প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বেদ- উপনিষদ ও সনাতন হিন্দুধর্ম - (৭) (অন্যান্য অনুচ্ছেদ)

বেদে ব্যবহৃত রহস্যাবৃত বা দ্ব্যর্থবোধক প্রতীকাত্মক শব্দের প্রকৃত অর্থ অনুসন্ধান করে তার যথাযথ ব্যাখ্যা শ্রী অরবিন্দ করে গেছেন তাঁর গবেষণায়. তাঁর অভিমত (আগেও বলা হয়েছে) শব্দ বা পদগুলির অর্থ সর্বদাই এক রেখে বেদ পর্যালোচনা করলেই বেদের অন্তর্নিহিত গভীর জ্ঞানময় ভাবটি প্রকাশ পাবে ও বৈদিক ঋষিদের ধী শক্তিরও পরিচয় মিলবে।

সত্যবাচক "ঋত" একটি পদ যার একটি তাত্পর্যপূর্ণ নির্দিষ্ট অর্থ রয়েছে। বেদমন্ত্রগুলিতে বারবার ব্যবহৃত আর একটি পদ "ধী" শব্দটি-অর্থ-চিন্তা বা বিচারশক্তি। তবে বিভিন্ন জায়গায় এর নানা অর্থ করেছেন অনেক ব্যাখ্যাকারেরা। শ্রী অরবিন্দ কিন্তু পদটিকে সর্বত্রই তার স্বাভাবিক সরল অর্থটি গ্রহণ করে ব্যাখ্যা করেছেন। "কেতু" শব্দটির প্রচলিত অর্থ, "রশ্মি", কিন্তু মননশীলতা বা বিচারবুদ্ধি বা বৌদ্ধিক উপলব্ধি অর্থেও শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়। যে মন্ত্রগুলিতে এই পদটি ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলির বিচার করে তিনি বলেন-- এই শব্দটি বোধিবাচক বা অন্তজ্র্ঞান রশ্মি বাচক। যেমন দেখা যায় সেই মন্ত্রাংশে যেখানে বলা হচ্ছে "কেতুনা" অর্থাত্ অন্তরে প্রকাশিত জ্ঞানরশ্মি দ্বারা সরস্বতীদেবী মহাসমুদ্রের (মহার্ণবের) চেতনা আমাদের চিত্তে এনে দেন। "উর্ধস্থিত পরম মূল থেকে অধোমুখে প্রেরিত রশ্মি সমূহ", এই উক্তির অর্থ, বোধ বা অন্তর্জ্ঞানরশ্মি। সত্য ও জ্যোতিঃ- সূর্যের কিরণ জাল বর্ননাতে এই বোধিরশ্মি বুঝতে হবে।

"ক্রতু" শব্দটির প্রথম ও প্রচলিত অর্থ; কর্ম বা যজ্ঞ কিন্তু অন্য অর্থেও ব্যাবহৃত হয়েছে বেদে- যেমন বল বা প্রজ্ঞা, বিশেষত সেই প্রজ্ঞাবল যা নির্দিষ্ট করে করণীয় কর্মটিকে, অর্থাত্ সঙ্কল্প শক্তি, বেদের অর্থের জন্য এটিই এখানে গ্রহনযোগ্য । অগ্নি হলেন "কবিক্রতু" অর্থাত্ দ্রস্টা-সঙ্কল্প শক্তি, তিনি হলেন "ক্রতু হৃদি", অর্থাত্ হৃদয়স্থ সঙ্কল্পশক্তি।

বেদে বহু ব্যবহৃত "শ্রবস" শব্দটির অর্থ করা হয়েছে "কীর্তি" বহু স্থলে। ভাষ্যকারেরা "অন্ন" অর্থেও পদটির ব্যাখ্যা করেছেন। শব্দটির উত্পত্তি শ্রবনার্থক শ্রু ধাতু থেকে। বেদে এর প্রয়োগ দেখা যায় শ্রবণেন্দ্রিয় অর্থেও, এবং এটি সুপ্রয়োগ। কখনো স্তুতি বা স্তব অর্থেও ব্যবহৃত হয়েছে। সায়ন এই শেষোক্ত দুটি অর্থই স্বীকার করেন।

অতএব অনুমান করা যায় শব্দটির প্রকৃত অর্থ "শ্রুত বিষয়" অর্থাত্ শ্রবণেন্দ্রিয়জাত জ্ঞান বা "শ্রুত জ্ঞান। বৈদিক ঋষিরা নিজেদের অভিহিত করেছেন, "সত--শ্রুত", তাঁদের শ্রবণলব্ধ জ্ঞানকে বলেছেন "শ্রুতি"। এই বিচারে "শ্রবস্" শব্দের অর্থ হয় --অন্তঃপ্রেরণা বা অন্তঃপ্রেরিত জ্ঞান। বেদের রহস্যভেদে এই অর্থই গ্রহণযোগ্য এবং গৃহীত হলে মন্ত্রার্থ হবে সুসঙ্গত ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ।

এখানে এবারে একটি প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠে আসে যে এই ব্যাখ্যারীতির অনুসরণে বেদের কোন গুপ্ত অর্থ বা রহস্যভাবনা জানা যাবে। শ্রী অরবিন্দের মতে, রহস্যবিদ ভাবুকদের ভাবাদর্শ সর্বত্র যা দেখা যায়, এই ব্যাখ্যা রীতির অনুসরণে তারই প্রতিফলন দেখা যাবে। ভারতীয় কৃষ্টির বিবর্তনের প্রথমদিকের পর্বে পাওয়া যায় আধ্যাত্মিক সত্যের আরম্ভের সূচনা বা রূপ যার পরাকাষ্ঠা বা শ্রেষ্ঠ পরিণতি পাওয়া যায় উপনিষদ যুগে। শ্রী অরবিন্দ নির্দেশিত পথ বেদ ব্যাখ্যায় ঐ সত্যের দিকে নিয়ে যায়। বেদান্ত মহাবৃক্ষের বীজের সন্ধান পাওয়া যায় বেদের অন্তরে গুপ্ত গুহ্য-জ্ঞানের ভিতরে। পরমার্থ সত্যের সাক্ষাত্কার, পরম জ্যোতির স্পর্শ ও অমৃতত্বের আকূতিকে কেন্দ্র করে সব ভাবনা চিন্তা আবর্তিত হচ্ছে।

বহির্জগতের সত্যের বাইরে আছে এক উচ্চতর ও গভীরতর সত্য, মানবীয় মানসলোকের আড়ালে রয়েছে এক বৃহত্তর ও উর্ধতর বোধি-জাত অন্তঃপ্রেরণা ও প্রকাশজ্যোতি, রয়েছে এক অমৃতত্বের সন্ধান যার দিকে চিদাত্মার উর্ধে আরোহণ। এই সত্যলোকের পথ খুঁজে বার করে যুক্ত হতে হবে সেই পরম সত্য ও অমৃতত্বের সাথে---"সপন্ত ঋতম অমৃতম"--- এই সত্যের গর্ভে জন্ম নিয়ে বর্ধিত হতে হবে এবং পরিণামে পরমলোকে পৌছে সেই সত্যধামে বাস করতে হবে। যাত্রা শেষে মিলবে পরমেশ্বরের নৈকট্য, সার্থক হবে মর্ত হতে অমর্তের অভিযান।
বৈদিক রহস্যবাদীদের মূল ও কেন্দ্রীয় প্রাথমিক শিক্ষা ও সিদ্ধান্ত হল এইটি।
প্রাচীন যুগের রহস্যবাদীদের সূত্র অনুসরণ করে প্লেটো শিষ্যরা এই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে-- মানব জীবন দুটি জগতের সংগে সম্বন্ধ যুক্ত। একটিকে বলা যেতে পারে অধ্যাত্ম জগত্ যেখানে উর্দ্ধতর সত্য সদা প্রতিষ্ঠিত, অন্যটিকে বলা চলে দেহধারী জীবাত্মার জগত্, আসলে উর্ধতর জগত্ থেকেই এই দ্বিতীয়টি ভূমিষ্ঠ হয়ে ভ্রষ্ট হয়েছে নীচের অবর--(নিকৃষ্ট) সত্য ও অবর চেতনার ভূমিতে। বৈদিক রহস্যবাদীদের সিদ্ধান্তও এই রূপই। কিন্তু তাঁরা এই তত্বটির অনেক বেশী বাস্তব ও ব্যবহারিক রুপ দিতে সমর্থ হয়েছিলেন কারণ দুটি জগতের সঙ্গেই তাঁদের যোগ ছিল অনুভূতি ও উপলব্ধির মাধ্যমে এবং এই ক্ষমতা ছিল তাঁদের সত্য সিদ্ধ ক্ষমতা।
তাঁরা উপলব্ধি করেছিলেন এক পরম সত্যধাম আছে--"ঋতস্য সদনম"--সত্য, ঋত ও বৃহতের ভুবন যেখানে সব কিছু সত্য --চিন্ময়, 'ঋত-চিত্'। এই দুই লোকের অন্তরীক্ষে দ্যুলোক পর্যন্ত রয়েছে নিজ নিজ জ্যোতির আলোকে আলোকিত বর্ণাঢ্য ভুবনের পর ভুবন, শীর্ষে রয়েছে পরম জ্যোতির্লোক- সত্য- সূর্যের ধাম স্বর্লোক বা স্বর্গলোক বা বৃহত্ দ্যৌ| সেই দিব্যধামের মার্গ বা পথ, "ঋতস্য পন্থা" আমাদের অনুসন্ধাণীয়, এটি দেবযান। বৈদিক ঋষিদের দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত হল এইটি।
তৃতীয় সিদ্ধান্ত---মানব জীবন এক যুদ্ধক্ষেত্র যেখানে অবিরত চলছে সুরাসুরের যুদ্ধ। সত্য ও জ্যোতির শক্তিরা--অমর দেবতারা-- অন্ধকারের শক্তিগুলির সঙ্গে সংগ্রামে রত। অন্ধকারের শক্তিরা বিভিন্ন নামে অভিহিত হয়েছে--যেমন বৃত্রবৃন্দ, বল ও পণি,দস্যু ও তাদের অধিপতিরা।

এরা পরম সত্যের প্রকাশের বাধা-- কখনও আবরক, কখনও বা অপহারক ,দিব্য ধারার (ঋতস্য ধারার), প্রবাহের বাধক, সকল প্রকার চিদাত্মার উর্ধগতির রোধক। এই বিরোধের উচ্ছেদের জন্য এই অন্ধকারের শক্তিদের পরাজিত করতে হবে দেবতাদের সহায়ে, তাঁদের আবাহন করতে হবে নিজ অন্তর্যজ্ঞের আহুতি দিয়ে, দিব্য বাণীর সাধনায় তাঁদের প্রতিষ্ঠিত করতে হবে নিজ অন্তরে-- মন্ত্রের বিশিষ্ট শক্তি হল এই। যজ্ঞের হবি অর্পণ করতে হবে তাঁদের উদ্দেশ্যে-- বিনিময়ে লাভ হবে অভয় বর যা সুগম করবে পরম সত্য প্রাপ্তির পথকে।

বহিরঙ্গের যজ্ঞের উপাদান ও সাধন সমূহ যে সব শব্দ বা পদের দ্বারা বেদে নির্দিষ্ট আছে তা অন্তর্যজ্ঞ ও আত্মসমর্পণেরই প্রতীক রূপ। আমরা স্বরূপে যা এবং যা আমাদের স্বকীয়, সব কিছুই সমর্পণ করে দিতে হবে পরম সত্যের কাছে, আমাদের অন্তরের আধার রূপে, যা আমাদের লৌকিক জীবনকে গড়ে তুলবে দিব্য সত্যের ঐশ্বর্য ও দিব্যজ্যোতির অবতরণ ক্ষেত্র রুপে। বিকশিত হবে আমাদের চিত্তে সঠিক বিচার, সঠিক বোধ ও সম্যক ক্রিয়াশীলতা। এসব সম্ভব হবে ঊর্ধতর সত্যের প্রেরণা ও সংবেগ থেকে, (ঋতস্য প্রেষা, ঋতস্য ধীতি), যাতে সেই পরম সত্যের পরিমণ্ডলে আমরা নিজেদের গডে তুলতে পারি।

যজ্ঞের যজন (পূজন) হল একটি যাত্রা-- তীর্থযাত্রাও বটে, সংগ্রাম অভিযানও বটে। তীর্থযাত্রা দেবাভিমুখী, অগ্নিদেব (অন্তরের অভীপ্সা) রয়েছেন সেই অভিযানের পুরোধায়, মার্গদর্শক ও নেতা রূপে। যজ্ঞে মানবীয় দ্রব্য আহুতি অগ্নিদেবের দ্বারা পরম লোকে উন্নীত হয়ে রূপান্তরিত হয় তাদের অমৃত স্বরূপে, ঊর্ধ থেকে নেমে আসে দিব্য দ্রব্য- সম্ভার আমাদের অন্তঃসত্তার গভীরে প্রতিষ্ঠিত হতে।
বেদান্তের শিক্ষা ও মতবাদের বীজ যেমন পাওয়া যায় ঋকবেদের সিদ্ধান্তের মধ্যে, তেমনি পরবর্তী যুগের যোগ-ক্রিয়া ও যোগ-সাধনার বীজ ও পাওয়া যায় ঋকবেদের আন্তর-ক্রিয়া (মনোগত বা হৃদয়ে নিহিত) ও আন্তর সাধনার অভ্যন্তরে।
সবশেষে উল্লেখ্য রহস্যবাদী বৈদিক ঋষিদের চরম ও চূড়ান্ত রহস্য বাণী-- নিখিল বস্তুসত্তার অদ্বয় (অদ্বিতীয়, ব্রহ্মা) সত্স্বরূপ "তদ একম", "তদ্সত্, তিনি এক তিনি সেই।

এই মহাবাক্যই হল উপনিষদ যুগের মর্মবাণী। দেবতারা হলেন সেই "এক"- এর নাম, রুপ ও শক্তি বিশেষ, প্রতি দেবতাটি সর্ব দেবময়, অন্য সব দেবতারা তাঁর অন্তর্গত। আছে একটিই সত্য "তত্ সত্যম্", আছে একটিই পরম আনন্দধাম যেখানে আমাদের আরোহণ করতে হবে। এটিই বেদের মর্ম কথা, তবে অধিকাংশ স্থলে এটিকে কিন্তু পাওয়া যায় যবনিকার অন্তরালে। এটি ছাড়া বেদে বক্তব্য আরো অনেক কিছু আছে কিন্তু এইটিই বেদের হৃদয়ে স্থিত কেন্দ্রীয় বাণী।

পরিশেষে বক্তব্য যে সরণী এতদিন ধরে তৈরী হল উপনিষদ মহাসৌধের দ্বারে উপনীত হতে , তার উচ্চতম প্রান্তে দাঁড়িয়ে সেই মহাসৌধের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা দ্বার উন্মুক্ত হোক পরমা জ্ঞানের, বিচ্ছুরিত হোক আলোক, আশীর্বাদ নেমে আসুক, নেমে আসুক শাশ্বত শান্তি, সত্যের , শিবের , আনন্দের ধারায়।

(চলবে)

কমলা রায়

সাহায্যকারী গ্রন্থ: 'বেদ রহস্য'- শ্রী অরবিন্দ

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।