বেদ-
উপনিষদ ও সনাতন হিন্দুধর্ম
(১১) (অন্যান্য অনুচ্ছেদ)
ভারতীয়
যত দর্শন আছে তার মধ্যে মীমাংসা দর্শনে জ্ঞান অর্জনের বিভিন্ন
রীতির বেশ বড় তালিকা রয়েছে। তাতে ছটি রীতি পাই: প্রত্যক্ষ,
অনুমান, উপমান, শব্দপ্রমাণ, অর্থাপত্তি ও অনুপলব্ধি । প্রথম
দুটি আমরা চিনি। উপমান হল তুলনার ভিত্তিতে অনুমান। আর একটি
বিশেষ অবস্থা থেকে যা অনুমান করা যায় তা অর্থাপত্তি। তাকে
অবস্থাজনিত প্রমানও বলা যায়। যেমন পথ ঘাট ভিজে দেখে অনুমান
করা যায় যে বৃষ্টি হয়েছিল। অনুপলব্ধি হল নেতিবাচক জ্ঞান।
শব্দপ্রমাণ হল-- কোন
শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি দ্বারা উচ্চারিত বা লিপিবদ্ধ যে জ্ঞানবাক্য
আছে তাকে বিনা দ্বিধায় সত্য বলে গ্রহণ করা, কারণ তা নির্ভরযোগ্য
সূত্র থেকে আসছে। ভারতীয় দর্শনে এর একটি মর্যাদার স্থান রয়েছে
এবং তার বহু প্রমানও রয়েছে। এর মূল কারণ ভারতীয় দর্শনে স্বাধীন
চিন্তার স্রোত কমে এসেছিল বৈদিক যুগের পরে, কতগুলি গোষ্টী
দ্বারা নির্ধারিত ধারায় দর্শনের আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকত এবং
তা রক্ষণশীল হয়ে ওঠায় পূর্বসূরিদের বচনকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ
করত।
উপনিষদ ইন্দ্রিয়লব্ধ
জ্ঞানের মাধ্যমে বিশ্বকে জানার স্বীকৃতি দিয়েছে। কারণ উপনিষদের
দর্শনে, রূপ, রস, শব্দ, স্পর্শ, গন্ধ মণ্ডিত বিশ্বের যে পরিচয়
জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলি এনে দেয়, তা থেকে বিশ্বসত্তা অভিন্ন।
পরোক্ষ বা অনুমানলব্বì
জ্ঞান লাভ হয় মনের সাহায্যে। উপনিষদ বলে আমরা মনের দ্বারা
মনন করি অর্থাত্ অনুমান করি। পরবর্তী কালে মনকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়
বলা হত। কিন্তু উপনিষদ মনকে ইন্দ্রিয় বলে না। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে
নানা বস্তুর সাথে পরিচিতি হয় ও মানুষ তাদের জানে ও ভোগ করে।
এই ইন্দ্রিয় ও ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞানকে পরিচালিত করতে ও লব্বì
অভিজ্ঞতা থেকে অনুমানের সাহায্যে জ্ঞান আহরণ করাতে একটি মনও
আছে, অতিরিক্ত আছে একটি আত্মা যা মানুষকে বিশেষ ব্যক্তি রূপে
চিহ্নিত করে। কঠ উপনিষদ তাই ব্যক্তি বা ভোক্তার তিনটি উপাদানের
উল্লেখ করেছে-- আত্মা, ইন্দ্রিয় ও মন।
উপনিষদে ব্রহ্ম সম্বন্ধে
জ্ঞান আহরণের জন্য পরস্পর আলোচনা রীতির ব্যবহারও দেখা যায়।
একে অনুমানভিত্তিক যুক্তিমার্গও বলা যায়। ছান্দোগ্য উপনিষদের
ষষ্ঠ অধ্যায়ে পিতা আরুণি ও শ্বেতকেতুর আলোচনা, সপ্তম অধ্যায়ে
নারদ ও সনত্কুমারের আলোচনা আছে। বৃহদারণ্যকের দ্বিতীয় ও চতুর্থ
অধ্যায়ে যাজ্ঞবল্ক ও তাঁর পত্নী মৈত্রেয়ীর আলোচনা আছে, প্রশ্ন
উপনিষদে নানা দার্শনিক প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা আছে।
বিশ্বের প্রকৃত সত্তা
উপনিষদে ব্রহ্ম বা অক্ষর বা আত্মা বা ভূমা বলে বর্ণিত হয়েছেন।
তাঁকে জানারও বিভিন্ন উপায় উপনিষদ আলোচনা করেছে। সেগুলি চার
ভাগে ভাগ করা যায়:
১) ব্রহ্ম অজ্ঞেয়, তিনি
অবাঙ্মনসোগোচর। কেন উপনিষদ বলে তিনি বিদিতও নন, অবিদিতও নন।
২) কঠ উপনিষদে পাওয়া
যায়-- 'বিধাতার প্রসাদ ভিন্ন তাঁকে জানা যায় না'। আলোচনার
মধ্য দিয়ে বা অনেক তত্তকথা শুনে বা প্রখর বুদ্ধি দিয়ে ব্রহ্মকে
জানা যায় না। যাকে তিনি বরণ করেন তার কাছেই তিনি প্রকট হন।
এটা যেন দিব্য অনুভুতির মধ্য দিয়ে ব্রহ্ম লাভের ইঙ্গিত করে।
৩) আবার অন্য দিকে জ্ঞানমার্গ
বা বুদ্ধিশক্তির সাহাযে যে ব্রহ্মকে জানা যায় এমন একাধিক উক্তিও
উপনিষদে পাওয়া যায়। কঠ উপনিষদই বলেছে আত্মা প্রকট নন, কারণ
জীবের মধ্যে তিনি প্রচ্ছন্নভাবে বিরাজমান। অতি সূক্ষ্ম বুদ্ধির
প্রয়োগেই তাঁকে জানা যায়।
৪) মুণ্ডক উপনিষদ বলে,
তাঁকে চক্ষু দ্বারা গ্রহণ করা যায় না, আলোচনার দ্বারা পাওয়া
যায় না, দেবতাদের সন্তুষ্ট করে বা তপস্যা করে বা কর্ম করে
তাঁকে পাওয়া যায় না। মনকে বিশুদ্ধ করে জ্ঞানের প্রসাদেই চিন্তা
করে তাঁকে পাওয়া যায়।
কঠ্ ও শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে
আর একটি বচন পাওয়া যায়, যার তাত্পর্য খুব গভীর। পরম সত্তাকে
পাওয়া যায় যদি কোন মনীষী তাঁকে হৃদয় ও মন দিয়ে গ্রহণ করেন।
এখানে অনুভুতি ও মননশক্তি দুইয়েরই প্রয়োগের উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
শুধু মন দিয়ে জানা নয়, হৃদয় দিয়েও তাঁকে অনুভব করতে হবে।
এতগুলি বিভিন্ন মত বা
পথ পরমসত্তাকে জানার জন্য, কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
তবে বেশীর ভাগ বচনগুলি পরমসত্তার প্রসাদের প্রয়োজনীয়তার থেকে
মননরীতির উপরই বিশেষ জোর দিয়েছে। বার বার উপনিষদগুলিতে বলা
হয়েছে: ব্রহ্মের অখণ্ডতা মন দিয়েই উপলব্বিì করতে হবে। উপনিষদের
ঋষিদের যে ধী শক্তির উপর গভীর আস্থা ছিল তা গায়ত্রী মন্ত্রের
প্রার্থনাই প্রমাণ করে।
নীতি
মানুষের মনের নানা ইচ্ছাকে
তাদের প্রকৃতি অনুযায়ী চিহ্নিত করার জন্য উপনিষদ প্রেয় ও শ্রেয়
এই দুটি শব্দ ব্যবহার করেছে।
প্রেয়-- ব্যক্তির স্বার্থকে
প্রথমে স্থান দেয় তাই তা সঙ্কুচিত দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গিতে তার আকর্ষণ বেশী। দেহের তৃপ্তির আকর্ষণ
মনের তৃপ্তির আকর্ষণের থেকে বেশী। তাই তা প্রেয় সমাজের ক্ষেত্রে,
ব্যক্তির স্বার্থ গোষ্ঠীর স্বার্থ থেকে বেশী আকর্ষণ করে। তাই
তা প্রেয়।
শ্রেয়-- অন্যদিকে শ্রেয়
বিস্তারিত প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাই সেই
দৃষ্টিতে দেহ ও মন নিয়ে সমগ্র ব্যক্তির কল্যাণ এবং ব্যক্তি
ও সমষ্টি নিয়ে সমগ্র সমাজের কল্যাণই মঙ্গল আনতে পরে। সামগ্রিক
কল্যাণ আনে বলেই তা শ্রেয়। আপাতদৃষ্টিতে তা আকর্ষণের বস্তু
নয়। তাই কঠ উপনিষদ বলে শ্রেয় ও প্রেয় ভিন্ন জিনিস। তারা মানুষকে
বিপরীত ভাবে আকর্ষণ করে। তাদের মধ্যে শ্রেয়কে গ্রহণ করলে কল্যাণ
হয়, আর যে প্রেয়কে গ্রহণ করে সে কল্যাণ হতে ভ্রষ্ট হয়।
এই শ্রেয়বাদ আবার সন্নাসবাদ
থেকে আলাদা। উপনিষদ সংসার ত্যাগ করে বা কৃচ্ছসাধন করে সন্নাসী
হতে বলে নি। উপনিষদ বলে ত্যাগ ও ভোগের সামঞ্জস্যের মধ্যেই
জীবনের সাথর্কতা। ইন্দ্রিয়গুলির বিষয়ের প্রতি আসক্তি আছে সত্য;
কিন্তু বিষয়ের সঙ্গে তাদের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদের প্রয়োজন নেই।
মানুষের আদর্শ হবে ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ, যাতে তারা প্রেয়র প্রতি
আকৃষ্ট না হয়ে শ্রেয়র পথে চলে। প্রয়োজন-- ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণ,
ইন্দ্রিয় দমন নয়।
কঠ উপনিষদ বলে ইন্দ্রিয়গুলি
অশ্বের মতো এবং বিষয়গুলির প্রতি তীব্র আকর্ষণ তাদের।
ভালো সারথির মতন এই ইন্দ্রিয়গুলিকে
পরিচালিত করে শ্রেয়র পথে চলতে হবে। নীতিজ্ঞান যার নেই ইন্দ্রিয়গুলি
তার বশে থাকে না। আর যার শ্রেয়র জ্ঞান পরিস্ফুট সে ইন্দ্রিয়গুলি
নিজের বশে রাখে।
উপনিষদের ঋষি প্রাকৃতিক
ঘটনার মধ্যে নীতিগর্ভ বাণী খুঁজে পেতেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদে
গল্প আছে, প্রজাপতি সমাবর্তনের দিনে তিন শিষ্যকে উপদেশ দিয়েছিলেন--
দ দ দ; অর্থাত্ আত্মদমন কর, দান কর, দয়া কর। তাই নাকি আকাশের
বুকে যখন বিদ্যুত্ খেলা করে তখন বজ্ররবে মেঘ প্রজাপতির সেই
উপদেশ বিশ্ববাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই ঋষি বলেন এই তিনটি
সদ্গুণ সর্বমানবের অভ্যাস করা উচিত।
সেকালে এই আত্মদমনের
জন্যই শিক্ষাব্যবস্থায় ব্রহ্মচর্য পালনের রীতি ছিল।তা সন্নাসের
প্রস্তুতি নয়, গৃহস্থ জীবনের প্রস্তুতি। তৈত্তেরীয় উপনিষদে
আছে, আচার্য সমাবর্তনের দিনে শিষ্যদের উপদেশ দিচ্ছেন: ' সত্যকথা
বলবে, ধর্ম আচরণ করবে। বেদপাঠ হতে বিরত থাকবে না। আচার্যকে
প্রিয় উপহার দেবে। বংশধারাকে অব্যাহত রাখবে'।
এখানে বংশধারাকে অব্যাহত
রাখার আদর্শটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিষ্য ব্রহ্মচর্য আশ্রমে
থাকার পর আদর্শ সংসারী রূপে সংসার ধর্ম পালনের উপযুক্ত হয়েছে।
তাই আচার্য শিষ্যকে উপদেশ দিচ্ছেন সংসার আশ্রমে ফিরে গিয়ে
বিবাহ করে বংশধারাকে অক্ষুণ্Ø রাখতে। ভোগের জন্যই কৃচ্ছসাধনের
প্রয়োজন, যেমন শষ্যের জন্য ভূমি কর্ষণের প্রয়োজন। জীবনে ত্যাগের
সাথে ভোগের স্থান আছে। শুধু ত্যাগ ও শুধু ভোগ সামগ্রিক কল্যাণের
পরিপন্থী।
তাহলে সামগ্রিক কল্যাণ
কোন কর্মের দ্বারা হয়? কোন কর্ম এই শ্রেয়র পথে এগিয়ে নিয়ে
যায়, তা ঠিক করার জন্য উপনিষদ একটি নীতিও স্থির করেছে। সেটাও
পাওয়া যায় তৈত্তিরীয় উপনিষদে, সমাবর্তনের দিনে আচার্যের উপদেশ
থেকে। তিনি বলছেন, যা অনবদ্য কর্ম তাই হল কর্তব্য কর্ম; অন্য
প্রকৃতির কর্ম বর্জন করে সেই কর্মই করা উচিত।
সর্বক্ষেত্রেই প্রযোয্য
এমন একটি নীতিই উপনিষদ স্থাপিত করেছে যা সামগ্রিক কল্যাণ আনে,
আর সেই সামগ্রিক কল্যাণকারী কর্মই অনবদ্য কর্ম-- যার কোন দোষ
কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ধরা যায় না। তা একাধারে ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি
হতে দেহ ও মনের এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী
উভয়ের মঙ্গল সাধন করে।
উপনিষদের আর একটি বৈশিষ্ট
হল তা হৃদয়বৃত্তির প্রসারের সাহায্যে স্বার্থ ও পরার্থের মীমাংসা
করেছে। এই সমাধানে বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে বিকাশ চেয়েছে উপনিষদ।
আর হৃদয়বৃত্তির বিকাশের সাহায্যে স্বার্থ ও পরার্থের মীমাংসা
করেছে। মানুষের হৃদয়বৃত্তির শ্রেষ্ঠ বিকাশ পাই স্নেহ, প্রীতি
ও ভালোবাসার বিস্তারে। এই বিস্তার স্বার্থকে শোধিত করে, কারণ
সব মানুষের মধ্যেই স্বার্থ ও পরার্থবোধ দুই-ই অল্পবিস্তর ক্রিয়াশীল।
সন্তানের জন্য মা আত্মত্যাগ করে, প্রিয়জনের জন্য প্রেমিক
সর্বত্যাগ করতেও দ্বিধা
বোধ করে না।
উপনিষদ এই পথেই স্বার্থ
ও পরার্থের মীমাংসা করেছে। একই মহাসত্তা যখন প্রচ্ছন্নভাবে
বিশ্বের সকল জীবে ব্যাপ্ত হয়ে আছেন, তখন সকলেই সকলের আত্মীয়।
এই অখণ্ডবোধ থেকেই সকলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বোধ প্রকাশিত হবে
এবং সকলের মনে প্রীতির সম্পর্ক স্থাপিত হবে। ফলে স্বার্থের
সংঘাত থাকবে না।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে যযাজ্ঞবল্ক
মৈত্রেয়ীকে বলছেন, জায়ার নিকট পতি, পতির নিকট জায়া, মায়ের
কাছে পুত্র প্রিয় হয় তাদের কারণে নয়, বিশ্ব আত্মার কারণেই
তারা একে অন্যের কাছে প্রিয় হন। একই আত্মা সকলকে ব্যাপ্ত করে
আছেন। আত্মা শব্দটি ব্রহ্মের প্রতিশব্দ হিসেবে এখানে ব্যবহৃত
হয়েছে।
ঈশ উপনিষদ এই তত্তটি
ধরেই মানুষকে পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের মত ব্যবহার করতে
উপদেশ দিয়েছে। বলেছে স্বার্থপরের মত একা ভোগ করতে নেই, ত্যাগের
সঙ্গে ভোগ করতে হয়, ভাগ করে ভোগ করতে হয়। 'ত্যক্তেন ভুঞ্জিথাঃ'।
কেন পালন করব এই নীতি? উত্তরে বলা হয়েছে-- বিশ্বে যা কিছু
সবই তো সেই একই মহাসত্তার দ্বারা পরিব্যাপ্ত;
'ঈশাবাস্যমিদং সর্বম্'।
কারও জিনিষও অপহরণ করতে নেই। 'মা গৃধঃ কস্যস্বিদ্ ধনম্'। আপনজনের
জিনিষ কি অপহরণ করা যায়?
রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার
মধ্যে তার প্রতিধবনি পাওয়া যায়:
ভাই তুমি যে ভাইয়ের মাঝে
প্রভু,
তাদের পানে তাকাই
না যে তবু,
ভাইয়ের সাথে ভাগ
করে মোর ধন
তোমার মুঠো কেন
ভরিনে।।
(গীতাঞ্জলি- ৯২)