প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বেদ- উপনিষদ ও সনাতন হিন্দুধর্ম ( ১৫) (অন্যান্য অনুচ্ছেদ)

কেন উপনিষদ (দ্বিতীয় ও শেষ ভাগ)

মানুষকে এই পার্থিব বা ইহলোকেই ব্রহ্মকে জানার চেষ্টা করতে হবে, তবেই মানবজীবন পরম সফলতা পাবে। ক্রমঃ উন্নতিশীল প্রত্যেক জীব, এই জীবন পরবত্র্তী উন্নত জীবন লাভের সিঁড়ি। তাই এ জীবনকেই করে তুলতে হবে ব্রহ্মময়, আনন্দময়, অমৃতময় তাঁর উপলব্ধির সাহায্যে।

একটি আখ্যায়িকার (গল্প) সাহায্যে ব্রহ্মকে জানার বোঝার চেষ্টা--

ব্রহ্ম দেবতাদের গৌরববৃদ্ধির জন্য দেবাসুরের যুদ্ধে অসুরদের হারিয়ে দেবতাদের জিতিয়ে দিলেন, কিন্তু দেবতারা মনে করলেন এই বিজয় তাঁদের, মহিমাও তাঁদের।

এ রকম গল্পের অবতারণা কেন? (ব্রহ্ম জ্ঞানীদের কাছে জ্ঞাত নন, অজ্ঞরা তাঁকে জানেন বলে মনে করেন। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেওয়া হল না।) সাধারণতঃ দেখা যায় যা বিজ্ঞাত বা জ্ঞানের মধ্যে, তাই সত্ অর্থাত্ সত্তাবান, আর যা আমাদের জ্ঞানের বাইরে তা অসত্ অর্থাত্ সত্তাহীন। কাজেই অল্পবুদ্ধি লোকেরা মনে করতে পারে ব্রহ্ম যখন অজ্ঞাত তখন ব্রহ্ম নাই। তাদের সন্দেহ দূর করার জন্য এই গল্পের সাহায্য নেওয়া। যে ব্রহ্ম সকলের শাসনকর্তা, ঈশ্বরগণেরও ঈশ্বর, দেবতাদের পরম দেবতা, দেবগণের জয়ের ও অসুরদের পরাজয়ের কারণ-- সেই ব্রহ্ম নেই একথা কী ভাবে বলা যায়?

ব্রহ্ম দেবতাদের মিথ্যা অভিমান জানতে পেরে তাঁদের মঙ্গলের জন্য তাঁদের নিকট আবির্ভূত হলেন। কিন্তু দেবতারা তাঁকে চিনতে পারলেন না। কারণ তাঁদের অজ্ঞানজনিত অহংকারবোধ। (অজ্ঞানের মোহ এবং অহংকার মানুষের চিত্তকে যতদিন অধিকার করে থাকবে ততদিন তার পক্ষে ব্রহ্মকে উপলব্বিì করা সহজসাধ্য হবে না।)

দেবতারা একে একে অগ্নি, বায়ু এবং অবশেষে ইন্দ্রকে পাঠালেন সেই পূজনীয় আবির্ভূত রূপটির কাছে। অগ্নি, বায়ু সবাই পরীক্ষায় হেরে গেছিলেন তাঁর কাছে, কিন্তু ইন্দ্রর সামনে থেকে তিনি অন্তর্হিত হলেন, কারণ ইন্দ্র সত্যি জিজ্ঞাসু ছিলেন। নিজের ক্ষমতার পরিচয় দেওয়া তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না। তাই তাঁর অহংকার চূর্ণ করার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু তবু ব্রহ্ম তাঁর জ্যোতির দর্শন দিলেন না ইন্দ্রকে। কারণ, অহংকার না থাকলেও তাঁর চিত্তে নির্মল বিবেকবুদ্ধির অভাব ছিল। তাই ব্রহ্ম উমারূপিণী ব্রহ্মবিদ্যাকে পাঠিয়ে দিলেন, অর্থাত্ ইন্দ্রের হৃদয়ে নির্মল বিবেকবুদ্ধির উদয় হল।


স তস্মিন্নেবাকাশে স্ত্রিয়মাজগাম
বহুশোভমানামুমাং হৈমবতীম্।
তাং হোবাচ-- কিমেতদ্ যক্ষমিতি।

 


ইন্দ্র আকাশে স্ত্রীরূপিণী বহুশোভায় শোভান্বিতা হৈবতী উমাকে দেখতে পেয়ে, তাঁর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন এই যক্ষ (পূজনীয় আবির্ভূত রূপটি) কে?
এখানে ব্রহ্মবিদ্যাকে বহুশোভমানা স্বর্ণালঙ্কারভূষিতা উমা বলা হয়েছে। এই বিদ্যা সব বিদ্যার শ্রেষ্ঠ। এই আধ্যাত্মজ্ঞানই ব্রহ্মকে জানবার উপায়।
নির্মলচিত্ত সাধক যখন যথার্থ জিজ্ঞাসু হয়ে ব্রহ্মকে জানার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী হন তখনই তাঁর চিত্তে এই ব্রহ্মবিদ্যা আবির্ভূত হন। এই জ্ঞান ইন্দ্রিয়মনবুদ্ধি জাত নয়, বিচারবিতর্ক দিয়ে এই জ্ঞান লাভ হয় না। চিত্ত নির্মল ও শান্ত হলে তর্কবিতর্কের কোলাহল থেমে যায় ও অন্তর্দৃষ্টি জাগে এবং সেই দৃষ্টিই ব্রহ্মকে উপলব্বিì করায়।

এই রূপক গল্পটির তাত্পর্য হল--

(১) এই জগতে দেবতারই সবচাইতে শক্তিশালী, তাঁরাই সমস্ত প্রাকৃতিক শক্তির প্রভু ও পরিচালক। কিন্তু তাঁদের নিজস্ব কোন শক্তি নাই। ব্রহ্মের শক্তিতেই তাঁরা শক্তিমান।

(২) এ জগতে দুটো বিরোধী শক্তি কাজ করছে, একটি জগতকে রক্ষা করে, কল্যাণের পথে উন্নতির পথে নিয়ে যায়-- এটাই দৈবী শক্তি। অন্যটি জগতকে অকল্যাণের পথে, ধবংসের পথে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে-- এটাই আসুরী শক্তি। এই দুই বিরোধী শক্তির সংগ্রাম সর্বদা সর্বত্র চলছে। এটাই দেবাসুরের সংগ্রাম রূপে কথিত।

৩৪ নং শ্লোকে বলা হয়েছে--

তস্যৈ তপো দমঃ কর্মেতি প্রতিষ্ঠা,
বেদাং সর্বাঙ্গানি, সত্যমায়তনম্।

অর্থাৎ-- তপস্যা (শরীর, মন ও ইন্দ্রিয়ের সাধন, অর্থাত্ চিত্তের একাগ্রতা) দম ( অন্তরিন্দ্রিয় ও বহিরিন্দ্রিয়ের সংযম), কর্ম (নিস্কাম কর্ম) -- এই সব উপনিষদের প্রতিষ্ঠা অর্থাত্ পদ স্বরূপ। চার বেদ উপনিষদের বিভিন্ন অঙ্গ, সত্য এর আয়তন। (শরীর বা আশ্রয়)।

এখানে ব্রহ্মবিদ্যাকে মানুষরূপী বলে কল্পনা করা হয়েছে। মানুষ যেমন পায়ের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, পা না থাকলে দাঁড়াতে পারে না, সেরকম উপনিষত্ (ব্রহ্মবিদ্যা) এদের উপর প্রতিষ্ঠিত। এদের অভাবে ব্রহ্মবিদ্যাও থাকতে পারে না। মানুষ যখন শ্রদ্ধার সঙ্গে জিজ্ঞাসু হয় ভগবানকে জানবার জন্য, তখন সে জ্ঞান লাভের যোগ্যতা অর্জন করে এবং অবশেষে ভগবত্ কৃপায় ব্রহ্মজ্ঞান লাভে সমর্থ হয়। কিন্তু অধিকাংশ লোকই বস্তুবাদী, ভোগ, সুখ, আরাম, বিলাস, ব্যসনে এতই ব্যস্ত যে তাদের চিত্তে ভগবানকে জানবার কোন ইচ্ছাই জাগে না। অহংকার ও অজ্ঞানতাই তাদের মূলধন। আর সেই ধন শুধু অন্ধকারের আবরণ দিয়ে ঢেকে রাখে তাদের চিত্তকে। অন্ধকারেই সমাপ্ত হয় তাদের মানবলীলা।

কঠ উপনিষদে নচিকেতার উপাখ্যানের মাধ্যমে বলা হয়েছে উপনিষদের মূল তত্ব। প্রশ্ন উপনিষদে মোট ছয়টি প্রশ্নের মাধ্যমে বলা হয়েছে জগত্- সৃষ্টির কারণ, ওঙ্কার উপাসনার ফল ইত্যাদি।

মুণ্ডক উপনিষদ আলোচনা করেছে অজ্ঞানের ফল, সর্বজীবের উদ্ভব ও লয়ের কারণ, আনন্দ ও অমৃতরূপ আত্মা, আত্মদর্শন, অহংজ্ঞানের বিনাশ ইত্যাদি।

মাণ্ডুক্য উপনিষদ বারোটি মন্ত্রে বলেছে ওঙ্কারের গুরুত্ব ও তার মাধ্যমে ব্রহ্মোপদেশ।

তৈত্তিরীয় উপনিষদ বর্ণনা করেছে-- অন্ন থেকে প্রজাগণের উত্পত্তির বিষয়, পঞ্চকোষতত্ব, ব্রহ্মানন্দ মীমাংসা ইত্যাদি।

ঐতরেয় উপনিষদ জানায় জগত্সৃষ্টি ও লোকপালের উদ্ভব, সৃষ্টির বিবর্তনক্রম, প্রাণের দেহপ্রবেশ, জীবাত্মার তিন জন্ম, প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম ইত্যাদি।

শেতাশ্বতর উপনিষদ বর্ণনা করেছে-- ঈশ্বরের সর্বেশ্বরত্ব, দেব ও গুরুতে ভক্তি অর্পণ ইত্যাদি।

ছান্দোগ্য উপনিষদ আমাদের জানায় ওঙ্কার উপাসনা , গায়ত্রী অবলম্বনে ব্রহ্মচিন্তা, ব্রহ্মের সর্বেশ্বরত্ব, সত্যকাম- জবালার কাহিনী, বিশ্বাত্মা ও জীবাত্মার একত্বজ্ঞান, ইন্দ্র- বিরোচন সংবাদ ইত্যাদি।

বৃহদারণ্যক উপনিষদ জানায় যাজ্ঞবল্কের দার্শনিক মত, অশ্বমেধ যজ্ঞের বর্ণনা, আত্মা সর্বাপেক্ষা প্রিয়, জগত্, জীব ও ব্রহ্মের একত্ব, মৈত্রেয়ীর উক্তি-- অমৃতই কাম্য, জনক- যাজ্ঞবÅ সংবাদ, আত্মা স্বয়ংজ্যোতি ও অদ্বৈত, আত্মার উত্ক্রমণ, পুনর্জন্ম ও মুক্তি, গায়ত্রী মন্ত্রের ব্যাখ্যা ইত্যাদি।

কৌষীতকী উপনিষদ বলে-- ব্রহ্মলোকের বর্ণনা, প্রাণতত্ব, বালাকি- অজাতশত্রু সংবাদ ইত্যাদি।

আমরা এই বিজ্ঞান ও প্রয়ুক্তিবিদ্যার উন্নতজগতে এখনও উপনিষদের এই মন্ত্রটি উচ্চারণ করতে পারি--

ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবাঃ
ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্যজত্রাঃ।
স্থিরৈরঙ্গৈস্তুষ্টুবাংসস্তনূভিঃ।
ব্যশেম দেবহিতং যদায়ুঃ।।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।

হে দেবগণ, আমরা কর্ণ দ্বারা যেন কল্যাণপ্রদ বাক্যসমূহই শ্রবণ করি, হে যজনীয় দেবগণ, আমরা চক্ষু দ্বারা যেন মঙ্গলকর বিষয়সমূহ দর্শন করি। স্থির দৃঢ় শরীর এবং অবয়বের দ্বারা তোমাদের স্তুতি করিয়া যেন দেবগণের বিহিত আয়ু প্রাপ্ত হই। আমাদের ত্রিবিধ বিঘ্নের শান্তি হউক।

আলোচনা সমাপ্ত করি এই মন্ত্রে--

ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাৎ পূর্ণমুদচ্যতে
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে।
ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।

(সমাপ্ত)

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।