ঈশা--
ঈশ্বর
বাস্যম্-- ঈশ্বরের বাসের জন্য অথবা ঈশ্বর
দ্বারা আচ্ছাদিত।
জগত্যাম্-- এই গতিশীল বিশ্বে
যৎ কিঞ্চ জগৎ-- যা কিছু চলমান
ত্যক্তেন-- ত্যাগের সহিত
তেন ভূঞ্জিথাঃ-- তা ভোগ করবে
কস্যস্বিদ ধনম-- কাহারও ধনে
মা গৃধঃ-- লোভ করিও না
এই
বিশ্ব সর্বদাই চল্ছে, সর্বদাই পরিবর্তিত
হচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্য এর স্থিরতা নেই,
এই জন্যই এর নাম জগৎ। এই জগতে যা কিছু আছে
সবই গতিশীল, চলমান। কিন্তু এই চলমান জগৎ
একটি অচল সত্তার প্রকাশ মাত্র। কারণ একটি
অচঞ্চল গতিহীন নিত্যসত্তা সমগ্র বিশ্বকে
এবং তার অন্তর্গত প্রতিটি বস্তুকে ধারণ
করে আছে, এবং তার ফলেই জগতের চঞ্চল প্রবাহ
সম্ভব হচ্ছে। এই অচঞ্চল স্থির সত্তাই ঈশ্বর।
তিনিই জগতের সমস্ত বস্তুর অন্তরে বাস করছেন
এবং সব কিছু নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালন করছেন।
বিশ্বের অন্তরে থেকে বিশ্বজগতের মধ্য দিয়ে
আপনাকে প্রকাশ করছেন। মানুষকে এই অন্তর্যামী
ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করতে হবে। বুঝতে
হবে ঈশ্বরের সত্তা-- নিরপেক্ষ কোন কিছুরই
অস্তিত্ব নেই। সর্বভূতে ঈশ্বরকে দর্শন করতে
হবে। এরকম অনুভূতি যাঁর হয় তাঁর কোন কিছুরই
প্রতি মোহ বা আসক্তি থাকে না। স্বাভাবিক
ভাবেই মনে অনাসক্তি আসে। ত্যাগ ও বৈরাগ্যের
ভাবে অন্তর পূর্ণ হয়। তখন তিনিই পারেন সর্বভূতে
ঈশ্বর দর্শন করে সকলকে ভালবাসতে, সব কিছুকে
ভোগ করতে।
মোহই
আনে আসক্তি-- তা থেকে দুঃখ, দৈন্য, অশান্তি।
যিনি আসক্তিহীন তিনি স্বাধীন। মানুষকে কামনা
বাসনাহীন ত্যাগ করে জগৎকে ঈশ্বরের প্রকাশ
মনে করে ভোগ করতে হবে, তা হলেই আনন্দলাভ
হবে। তাই ঋষি প্রথম মন্ত্রেই বলেছেন ত্যাগের
দ্বারা ভোগ কর। ধন বা সম্পত্তি, নিজের বা
অপরের, তার প্রতি লোভ করো না।
দ্বিতীয় মন্ত্র--
কুর্বন্নেবেহ কর্মাণি জিজীবিষেৎ শতং সমাঃ।
এবং ত্বয়ি নান্যথেতোহস্তি ন কর্ম লিপ্যতে
নরে। ।
এ
সংসারে যথাবিহিত কর্তব্যকর্ম অনুষ্ঠান করেই
মানুষ শতবর্ষ বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করবে। মানুষ
এই রকম কর্ম করলে কর্মবন্ধনে আবদ্ধ হবে
না। এ ছাড়া অন্য পন্থা নাই। কামনা বাসনা
ত্যাগ করে নিরাসক্ত ভাবে কর্ম করাই হবে
মানুষের ধর্ম।
তৃতীয়
মন্ত্র--
অসূর্যা নাম তে লোকা অন্ধেন তমসাবৃতাঃ।
তাংস্তে প্রেত্যভিগচ্ছন্তি যে কে চাত্মহনো
জনাঃ। ।
পরলোকে
যে সকল অজ্ঞান অন্ধকার দ্বারা আবৃত লোক
আছে, আত্মার স্বরূপ যারা বুঝতে পারে না
তারা মৃত্যুর পর সে সব লোকে যায়।
এখানে
তুলনা করা যায় গীতার পঞ্চম অধ্যায়ের দশম
স্তোত্রের সাথে--
প্রথম
ও দ্বিতীয় মন্ত্র দুটিতে গীতার সারার্থই
পাওয়া যায়। মৃত্যুর পর দেহের নাশ হলেও আত্মার
বিনাশ হয় না। মৃত্যুর পরপারে বিভিন্ন লোকের
অস্তিত্ব উপনিষদ স্বীকার করেছে।
কোনটি
বিষাদময় অন্ধকার- কোনটি আলোকময়, আনন্দময়।
এই লোকগুলিকে চৈতন্যেরই বিভিন্ন স্তর বলা
যেতে পারে। সাধারণ মানুষ অজ্ঞান; তারা দেহ
এবং ইন্দ্রিয় ছাড়া পৃথক চৈতন্যময় আত্মার
অস্তিত্ব স্বীকার করে না। এবং এর ইন্দ্রিয়ের
দাস হয়ে কামনাপূর্ণ জীবন যাপন করে। তাদেরই
বলা হয়েছে 'আত্মহনঃ', অর্থাৎ আত্মঘাতী।
এরা পৃথিবীতে যতই শক্তি ও বিত্তের অধিকারী
হোক না কেন, মৃত্যুর পর তাদের গতি সেই বিষাদময়
সূর্যহীন লোকে।
চতুর্থ
শ্লোকে বলা হয়েছে ব্রহ্ম এক ও গতিহীন হয়েও
মন থেকেও অধিকতর বেগবান-- দেবতা বা ইন্দ্রিয়সকল
তাঁকে পায় না। ইনি সকলের আগে গমন করেন।
এই ব্রহ্ম বা আত্মা অন্য সব দ্রুতগামী শক্তিকেও
অতিক্রম করেন। এই ব্রহ্মে প্রতিষ্ঠিত থেকে
প্রাণশক্তি জগতের সমস্ত শক্তিকে ধারণ করে।
আত্মার স্বরূপ বর্ণনা এই মন্ত্রের উদ্দেশ্য।
এখানে
প্রশ্ন হতে পারে যিনি নিশ্চল তিনি আবার
গতিশীল হতে পারেন কি করে। শংকরাচার্য উত্তরে
বলেন-- ব্রহ্মের দুটি ভাব আছে, একটি ব্রহ্মের
নিরুপাধিক ভাব আর একটি সোপাধিক ভাব। প্রথম
রূপে তিনি সত্য, জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ। ইনি
কিছু করেন না। উনার কোন পরিবর্তন নাই। এই
আত্মা বা ব্রহ্ম তাই নিশ্চল ও গতিহীন। মনকে
আত্মার উপাধি বলা যেতে পরে। এই মনযুক্ত
আত্মা সোপাধিক। একেই বেগবান বলা হয়েছে।
মন দেহের মধ্যে থাকলেও ইচ্ছামাত্র মুহূর্তে
ব্রহ্মলোকাদি স্থানে যেতে পরে। কিন্তু মন
যেখানেই যায়, গিয়ে দেখে আত্মা সেখানে আগেই
উপস্থিত। কারণ কোন কিছুই ব্রহ্ম বা আত্মার
অধিষ্ঠান ছাড়া থাকতে পারে না।
দেবতাদের
স্বভাব নিজেকে প্রকাশ করা। ইন্দ্রিয়গুলিও
জ্ঞানের প্রকাশক। এই প্রকাশধর্মের সাদৃশ্য
থাকায় এদেরও 'দৈব' নমে অভিহিত করা হয়েছে।
মনের সঙ্গে যুক্ত না হলে ইন্দ্রিয়রা কোনও
জ্ঞান দিতে পারে না। তাই এরা মনের অধীন।
আবার মন থেকেও আত্মা বেশী বেগবান, তখন ইন্দ্রিয়
থেকেও আত্মা যে অনেক বেশী বেগবান তা বলার
অপেক্ষা রাখে না। তাই বলা হয়েছে কোন দেবতা
বা ইন্দ্রিয় আত্মাকে পায় না বা ধরতে পারে
না।
আত্মা
দেহের ভিতর দিয়ে প্রকাশিত হয় বলে ধারণা
হতে পরে যে মনের সুখ, দুঃখের দ্বারা আত্মাও
ক্লিষ্ট হন। কিন্তু তা নয়।
মনের সুখ, দুঃখ মনেরই বিকার মাত্র। আত্মাকে
এসব স্পর্শ করে না। তাই সব কিছুর মধ্যে
থেকেও আত্মা সব কিছু অতিক্রম করে যান এবং
স্বয়ং ধীর, স্থির, বিকারহীন ভাবে বিরাজ
করেন।
প্রাণের
মূলে রয়েছে বায়ু। এই বায়ু সর্বদা গমন করে
তাই বায়ুকে মাতরিশ্বা বলা হয়েছে(মাতরি অন্তরিক্ষে
শয়তি গমন করে) কিন্তু এই প্রাণবায়ু প্রাণকে
ধরে রাখতে পারে যদি আত্মার সঙ্গে যুক্ত
থাকে। আলাদা ভাবে বায়ুর কোন ক্ষমতা নেই।
আত্মচৈতন্যের সঙ্গে যুক্ত থেকেই এই মাতরিশ্বা
বা প্রাণশক্তি জীবের প্রাণ ধারণের সব ক্রিয়া
সম্পন্ন করে। সহজ কথায় এই বিশ্ব সৃষ্টির
মূলে রয়েছে যে শক্তি তারও মূলে রয়েছে এই
আত্মা-- ব্রহ্ম।
পঞ্চম
মন্ত্রে বলা হয়েছে-- তিনি চলেন আবার চলেন
না। তিনি দূরে, নিকটে, বিশ্বের সব কিছুর
অন্তরে আবার সব কিছুর বাইরেও আছেন। অর্থাৎ
দেশ ও কালের মধ্যে সমস্ত জগৎ, কাছের ও দূরের
সকল বস্তু, অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সব
ঘটনাতেও একই ব্র্হ্মের বিকাশ। অজ্ঞানীর
কাছে তিনি দূরে, জ্ঞানীর কাছে তিনি অন্তরে।
অ- সাধকের কাছে তিনি দুর্গম, ভক্ত সাধকের
কাছে তিনি সহজ।
ষষ্ঠ
মন্ত্র বলছে-- যিনি ব্রহ্ম থেকে তৃণ সব
কিছুকেই নিজের আত্মাতে দর্শন করেন-- অর্থাৎ
আত্মা থেকে পৃথক দেখেন না এবং সকল ভূতের
মধ্যে নিজের আত্মাকেই দর্শন করেন, তিনি
কাউকে ঘৃণা করেন না। জ্ঞানী ব্যক্তি এইরূপই
আচরণ করেন।
'যস্তু সর্বানি ভূতানি আত্মনেব অনুপশ্যতি'।
সপ্তম মন্ত্র-- শুধু উপরোক্ত জ্ঞানই যথেষ্ট
নয়। জ্ঞানের সঙ্গে চাই সাধনা ও সাধনালব্ধ
অনুভূতি। সমস্ত জীবনকে এমন ভাবে চালনা করতে
হবে যেন বুদ্ধি দ্বারা যা উপলব্ধ হয়, অন্তর্দৃষ্টি
দ্বারা যা দেখতে পাওয়া যায় তাই যেন সত্তার
মধ্যে প্রকাশিত হয়। নিজের চিন্তা ভাব ও
অনুভূতিকে সেই অনুসারে চালনা করতে পারলেই
দিব্যচৈতন্যের অধিকারী হওয়া যায়। আর সেই
চৈতন্যই উপলব্ধি করায়, এক স্বয়ম্ভু আত্মা
এই জগৎ প্রপঞ্চে নিজেকে প্রসারিত করেছেন--
এক আত্মাই সমস্ত হয়েছেন-- 'সর্বানি ভূতানি
আত্মৈব অভূৎ।
মানুষ
তার অহং- এর জন্য সব কিছুকে পৃথক বা স্বতন্ত্র
বলে দাবী করে। মানবীয় ধারণাটি এই যে প্রত্যেকেই
জগতে অপরের থেকে সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে।
ভগবান বা ব্রহ্ম কিন্তু সেই দৃষ্টিতে বিশ্বকে
দেখেন না। তাঁর দৃষ্টিতে তিনিই এক মাত্র
সত্তা এবং তিনিই সব ধারণ করে আছেন এবং সকলকে
সমভাবে সাহায্য করেন। তিনিই অনাদিকাল থেকে
কতগুলি নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে এই সমগ্র
সৃষ্টিকে ক্রমবিকাশের পথে, একটি মহান ভাগবতী
সিদ্ধির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন, যার শেষ হয়
সচ্চিদানন্দের বা অমৃতের উপলব্ধিতে। এই
উপলব্ধিই মানুষকে জগতের বহুর সঙ্গে একাত্মতা
অনুভব করায়।
ঈষ
উপনিষদের এটিই সার কথা বা আদেশ-- বিদ্যা
ও অবিদ্যার, এক ও বহুর একত্র মিলন। এই সংসারে
বাস করেও মৃত্যুকে অমৃতে পরিণত করা। কেবল
বুদ্ধি দ্বারা এই উপলব্ধি হয় না। পরিপূর্ণ
সত্তা দিয়ে অনুভূতির মাধ্যমে উপলব্ধি করতে
হবে। এটাই হৃদয়ে সকলের প্রতি প্রেমের উপলব্ধি
আনবে ও হৃদয় আনন্দপূর্ণ হবে তখনই। এই আনন্দই
আপন, পর ভেদ ঘুচাবে। সর্বত্র একই ঈশ্বর
বিরাজিত এই বোধ থেকেই জন্ম নেবে 'আমিই এই
সকল' এবং 'এই সকলই আমি'। এটিই চরম উপলব্ধি
যাকে বলা হয় চরম আনন্দের অবস্থা।
অষ্টম
মন্ত্রে ঋষি আত্মার স্বরূপ বর্ণনা করেছেন,
এই আত্মা বিশুদ্ধ ও জ্যোতির্ময় এবং চৈতন্যস্বরূপ।
চৈতন্য সব কিছু প্রকাশ করে তাই তা জ্ঞানময়
ও আলোময়। আত্মার কোন স্থূল বা সূক্ষ্ম শরীর
নাই। তিনি অক্ষত ও শিরাশূন্য। শরীর না থাকলে
শিরাও থাকে না। মানুষের মত স্নায়ুর শক্তিতে
তিনি কাজ করেন না। তাঁর সৃজনী শক্তি স্বতঃস্ফূর্ত,
তিনি অপাপবিদ্ধ-- পাপ পূণ্যের ঊর্ধে তিনি
বিরাজ করেন। তিনি কবি-- ভূত- ভবিষ্যত- বর্তমানদর্শী।
তিনি মনীষী, মনেরও প্রভু। তিনি পরিভূ--
সকলের উপরে বিরাজমান। তিনি সকলের যথাকর্তব্য
নির্দেশ করে দেন; তিনি সকলকে কর্মফল যথাযথ
ভাবে দান করেন। মোক্ষ লাভের জন্য যার যা
উপযুক্ত তাকে তাই দান করেন।
**
টীকা-- সব কটি সংস্কৃত মন্ত্র উল্লেখ করা
হচ্ছে না এবং বিভিন্ন ভাষ্যকারের ব্যাখ্যাও
উল্লেখ করা হচ্ছে না প্রবন্ধের আকার সংক্ষিপ্ত
করার জন্য।