বেদ-
উপনিষদ ও সনাতন হিন্দুধর্ম - (৫)
(অন্যান্য
অনুচ্ছেদ)
বেদের মন্ত্রগুলিতে
গুহ্য অর্থ বা রহস্য জ্ঞান নিহিত আছে এ ধারণা পরম্পরা
ততটাই প্রাচীন যতটা প্রাচীন বেদ। বৈদিক ঋষিরা বিশ্বাস
করতেন যে মন্ত্রগুলি তাঁদের চেতনার কোন উচ্চতর ও
গুপ্ততর স্থান থেকে স্ফুর্ত| বেদ- বাক্যের প্রকৃত
অর্থ তিনিই জানতে পারেন যিনি স্বয়ং দ্রষ্টা কবি
বা রহস্যবেত্তা। অন্যের কাছে এর গূঢ় অর্থ প্রকাশ
পাবেনা। ঋষি বামদেব চতুর্থ মণ্ডলের একটি সূক্তে
নিজেকে এই ভাবে বর্ণনা করেছেন-- " অন্তঃ প্রকাশযুক্ত
(বিপ্রঃ) হয়ে আমি স্বগত বিচার- ভাবনা (মতিভিঃ) ও
অন্তস্ফূর্ত শব্দসমূহে (উকথৈ:) মার্গদর্শক (নীথানি)
গুহ্য বচনগুলি (নিণ্যা বাচাংসি) ব্যাঞ্জিত করছি"
-- আবার বলছেন, " ঋষি প্রজ্ঞালব্ধ বাক্য, যার
অন্তরর্থ দ্রষ্টা বা কবিকেই শোনাবার জন্য"
-- " কাব্যানি কবয়ে নিবচনা "। বেদমন্ত্র
সম্বন্ধে ঋষি দীর্ঘতামস বলেছেন, " ঋকগুলি সেই
পরমাকালে প্রতিষ্ঠিত যা অ- ক্ষর, যা অ- পরিবত্র্তনীয়,
যে আধারে সকল দেবতারা অধিষ্ঠিত রয়েছেন", আরও
বলছেন, " যিনি এই আধারকে জানেন না, বেদমন্ত্র
তাঁর কোন কাজে লাগবে? " ( ঋ: ১: ১৬৪: ৩৯ )
এর পরে বাক্যের চারটি স্তর নির্দেশ করে তিনি বলছেন-
তিনটি স্তর গুহায় নিহিত, চতুর্থটি মানবীয় যেখান
থেকে মানবভাষায় ব্যবহৃত সাধারণ শব্দগুলি জন্ম নিয়েছে।
বেদের শব্দগুলি ও বিচারধারা উচ্চতর তিনটি স্তরে
সংবদ্ধ ( ঋ: ১: ১৬৪: ৪৫ ), অন্যত্র বলা হয়েছে বেদবাণী
পরমা ( প্রথমম্ ), সর্বোচ্চ শিখরভূতা ( বাচো অগ্রম
), শ্রেষ্টা ও নিতান্ত নির্দোষা ( অরিপ্রম্ ) (
ঋ: ১০: ৭১ ) বেদবাণী গুহায় নিহিত, সেইখান থেকে এর
উদ্ভব এবং প্রকাশ। সত্যদ্রষ্টার অন্তরেই এর প্রবেশ--
ঋষিদের অন্তরে-- এবং তাঁদের বাক্পদ্ধতি অনুসরণেই
তা লাভ করা যাবে। কিন্তু সাধারণের পক্ষে এর নিগূঢ়
অর্থ বোঝা অসম্ভব। বিরল সেজন যাকে কামনা করে' দিব্যবাণী
আপনাকে নিরাবরণ করেন। অপরে যাঁরা অবিরাম বেদ- ধেনুর
দুগ্ধ পানে অসমর্থ, তাঁরা বন্ধ্যা গাভী নিয়ে বিচরণ
করেন, তাঁদের কাছে বেদ- বৃক্ষ ফলপুষ্পহীন শুষ্ক
বল্লরী (শুক্নো গাছ মাত্র ), দ্বিধাহীন, নি:সংকোচ
এই উক্তি।
সহজেই তাহলে এ সিদ্ধান্তে আসা যায়-- পবিত্র বেদমন্ত্রগুলি
গুহ্য ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান- তত্ব, কেবলমাত্র এই জ্ঞানের
দ্বারাই দিব্য সত্যকে জানা যায় ও উচ্চতর সাধনভূমিতে
আরোহন করা যায়। এই বিশ্বাস কোন অর্বাচীন পরম্পরা
নয়, সম্ভবতঃ বৈদিক যুগের সব ঋষিরা, অন্তত বামদেব
ও দীর্ঘতামস প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ ঋষিরা এই বিশ্বাস পোষণ
করতেন।
বেদ ব্যাখ্যার একাধিক
সম্প্রদায়ের উল্লেখ যাস্ক মুনি করেছেন। একটি যাজ্ঞিকী
বা কর্মকাণ্ডীয়, একটি ঐতিহাসিকী বা পৌরাণিক রূপকথা
আর তৃতীয়টি ব্যাকরণ ও শব্দ-- ব্যুত্পত্তি বিশারদের
ব্যাখ্যা অর্থাত্ আধ্যাত্মিক। যাস্ক মুনি স্বয়ং
বলছেন বেদসূক্তগুলির তিনটি ভিন্ন অর্থ সম্ভব-- একটি
অধিযজ্ঞীয় বা কর্মকাণ্ডীয়, দ্বিতীয়টি আধিদৈবিক অর্থাত্
দেবতা- স্বরূপাত্মক, শেষটি আধ্যাত্মিক, এবং এটিতেই
নিহিত বেদের প্রকৃত তাত্পর্য যা অধিগত হলে অন্য
সব অর্থ গৌণ হয়ে যায়। আধ্যাত্মিক অর্থটিই ত্রাণ-
সমর্থ, অন্য অর্থগুলি বাহ্য এবং গৌণ। যাস্ক বলেন
বস্তুর সত্য স্বরূপ ও সত্য ধর্ম ঋষিরা অন্তর্দৃষ্টিতে
প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পরে যখন বেদনিহিত জ্ঞান ও অন্তরার্থ
প্রায় বিলুপ্ত, তখন যে ঋষিদের সে জ্ঞান লুপ্ত হয়
নি তাঁদের কর্ত্তব্য হল সেটিকে রক্ষা করা দীক্ষিত
শিষ্য পরম্পরার মাধ্যমে। আরও পরে বেদের অর্থ উদ্ধারের
জন্য নিরুক্ত ও বেদাঙ্গাদির যোগ হল। এ পরিস্থিতিতে
যাস্কের মন্তব্য " বেদের সত্য- অর্থের সাক্ষাত্কার
হয় ধ্যানযোগ বা তপস্যার দ্বারা "। এর প্রয়োগে
যাঁরা সমর্থ তাঁদের অন্য কোন সাহায্যের প্রয়োজন
হয় না।
বেদে নিহিত রহস্যতত্বই যে ভারতীয় দর্শন, সভ্যতা,
সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ধর্মের মূল উত্স এ ধারণা পরম্পরা
ঐতিহাসিক তথ্যের দ্বারা অনেক বেশী সমর্থিত ইউরোপীয়
মতবাদের চাইতে, যে মতবাদে ভারতীয় ধারণা তুচ্ছ ও
নগণ্য বলে কল্পিত। জড়বাদী বাস্তবতার যুগে লিখিত
উনবিংশ শতকের বিদ্বানদের বিচারে জাতির আদিম রূপ,
বর্বরতা বা অর্ধবর্বরতা, সমাজ, ধর্ম ও সমাজজীবন-
অপরিপক্ক ও কুসংস্কারবহুল। প্রগতির ধারায় বুদ্ধি,
তর্কশক্তি, কলা, দর্শন ও ভৌতিক বিজ্ঞানের উত্কর্ষে
ও উন্নত ব্যবহারিক বুদ্ধির উদ্ভবে গড়ে ওঠে সভ্য
আচার- ব্যবহার ও রীতিনীতি। এই আলেখ্যে বেদ সম্বন্ধে
পুরানো উচ্চাঙ্গের ধারণার কোন স্থান তো ছিলই না,
বরং বেদগ্রন্থ ভ্রান্ত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন এটাই
দর্শানো হয়েছিল। ভারতবাসী জাতি প্রগতির যথার্থ ধারণা
করতে সক্ষম এখন।
প্রাচীন সভ্যতাগুলির আদিম পর্বে প্রাজ্ঞেরা বৈজ্ঞানিক,
দার্শনিক, বা উচ্চতর্কবুদ্ধি সম্পন্ন ছিলেন না।
তাঁরা ছিলেন রহস্যবাদী-- অতিন্দ্রীয় শক্তির অনুসন্ধিত্সু
ও ধর্মজিজ্ঞাসু। তাঁরা বস্তুর বাহ্য গুণের সন্ধানী
ছিলেন না। অন্তরালে যে সত্য প্রচ্ছন্ন (লুকিয়ে আছে)
তারই অন্বেষণ তাঁরা করতেন। দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক
যুগ আসে পরে। প্লেটো ও পাইথাগোরাসের মতো মনীষীরা
কিছুটা এই রহস্যবাদী ভাবুক (Mystic ) ছিলেন, কিংবা
ভাবুকদের ভাবধারা থেকে নিজেদের চিন্তার উপাদান আহরণ
করেছিলেন। ভারতে দর্শনবিদ্যা রহস্যবাদীদের জিজ্ঞাসা
থেকে বর্ধিত হয়ে তাঁদেরই আধ্যাত্মিক লক্ষ্যের রক্ষা
ও পুষ্টি সাধন করেছে। পরবর্তী যুগের অধ্যাত্ম সাধনায়
ও যোগমার্গে তাঁদের পদ্ধতিগুলি কিছুটা রক্ষিত হয়েছে।
বেদে গূঢ় রহস্য আছে এই জনশ্রুতি ঐতিহাসিক তথ্যের
দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সঙ্গত এবং ভারতীয় কৃষ্টির ইতিহাসে
উল্লেখযোগ্য। বেদই ভারতীয় কৃষ্টির ধ্রুব প্রতিষ্ঠান
ভূমি- কুসংস্কারবদ্ধ যাজ্ঞিক পূজাবিধি, বর্বর বলিপূজার
মন্ত্রমাত্র নয়।
যদিও সূক্তগুলিতে উচ্চাঙ্গের অধ্যাত্মজ্ঞান ও উচ্চ
বিচারশালী ভাব যা পাওয়া যায়, তা বেদের অল্প ভাগই
অধিকার করে আছে ,বাকী বিষয়বস্তু- যাজ্ঞিক পূজাবিধি,
দেবতার স্তুতি ও বর প্রার্থনা, যজমানের প্রার্থনার
বিষয়-- প্রভূত গো ও অশ্ব, যোদ্বৃìবীরবৃন্দ, পুত্ররত্ন,
সর্বপ্রকার ঐশ্বর্য, বিপদে রক্ষা, সংগ্রামে বিজয়,
আকাশ থেকে বৃষ্টির পতন, মেঘ ও রাত্রির হাত থেকে
সূর্যের মুক্তি, সাত নদীর বাধাহীন প্রবাহ, দস্যুর
হাত থেকে চুরি যাওয়া গবাদি পশুর মুক্তি এবং এইরকম
বহু প্রার্থনা যেগুলিকে স্থূল দৃষ্টিতে কর্মকাণ্ডীয়
পূজার লক্ষ্যবস্তু বলা যায়।
শ্রীঅরবিন্দের মতে ঋষিরা
কিছু আধ্যাত্মিক ও গোপন জ্ঞানের অধিকারী হলেও প্রভাবিত
ছিলেন তত্কালীন প্রাকৃত সুলভ বিচার ও ধারণার দ্বারা।
অতএব তাঁদের স্তুতি পাঠে এই দুই মনোভাবের ঘনিষ্ঠ
মিশ্রণ অনিবার্য। পরম্পরাগত বেদভাষ্যে যে দুর্বোধ্যতা
ও কোথাও যে আবোল তাবোল প্রলাপ উক্তি দেখা যায় তার
কারণ এই দুই ধারার মিশ্রণ। কিন্তু তিনি বলেন, বেদের
বেশীর ভাগ অংশেই পাওয়া যায় উচ্চ চিন্তা ও বিচারের
পরিচয়, বহু মন্ত্রের, বা সম্পূর্ণ বহু সূক্তগুলির
ব্যাখ্যা সম্ভব একমাত্র অতীন্দ্রিয় (Mystic) ভাব
ও অভিপ্রায়ের দ্বারা এবং দেখা যায় কর্মকাণ্ডীয় ও
বহিরঙ্গের প্রক্রিয়ার বর্ণনা এরকম সব প্রতীকের রূপ
নিয়েছে যা রহস্যবিদেরা সর্বদা ব্যবহার করতেন। সূক্তগুলির
ভিতরেই প্রতীকি অর্থের সুস্পষ্ট সংকেত ও নির্দেশ
রয়েছে।
তাই তাঁর মতে গোপন রহস্যবাদীদের একটি মহান শাস্ত্র
গ্রন্থ এই বেদ যা দ্ব্যার্থাত্মক-- একটি অর্থ বাহ্য,
অপরটি গুহ্য। প্রতীকগুলিরিই এমন নিজ নিজ বিশিষ্ট
অর্থ আছে যা সেগুলিকে তাত্পর্যের দিক থেকে গূঢ় বিদ্যার
অন্তর্ভূক্ত করে এবং সেই বিদ্যাকে তত্বজ্ঞান ও গোপন
শিক্ষার বিষয়বস্তু করে। অল্পকটি সূক্ত ছাড়া সমস্ত
বেদই অন্তর্গূঢ় অর্থে এরকম একটি ধর্মগ্রন্থ। বেদ
রচয়িতারা হয়ত' ঋক্ সূক্তগুলিকে বাক্ বলে মনে করতেন।
এই বাক্ শুধু আন্তর- সাধনেই শক্তিময়ী নয়,বহিরবস্তু
সম্পর্কেও একই ভাবে শক্তিময়ী| বিশুদ্ধ আধ্যাত্মিক
শাস্ত্রে কেবল অধ্যাত্ম অর্থ ও তাত্পর্যের স্থান;
কিন্তু প্রাক্তন ঋষিরা ছিলেন এমন মানুষ যাঁরা বিশ্বাস
করতেন অন্তর ও বহিঃ এই দুই পরিণাম সাধনলব্ধ এবং
বাক্ ও মননের এমন প্রয়োগ সম্ভব যাতে উভয় প্রকার
সিদ্ধিই, বেদের ভাষায় 'দিব্য' ও 'মানুষী', লভ্য
হ'তে পারে।
বেদে গূঢ় বাক্ ও অর্থের
এ যোগ ও সমবায় পাওয়া যাবে যদি ঋষি প্রযুক্ত পদ ও
সূত্রগুলির প্রাথমিক সহজ সরল অর্থ এবং সর্বদাই ঐ
একই অর্থ আমরা গ্রহণ করি, বিশেষ করে সেই পদ সমূহ,
যেগুলিকে রহস্যবাদের ভিত্তির মূল বলা যেতে পারে।
এরকম একটি মহান পদ সত্যপর্যায়ী 'ঋত '।সত্যের সন্ধানই
ছিল রহস্যবাদী ভাবুক ঋষিদের গবেষণার মূল লক্ষ্য--
আধ্যাত্মিক-সত্য বা আন্তর- সত্যের সত্য স্বরূপ।
কর্মকাণ্ডীয় ব্যাখ্যায় কিন্তু বৈদিক ভাবনার মূখ্য
'ঋত' পদটির নানা অর্থ করা হয়েছে ভাষ্যকারের সুবিধা
ও খেয়াল খুশী অনুযায়ী-- যেমন সত্য, যজ্ঞ, জল, বিগত
ব্যক্তি, এমন কি অন্ন, এরকম ভিন্ন অর্থবোধক আরও
বহু শব্দ আছে।
শ্রীঅরবিন্দ তাই এই মত পোষণ করেন-- বেদ গবেষণায়
যদি সর্বদা এবং সর্বস্থানে ঋত পদটির প্রধান মূখ্য
সত্য অর্থই গ্রহণ করা হয়, এবং বেদে ব্যবহৃত অনুরূপ
স্থায়ী পদগুলির অর্থ বিবেচনায় এই ব্যবস্থাই অক্ষুণ্ণ
থাকে, তাছাড়া বেদের প্রতীকাত্মক পদগুলির আন্তর অর্থের
ক্ষেত্রে ঋষি নির্দেশিত সংকেতগুলি অনুসরণ করা যায়
এবং রহস্যগর্ভ কাহিনীগুলি সেই অর্থ অনুযায়ী ব্যাখ্যা
করা যায়, যেমন বৃত্র ও বৃত্রশক্তির সংগ্রাম, বৃত্রবিজয়,
পণি বা অন্যান্য দস্যু- হস্ত থেকে সূর্য, অপ্ ও
গাভীদিগের মুক্তি-- তাহলে সমগ্র ঋকবেদকে আমরা পাই
একটি নিগূঢ়, গুপ্ত আধ্যাত্মিক শাস্ত্র ও সাধনসূত্রের
সমষ্টিরূপে যার উদ্ভব অন্য যে কোন প্রাচীন দেশে
মরমী ভাবুকদের দ্বারা সম্ভব হ'তে পারত' এবং ভারতবর্ষে
যা আজও টিকে আছে বেদের মধ্যেই।
(চলবে)
কমলা
রায়
সাহায্যকারী
গ্রন্থ: 'বেদ রহস্য'- শ্রী অরবিন্দ