প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বেদ- উপনিষদ ও সনাতন হিন্দুধর্ম - (৮) (অন্যান্য অনুচ্ছেদ)

ভূমিকা-- বেদকে আশ্রয় করেই বৈদিক যুগের শেষে উপনিষদগুলি ধীরে ধীরে তৈরী হয় ও ক্রমে সমৃদ্ধ হয়ে ভারতীয় দর্শনের জন্মদাতা হয়। বেদের সংহিতা অংশে তার জন্ম,আরণ্যক অংশে তার পরিবর্ধন। বেদের যজ্ঞানুষ্ঠান্কে কেন্দ্র করে যে আনুষ্ঠানিক পর্বের (কর্মকাণ্ড) প্রচলন হয় তা থেকে উপনিষদ্কে আলাদা করার জন্য তাকে জ্ঞান্কাণ্ড নামে অভিহিত করা হয়। বৈদিক দেব দেবীর স্তুতির সঙ্গে সঙ্গে ঋষিদের মনে জেগে ওঠে বিশ্ব রহস্যকে ভেদ করার এক প্রবল আকূতি। এই জ্ঞানতৃষ্ণাই তাঁদের্কে আরণ্যক যুগে এক বিশুদ্ধ দার্শনিক জ্ঞানের খোঁজে আত্মনিয়োগ কর্তে বাধ্য করে। তারই পরিণতি উপনিষদ ।
উপনিষদের সংস্কৃত অর্থ-- উপ - নি - সদ্‌ -- অর্থাৎ তাঁর নিকটে-- সেই পরমের নিকটে যাওয়া। যদিও উপনিষদের অর্থ নিয়ে মত পার্থক্য আছে। ডয়সন বলেন-- তা হল রহস্য্গত জ্ঞান। ম্যাক্স্মূলার বলেন-- গুরুর নিকটে বসে দার্শনিক বিদ্যা আয়ত্ত করা হত বলে এই নাম। বেদের প্রান্তে বেদ্কে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছিলো বলেই তাকে উপনিষদ বলা হয় বেদান্ত্কে উপনিষ্দের সমার্থবোধক শব্দ হিসাবে ব্য্বহার করা হয়েছে। শেতাশ্ব্তর উপনিষদে বলা হয়েছে: পরম গুহ্য এই তত্ত্টি প্রচারিত হয়েছে। " বেদান্তে পরমং গুহ্যং পুরা কল্পে প্রচোদিতম"।
কর্মকাণ্ড থেকে পৃথক করার জন্য উপনিষ্দ্কে পরাবিদ্যাও বলা হয়েছিলো; মুণ্ডক উপনিষ্দে পরা ও অপরা বিদ্যার কথা বলা হয়েছে। অপরা বিদ্যার অন্তর্গত-- চারটি বেদ এবং ছয়টি বেদাঙ্গ। এই বেদাঙ্গের ব্য্বহারিক প্রয়োগ দেখা যায় যজ্ঞানুষ্ঠানে। সুতরাং অপরা বিদ্যা বল্তে বৈদিক কর্মকাণ্ড এবং তার আনুষ্ঙ্গিক বিদ্যাকে বোঝায়।
পরা বিদ্যারও একটি সংজ্ঞা এরকম-- পরা বিদ্যা হল সেই বিদ্যা যার দ্বারা সেই অক্ষরকে জানা যায়। "অক্ষর" অর্থ হল যার ক্ষয় নেই, যা স্থান কালের অতীত, অর্থাৎ তা ব্রহ্মের সমার্থবোধক। সুতরাং যা বেদের কর্মকাণ্ড হতে সরে এসে উপনিষ্দ বা বেদান্তে আশ্রিত ব্রহ্ম সম্বন্ধে আলোচিত তাই পরা বিদ্যা।
এই উপনিষদের বৈদিক যুগে এক অভাবনীয় মর্যাদা ও প্রতিপত্তি ছিলো। উপনিষদেই কাহিনী আছে যে রাজর্ষি জনক এই ব্রহ্মবিদ্যা লাভের জন্য যাজ্ঞবল্কের শিষ্য্ত্ব গ্রহণ করেছিলেন। উপনিষদে মৌলিক বচনগুলি অভ্রান্ত সত্য বলে গৃহীত হত। ষড়দর্শনের যুগে তাদের একটি বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে এবং আপ্তবচন (শ্রদ্ধাভাজন ব্য্ক্তি দ্বার উচ্চারিত বা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ জ্ঞানবাক্য যা বিনা দ্বিধায় সত্য বলে গ্রহণ করা হয়) হিসাবে বিভিন্ন দার্শনিক তত্তের সমর্থনে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
মনে হয় পরবর্তীকালে উপনিষদের আলোচনা একটু শিথিল হয়ে পড়েছিলো। একটি কারণও ছিলো তার। বাদরায়ণ উপনিষদের দার্শনিক তত্তকে সূত্রাকারে স্থাপন করার জন্য ব্রহ্মসূত্র রচনা করেন। তাই যারা বেদান্ত পাঠে আগ্রহী, তাঁরা ব্রহ্মসূত্র পাঠেই মনোনিবেশ করেন। তবে উপনিষদ্গুলি তখনো পরিপূর্ণ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ছিলো। পুরাণের যুগেও তাদের মহিমা ক্ষুণ্ণ হয় নি। তা না হলে অষ্টম ও নবম শতাব্দীর সন্ধিক্ষনের মানুষ হয়েও শংকরাচার্য কেন প্রাচীন উপনিষদ্গুলির উপর ভাষ্য লিখবেন? তারপরে অবশ্য শংকরাচার্য প্রবর্তিত অদ্বৈতবাদের প্রতিপত্তির ফলে তার পৃথক আলোচনায় কেউ বিশেষ আগ্রহী ছিলেন না। মধ্য্যুগে ভক্তিবাদের সংগে অদ্বৈতবাদের প্রতিদ্ব্ন্দিতাই দার্শনিক্দের একমাত্র আকর্ষণের বস্তু হয়ে উঠেছিলো।
তবু উপনিষদের স্ব্কীয় দীপ্তি বিশেষ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ কর্ত। তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন দারা শিকোর উপনিষদের প্রতি আকর্ষণ। যার ফল স্বরূপ ফার্সী ভাষায় তার অনুবাদের ব্য্বস্থা করেন ১৬৫৭ খৃষ্টাব্দে। তার তাৎপর্য ছিলো সুদূর প্রসারি। কারণ সুদীর্ঘ কাল পরে হলেও সেই অনুবাদের সূত্র ধরেই উপনিষদের বহির্বিশ্বে আত্মপ্রকাশের পথ উন্মুক্ত হয়। আঁকেতিল দ্যী পেরঁ নামে এক ফরাসী পর্যটক সেই পুঁথি দেশে নিয়ে যান এবং সেটা অনুসরণ করে তার এক লাটিন অনুবাদ প্রকাশ করেন ১৮০১-১৮০২ খৃষ্টাব্দে। সেই সূত্রেই শোপেন্হাউএর সাথে তাঁর পরিচয় হয়। দার্শনিক শেলিং-ও উপনিষদের প্রতি বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হন। বিখ্যাত ভারততত্তবিদ ম্যাক্সমূলার শেলিং এর মুখে উপনিষদের প্রশংসা শুনে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ বোধ করেন। পরবর্তীকালে তিনি সব কটি প্রাচীন উপনিষদের ইংরেজী অনুবাদ করে ইংরেজীভাষীদের কাছে উপনিষদের দ্বার খুলে দেন। তার ফলে সূদূর পাশ্চাত্যেও উপনিষদ বিদগ্ধ মানুষের মনে আলোড়ন তুলেছিলো। মার্কিন কবি দার্শনিক র্যা্ল্ফ্‌ ওয়াল্ডোইমার্সনের উপর উপনিষদের চিন্তাধারার প্রভাব দেখা যায়, তাঁর বিশ্ব আত্মাতত্ত (world soul) রচনায় এর প্রতিফলন হয়। উপনিষদের "আত্মা অন্তর্যামী" এই চিন্তা তাঁকে প্রভাবিত করেছিলো বোধয়। বিংশ শতাব্দীতে ও উপনিষদের বাণীর প্রভাব দেখা যায়। টি এস্‌ ইলিয়টের "ওয়েষ্টল্যাণ্ড" ( waste land ) শীর্ষক কাব্যগ্রন্থে একটি কবিতায় উপনিষদে প্রচারিত তিনটি "দ" এর (দাম্যত, দত্ত, দয়ধ্বম্‌) কাহিনীর প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়।
বাংলাদেশে উপনিষদ চর্চার নতুন করে প্রবর্তন করেন রামমোহন রায়। উনবিংশ শতাব্দীতে খ্রীষ্ট ধর্মের সংগে ভারতবাসীর পরিচয় ও ইংরেজী শিক্ষার ফলে পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের প্রতি ইংরেজী শিক্ষিত মানুষের আকর্ষণ কমে যায়। ঐ পরিস্থিতিতে রামমোহন রায় বিগ্রহ বর্জিত উপাসনা রীতির সন্ধানে ব্রহ্মসূত্র ও উপনিষদের প্রতি আকৃষ্ট হন। ব্রহ্মসূত্রকে ভিত্তি করেই তিনি নিরাকার উপাসনার রীতির সমর্থন করেন এবং 'বেদান্ত' গ্রন্থ রচনা ও ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্কৃতে অনভিজ্ঞ বাঙালীকে উপনিষদের বানীর সংগে পরিচয় করানোর জন্য তিনি ঈশ, কেন, কঠ, মুণ্ডক ও মাণ্ডুক্য-- এই পাঁচটি ছোট উপনিষদের বাংলা অনুবাদ করেন ১৮১৬- ১৯ খRীষ্টাব্দে ও ভারতে সর্বপ্রথম উপনিষদের ইংরেজী অনুবাদ তাঁরই।
তাঁর মৃত্যুর পর মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রাহ্মসমাজের পরিচালক হন ও ব্রাহ্মধর্মের গোড়া পত্তন করেন। তাঁর সাধনজীবনের আরম্ভই হয় ঈষ উপনিষদের প্রথম পংক্তি দিয়ে।
স্বামী বিবেকানন্দের বেদান্ততত্তের প্রচারেও বাংলা ভাষায় উপনিষদ চর্চার পথ সুগম হয়েছিল। অদ্বৈত বেদান্তের সংগে উপনিষদের বাণীর নিবিড় যোগ আছে। তাই রামকৃষ্ণ মিশন থেকেও প্রাচীন উপনিষদগুলির ব্যাখ্যা ও অনুবাদ গ্রন্থ প্রচারিত হয়েছে। এই ভাবেই উপনিষদের মর্যাদা ও প্রতিপত্তি অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। তার ফলে একটি সমস্যারও সৃষ্টি হয়েছিল।
আমাদের দেশে একটি রীতি প্রচলিত ছিল। কোন শ্রেণীর গ্রন্থ বিশেষ মর্যাদা পেলে ব্যক্তিবিশেষ নিজের বিশিষ্ট মতকে সহজে প্রচার করার জন্য সেই নামে তাকে প্রচার করত। আরও একটি উপায় ছিল বিশেষ গ্রন্থকে নিজের প্রচারিত তত্তের অনুকূলে ব্যাখ্যা করে একই উদ্দেশ্য সাধন করা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যের উদাহরণ পাওয়া যায় ব্রহ্মসূত্র ও গীতার ব্যাখ্যায়। ব্রহ্মসূত্রের অদ্বৈতবাদের ভিত্তিতে যমন ব্যাখ্যা আছে তেমনি বৈষ্ণবমতেও ব্যাখ্যা আছে। গীতার ব্যাখ্যার বৈচিত্র আরও বেশী। উপনিষদের ক্ষেত্রে প্রথম রীতিটি নেওয়া হয়েছিল। প্রাচীন ব্রহ্মতত্তের অনুসরণে উপনিষদ ব্যাখ্যা পেয়েছে, আবার যোগদর্শনের দ্বারা প্রভাবিত সন্নাসবাদও উপনিষদ নামে অভিহিত হয়েছে। ভক্তিতত্তমূলক উপনিষদও আছে। এরকম পরিস্থিতেই উপনিষদের আলোচনা সমস্যাসংকুল হয়ে উঠে।
এখানে প্রাসঙ্গিক আরও একটি কথা, সাধারণ দর্শন যেভাবে লেখা হয় উপনিষদের দর্শন ঠিক সেভাবে গড়ে উঠেনি। দর্শনের আলোচন তথ্যভিত্তিক। নানা তথ্যের মাধ্যমে যুক্তির প্রয়োগে একটি সিদ্ধান্তে আসা হয়। চিন্তাগুলিও সুসংবদ্ধভাবে সাজানো হয়। উপনিষদগুলি ঠিক সেই রীতিতে রচিত হয়নি। কারণ উপনিষদের ঋষিরা ছিলেন কিছুটা কবি, কিছুটা দার্শনিক। তাঁরা সমস্যাগুলিকে আলাদা করে, তথ্যগুলিকে যুক্তি হিসেবে সাজিয়ে সিদ্ধান্তে আসেননি। বিশ্বের নানা সমস্যা তাদের মনকে আলোড়িত করত। সেই নিয়ে তাঁরা গভীর চিন্তা করে, কবিসুলভ ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁদের প্রচারিত বাণীগুলিও পরস্পরের সংগে সম্পর্কযুক্ত নয়। বিভিন্ন বস্তুর পৃথক আলোচনাও নেই। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মনীষী যা উপলব্ধি করেছেন উপনিষদের পাতায় বিক্ষিপ্ত ভাবে তা ছড়িয়ে আছে। তাই উপনিষদের দার্শনিক তত্ত্বের পরিপূর্ণ রূপটি সাজানো অবস্থায় এক জায়গায় পাওয়া যাবেনা।
ভারতে দার্শনিক চিন্তাধারা সময়ের সংগে পরিবর্তিত হয়েছে। এই পরিবর্তন ভারতীয় দার্শনিক চিন্তাকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করে। শ্রুতিপ্রস্থান, ন্যায়প্রস্থান ও স্মৃতিপ্রস্থান। প্রথমটি বৈদিক সাহিত্যের অঙ্গ হিসেবে যে দার্শনিক চিন্তা গড়ে উঠেছিল তা বিবৃত করে। ভারতীয় ষড়্‌দর্শনের যুগে যে দার্শনিক চিন্তা গড়ে উঠেছিল তাকে ন্যায়প্রস্থান বলা হয়। পরবর্ত্তীকালে পৌরাণিক যুগের ভক্তিবাদী চিন্তাকে বলা হয় স্মৃতিপ্রস্থান। সুতরাং বিভিন্ন যুগের চিন্তার পার্থক্য এভাবে স্বীকৃত।
প্রাচীন উপনিষদগুলির মধ্যে এই তিন শ্রেণীর চিন্তাই বর্তমান। প্রাচীন উপনিষদগুলি চিহ্ণিত করলে, তার ভিত্তিতে জানা যাবে উপনিষদের দার্শনিক তত্ব কি ছিল। প্রাচীনতম যুগের অর্থাৎ বেদের অন্তর্ভুক্ত উপনিষদের যুগের চিন্তাধারার সংগে যে উপনিষদের চিন্তাধারা মিলে যাবে তা এই প্রাচীন শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত হবার যোগ্য। বৈদিক সাহিত্যের সংগে সম্পর্কের ভিত্তিতেও উপনিষদগুলির প্রাচীনতা পরীক্ষা করা যেতে পারে। বেদের চারটি অংশ আমরা জানি-- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতা অংশে বৈদিক দেবতাদের প্রশস্তি বা দার্শনিক তত্ত্ববিষয়ক রচনা আছে। ব্রাহ্মাণ অংশে পাওয়া যায় কি ভাবে এই প্রশস্তিগুলি নানা যজ্ঞে ব্যবহৃত হবে সে ব্যাপারে নির্দেশ। তারপর আসে আরণ্যক। সেখানে পাওয়া যায় ঋষিদের মন যে তাত্বিক আলোচনায় ব্যাপৃত থাকত তার বিবরণ। অরণ্যে সে আলোচনা চলত বলেই তা আরণ্যক। সবশেষে আসে উপনিষদ। সেখানে আলোচনা কেবল মাত্র ব্রহ্মতত্ত্বে সীমাবদ্ধ থাকত।
প্রাচীন উপনিষদগুলি বৈদিক সাহিত্যের কোন অংশের সংগে যুক্ত তার একটি তালিকা নীচে দেওয়া হল।

১) ঈশ শুক্লযজুর্বেদের বাজসনেয় সংহিতার অংশ
২) ঐতরেয় ঋগ্‌বেদের ঐতরেয় আরণ্যকের অংশ
৩) কৌষীতকি ঋগ্‌বেদের শাঙ্খায়ন আরণ্যকের অংশ
৪) তৈত্তিরীয় কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকের অংশ
৫) বৃহ্দারণ্যক শুক্লযজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের অংশ
৬) ছন্দোগ্য সামবেদের ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণের অংশ
৭) কেন সামবেদের জৈমিনীয় ব্রাহ্মণের অংশ
৮) কঠ ঐতিহ্য অনুসারে কৃষ্ণযজুর্বেদের অন্তর্ভুক্ত
৯) শ্বেতাশতর ঐতিহ্য অনুসারে কৃষ্ণযজুর্বেদের অন্তর্ভুক্ত
১০) মুণ্ডক ঐতিহ্য অনুসারে অথর্ববেদের অংশ
১১) প্রশ্ন অথর্ববেদের পৈপ্পনাদ শাখার অন্তর্ভুক্ত
১২) মাণ্ডুক্য ঐতিহ্য অনুসারে অথর্ববেদের অংশ

ঐতিহ্য অনুসারে বলতে বোঝান হচ্ছে, যেখানে বৈদিক সাহিত্যের সংগে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ পাওয়া যায় না, সেখানে একটি ঐতিহ্য আছে, তা বিশেষ বিশেষ বেদের সংগে যুক্ত করা।
শঙ্করাচার্য উপরের তালিকার কৌষীতকি অংশ ছাড়া বাকি এগারোটির উপর ভাষ্য লিখেছিলেন।
ভারতীয় দর্শনে আমরা চারটি চিন্তার স্তর পাই। বেদের সংহিতা অংশে বহু দেবতাবাদ, বেদের উপনিষদ অংশে সর্বেশ্বরবাদ, ষড়্‌দর্শনের যুগে জ্ঞানমার্গে মুক্তিবাদ এবং সবশেষে পুরাণের যুগে ব্যক্তিরূপী ঈশ্বরকে ভিত্তি করে ভক্তিবাদ।
বেদ শুধু ধর্মগ্রন্থ নয় দার্শনিক গ্রন্থও বটে। একদিকে যেমন যজ্ঞ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ধর্ম গড়ে উঠেছে, অন্য দিকে ঋষিদের জিজ্ঞাসু মনোভাবও প্রবল হয়ে উঠেছিল। নানা সূক্তের মধ্যে বিভিন্ন দার্শনিক প্রশ্ন উঠে এসেছে। যেমন, এই সৃষ্টি কোথা হতে এল? দেবতা এক বা বহু? বিভিন্ন সূক্তে এইসব প্রশ্নের উত্তরও দেওয়া হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ঋগ্‌বেদের নাসদীয় সূক্ত, পুরুষ সূক্ত এবং আত্মাসূক্তের উল্লেখ করা যায়। এই দার্শনিক চিন্তার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বহু দেবতা নিয়ন্ত্রিত বিশ্বের পরিকল্পনা থেকে এই ধারণা গড়ে উঠে যে বিশ্ব একটি মাত্র নৈর্ব্যক্তিক শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তাকে বলা হয়েছে পুরুষ, আত্মা বা সৎ।
এই চিন্তাধারাই প্রাচীন উপনিষদগুলির মধ্যে পরিণতি লাভ করেছে। ব্যবহারিক প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে ঋষিদের মন জিজ্ঞাসু হয়েছে বিশ্বসত্তার পরিচয় পেতে। সেখানে প্রার্থনা হয়ে উঠল, বিশ্বস্রষ্টা ঋষিকে এমন ধীশক্তি দান করুন যাতে তাঁর প্রকাশকে ধারণা করা যায় (ধিয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ)। এই জিজ্ঞাসার ফলে যে দর্শন জন্ম নেয় তাতে বিশ্বসত্তা কল্পিত হয়েছেন এক সর্বব্যাপী প্রচ্ছন্ন শক্তিরূপে। সকল মানুষ, সকল জীব, সকল বস্তুকে জড়িয়ে নিয়ে তিনি প্রচ্ছন্ন (আড়ালে) থেকেও সবকিছুকে ব্যাপ্ত করে আছেন বলেই তাঁকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে। ব্রহ্মের ধ্বনিগত অর্থও তাই।
সংহিতা অংশের বহু প্রাকৃতিক শক্তির উপর দেবত্ব আরোপ করে বহু দেবতাবাদের পর আসে এই ব্রহ্ম বা সর্বেশ্বরবাদ উপনিষদ যুগে। ষড়্‌দর্শনের যুগে আসে জিজ্ঞাসু অবস্থার পরিবর্তিত রূপ। উপনিষদ যুগে জিজ্ঞাসার প্রেরণা ছিল বিশুদ্ধ কৌতুহলকে চরিতার্থ করা। কিন্তু ষড়্‌দর্শনের যুগে জিজ্ঞাসার পথে উত্তর খোঁজা হয় ব্যবহারিক প্রয়োজনে। ঐ যুগে কর্মফল ভোগ এবং তার জন্য জন্মান্তরের বন্ধন বদ্ধমূল সংস্কারে পরিণত হয় ও এই জন্মবন্ধন সুখকর নয় এই ধারণা তৈরী হয়। কাজেই পরজন্ম থেকে মুক্তির আকাঙ্খা জাগে। আর তার উপায় হিসেবে জ্ঞানমার্গই অবলম্বন হয়। তার ফলে বিভিন্ন দর্শন জন্ম নেয়।
প্রকৃত ভক্তের দৃষ্টিভঙ্গি যা একেশ্বরবাদকে ঘিরে গড়ে ওঠে তার জন্ম হয় ভারতে অনেক পরে। বৌদ্ধ ও জৈন দর্শন ঈশ্বর সম্বন্ধে নীরব। ষড়্‌দর্শনের অধিকাংশ দর্শনও ঈশ্বর সম্বন্ধে নীরব ছিল। যোগদর্শনে ঈশ্বর স্বীকৃত হলেও, তিনি বিশ্বের অনেকগুলি মৌলিক তত্ত্বের একটিমাত্র। ন্যায়সূত্রে ঈশ্বরের উল্লেখ আছে। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই ঈশ্বর পূর্ণ মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হন নি।
তারপরে ঈশ্বরকে বিশ্বতত্তের কেন্দ্রে স্থাপন করে তাঁর উপর সব মৌলিক শক্তি আরোপ করে তাঁকে ব্যক্তিসত্তারূপে কল্পনা করে, ঈশ্বরে ভক্তিই একমাত্র প্রকৃত সাধন পথ বলে প্রচারিত হয়। এইভাবেই ভারতের দার্শনিক তথা ধর্ম সম্পর্কিত চিন্তাধারা চতুর্থবার পরিবর্তিত হয়।
সর্বেশ্বরবাদের চিন্তাধারার সংগে মিলে যাচ্ছে যে উপনিষদগুলি সেগুলিই প্রাচীন উপনিষদের পর্যায়ভুক্ত। অতএব উপনিষদের দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনায় এই প্রাচীন উপনিষদগুলিই নির্ভরযোগ্য।

(চলবে)

কমলা রায়


সাহায্যকারী গ্রন্থ -- উপনিষদ, অখণ্ড সংস্করণ
অতুলচন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্ত্বভূষণ,
মহেশচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক
অনূদিত ও সম্পাদিত

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।