প্রথম
পাতা
শহরের তথ্য
বিনোদন
খবর
আইন/প্রশাসন
বিজ্ঞান/প্রযুক্তি
শিল্প/সাহিত্য
সমাজ/সংস্কৃতি
স্বাস্থ্য
নারী
পরিবেশ
অবসর
|
বেদ-
উপনিষদ ও সনাতন হিন্দুধর্ম
( ১৪) (অন্যান্য
অনুচ্ছেদ)
কেন
উপনিষদ
কেন উপনিষদের
বিষয়বস্তু বলার আগে দুএকটি কথা বলে নিতে চাই|
সমস্ত উপনিষদগুলির মূল বক্তব্যই হচ্ছে আত্মা
বা পরমাত্মাকে নিয়ে, তাঁর স্বরূপ নিয়ে, এবং
তাঁকে উপলব্ধি করতে গেলে কী উপায়ের অবলম্বন
করতে হবে ইত্যাদি অতি উচ্চ ভাবের আলোচনাই উপনিষদের
ঋষিরা বিভিন্ন উপনিষদের মাধ্যমে বলেছেন; বলেছেন
তাঁদের নিজেদের অন্তরের উপলব্ধির সাহায্যে|
বৃহদারণ্যকে (১/৪/৮) ঋষি বলেছেন: 'যে পরমাত্মা
সর্বাপেক্ষা অন্তরতম, তিনি পুত্রের চাইতে প্রিয়,
বিত্তের চাইতে প্রিয়, আর আর সকল বস্তুর চাইতে
প্রিয়|' উপনিষদের ঋষিরা এই দিব্যচেতনা (যা সাধারণ
মানুষের ধারণারও বাইরে) লাভ করেছিলেন বলেই উদাত্ত
কণ্ঠে মানুষকে অমৃতের পুত্র বলে সম্বোধন করেছেন|
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন উপনিষদ আমাদের 'অভী'
মন্ত্রে দীক্ষা দিয়েছে| রবীন্দ্রনাথও এই অভয়কেই
সাধনা করেছেন| পদে পদে ভীত হওয়া বা ভয়কে প্রশ্রয়
দেওয়াই দুর্গতির একটি প্রধান কারণ| 'নৈবেদ্য'
কাব্যাংশে তাই তিনি বলেছেন:
অস্ত্রে দীক্ষা দেহো রণগুরু|
তোমার প্রবল পিতৃস্নেহ ধ্বনিয়া উঠুক আজি
কঠিন আদেশে|
এ
দুর্ভাগ্য দেশ হতে হে মঙ্গলময়
দূর করে দাও তুমি সর্ব তুচ্ছ ভয়--
লোকভয়, রাজভয়, মৃত্যুভয় আর|
রবীন্দ্রনাথ
উপনিষদের ঋষিদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন
তাঁর জীবন দিয়ে, তাঁর বাণী দিয়ে, তাঁর কাজ দিয়ে,
তাই তিনি বলেন--
তোমারে বলেছে যারা পুত্র হতে প্রিয়,
বিত্ত হতে প্রিয়তর, যা-- কিছু আত্মীয়
সব হতে প্রিয়তম নিখিল ভুবনে,
আত্মার অন্তরতর, তাদের চরণে
পাতিয়া রাখিতে চাহি হৃদয় আমার|
(নৈবেদ্য)
ভারতের
ঋষিরা ধ্যানদৃষ্টিতে যে সব সত্য প্রত্যক্ষ করেছেন,
উপনিষদগুলিতে সেই সব শাশ্বত সত্যই বলা রয়েছে|
রবীন্দ্রনাথ ঋষিদের হৃদয়ের বাণীর উপর নতুন আলোকপাত
করেছেন| ঋষিরা দেখেছেন, প্রকৃতির রাজ্যে আছে
নিয়মের রাজত্ব বা ঋত (heteronomy); মানুষের
জীবন একদিকে নিয়মের অধীন, অন্যদিকে স্বাধীন|
ব্রহ্ম একদিকে সত্যস্বরূপ ও জ্ঞানস্বরূপ, অন্যদিকে
আনন্দস্বরূপ ও অমৃতস্বরূপ| প্রকৃতিতে যিনি নিয়মরূপে
প্রকাশিত, তিনিই মানুষের আত্মার আনন্দরূপে উদ্ভাসিত|
উপনিষদের
আধুনিক ভাষ্যকার রবীন্দ্রনাথ তাই বলেন, 'ঈশ্বরের
ইচ্ছা যে দিকে নিয়মরূপে প্রকাশ পায়, , সেই দিকে
প্রকৃতি-- আর ঈশ্বরের ইচ্ছা যে দিকে আনন্দরূপে
প্রকাশ পায়, সেই দিকে আত্মা| এই প্রকৃতির ধর্ম
বন্ধন আর আত্মার ধর্ম মুক্তি| এই সত্য এবং আনন্দ,
বন্ধন এবং মুক্তি তাঁর বাম ও ডান বাহু| এই দুই
বাহু দিয়েই তিনি মানুষকে ধরে রেখেছেন|
'ছিন্ন পত্রাবলী'- তে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন: 'প্রকৃতির
মধ্যে, মানুষের মধ্যে, আমরা আনন্দ কেন পাই (সে
আনন্দ যতই ক্ষুদ্র, যতই চঞ্চল হোক)-- তার একটি
মাত্র সদুত্তর হচ্ছে-- আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি
ভুতানি জায়ন্তে, আনন্দেন জাতানি জীবন্তি, আনন্দং
প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি| এ কথা নিজে না বুঝলে
কাউকে বোঝাবার জো নেই|'
সত্যিই ব্রহ্ম যে 'আনন্দরূপমমৃতম্' এটা উপলব্ধির
বস্তু| এই সত্য উপলব্ধি করেই গীতাঞ্জলী'- তে
তিনি বলেছেন:
জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ,
ধন্য হল, ধন্য হল মানব-- জীবন|
এই আনন্দবাদ
ঋষিদের চিন্তাধারার অন্যতম বৈশিষ্ট্য| এই আনন্দের
মন্ত্রে যিনি দীক্ষিত, যিনি আনন্দস্বরূপকে জেনেছেন,
তিনি অভয় ও অশোক হয়েছেন-- রবীন্দ্রনাথ তাঁর
নানা রচনায় এ কথা বারবার উদাত্ত কণ্ঠে ঘোণা
করেছেন|
এবারে বলি এই সত্যব্রহ্মের রূপ জানা ও উপলব্ধি
করতে গেলে যে মানসিক প্রস্তুতির দরকার, যে যে
সত্য অভ্যাসের দরকার, বুদ্ধির সূক্ষ্মতা যতখানি
দরকার, বুদ্ধির সঙ্গে হৃদয়ের যোগে যে অনুভূতি
প্রবণ মন দরকার তা হয়তো আমাদের অনেকেরই নেই|
সেটা দোষণীয় নয়| তবে মন তার দরজা জানালা খুলে
রাখলে আলো প্রবেশ করবেই, অন্ধকার দূর করে জটিলতার
গ্রন্থি খুলে সত্যকে পথ করে দেবেই, কঠিনও হয়ে
উঠবে সহজ সরল-- তাই চাই পূর্ণ আত্মসমর্পণ--
সমস্ত অহং ত্যাগ-- তবেই পরমাত্মার জ্যোতিস্পর্শ
পাব আমরা|
কেন উপনিষদের
প্রথম শব্দ 'কেন'| এটি চার ভাগে বিভক্ত-- প্রথম
দু' ভাগ পদ্যে ও শেষ দু' ভাগ গদ্যে লেখা| অনেকের
মতে গদ্যাংশ পদ্যাংশের অনেক আগে রচিত হয়েছিল|
ঈশ উপনিষদের মতো কেনোপনিষদের উদ্দেশ্যও অমরত্ব
লাভ ও ব্রহ্মের সঙ্গে জগতের ও জীবনের সম্পর্ক
স্থাপন| প্রথমে শিষ্য- আচার্য সংবাদের মাধ্যমে
ও পরে একটি রূপকের সাহায্যে ব্রহ্মতত্ত্বের
আলোচনা করা হয়েছে|
উপনিষদটি শুরু হয়েছে কটি প্রশ্নের অবতারণায়|
প্রশ্নগুলো হল: কার ইচ্ছা দ্বারা প্রেরিত হয়ে
মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়বর্গ নিজ নিজ কাজ সম্পন্ন
করে? এদের প্রকৃত কর্তা কে?
এর শান্তিপাঠে
বলা হয়েছে-- "আমার সমস্ত অঙ্গ এবং বাক্,
প্রাণ, চক্ষু, কর্ম, বল ও সমস্ত ইন্দ্রিয় পুষ্টি
লাভ করুক| সমস্তই উপনিষদ প্রতিবাদিত ব্রহ্ম|
আমি যেন ব্রহ্মকে অস্বীকার না করি, ব্রহ্মও
যেন আমাকে প্রত্যাখ্যান না করেন| তাঁহার ও আমার
নিয়ত সম্বন্ধ বিদ্যমান থাকুক| উপনিষদে যে সকল
ধর্মের কথা বলা হয়েছে আত্মনিষ্ঠ আমাতে সেই ধর্মসমূহ
প্রকাশ লাভ করুক| আমাদের বিঘ্নসমূহের (আধ্যাত্মিক,
আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক) শান্তি হোক|"
এই উপনিষদে মোট পঁয়ত্রিশটি মন্ত্র আছে| প্রশ্ন-
উত্তরে এই মন্ত্রগুলি| সব কটি মন্ত্র উল্লেখ
করা হচ্ছে না| কারণ মূল বিষয় ব্রহ্মতত্ত্বই
সব মন্ত্রের বিষয়|
প্রথম
মন্ত্রেই প্রশ্ন করা হয়েছে মানুষের মন কার ইচ্ছায়
নিজ বিষয়ে প্রবেশ করে অথবা কার দ্বারা প্রেরিত
হয়ে মন অভীষ্ঠ বিষয়ে গমন করে? সমস্ত ইন্দ্রিয়বৃত্তির
প্রথমে উৎপন্ন প্রাণ কার দ্বারা নিযুক্ত হয়ে
স্বব্যাপারে প্রবৃত্ত হয়? লোকসকল কার ইচ্ছায়
বাক্য উচ্চারণ করে? কোন দেবতা চোখ ও কানকে নিজ
নিজ বিষয়ে নিযুক্ত করেন?
সাধারণ
ভাবে মানুষ মনে করে মানবমন স্বাধীন স্বপ্রতিষ্ঠিত;
এর কোন পরিচালক বা প্রেরক নেই| নিজে থেকেই মন
চিন্তা, সঙ্কল্প ইত্যাদি কাজ করে| মনই আবার
অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের পরিচালক; অথবা মন, বুদ্ধি
ও ইন্দ্রিয় যুক্ত যে দেহ তাই সব কিছুর পরিচালক|
মানুষ আরও মনে করে যে, ইন্দ্রিয়- মন- বুদ্ধি
দ্বারা যে জ্ঞান লাভ হয় তার উৎপাদক এরাই|
কিন্তু প্রশ্নকর্তার সন্তুষ্টি হল না এই ব্যাখ্যায়|
তাই দ্বিতীয় মন্ত্র ও পরবর্তী কয়েকটি মন্ত্রে
তার উত্তর দিলেন ঋষি|
বললেন যাঁর শক্তিতে কান শোনে, মন মননকার্য করে,
বাগিন্দ্রিয় বাক্য উচ্চারণ করে, তাঁর শক্তিতেই
প্রাণ প্রাণনকার্য করে এবং চোখ দেখে| এটা জেনে
পণ্ডিতরা কর্ণাদি ইন্দ্রিয়, প্রাণ ও মন থেকে
তাঁকে পৃথক করে (অর্থাৎ এই সব আত্মবুদ্ধি ত্যাগ
করে পার্থিব জীবনের ঊর্ধে উঠে) অমৃতত্ব লাভ
করেন| মন, প্রাণ ও ইন্দ্রিয়বর্গের পরিচালক রূপে
যে স্বতন্ত্র চেতন পুরুষ আছেন, তিনিই ব্রহ্ম|
অগ্নি
যেমন সব কিছু দহন করে, কিন্তু নিজেকে দহন করতে
পারে না, সেরকম আমাদের সব ইন্দ্রিয়ই তাদের অন্তরের
শক্তি দ্বারা (চেতন পুরুষ) পরিচালিত হয়ে নানা
বিধিবদ্ধ কাজ করে, কিন্তু ব্রহ্মের এই শক্তিকে
জানতে পারে না| কিন্তু জ্ঞানী লোকেরা দেহ- মন-
বুদ্ধি থেকে আত্মাকে পৃথক বলে জানেন| তাঁরা
জানেন এই সব সমন্বিত দেহ আত্মা নয়| এদের যে
সচেতন বলে মনে হয়, সেটাও ভ্রম| এক চৈতন্যস্বরূপ
আত্মাই সকলের মূলে থেকে এদেরকে চৈতন্য দান করছেন|
এই জেনে জ্ঞানীরা পার্থিব বিষয়ে আসক্ত হন না|
তাঁরা সুখ- দুঃখ, দ্বন্দ্ব- বিরোধ, অজ্ঞান-
মৃত্যুময় জীবনের ঊর্ধে উঠে অমৃতময় মুক্ত দিব্য
জীবন লাভ করেন|
এই আত্মাকে
চোখ দিয়ে দেখা যায় না, বাক্য দ্বারা তাঁকে প্রকাশ
করা যায় না, মনন দ্বারাও তাঁকে চিন্তা করা যায়
না| তিনি ইন্দ্রিয় মনের অগোচর| আচার্য শিষ্যকে
বলছেন পূর্বগামী আচার্যরা এরকমই ব্রহ্ম উপদেশ
দিয়েছেন শিষ্যদের|
প্রশ্ন-- আত্মা যদি বাক্য ও মনের অগোচর হয়,
তবে আচার্যরা কি ভাবে শিষ্যদের আত্মা সম্বন্ধে
উপদেশ দিয়েছেন? এর উত্তর দেওয়া খুব কঠিন| ঋষিরা
বলেন আত্মা ইন্দ্রিয়গোচর বস্তু থেকে আলাদা,
মনের চিন্তা বা অনুমান দ্বারা জানা যায় যে আত্মা
তাদের থেকে পৃথক, সত্যদর্শী ঋষিরা নির্মল বুদ্ধির
সাহায্যে আত্মাকে জানতে পেরেছেন, এবং তাঁরাই
বলেন আত্মা সব কিছুর উপরে, সব বিদিত ও অবিদিত
বস্তুর অতীত| আবারও প্রশ্ন-- তবে কি আত্মা অজ্ঞেয়?
না, তা নয়| আমাদের মলিন ইন্দ্রিয়- মন আত্মার
স্বরূপ উপলব্ধি করতে পারে না| ইন্দ্রিয়, মন
শুদ্ধ ও নির্মল হলে যে বোধ বা অন্তর্দৃষ্টি
(Intuitive Perception) জাগ্রত হয়, তার সাহায্যে
আত্মাকে জানা যেতে পারে| আত্মা যে কেবল জ্ঞেয়
তাই নয়, আত্মাই আমাদের উপাস্য| তৃতীয়- চতুর্থ
পর্যন্ত শ্লোকে এই বিবৃত আছে| পরবর্তী কিছু
শ্লোকে আত্মার উপাসনার কথা বলা হয়েছে|
গুরু শিষ্যকে বলছেন-- সর্বব্যাপী সর্বশক্তিমান
অদ্বিতীয় চেতনপুরুষ জগত ব্যাপিয়া আছেন, তিনিই
আত্মা স্বরূপে আমাদের সমস্ত জ্ঞানের প্রকাশক|
এই ব্রহ্মই উপাস্য| মনন দ্বারা যাকে জানা যায়
না, কিন্তু মন যাঁর দ্বারা নত (অর্থাৎ প্রকাশিত)
তাঁকেই ব্রহ্ম বলে জানবে| মন বলতে সমস্ত অন্তঃকরণকে
বোঝাচ্ছে| কাম, সঙ্কল্প, বিচিকিৎসা ইত্যাদি
অন্তঃকরণের বৃত্তি| এই বৃত্তিসম্পন্ন মন দ্বারা
চৈতন্য- জ্যোতির্ময় আত্মাকে মনন করা যায় না|
মনন করা অর্থ চিন্তা করা, ধারণা করা, নিশ্চিত
করা| ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে বিষয়ানুভূতি হয়
সেগুলিই মন মনন করতে পারে, কিন্তু মন কখনও স্ব-
স্বরূপ আত্মাকে মনন বা প্রকাশ করতে পারে না|
তা ছাড়া মনের নিজস্ব কোন জ্ঞান উৎপাদনের শক্তিও
নেই| আত্মার চৈতন্যজ্যোতি দ্বারা উদ্ভাসিত
হলেই মনের মনন শক্তি জন্মে|
এই আত্মার
আলোকে আলোকিত হয়েই ইন্দ্রিয়সমূহের স্ব স্ব বিষয়ের
জ্ঞান জন্মায়| এই আত্মাই ব্রহ্ম|
এই উপনিষদের শ্রেষ্ঠ কথাটি বলা হয়েছে ত্রয়োদশ
শ্লোকে--
প্রতিবোধবিদিতং মতমমৃতত্ত্বং হি বিন্দতে|
আত্মনা বিন্দতে বীর্যং বিদ্যয়া বিন্দতেহমৃতম্||
যখন ব্রহ্মকে
প্রত্যেক বিষয় প্রতীতির মধ্যে জানা যায়, তখনই
সম্যগ্জ্ঞান হয়| এই জ্ঞান থেকেই ব্যক্তি অমৃতত্ব
লাভ করেন| আত্মার জ্ঞান থেকেই পুরুষ বীর্য লাভ
করেন, বিষয়ের জ্ঞান থেকে নয়| বিদ্যা অর্থাৎ
একত্বের জ্ঞান দ্বারা তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন,
জ্ঞানী ব্যক্তি প্রত্যেক বোধ বা প্রতীতির সঙ্গে
তার প্রকাশক এবং দ্রষ্টারূপে আত্মার বিদ্যমানতাও
উপলব্ধি করেন| তিনি বুঝতে পারেন যে, বোধগুলি
বিভিন্ন ও বিচ্ছিন্ন হলেও এদের বোধ প্রকাশক
এবং দ্রষ্টা আত্মা এক, অখণ্ড, ধ্বংসহীন এবং
নিত্যজ্ঞান স্বরূপ| এক আত্মাই সমস্ত বোধকে ধারণ
করে আছে| এভাবে প্রত্যেক বোধ বা প্রতীতির সঙ্গে
আত্মার যে উপলব্ধি-- এটাই হল যথার্থ জ্ঞান বা
সম্যগ্দর্শন (মতম্)| জাগতিক প্রত্যেক বস্তুর
জ্ঞানের সঙ্গে যিনি ব্রহ্মকে অনুভব করেন তাঁর
জীবন ব্রহ্মময় হয়ে যায় এবং তিনি বিশ্বময় ব্রহ্মকেই
দর্শন করেন| এ জন্যও একে সম্যগ্দর্শন বলা হয়েছে|
এই দর্শন থেকেই অমৃতত্ব লাভ হয় এবং সম্যগ্দর্শনপ্রাপ্ত
ব্যক্তিই শোক, দুঃখ- অজ্ঞান মোহময় পার্থিব জীবনের
ঊর্ধে উঠে অমৃতময় আনন্দময় জীবন লাভ করেন|
আত্মার
জ্ঞান থেকে বীর্য লাভ হয় বলা হয়েছে| এখানে বীর্যের
অর্থ অমৃতত্ব লাভের সামর্থ্য| বিষয়ের জ্ঞান
যে বীর্য দেয় তাতে অমৃতত্ব লাভ হয় না, আমাদের
শোকদুঃখের অতীত করতে পারে না, মৃত্যুভয় নিবারণ
করতে পারে না| একমাত্র আত্মার জ্ঞান থেকেই এই
সামর্থ্য লাভ হয়| কারণ তখনই মানুষ বুঝতে পারে--
'আমি ইন্দ্রিয়-মন-বুদ্ধি বিশিষ্ট দেহ নই, আমি
আত্মা, আমি জন্মমৃত্যুহীন, আমি চৈতন্যস্বরূপ,
আমি দেহাদির মত ধ্বংসশীল জড় পদার্থ নই|' এই
জ্ঞান থেকেই বীর্য লাভ হয় যার দ্বারা শোক- দুঃখ
জয় করা যায়, মৃত্যুভয় নিবারিত হয়|
বিভিন্ন
জীব একই আত্মার বিভিন্ন প্রকাশ, এক পরমাত্মা
আপনাকে বিভিন্ন জীবে, বিভিন্ন রূপে প্রকাশ করেছেন|
এই যে একত্বের জ্ঞান-- এই- ই 'বিদ্যা'| এই বিদ্যালাভেই
মানুষ বুঝতে পারে তার আত্মা স্বরূপতঃ পরমাত্মাই
বটে| সমগ্র বিশ্বে যে পরমাত্মা আপনাকে প্রকাশ
করেছেন, তিনি স্বরূপতঃ জীবের আত্মা থেকে অভিন্ন|
এভাবে যিনি সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে, সমস্ত জীবের
সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করেন তিনিই অমৃতত্ব পান|
Copyright
© 2014 Abasar.net. All rights reserved.
|
অবসর-এ প্রকাশিত
পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।
|