচয়িতা বোঝায় কি? যাঁরা বলেন বেদ নিত্য অর্থাত্ কারও দ্বারা রচিত নয়, তাঁদের উত্তর এই যে বেদ মন্ত্র সব ঋষিদের সামনে আবির্ভুত হয়েছিল- তাঁরা রচনা করেন নি, জ্ঞানবলে দেখেছিলেন। যে ঋষি যে সূক্ত দেখেছিলেন- তিনিই সেই সূক্তের ঋষি। আমরা জানি শব্দ শোনা যায়। কিন্তু শব্দ দেখা যায়- যোগবলে বা যে বলেই হোক, তা মানা যুক্তিবাদী মনের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি কেউ মনে করেন সূক্তমন্ত্রগুলি লিপিবিদ্যা সৃস্টি হবার আগে এই মূর্তি ধরে ঋষিদের সামনে আবির্ভুত হয়েছিল তা হলে সেটা তাঁর বিশ্বাস। আমরা এটুকু বলতে চাই বেদেই অনেক জায়গায় আছে যে মন্ত্রগুলি ঋষিদের দ্বারা রচিত, দৃষ্ট নয়। অনেকই উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে- কিন্তু পরিসরের হিসেব রাখতে গেলে দেওয়া চলে না। তাই এটুকু বলাই যথেষ্ট যে এমন অনেক সূক্ত আছে যাতে ঋষিরা বলেছেন, 'আমরা মন্ত্র রচনা করেছি'। যা হোক এটুকু বোঝা গেল যে ঋষির অর্থ মোটেই তপোবলসম্পন্ন মহাপুরুষ নয়, সূক্তের বক্তা মাত্র। তাই ঋষির সধারণ বা লৌকিক অর্থের ব্যবহার এখানে হয় নি।

এবারে দেবতা শব্দের তাত্পর্য বিচার করলে দেখা যাবে 'যস্য বাক্যং স ঋষি যা তেনোচ্যতে সা দেবতা' - নিরুক্তকারের মতে সূক্তে যার কথা থাকে সেই সে সূক্তের দেবতা। অর্থাত্ সূক্তের বিষয়ই দেবতা। এখনে একটি কথা উঠতে পারে- এই সব সূক্তে যাদের দেবতা বলে অর্থাত্ ইন্দ্রাদি, সকলেই তারা স্তুত হয়েছেন- তাঁরা বেদমন্ত্রেও কি দেবতা একই অর্থে? দানস্তুতিগুলি বুঝতে পারলে এই কথা ওঠে না। কতগুলি সূক্তে কোন দেবতার প্রশংসা নাই, কেবল দানেরই প্রশংসা আছে, অতএব দানই দেবতা সেখানে।

এখন আবারও প্রশ্ন করা যেতে পারে- যদি দেবতা শব্দের অর্থ সূক্তের বিষয়, তবে দেবতার আধুনিক অর্থ এল কোথা থেকে? একটু গভীরে গেলেই বোঝা যাবে দেবতা শব্দের অর্থ। নিরুক্তকার যাস্ক বলেছেন, 'যো দেবঃ সা দেবতা' - যাকে দেব বলে তাকেই দেবতা বলা যায়। দিব্ ধাতু থেকে দেব শব্দের জন্ম। যা উজ্জল তাই দেব। 'দিব্ দীপনে'। আকাশ, সূর্য, অগ্নি, চন্দ্র সবাই উজ্জল, এ জন্য এ সব আদি দেব, মহিমাময় বস্তু, এবং আদিতে এদের প্রশংসায় স্তোত্র বা সূক্ত রচিত হয়েছিল। কালক্রমে যাদের প্রশংসায় সূক্ত রচিত হতে থাকলো তারাই দেব বলে গণ্য হলো। পজ্র্জন্য, যিনি বৃষ্টি করেন, তিনি উজ্জল না হয়েও দেব হলেন। ইন্দ্ ধাতুর পর 'র' প্রত্যয় যোগ করে 'ইন্দ্র' হয়। যিনি বৃষ্টি করেন তিনিই ইন্দ্র- তিনি উজ্জল না হলেও ক্ষমতাবান- বৃষ্টি না হলে শস্য হয় না- শস্য ছাড়া লোকের প্রাণ বাঁচে না। কাজেই তিনি বৈদিক সূক্তে স্তুত হলেন ও দেবতার স্থান পেলেন।

এখন বলি 'গায়ত্রীছন্দঃ' শব্দের অর্থ। ছন্দ বাংলা ও ইংরাজী দুই ভাষাতেই আছে, ঋকগুলি পদ্যে রচিত তাই ছন্দে নিবদ্ধ। 'যদক্ষর পরিমাণং তচ্ছন্দঃ'- অক্ষরের পরিমাণকে ছন্দ বলে। চৌদ্দ অক্ষরে পয়ার হয়- পয়ার একটি ছন্দ। বাংলাতে যেমন পয়ার, ত্রিপদী, চতুäপদী, নানা ছন্দ আছে, বেদেও তেমনি গায়ত্রী, অনুষ্টুভ, ত্রিষ্টুভ, বৃহতী পংত্তি ইত্যাদি নানা ছন্দ আছে। সূক্তে দেবতা ও ঋষির পরে ছন্দের নাম বলা থাকে। যাঁরা মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র ইত্যাদি পুরাতন কবিদের কাব্য পড়েছেন, তাঁরা এ প্রথার সঙ্গে পরিচিত।
ঋষি, দেবতা ও ছন্দের পরে প্রয়োগ বলা হয়- অর্থাত্ যে কাজের জন্য সূক্তটির প্রযোজন তাই প্রয়োগ বা বিনিয়োগ। যেমন অগ্নিষ্টোমে বিনিয়োগঃ- অর্থাত্ সূক্তটি অগ্নিষ্টোম যজ্ঞে ব্যবহার হয়। এ রকম প্রায় সব সূক্তেই শিরোনামটি আগে থাকে যার দ্বারা রচয়িতা বা ঋষি, দেবতা, ছন্দ ও বিনিয়োগ বোঝা যায়।

এবার ঋকটি বলি-

অগ্নিমীলে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবমৃত্বিজম্।
হোতারং রত্নধাতমম্।।

'অগ্নিমীলে' - অর্থাত্ অগ্নিকে স্তব করি। বাকী কথাগুলি সব অগ্নির বিশেষণ। অগ্নি পুরোহিত, কারণ তিনিই হোমকার্য সম্পন করেন। 'রত্নধাতমম্'- যিনি রত্ন দান করেন। অগ্নি যজ্ঞফল স্বরূপ রত্ন প্রদান করেন।
এই সূক্তে এরকম নয়টি ঋক আছে। সবই প্রশংসা, স্তুতি ও প্রার্থনা সূক্তের দেবতার কাছে। দ্বিতীয় সূক্তের দেবতা একজন নয়, প্রথম তিন ঋকের দেবতা বায়ু। চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ ঋকের দেবতা ইন্দ্র ও বায়ু; শেষ তিনটি ঋকের দেবতা মিত্র ও বরুণ। এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো। বত্র্তমান যুগে হিন্দুর এমন অনেক দেব বা দেবীর পূজা করেন যাঁদের উল্লেখ বেদে নেই। (যাঁরা বেদ পড়েছেন তাঁরাই জানেন।) এইভাবে তৃতীয় সূক্তের অনেক দেবতা - যথা দুই অশ্বিনীকুমার, ইন্দ্র, বিশ্বদেবাঃ, সরস্বতী। চতুর্থ সূক্তের দেবতা আবার ইন্দ্র, ঋকবেদে ইন্দ্রেরই প্রাধান্য। ষষ্ঠতে মরুতগণ - তাঁরা বায়ু থেকে আলাদা - ১২ নং সূক্তে আবার অগ্নি দেবতা- ইন্দ্রের পরে অগ্নির স্থান ঋকবেদে, ১৩ নং সূক্ত আপ্রীসূক্ত, এটির প্রয়োগ পশুযজ্ঞে- ১০-টি এরকম আপ্রীসূক্ত আছে ঋকবেদে। এর দেবতাও অগ্নি। এই সূক্তে অবশ্য অগ্নির ১২-টি মূর্তির স্তব করা হয়েছে। ১৪ নং সূক্তে অনেক দেবতা- বিশ্বদেবাঃ, ইন্দ্র, বায়ু,অগ্নি, মিত্র, বৃহäপতি, পূষা, ভগ, আদিত্য ও মরুদগণ। ১৫ নং সূক্তেরও অনেক দেবতা, ঋতুরাই প্রধানতঃ এই সূক্তের দেবতা। ১৬ নং- এ ইন্দ্র একা দেবতা, ১৭-তে ইন্দ্র ও বরুণ, ১৮-তে দেবতা ব্রহ্মণস্পতি- যদিও তাঁর পরিচয় বিশেষ ভাবে উল্লিখিত নেই, আরও ইন্দ্র ও সোম, দক্ষিণা ও সদসস্পতি বা নারাশংস বলে এক দেবতা আছেন। ১৯-তে দেবতা অগ্নি ও মরুত্, বৈদিক দেবতাদের মোটামুটি তালিকা এই রকম। এই তালিকায় বত্র্তমানে পূজিত ব্রহ্মা, বিষুÎ, মহেশ্বর, দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, কাত্র্তিক, গণেশ - এরা কেউ নেই। ঋে±÷দের অন্য স্থানে বিষুÎর উল্লেখ আছে, শিবের বদলে রুদ্রকে, ব্রহ্মার বদলে প্রজাপতি ও লক্ষ্মীর স্থানে শ্রীকে স্তুতি করা হয়েছে। কিন্তু বাকীদের বৈদিক আবাস নেই। ঋকবেদ অনুযায়ী ৩৩ জন দেবতা আছেন কিন্তু তাঁদের প্রত্যেকের নামের উল্লেখ নেই। শতপথ ব্রাহ্মণে, মহাভারতে, রামায়ণ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও ৩৩ জন দেবতার কথাই বলা আছে। তাহলে প্রশ্ন এই ৩৩ জন কী করে তেত্রিশ কোটিতে পরিণত হল, তার সঙ্গত কোন উত্তর দেওয়া যায় না। তবে ৩৩ জন দেবতা কে কে ঋকবেদে তার উল্লেখ নেই। শতপথ ব্রাহ্মণে ও মহাভারতে এদের শ্রেণীবিভাগ ও নাম পাওয়া যায়।

শ্রেণীবিভাগটি এই রকম- ১২ জন আদিত্য, ১১ জন রুদ্র এবং আটজন বসু।
'আদিত্য', 'রুদ্র' এবং 'বসু' বিশেষ এক দেবতার নাম নয়, দেবতার জাতি বা শ্রেণীবাচক মাত্র। এ ভাবে আমরা ৩১ জন দেবতার হিসেব পাই; দ্যাবা ও পৃথিবী এই দুটি নিয়ে মোট ৩৩ জন হয়। মহাভারতের অনুশাসন পর্বে এঁদের নামোল্লেখ আছে। নামের তালিকাটি এ রকম-

আদিত্য - অংশ, ভগ, মিত্র, জলেশ্বর, বরুণ ধাতা, অর্যমা, জয়ন্ত, ভাস্কর,ত্বষ্টা,পূষা, ইন্দ্র, বিষুÎ।
রুদ্র - অজ, একপদ, অহিব্রধু,পিণাকী, ঋত, পিতৃরূপ, ত্র্যম্বক, বৃষকপি,শম্ভু, হবন, ঈস্বর।
বসু - ধর, ধ্রুব,সোম, সবিতা, অনিল, অনল, প্রত্যুষ, প্রভাস।
গল্পে, কথকতায় এরাই তেত্রিশ কোটি হয়েছেন খুব সম্ভবত। (চলবে)

কমলা রায়


টীকা:
নিরুক্ত - বেদের দুরূহ শব্দসমূহের ব্যুত্পত্তি ও ব্যাখ্যাসঙ্কলিত গ্রন্থ বিশেষ। যাস্ক প্রমুখ কয়েকজন প্রাচীন পণ্ডিত নিরুক্তকার হিসেবে খ্যাত।
অনুবাক - বিভাগ ও অনুবিভাগ।

প্রবন্ধটি লিখতে বিশেষ করে নীচের গ্রন্থগুলির সাহায্য নেওয়া হয়েছে:
(১) 'দেবতত্ব ও হিন্দুধর্ম' : বঙ্কিম রচনাবলী
(২) উপনিষদ- অখণ্ড সংস্করণ: অতুলচন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্বভূষণ ও
মহেশচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।