প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বেদ- উপনিষদ ও সনাতন হিন্দুধর্ম - (৩) (অন্যান্য অনুচ্ছেদ)

বৈদিক ধর্ম আসলে কী ছিল, তার যথার্থ মর্ম কি,তা থেকে বর্তমান হিন্দু ধর্ম কী করে সৃষ্টি হল তার একটা রুপরেখা এবার আঁকার চেষ্টা করি।
আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগের আলোচনায় দেখলাম যে বেদের দেব দেবীরা সব অচেতন জড় পদার্থ। বেদে কেন এরকম জড় অচেতন পদার্থের উপাসনা? কোথা থেকে এই উপাসনার উত্পত্তি, কারণই বা কী?

আশ্চর্যের কথা এই যে কেবলমাত্র বৈদিক হিন্দুরাই এই সব ইন্দ্রাদির উপাসনা করতেন না, পৃথিবীর অনেক সভ্য ও অসভ্য জাতি ও এদের উপাসনা করত এবং এখনো অনেকে করে।তাদের মধ্যে দেবতাদের নাম ভিন্ন, কিন্তু উপাস্য দেবতা একই। প্রাচীন আর্য জাতি থেকে জাত যোন, রোমান প্রভৃতি জাতিরা কেবলই নয়, হিন্দুরা যে জাতি থেকে উত্পন্ন হয়েছে, তারাও সেই জাতি থেকে জাত এবং একই দেবতার উপাসনা যে ওদের মধ্যেও প্রচলিত থাকবে-- তা খুব একটা আশ্চর্যের কথা নয়।
খুবই অবাক করা বিষয়টি এই, যে সব জাতির সঙ্গে আর্যবংশীয়দের বংশগত, স্থানগত বা অন্য কোনো রকম ঐতিহাসিক সম্বন্ধ নেই, তারাও এই সব ইন্দ্রাদি দেবতার উপাসনা করত দিবাসীদের মধ্যেও এই সব দেবতাদের উপাসনা প্রচলিত ছিল, ইতিহাস ঘাটলে এর প্রমাণ পাওয়া যায়, যাদের ইচ্ছে তারা পড়ে নিতে পারেন, লেখাটিকে এই ব্যাপারে উদাহরণ দিয়ে আর বড় করলাম না।


বেদে দ্যাবা ও পৃথিবীর কি তাত্পর্য -

আকাশের একটি নাম দ্যু বা দ্যৌ। এই দ্যু বা দ্যৌ বেদে বন্দিত হয়েছেন কিন্তু আকাশের কোন রূপ তা বলা নেই। আকাশের মত পৃথিবীরও স্তোত্র আছে বেদে। আকাশ দেব এবং পৃথিবী দেবী বলে স্তুত হয়েছেন একই সাথে। আকাশ তাই পুরুষ এবং পৃথিবী স্ত্রী। এঁরাই জীবের পিতা মাতা বলে ব্যাখ্যা পেয়েছেন। আমরা আজও পৃথিবীকে মা বলি, কিন্তু আকাশকে পিতা বলে ডাকতে ভুলে গেছি। বৈদিক ঋষিরা আকাশকে পিতা ও পৃথিবীকে মাতা বলে সম্বোধন করতেন। এই পিতা গ্রীকদের গ্রীকদের zeus pater এবং রোমানদের Jupiter|

এদিকে হিন্দু দর্শনশাস্ত্র মতে আকাশ পঞ্চভূতের একটি। এটি আদিম। আকাশ থেকে বায়ু, তা থেকে তেজঃ, তেজঃ থেকে জল, জল থেকে ক্ষিতি। ঋকবেদ সংহিতায় এ সব কথা নেই, যেহেতু দর্শনশাস্ত্র এর বিষয়বস্তু নয়। কিন্তু এ কথা বলা আছে যে আকাশ থেকে সর্বভূতের উত্পত্তি।
তাই ইন্দ্র আকাশের বৃষ্টিকারক মূর্তি, বরুণ আবরক মূর্তি, অদিতি অনন্ত মূর্তি, দ্যু বা দ্যৌ জনক মূর্তি, পৃথিবী মাতৃ মূর্তি| বিজ্ঞানসম্মত ভাবে আকাশই সব কিছুর সৃষ্টিকারক এটা যুক্তিগ্রাহ্য না হলেও আদি পৃথিবীতে এটাই সবাই স্বীকার করেছিল। সব আদি ধর্মে আকাশ জনক, অনেক ধর্মে আকাশই ঈশ্বর।

বেদে দ্যৌ স্বামী ও পৃথিবী স্ত্রী। প্রাচীন গ্রীকদের মধ্যেও আকাশ স্বামী ও পৃথিবী স্ত্রী। গ্রীক পুরাণে দ্যৌ শব্দইJews কিন্তু তিনি পৃথিবীর স্বামী নন। গ্রীক পুরাণে Ouranos দেবের পত্নী Gaia দেবী। Gaia সংস্কৃতে 'গো' হয়েছে এবং অর্থ পৃথিবী, সবাই জানেন। Ouranos 'দ্যৌ' নন, তিনি বরুণ। আবার বরুণও আকাশ- সেই অর্থে গ্রীক পুরাণেও আকাশ পৃথিবীর স্বামী। উত্তর আমেরিকা, আফ্রিকার অনেক জাতির মধ্যেই আকাশদেবের পূজা প্রচলিত ছিল। চীন জাতিরাও আকাশকে জনক বলে প্রতিষ্ঠিত করেছিল এবং আকাশবাচক শব্দকেই ঈশ্বরবাচক শব্দে পরিণত করেছিল। এভাবেই আর্য জাতি ও অন্যান্য অনেক জাতির মধ্যে আকাশ পিতা, পৃথিবী মাতা ও আকাশের স্ত্রী এবং এই দুইএর বিবাহে বা সংযোগে জীব সৃষ্টি এই ধারণা প্রচলিত হয়। প্রকৃতি ও পুরুষ এই তত্ব হয়তো এই ধারণারই ফসল।
এই আলোচনাশেষে দুটি মূল কথা উঠে আসে:

১) বিভিন্ন বৈদিক দেবতারা বিশ্বের নানা বিকাশ মাত্র।
২) কেবল ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর প্রায় সব স্থানেই এদের উপাসনা প্রচলিত ছিল।
আগেও বলেছি আবারও বলি সঙ্গতি রাখার জন্য, কেন এ রকম ধারণাগুলি হয়েছিল এবং উপাসনা ব্যাপারটি কী জানতে পারলে ধর্মের উত্পত্তির একটা সঙ্গত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। প্রথম প্রশ্ন - ধর্মের উত্পত্তি। পৃথিবীতে সব মানুষেরই একটা ধর্ম আছে। বিভিন্ন ধর্মপ্রচারকরা প্রচলিত ধর্মের উন্নতি সাধন করেছেন, সৃষ্টি করেন নি। ধর্মের সংস্কারক আছেন কিন্তু স্রষ্টা দেখা যায় না। সৃস্ট ধর্ম নেই। সব ধর্মই পরম্পরাগত, কখনও তা সংস্কৃত বা মার্জিত।

পৃথিবীতে জীব কী করে এবং কোথা থেকে এল এই প্রশ্ন যেমন আছে তেমনি আছে ধর্মের উত্পত্তির প্রশ্ন। জীব সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক উত্তরের মত ধর্ম সৃষ্টিরও একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকা দরকার। বিজ্ঞানের প্রথায় বিশেষের লক্ষণ দেখে সাধারণ লক্ষণ নির্দেশ করা হয়।


চৈতন্যবাদ - ঋষি বঙ্কিমের মতে এই প্রণালীতে ধর্মের উত্পত্তি সাধনে ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা নানা মত ব্যক্ত করেছেন যা তাঁর কাছে সব সময় গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় নি। তাঁর মত বা পথ অনুসন্ধান করে এই প্রসঙ্গটির আলোচনা করি। তিনি বলেছেন ধর্মের মূল জানতে গেলে সভ্য জাতির ধর্মের মধ্যে অনুসন্ধান না করে অ- সভ্য জাতির ধর্মের অনুসন্ধান করতে হবে কারণ সভ্য জাতির ধর্মের প্রথম অবস্থা আর নেই, তার ধর্ম অনেক পুরনো। যেমন, গাছ কী করে হল, তা অঙ্কুর দেখে যেমন বোঝা যায় বৃদ্ধ বৃক্ষ দেখে তা বোঝা যায় না সেরকম।

মানুষ সভ্য হবার আগে যতই অমার্জিত থাকুক না কেন একটা কথা বুঝতে পারত সহজেই যে শরীর থেকে চৈতন্য পৃথক একটি বস্তু। জীবিত অবস্থায় একটি মানুষ খাচ্ছে, চলছে, সব কাজ করছে, কিন্তু মরে গেলে আর কিছুই সে করতে পারছে না। মৃত অবস্থায় তার শরীর জীবিতাবস্থার মতই আছে, সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিদ্যমান, কিন্তু সে তার কোনটাই ব্যবহার করতে পারছে না। একটা কিছু তার আর নেই, যার বলে সে এতদিন সচল ছিল। তাই অসভ্য মানুষও বুঝতে পারত শরীর ছাড়াও জীবে আর একটা কিছু আছে যার শক্তিতে জীবত্ব, শরীরের শক্তিতে জীবত্ব নয়। সভ্য হবার পর মানুষ এর নাম দেয় প্রাণ বা জীবন। এটাও সেই আদিম মানুষ বুঝতে পারে গাছপালাতে এমনই একটা কিছু আছে যা থাকলে ফুল হয়, ফল হয়, নতুন পাতা গজায়, সেটা না থাকলে গাছ শুকিয়ে মরে যায়। অতএব গাছপালারও জীবন আছে। তবে মানুষের সঙ্গে পার্থক্য গাছপালা ইচ্ছা দ্বারা কোন কাজ করতে পারে না যেমনটি মানুষ পারে- চলাফেরা, শব্দ করা ইত্যাদি। অতএব আদি বা অ- সভ্য মানুষ জ্ঞানের সিঁড়ির আরো এক ধাপ উঠল। মানুষ সভ্য হয়ে এই বিশেষ অবস্থার নাম দেয় 'চৈতন্য'। মানুষ মারা গেলে তার শরীর কিছুক্ষণ অন্তত থাকে, কিন্তু চৈতন্য থাকে না। তখনই মানুষ বুঝতে পারে চৈতন্য একটা আলাদা বস্তু।

এখন আদি মানুষের মনেও এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই জেগেছিল যে শরীর না থাকলেও এই চৈতন্য থাকে কি না। স্বপ্নে শরীর এক জায়গায় থাকে, চৈতন্য আর এক স্থানে যায়, বেড়ায়, নানা কাজ করে- এ রকম উপলব্ধি প্রায় সকলেরই হয়। আর একটি - ধারণা মানুষ সময় সময় ভুত দেখে- তা মস্তিষ্কের রোগ বা ভুলবশতঃ যে কারণেই হোক, আদি মানুষ ভাবত মরা মানুষের ভুত যখন কেউ কেউ দেখে তখন শরীর গেলেও চৈতন্য থাকে। এই আদি বিশ্বাস থেকেই পরলোকে বিশ্বাস এবং ধর্মের সূত্রপাত হয় এখান থেকেই।

আদিম মানুষ, যাকে নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে দেখে, তারই চৈতন্য আছে এই বিশ্বাস করে। জীব আপন ইচ্ছায় কাজ করে তাই তার চৈতন্য আছে, জীব ছাড়া প্রকৃতির আর সব নিজ ইচ্ছায় কাজ করতে পারে না, তাই তাদের চৈতন্য নেই। কিন্তু প্রকৃতিরও অনেক কিছু হঠাত্ ক্রিয়াশীল হয়ে উঠে- যেমন হঠাত্ অচেতন জড় পর্বত থেকে আগুন বেরোতে থাকে এবং ভয়াবহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। নদী রাতদিন ছুটে চলেছে, কিন্তু কখনও দুকুল ভাসিয়ে ভয়াবহ রূপ ধারণ করে সর্বনাশ করে, কখনও বা পরিমিত জলসম্পদের সাহায্যে শস্য উত্পাদনে মানুষকে সাহায্য করে। আর সূর্য- সে তো আপন নিয়মে, ঠিক সময়ে পূর্বদিকে উদয় হচ্ছে আবার নিদ্র্দিষ্ট পথে সমস্ত দিন ঘুরে পশ্চিমে চলে যাচ্ছে। জগতে যা কিছুই ঘটুক না কেন তার এই নিয়মের কোন পরিবর্তন নেই।

আকাশে মেঘের সঞ্চার হয়, মেঘ এসে বৃষ্টি করে, বৃষ্টি হয়ে গেলে মেঘ থাকে না। আবার কখনও বা মেঘ এলেও বৃষ্টি হয় না। প্রয়োজনীয় সময়ে সচরাচর বৃষ্টি হবার ফলে শস্য হয়, আবার কখনও বৃষ্টি সঠিক সময়ে আসে না; শস্য উত্পাদনে অসুবিধা হয়, খরা দেখা দেয়। এ সবই পর্বত, নদী, আকাশের ইচ্ছানুযায়ী ক্রিয়া বলেই আদিম মানুষ ভাবত এবং এদেরকে সচেতন বলে মনে করত। ঝড়, বায়ু, বজ্র, বিদ্যুত্ সম্বন্ধেও এরূপ ধারণাই জন্মায়। প্রকৃতি বিজ্ঞান তখনও তার আয়ত্বে আসে নি।

এভাবেই জড়ে চৈতন্য আরোপ - ধর্মের দ্বিতীয় ধাপ। একে অনেকেই প্রকৃত ধর্ম না বলে উপধর্ম বলতে পারেন - তবে উপধর্মই সত্য ধর্মের প্রথম অবস্থা। বিজ্ঞানের প্রথম অবস্থা যেমন ভ্রমজ্ঞান, ইতিহাসের প্রথম অবস্থা যেমন লৌকিক উপন্যাস বা উপকথা, ধর্মের প্রথম অবস্থাও তেমনি উপধর্ম। অন্য মত আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু উত্তরে বলা যায় প্রথম অবস্থায় বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, কাব্য, সাহিত্য, সব বিদ্যাবুদ্ধি, সব কিছুই নিম্নমানের ছিল তাই ধর্মের প্রথম অবস্থায় শ্রেষ্ঠ তত্বজ্ঞান থাকবে- এমন আশা করা অন্যায়।

তার পর ধর্মের তৃতীয় ধাপ - যে সব জড় পদার্থে মানুষ চৈতন্য আরোপ করল, তাদের মধ্যে অনেকগুলি প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী, তেজস্বী বা সুন্দর। আগ্নেয়গিরির কাণ্ডকলাপ দেখে মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে যায়, বুদ্ধি লুপ্তপ্রায় হয়। নদীর মঙ্গলময়ী শক্তির সঙ্গে অতি ভয়ঙ্করী রূপ দেখে মানুষ ভীত হয়। ঝড়, বায়ু, বৃষ্টি, বজ্র, বিদ্যুত, অগ্নি- এদের থেকে বলবান আর কে হতে পারে? এদের থেকেও শ্রেষ্ঠ সূর্য- এর প্রচণ্ড তেজ, গতি, শক্তি, আলো সবই বিস্ময়কর।ইনি না থাকলে জগতের কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে যায়, তাই তিনিই জগতের রক্ষক। এই মহিমাময় জড় পদার্থের ক্রিয়াকলাপে মানুষের মনে ভয় ও প্রীতি দুই জাগরিত হল। এরা কেবল শক্তির আধার তা নয়। মানুষ অভিজ্ঞতায় জানে যে চৈতন্যযুক্ত সে তুষ্ট থাকলে মঙ্গল, রুস্ট হলে অনিষ্টকারী। তাই আদি মানুষ ভাবে এ সব মহাশক্তিধর জড় পদার্থরাও আসলে চৈতন্যযুক্ত এবং এদের সন্তুষ্ট রাখাই মঙ্গলদায়ক। এর থেকেই শুরু উপাসনার - ধর্মের তৃতীয় ধাপ। এই জন্যই সব দেশে সূর্য, চন্দ্র, বায়ু, বরুণ, ঝড়, বৃষ্টি, অগ্নি, আকাশের উপাসনা। এই জন্যই বেদেও এদের উপাসনা।

উপাসনা আবার দু রকম। যার শক্তিতে ভীত হয় মানুষ কিংবা যার শক্তিতে সুফল লাভ করে বা আশা করে, তারই উপাসনা করে। তা ছাড়াও আরও অনেক বস্তু আছে যাদের ভয়দায়ক শক্তি নেই, কিন্তু মানুষের কল্যাণের শক্তি আছে, তাদেরও উপাসনা বা আদর বা সেবা করে মানুষ। উপকারী অশ্ব, গৃহরক্ষক কুকুর, অচেতন ওষধি, ছায়াকারক বট,স্বাস্থ্যদায়ক শেফালী ফুল বা তুলসী গাছ ইত্যাদিকে মানুষ যত্ন করে, আদর করে, সেবা করে। গাভী দুধ দেয়, হাল বয় বলদ কৃষিকার্যে- তাই এরা আরও বেশী উপকারী। ধার্মিক মানুষকে সকলেই ভক্তি করে। এ সবও এক জাতীয় উপাসনা। এরই বশবত্র্তী হয়ে হিন্দু ছুতার কুড়াল পূজা করে, কামার হাতুড়ি পূজা করে, লেখক লেখনী পূজা করে, ব্রাহ্মণ পুঁথি পূজা করে।
আবার যা সুন্দর, তা কোন উপকারে না এলেও মানুষ তাকে খুবই ভালোবাসে। আসলে এটা উপাসনা নয়, কেবলই আদর। বৈদিক ধর্মে অনেক সময় তাই হয়েছে। একটু বিস্তার করলে ভালো বোঝা যাবে। যাই শক্তিশালী তাই নৈসর্গিক পদার্থের সাথে কোন বিশেষ সম্বন্ধযুক্ত বলেই শক্তিশালী। অঙ্গারের সঙ্গে অম্লজানের সম্বন্ধই অগ্নির উত্পত্তির কারণ। তাপ, জল ও বায়ু এই তিন পদার্থ পরস্পরের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কযুক্ত বলে মেঘের শক্তি। এই জাগতিক পদার্থের পরস্পরের সঙ্গে যে সম্বন্ধ, তারই বৈজ্ঞানিক নাম সত্য। সত্যই শক্তি। জড়শক্তি, আধ্যাত্মিকশক্তি সম্বন্ধে এই কথা সত্য। যা হিতকর, শক্তিশালী হোক বা না হোক, তাই শিব, সুন্দর, সৌম্য। এই সত্য, শিব ও সুন্দর এই তিন ভাবই মানুষের উপাস্য। এই উপাসনা আবার দু রকম:

১) অচেতন উপাস্যকে সচেতন মনে করে উপাসনা- আদিম মানুষ তাই করত।
২) অচেতনকে অচেতন বলেই জ্ঞানে রেখে উপাসনা। গ্যেটে, ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিলেন এই রকম জড়োপাসক।

এই দু রকম উপাসনাই বেদে আছে।

এই উপাসনা আবারও দু রকম- সকাম ও নিষ্কাম।

১) যা ফলপ্রদ, তার কাছে ফল কামনায় উপাসনা।
২) যাকে ভালোবাসি বা যার কাছে কৃতজ্ঞ তাকে প্রশংসা করা বা আদর করা।
প্রথমটি সকাম, দ্বিতীয়টি নিষ্কাম। এই নিষ্কাম উপাসনা কেবল ঈশ্বর সম্বন্ধেই হতে পারে এমন নয়, জড় বস্তু সম্বন্ধেও হতে পারে।

অহিন্দুরা বিশ্বাস করে যে, হিন্দুরা গোরুর উপাসনা করে। গোরু ঘাস খায় আর দুধ দেয়, তা ছাড়া আর কিছু পারে না এটা সব হিন্দুই জানে। তবে সাধারণ হিন্দুর বিশ্বাস, গোরুকে যত্ন করলে, আদর করলে দেবতা প্রসন্ন হবেন। এ কথাটা ততটা অসঙ্গত নয়। যা উপকারী, তাই আদরের- তার আদর করাই ধর্ম এবং তা ঈশ্বর অনুমোদিত। শুক্লযজুর্বেদসংহিতায় দশপূর্ণমাস যজ্ঞে ব্যবহৃত গোরু সম্পর্কিত কটি এই রকম আদরের কথা শ্লোকে আছে, তার বাংলা অনুবাদ:
- 'হে গাভীগণ, আমরা শ্রেষ্ঠতম কার্য আরম্ভ করিয়াছি। তত্সাধনার্থ সবিতা দেবতা তোমাদিগকে প্রভুত তৃণবন প্রাপ্ত করান।'
- 'হে বত্সগণ, তোমরা ক্রীড়াপরবশ, সুতরাং বায়ুবেগে দিকদিগন্তরে ধাবমান হও। বায়ুদেবতাই তোমাদিগের রক্ষক।'
ঐ যজ্ঞের দুধকে সম্বোধন করে বলা হচ্ছে_'হে দুধ, যজ্ঞীয় সুপবিত্র শতধার এই পবিত্রে তুমি শোধিত হও। সবিতা দেবতা তোমাকে পবিত্র করান' ইত্যাদি। এই শ্লোক কটির অনুবাদ শ্রীযুক্ত সত্যব্রত সামশ্রমী- কৃত বাজসনেয়ীসংহিতার অনুবাদ থেকে গৃহীত)

অন্য একটি যজ্ঞেও হাতাকে বলা হচ্ছে- 'হে দর্বি, তুমি অন্নে পরিপূর্ণ হইবার অপূর্ব শোভা ধারণ করিয়াছ। এই আকারেই ইন্দ্রদেবতার সমীপে গমন কর। ভরসা করি পুনরাগমন কালেও ফলে পরিপূর্ণ হইয়া এইরূপ শোভিত হইবে'।
অগ্নিষ্টোম যজ্ঞে প্রথমেই যজমানের চুল ও দাড়ি ক্ষুরের দ্বারা কেটে ফেলতে হয়। আগে কুশ কেটে ক্ষুরের ধার পরীক্ষা করতে হয়। সেই সময় কুশকে বলা হয় 'হে কুশ সকল! অতি তীক্ষ্ণধার ক্ষুরের দ্বারা ক্ষৌরে যে কষ্ট হইতে পারে, তাহা হইতে ত্রাণ কর। অর্থাত্ তোমাদিগের দ্বারাই তাহা পরিক্ষীত হউক'। পরে ক্ষুরকে বলা হয়- 'হে ক্ষুর, তুমি যেন ইঁহার রক্তপাত করিও না'। এ ভাবে অনেক জড় পদার্থের উপাসনা আছে, সেগুলি চৈতন্যবিশিষ্ট নয় জেনেও। করা হয়েছে আদর করে। ঋকবেদে ইন্দ্রাদি দেবের স্তুতি সবও এই রকম আদর বা প্রশংসা মাত্র।
বৈদিকসংহিতায় যে উপাসনা আছে তার অধিকাংশই সকাম, এবং উপাস্যেরা চৈতন্যবিশিষ্ট দেবতা বলে বর্ণিত হয়েছেন। এই সব জড়শক্তির প্রশংসা পদ্ধতি প্রচলিত হবার পরে শব্দের আধিক্যে তার প্রকৃত তাত্পর্য হারিয়ে গেল। 'জগতের রাজা' এবং 'জীবগণের অধীশ্বর' ইত্যাদি বাক্যের যে যথার্থ অর্থ- বৃষ্টি থেকেই জগতের ও জীবের রক্ষা, লোকে এটা ভুলে গেল ক্রমশঃ এবং ইন্দ্রকে চৈতন্যবিশিষ্ট রাজা বা জগতের অধীশ্বর বলে মনে করতে আরম্ভ করল। তখনই জড়শক্তির নিষ্কাম প্রশংসার স্থলে সকাম উপাসনা আরম্ভ হল। যা চিত্তের ভালো বৃত্তিগুলির অনুশীলন ছিল তা বহু দেবতার উপধর্মরূপে পরিণত হল।
এবারে বলা যায় বৈদিক ধর্মের উত্পত্তির একটি মোটামুটি সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া গেল উপরোক্ত আলোচনার সূত্রে।

তবে বৈদিক সুক্তে একেশ্বরবাদেরও উল্লেখ পাওয়া যায়। উপরে বলা সুক্তগুলি থেকেই অনুমান করা যায়, ওগুলি আদিম অবস্থার। মধ্য অবস্থায় সচেতন ইন্দ্রাদির উপাসনাত্মক সুক্তগুলি লেখা হয়েছিল। আর সম্ভবত শেষ অবস্থায় রচিত হয় একেশ্বরবাদের সুক্তগুলি।

বেদব্যাস বেদ ভাগ করেছিলেন। সঙ্কলন ছাড়া চার বেদের ভাগ হয় নি। আর যা সঙ্কলিত তাই নানা ব্যক্তির দ্বারা নানা সময়ে হয়েছিল- সেই যুক্তিতে আদি, মধ্য এবং শেষ অবস্থার সুক্তগুলিকে ভাগ করা যেতেই পারে। ধর্মের প্রথম অবস্থায় জড়ের প্রশংসা, মধ্যকালে চৈতন্যবাদ এবং পরিণতি একেশ্বরবাদে। সুক্তের তাত্পর্য বুঝেই পণ্ডিতেরা তার সময় নির্দেশ করেন।


বৈদিক ঋষিরা উপলব্ধি করেছিলেন এই সমগ্র বিশ্ব চৈতন্যময় পুরুষের এক দেহ, ভিন্ন ভিন্ন শক্তির আধার। অগ্নি, বায়ু ইত্যাদি সব সেই দেবতার অঙ্গ বিশেষ। এই সকল সেই চৈতন্যময় পুরুষ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই অগ্নি ও বায়ুতেও চৈতন্যেরই প্রকাশ। আর যার কাছে সেই প্রকাশ অনুভুত হয় না সে অগ্নিকে জড় পদার্থ বলে স্বীকার করে। প্রাচীন হিন্দুরা বা আজও হিন্দুরা জড়ের উপাসক নয়। চেতনাবিহীন পদার্থ হিন্দুদের কাছে অস্পৃশ্য।

চৈতন্যময় এক পুরুষই ঈশ্বর যিনি এই জগত্ সৃষ্টি করেছেন, এর স্থিতি বিধান করছেন ও ধবংস করছেন- এ কথাটা নিত্য, শুনলেও এর গুরত্ব উপলব্ধি করা খুবই কঠিন কাজ। পরিশীলিত অনুশীলিত চিত্তের অধিকারী না হলে এ তত্ব বোঝা দুস্কর। শুধু শাস্ত্র পড়েও চিত্তশুদ্ধি হয় না। প্রয়োজন জ্ঞানের সাথে ভক্তি ও বুদ্ধির অনুশীলন, তবেই ঈশ্বর সম্বন্ধে ধারণা সম্ভব। না হলে দেবদেবীর উপাসনাই শুধু হবে। বুদ্ধির মার্জিত অবস্থায় উত্তরণ করেই বৈদিক হিন্দুরা ঈশ্বরজ্ঞানে উপনীত হয়েছিল। বৈদিক হিন্দুরা কী ভাবে বিভিন্ন প্রণালীতে ধাপে ধাপে চরম জ্ঞানে পৌঁছেছিলেন তার বিবরণ পাওয়া গেল। (সমগ্র আলোচনা যা এতক্ষণ বলা হল তা থেকে।)


সরল ঈশ্বরজ্ঞান - বৈদিক হিন্দুরা জ্ঞানের উন্নতিতে বুঝেছিলেন পৃথক পৃথক নামে যত দেবদেবীরই উপাসনা হোক না কেন সবই এক ঈশ্বরের একটি নিয়মের অধীনে ঘটে। যে নিয়মে হাত থেকে জল পড়ে যায়, সেই নিয়মেই আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়, এই নিয়ম সর্বত্র এক এবং সকলেই সেই নিয়মের অধীনে নিজের নিজের কাজ করেন। এই নিয়ম কেউ ভাঙছে না। এই নিয়মের কর্ত্তা একজনই আছেন, তাঁরই অধীনে সব। ইন্দ্রাদি থেকে ধূলোকণাটি পর্যন্ত সবই এক নিয়মের অধীন, সকলেই একজনের সৃষ্ট ও রক্ষিত এবং একজনই তার লয়কারকও। এই হচ্ছে সরল ঈশ্বরজ্ঞান।জড়ের উপাসনা করতে করতেই এই জ্ঞান জন্মে কারণ, জড়ের একতা ও নিয়মাধীন থাকা উপাসকের হৃদয়ঙ্গম হয়ে এই অনুভুতির জন্ম হয়।

তবে ঈশ্বরজ্ঞান প্রাপ্তি হলেই যে দেবদেবীর উপাসনা লুপ্ত হয়ে যায়- তেমনটা ঘটে না। কারণ, আগে যাঁদের চৈতন্যবিশিষ্ট বলে জানা হয়েছে, জ্ঞানের উচ্চসীমায় না পৌঁছালে, বিজ্ঞানশাস্ত্রের বিশেষ আলোচনা না করলে তাদেরকে জড় বা অচেতন বলে বিবেচনা করা সম্ভব হয় না সাধারণের পক্ষে। ঈশ্বরজ্ঞান এই বিশ্বাসকে লুপ্ত করে না। ঈশ্বর জগত্শ্রষ্টা হলেও এই সব দেবদেবীরাও আছেন- এই বিশ্বাস অটুট থাকে, তবে এটুকু বিবেচিত হয় যে এরাও ঈশ্বরসৃষ্ট, নিজ নিজ ধর্ম পালন করছেন ও, ঈশ্বর দ্বারাই, লোকরক্ষায় নিযুক্ত আছেন। এই কারণেই ঈশ্বরজ্ঞান জন্মালেও হিন্দুদের মধ্যে দেবদেবীর উপাসনা উঠে যায় না। এটিই প্রচলিত হিন্দুধর্ম- অর্থাত্ লৌকিক হিন্দুধর্ম, বিশুদ্ধ হিন্দুধর্ম নয়। ঈশ্বর সর্বস্রষ্টা ও সর্বকর্ত্তা কিন্তু দেবদেবীগণও আছেন এবং তাঁরা ঈশ্বর কর্ত্তক নিযুক্ত হয়ে লোকরক্ষা করছেন- এই লৌকিক হিন্দুধর্ম বেদে এবং হিন্দুশাস্ত্রের অনেক স্থানেই বলা হয়েছে। বেদের বিভিন্ন সূক্তে এই ভাবের প্রাধান্য আছে- কোথাও ইন্দ্রে জগদীশ্বরত্ব, কোথাও বরুণে জগদীশ্বরত্ব, কোথাও সূর্যে জগদীশ্বরত্ব আরোপিত হয়েছে।
তাহলে আমরা বলতে পারি শেষে যে বৈদিক ধর্মের তিনটি অবস্থা:

১) প্রথম দেবোপাসনা- জড়ে চৈতন্য আরোপ, তাঁর উপাসনা।
২) ঈশ্বরোপাসনা এবং তার সঙ্গে দেবোপাসনা।
৩) ঈশ্বরোপাসনা, এবং দেবগণের ঈশ্বরে বিলয়।

বৈদিক ধর্মের চরম উত্কর্ষ সাধিত হয় উপনিষদে। উপনিষদে দেবতারা একেবারে অনুপস্থিত বললেই হয়। কেবল আনন্দময় ব্রহ্মই উপাস্য। এটিই চতুর্থ অবস্থা বৈদিক ধর্মের ও অতি বিশুদ্ধ ধর্ম কিন্তু অসম্পূর্ণ।

গীতা ও অন্যান্য ভক্তিশাস্ত্রের আবির্ভাবে এই আনন্দময় ব্রহ্ম বা সচ্চিদানন্দের উপাসনার সঙ্গে ভক্তি মিলিত হল, সম্পূর্ণ করল হিন্দুধর্মকে। এই ধর্মই সর্বাঙ্গ সম্পূর্ণ ধর্ম ও জগতশ্রেষ্ঠ আমাদের মতে। নির্গুণ ব্রহ্মের স্বরূপ জ্ঞান, এবং সগুণ ঈশ্বরের ভক্তিযুক্ত উপাসনাই বিশুদ্ধ হিন্দুধর্ম এবং সকলের অবলম্বনীয়।
কিন্তু পরম পরিতাপের কথা এই যে এখন সকলে সব কিছু ভুলে গিয়ে শুধু দেশাচারকে উপাচারকে হিন্দুধর্মের স্থান দিয়েছে। এতে জাতীয় চরিত্রের অবনতিই চিহ্নিত করে।


বেদের ঈশ্বরবাদ - প্রবাদ আছে হিন্দুদের তেত্রিশ কোটি দেবতা। কিন্তু বেদে বলে মোটে তেত্রিশটি দেবতা। পাঠক প্রথম পর্বটি স্মরণ করুন। বেদে বলে এই তেত্রিশ দেবতা তিন শ্রেণীভুক্ত- এগারোজন আকাশে, এগারোজন অন্তরীক্ষে এবং এগারোজন পৃথিবীতে। নিরুক্তকার যাস্ক বলেন- নৈরুক্তদিগের মতে বেদের দেবতা তিনজন- পৃথিবীতে অগ্নি, অন্তরীক্ষে ইন্দ্র বা বায়ু এবং আকাশে সূর্য। তাঁহাদের মহাভাগত্ব কারণ এক একজনের অনেকগুলি নাম অথবা তাঁহাদিগের কর্মের পার্থক্যের জন্য। যথা হোতা, অধ্বুর্য, ব্রহ্ম, উদগাতা একজনেরই নাম হয়।

গোড়ায় তেত্রিশ কোটির স্থলে তেত্রিশ পাওয়া গিয়েছিল, নিরুক্তের মতে তেত্রিশের জায়গায় মাত্র তিনজন। বহু সংখক পৃথক চৈতন্য দ্বারা যে জগত্ শাসিত হয় না, জাগতিক শক্তি এক, বহু নয়, পৃথিবীতে সর্বত্র এক নিয়মের শাসন, অন্তরীক্ষেও সর্বত্র এক নিয়মের শাসন, আকাশেও সর্বত্র এক নিয়মের শাসন তাঁরা অনুভব করেন। পৃথিবীতে আর এগারো জন দেবতা নন- একই দেবতা, কর্মভেদে অনেক নাম, তেমনি অন্তরীক্ষ ও আকাশেও এক দেবতা।

তবু বোঝা গেল না তখনও ঋষিরা জাগতিক শক্তির সম্পূর্ণ ঐক্য বুঝতে পেরেছিলেন কিনা! কারণ পৃথিবীতে জীব, উদ্ভিদ ইত্যাদির জন্ম ও রক্ষা, তা থেকে বায়ু, বৃষ্টি অন্তরীক্ষের কাজ এত অন্য প্রকৃতির, আবার এ সব থেকে আলোক ইত্যাদি আকাশের সব ক্রিয়া এত আলাদা যে, এই তিনের ঐক্য ও এবং এক নিয়মের অধীনত্ব অনুভব করা তখনও পর্য্ন্ত ঋষিদের চেতনা বা জ্ঞান বা অনুভবে আসে নি। তবে অসীম প্রতিভার অধিকারী বৈদিক ঋষিদের কাছে সে জ্ঞানও বেশী দিন অপ্রকাশিত থাকে নি।

ঋকবেদ সংহিতাতেই পাওয়া যায় (১০-৮৮) 'মূর্ধা ভূবো ভবতি নক্তমগ্নিস্ততঃ সূর্য জায়তে প্রতিরুদ্যন্' অর্থ- 'অগ্নি রাত্রে পৃথিবীর মস্তক, প্রাতে তিনি সূর্য হইয়া উদয় হন।' 'এনং অগ্নিং সূর্যং আদিত্যেয়ং ' ইত্যাদি বাক্যে অগ্নিই সূর্য বোঝাচ্ছে। এই সূক্তের ব্যাখ্যায় যাস্ক বলেন- ত্রেধা ভাবায় পৃথিব্যামন্তরিক্ষে দিবি ইতি শাকপূণিঃ'- অর্থাত্ শাকপূণি বলেছেন যে- পৃথিবীতে, অন্তরীক্ষে এবং আকাশে, তিন স্থানে অগ্নি আছেন।

ক্রমশঃ জগতের এক শক্তির অধীনত্ব ঋষিদের মনে আরও স্পষ্ট হয়। তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, অগ্নি, ইন্দ্র, সূর্য, পৃথিবীর দেবগণ, অন্তরিক্ষের দেবগণ এবং আকাশের দেবগণ সব এক, একই শক্তির দ্বারা একই নিয়মাধীন, একই নিয়ন্তার অধীন। 'মহাদ্দেবানামসুরত্বমেকম্' (ঋকবেদ সংহিতা- ৩:৫৫)। এই ভাবে বেদে একেশ্বরবাদের সূচনা। অতএব তেত্রিশ কোটি নয়, তেত্রিশ নয়, তিন নয়- এক ঈশ্বরের উপাসনাই বিশুদ্ধ বৈদিক ধর্ম।

অতএব অতি প্রাচীন কালেই বৈদিক ঋষিরা জড়ের উপাসনা থেকে ক্রমশ বিশুদ্ধ একেশ্বরবাদে উপনীত হয়েছিলেন। কিছুদিন- সঙ্গে অন্যান্য ইন্দ্রাদি বহু দেবের উপাসনা প্রচলিত ছিল। ক্রমে তাঁরাও পরমাত্মায় লীন হলেন। হিন্দুধর্মের প্রকৃত মর্ম একমাত্র জগদীশ্বরের উপাসনা। বাকী সব তাঁরই ভিন্ন ভিন্ন নাম মাত্র।

যেহপ্যন্যদেবতা ভক্তা যজন্তেশ্রদ্ধয়ান্বিতা:।
তেহপি মামেব কৌন্তেয় যজন্ত্যবিধিপূর্বকং ।।
গীতা: ৯-২৩
(হে অর্জুন! যাঁহারা শ্রদ্ধা সহকারে অন্য দেবতার অর্চনা করেন, তাঁহারাও না জানিয়া আমাকেই ভজনা করেন।।)

তাই হিন্দুধর্ম বুঝতে গিয়ে ঋকবেদ দিয়ে আরম্ভ করি বা রামপ্রসাদের শ্যামা বিষয়ক গান দিয়েই আরম্ভ করি উপনীত হব গীতার সাগর তটে- কৃষ্ণোক্ত ধর্মে। এক ঈশ্বর আছেন, অন্য কোন দেবতা নাই। যে নামেই ডাকি না কেন, ডাকি তাঁকেই। এই কৃষ্ণোক্ত ধর্ম।

(চলবে)

কমলা রায়


প্রবন্ধটি লিখতে বিশেষ করে নীচের গ্রন্থগুলির সাহায্য নেওয়া হয়েছে:
(১) 'দেবতত্ব ও হিন্দুধর্ম' : বঙ্কিম রচনাবলী
(২) উপনিষদ- অখণ্ড সংস্করণ: অতুলচন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্বভূষণ ও
মহেশচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।