প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বেদ- উপনিষদ ও সনাতন হিন্দুধর্ম - (১০) (অন্যান্য অনুচ্ছেদ)

মায়া বাদ

বেদান্ত দর্শন জন্ম নিয়েছে প্রাচীন উপনিষদ্গুলিকে ভিত্তি করে এবং বাদরায়ণের ব্রহ্মসূত্র তার মূল গ্রন্থ । উপনিষদের আপ্ত বচনগুলিকে ভিত্তি করেই তা সূত্রাকারে পরিণত হয়েছে। কাজেই এই ব্রহ্মসূত্রের ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই বিভিন্ন দার্শনিক মতকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এই ব্যাখ্যাগুলিকে দু ভাগে ভাগ করা যায়। এক ভাগ পৃথক ঈশ্বরের অস্তিত্ত্ব স্বীকার করেনা , অন্য ভাগ স্বতন্ত্র ঈশ্বরকে স্বীকার করে ও ভক্তিবাদের পথ সুগম করে । প্রথমটির প্রবর্তক শঙ্করাচার্য । বিশ্ব্সত্তা এক এবং তাঁকে ভাগ করা যায়না । এই মত তাঁর এবং একে অদ্বৈতবাদ বলা হয়। দ্বিতীয় মতপন্থীদের বৈষ্ণবপন্থী বেদান্ত বলে । রামানুজ, মধ্ব, বল্লভাচার্য, নিম্বার্ক এবং বলদেব এই মতের সমর্থনে ব্রহ্মসূত্রের বিভিন্ন ভাষ্য লিখেছেন, এবং সেই ভাষ্যে উপনিষদের বচন উদ্ধৃত করে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাতে একেশ্বরবাদ বা দ্বৈতবাদের সংগে সঙ্গতি রেখেছেন ।

তাই প্রশ্ন করা যায়--- উপনিষদ কি অদ্বৈতবাদকে সমর্থন করেনি ? শংকরাচার্যের অদ্বৈতবাদকে মায়াবাদ ও বলা হয়। কারণ মায়াতত্ত্বটি তাঁর সৃষ্ট দর্শনের একটি অংশ। একটি প্রবাদ বাক্য প্রচলিত আছে যে মায়াবাদ বলে: ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা; কিন্তু তা ঠিক নয়। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকে তিনি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেননি। তাঁর মত--- ব্রহ্ম হতে তা আলাদা নয়, তাঁকে ভুল করে আমরা বহু আকারে দেখি । তাঁর মতে ব্রহ্ম সকল অবস্থাতেই ঐ একমেবাদ্বিতীয়ম ঑, অর্থাৎ কোন অবস্থাতেই তিনি বহু হন না। এটা একটি অসম্ভব পরিস্থিতি-- কারণ-- ব্রহ্ম যদি সব অবস্থাতেই এক হন তা হলে বিশ্বে আমরা যে বহু ও নানা বস্তুর সমাবেশ দেখি তার সঙ্গে ব্রহ্মের বিশুদ্ধ একক রূপের সঙ্গতি ঘটবে কি করে ?

উত্তরে তিনি বলেন-- দৃশ্যমান জগৎ নিশ্চয়ই ব্রহ্ম, ব্রহ্ম থেকে আলাদা নয়। তবে বহুসত্তা যে আমরা দেখি সেটিই ভুল। ভ্রান্ত দর্শন বা উপলব্ধি দুভাবে ঘটে। এক-- যা একেবারে নেই তাকে দেখা, যেমন স্বপ্ন ও দুই-- যা আছে তাকে ভুল করে দেখা, যেমন দড়িকে সাপ বলে ভুল করা বা দেখা। তিনি বলেন এই দেখার ভুলের কারণ হল মায়া, যেমন দড়িকে সাপ বলে দেখার কারণ আলোর অভাব ও এই অভাবই মায়ারূপে কাজ করছে। ঐ মায়া ঐ শক্তিটির এমন ক্ষমতা-- যা আসল জিনিষটির রূপকে ঢেকে রাখে এবং তার বিকৃত রূপকে প্রকট করে। ফলে আমরা আসল রূপের পরিচয় পাই না, তার বিকৃত রূপ দেখি। যা এক তাকে বহুরূপে দেখি। কাজেই এই নানা ও বহুর জগৎ একেবারে ভিত্তিহীন নয়। তা একরকম আছে আবার নেই ও। তাই তাঁকে তিনি ' সদসৎ ' বলেছেন। সুতরাং দৃশ্যমান বিশ্ব ব্রহ্মের উপরেই প্রতিষ্ঠিত। দেখার ভুলে তাঁকে বহুরূপে দেখি।

প্রাচীন উপনিষদগুলি প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে এই মায়াবাদ সমর্থন করেছে। বৃহদারণ্যক উপনিষদে আছে ইন্দ্র মায়ার সাহায্যে বিরাট আকার ধারণ করেছেন, তাঁর রথের সংখ্যা দশ শত। ঒ ইন্দ্রো মায়াভিঃ পুরুরূপ ঈয়তে-- যুক্তা হাস্য হরয়ঃ শতা দশেতি ও। (বৃহদারণ্যক ২। ৫। ১৯)। শংকরাচার্য এর রূপক ব্যাখ্যা করেছেন। অর্থাৎ ইন্দ্রের স্থলে ব্রহ্মকে বুঝিয়েছেন। তবে এই যুক্তি খুব সবল নয় কারণ এই বচনটি ঋগ্‌বেদের ষষ্টঃ মণ্ডলের সাতচল্লিশ সংখ্যক সূক্ত থেকে নেওয়া এবং সেখানে সেটি সহজ অর্থেই ধরা হয়েছে। ইন্দ্র সেখানে নানা দেবতাদের মধ্যে একজন।

অনুভূতিকে সম্ভব করতে দুটি ভিন্নধর্মী সত্তার প্রয়োজন। একটি জানার ও উপভোগ করার ক্ষমতা রাখবে এবং অন্যটি জ্ঞাত ও ভোগ্য হবার উপযুক্ত হবে। এই দুটি সত্তার সম্পর্কের ভিত্তিতেই বহু ও বিভিন্ন বস্তুর সমাবেশ হিসাবে বিশ্ব মানুষের মনের কাছে প্রকাশ পায়। একেই বলা হয় দ্বৈতভাব যার অভাবে বিশ্বের বৈচিত্র্যময় প্রকাশ সম্ভব হয় না। বৃহদারণ্যক উপনিষদে দুই স্থানে ইঙ্গিতে বলা হয়েছে যে এই দ্বৈতভাব বিশ্বের স্বাভাবিক প্রকৃতি নয়। তা একটি কৃত্রিম অবস্থার মত: " যত্র হি দ্বৈতমিব ভবতি তদিতর ইতরং জিঘ্রতি তদিতর ইতরং পশ্যতি " ইত্যাদি। এই উক্তিটি যাজ্ঞবল্কের। দ্বৈতমিব কথাটির দ্বারা তিনি যেন বলতে চেয়েছেন দুটি ভিন্নধর্মী সত্তার সম্পর্কের ফলে বিশ্বে যে বহুরূপ দেখা যায় তা ব্রহ্মের কৃত্রিম রূপ এবং যেখানে এর লোপ হয় সেখানে তাঁর অদ্বৈতরূপ বর্তমান থাকে এবং সেটিই তাঁর প্রকৃত রূপ।

অন্যত্র ব্রহ্মের মূর্ত ও অমূর্ত রূপের উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে মূর্তরূপের কৃত্রিমতার ইঙ্গিত না থাকলেও অমূর্তরূপই যে ব্রহ্মের অদ্বৈতরূপ তা বোঝা যায়। কঠ উপনিষদে এই অদ্বৈতরূপের একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে তিনি অশব্দ, অস্পর্শ, অরূপ, অব্যয়, অনাস্বাদেয়, নিত্য এবং অগন্ধ।

এই বাণীগুলির মধ্যেই পরোক্ষভাবে মায়াবাদের সমর্থন আছে বলে মনে হয়।

উপনিষদের মূল ভাবই হল যে বিশ্বশক্তির স্বাভাবিক গতিই হল বিশুদ্ধ একক অবস্থা থেকে বহু ও বিচিত্ররূপে আত্মপ্রকাশ করা-- আনন্দ পাবার জন্য। তিনি শিল্পী-- বহুরূপে প্রকাশিত না হলে তাঁর শিল্পরচনা সার্থক হয় না, তাঁর আনন্দের মহাকাব্য রচিত হয় না।

তা হলে এই সিদ্ধান্তে আসা অনুচিত হবেনা যে উপনিষদের মূল ভাবধারা মায়াবাদকে সমর্থন করেনা। মায়াবাদের কিছু বীজ উপনিষদে থাকলেও তা শংকরাচার্যের মনেই বর্ধিত হয়েছে।

মধ্যযুগের চিন্তানায়ক চৈতন্যদেবও এরকম সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। কৃষ্ণদাস রচিত ' চৈতন্যচরিতামৃত ' গ্রন্থে এর উল্লেখ আছে (সপ্তম অধ্যায়)। তাঁর সময়ে অদ্বৈতবাদের দারুণ প্রতিপত্তি ছিল, অথচ তিনি ছিলেন ভক্তিবাদী। বর্ণনায় পাওয়া যায় এই পরিস্থিতে বেদান্তবাদীদের সঙ্গে তাঁর বিতর্ক হয়। তিনি এই যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে বেদান্তের অদ্বৈত তত্ত্বের ব্যাখ্যাপ্রসঙ্গে শংকরাচার্য যা স্থাপন করেছেন তা ঠিক উপনিষদের মুখ্য ভাবধারার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে না। তাঁর মন্তব্যের প্রাসঙ্গিক অংশটি এই:

উপনিষদ সহিত সূত্র কহে যেই তত্ত্ব।
মুখ্যবৃত্তি সেই অর্থ পরম মহত্ব।
গৌণবৃত্তে যে ব্যাখ্যা করিলা আচার্য।

অর্থাৎ ব্রহ্মসূত্র উপনিষদের দর্শনের সংকলন গ্রন্থ। তার ব্যাখ্যা করতে হবে উপনিষদের মুখ্য ভাবধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। গৌণ ভাবধারাকে অবলম্বন করলে ব্যাখ্যা নির্ভরযোগ্য হবে না। তাঁর আক্ষেপ হল শংকরাচার্য ঠিক তাই করেছেন। তাই তিনি আরো বলেন-- " গৌণার্থ করিল মুখ্য অর্থ আচ্ছাদিয়া "।

 

(চলবে)

কমলা রায়

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।