প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

বেদ- উপনিষদ ও সনাতন হিন্দুধর্ম - (৯) (অন্যান্য অনুচ্ছেদ)

এবারে আরো কয়েকটি বিষয়-- যেমন, উপনিষদে বিশ্বতত্ত্ব, শংকরাচার্যের মায়াবাদ; জ্ঞানের স্বীকৃত নীতি, উপনিষদের নীতি এই নিয়ে কিছু বক্তব্য: ----
বিশ্বতত্ত্ব----- ব্রহ্মবাদের প্রকৃতি সহজে বোঝা যাবে কারণ ও উদ্দেশ্য এই ব্যাপারগুলিকে বুঝতে পারলে। এখানে কারণ বিজ্ঞানের কারণ থেকে আলাদা। বিজ্ঞানে ঘটনা পরম্পরাকে পরস্পরের সংগে বিচ্ছেদহীন সম্বন্ধে যুক্ত করে জানার চেষ্টা হয়। দুটি পর পর ঘটে যাওয়া ঘটনার যদি শর্ত ছাড়া অব্যবহিত এবং সর্বকালীন সংযোগ থাকে তাহলে প্রথমটিকে কারণ বলা হয়। উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি অবস্থার সৃষ্টিতে যে যে শক্তি কাজ করে তাকে বোঝার চেষ্টা। এরিষ্টটলের মত অনুযায়ী কারণ চার প্রকার : উপাদান কারণ, নিমিত্ত কারণ, রূপ কারণ, এবং উদ্দেশ্য কারণ (material cause, efficient cause, formaal cause and final cause)। ভারতীয় দর্শনে প্রথম দুটি কারণের প্রয়োগ আছে, শেষের দুটির উল্লেখ নেই। একটি মাটির পাত্রকে উদাহরণ রূপে ধরা যাক। মাটির পাত্রের উপাদান কারণ হল মাটি। তার নিমিত্ত কারণ হল কুম্ভকার, রূপকারণ- ও কুম্ভকার ও উদ্দেশ্য কারণ হল যে উদ্দেশ্যে তাকে ব্যবহার করা হয়।

বিশ্ব হল সৃষ্টি এবং ব্রহ্ম হলেন স্রস্টা । উপনিষদে এঁদের নিবিড় সম্পর্ক এমন ভাবে কল্পিত যে ব্রহ্মের উপর সবগুলি কারণত্ব আরোপ করা যায়। উভয়ের মধ্যে উভয়ে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। যার তাৎপর্য---- বিশ্বের মধ্যে বিশ্বশক্তি আড়ালে থেকে ক্রিয়াশীল। সেই শক্তিই বিশ্বের আশ্রয় এবং সমগ্র বিশ্বকে এক করেছে। বিশ্বশক্তি বিশ্বের মধ্যেই ছড়িয়ে রয়েছে---- এই হল উপনিষদের ব্রহ্মবাদের মূল সুর। ব্রহ্ম সব কিছু ব্যাপ্ত করে আছেন, সব কিছু ধারণ করে আছেন এবং সব কিছুর অন্তরে অধিষ্ঠান করছেন---- উপনিষদের নানা বাণীতে এ কথাই বার বার বলা হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদে এর সারমর্ম বোঝানো হয়েছে এই যে, এই সব কিছুই ব্রহ্ম, ব্রহ্মেই তাদের পুষ্টি, এবং বিলয় (শেষ) "সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম তজ্জলানিতি"।
ব্রহ্মই যে বিশ্বের উপাদান কারণ উপনিষদে এই কথাটির উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। তাই ব্রহ্মের সংগে সৃষ্টির নিগূঢ় যোগ। একটি উদাহরণ যোগে এটা বোঝার চেষ্টা করি। মানুষের তৈরী বস্তুর মধ্যে দুটি জিনিস লক্ষণীয়-- একটি তার বিশেষ রূপ এবং অন্যটি তার উপাদান। যেমন মাটির পাত্রের উপাদান মাটি ও পাত্র রূপে তার প্রকাশ। এখানে মূল তত্ত্ব হল উপাদান ও গৌণ তত্ত্ব হল তার বিভিন্ন রূপে প্রকাশ। উপাদানের বিকার (রূপ বদল) হতেই বিশেষ রূপ বা গৌণ তত্ত্বের প্রকাশ এবং তাকে আলাদা করতে নাম দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই রকমই বিশ্বের মূল তত্ত্ব ব্রহ্ম; তাঁর উপাদান বিভিন্ন রূপে প্রকাশ হয়ে নামের দ্বারা চিহ্নিত হয়ে বহুরূপে প্রকাশ হয়েছে।

এ থেকে মনে হতে পারে ব্রহ্মের রূপ কারণতত্ত্বের উপর তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, উপাদান যখন এক তখন তার পৃথক রূপের তেমন মূল্য নেই। কিন্তু উপনিষদে এমন বচন- ও আছে যেখানে বিশ্বসত্তার বহুরূপে প্রকাশকে গৌণ প্রকাশ বলে নির্দেশ করা হয়নি। কঠ উপনিষদে আছে-- একই ব্রহ্ম বিভিন্ন রূপ ধারণ করেছেন এবং বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে যোগসূত্র হিসাবে প্রচ্ছন্ন ভাবে বর্তমান আছেন। "একো বশী সর্বভুতান্তরাত্মা একং রূপং বহুধা যঃ করোতি"। বহুকে ব্যাপ্ত করেই তাঁর একত্ব।

একই অগ্নির বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রূপে প্রকাশ হলেও অগ্নি বলেই তাকে আমরা চিনি । সেই রকম একই আত্মা বিভিন্ন জীবের রূপে প্রকট হয়েও তিনি তাদের অন্তরে বিরাজমান প্রচ্ছন্নভাবে। একই শক্তির বিশ্বে বহুরূপে প্রকাশ ঘটেছে।
নিমিত্ত কারণের লক্ষণ হল তা সৃষ্টির নিয়ামক শক্তি। ব্রহ্ম যে বিশ্বের অভ্যন্তরে থেকে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রিত করেন এ বিষয়ে উপনিষদে সুস্পষ্ট উক্তি আছে। এখানেই মানুষের কারণের সংগে বিশ্বশক্তির কারণত্বের পার্থক্য। মানুষ যখন নিমিত্তকারণ হিসাবে কাজ করে কিছু নির্মাণ করে, সে তার নির্মাণের বাইরে থেকে যায়, তাকে নিয়ন্ত্রিত করে বাইরে থেকে। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক শক্তি তার ভিতরে থেকেই কাজ করে। কারণ, সে শক্তি প্রকৃতির বাইরে অবস্থিত নয়, অণুর মধ্যে যে প্রোটন, নিউট্রন ও ইলেকট্রন আছে তার নিয়ামক শক্তি তাদের ভিতরেই স্থিত-- যে প্রাণশক্তি দেহের নিয়ন্ত্রণ করে তাও দেহের অভ্যন্তরেই স্থিত। উপনিষদে তাই বলা হয়েছে যে ব্রহ্ম নিয়ামক শক্তি হিসাবে দুই ভাবে কাজ করেন। প্রথম-- তাঁর প্রশাসনে সমগ্র বিশ্ব বিধৃত ও পরিচালিত; দ্বিতীয়ত-- তিনি বিভিন্ন জীবের অন্তরে থেকে তাদের অজানিত ভাবে নিয়ন্ত্রিত করেন। সকল ভূত তাঁর শরীর স্বরূপ এবং তাদের অন্তরে থেকে তাদের নিয়মিত করেন বলেই তিনি অন্তর্যামী। দেহ পরিবর্তিত হয়, কিন্তু তার নিয়ামক শক্তি নিত্য এবং তাই অমৃত।

উপনিষদের ঋষিগণ সামগ্রিক ভাবে বিশ্বের একটি উদ্দেশ্য কারণ- ও আবিষ্কার করেছেন। তাঁদের মতে এই উদ্দেশ্য কারণ হল 'রসের' আস্বাদন। তৈত্তিরিয় উপনিষদে এই রস বলতে ব্রহ্মকেই বোঝান হয়েছে। তিনিই রসস্বরূপ, কারণ, তিনি রস অনুভব করে আনন্দ পান। এই আনন্দ হল শিল্পরসিকের আনন্দ। ব্রহ্ম যখন সব জড়িয়ে সব নিয়ে আছেন তখন তাঁকে শিল্পী, শিল্পরসিক এবং শিল্পকর্মের একই সত্তারূপে কল্পনা করা হয়েছে। তাই বিশ্বসত্তাও রসস্বরূপ হয়ে ওঠেন।

এখন, আনন্দ এই শব্দটি শুধুই সুখ বোঝায় না। তার অর্থ আরো ব্যাপক-- সুখ, দুঃখ সব কিছুকে জড়িয়ে নিয়ে। এই আনন্দ শব্দটির সমার্থবোধক কোন ইংরাজী প্রতিশব্দ নেই। সব থেকে কাছে যায় যে কথাটি তা হল শিল্পতাত্তিক অনুভূতি ( aesthetic emotion )। শিল্পরসিক ক্লাইভ বেল এই কথাটির প্রবর্তন করেন। এই আনন্দ কোন ব্যবহারিক প্রয়োজনের সংগে যুক্ত নয়, এ অহেতুক। উপনিষদ বলতে চেয়েছে বিশ্বসত্তা শিল্পরসিক; তাই শিল্পীর ভূমিকায় আনন্দ পান। এই চিন্তা যুক্তিসংগত, কারণ, বিশ্বশক্তির ব্যবহারিক প্রয়োজন থাকতে পারে না-- তা থাকে মানুষের।

রস উপলব্ধি করতে দুটি বিভিন্ন প্রকৃতির সত্তার প্রয়োজন। বিশুদ্ধ একত্তের মধ্যে রসের উপলব্ধির অবকাশ নেই তার জন্য দরকার দ্বৈত বোধের, প্রয়োজন রূপ- রস- শব্দ- স্পর্শ- গন্ধের জগৎ; চাই সংযোগ স্থাপনের মন। দুই- এর পরিণয়, প্রীতি অবলম্বন করেই তো রসের ধারা সৃষ্টি হবে। সেই জন্য আদিতে একক সত্তা অবস্থায় ব্রহ্ম তাঁর একাকীত্ব উপভোগ করলেন না। রসের উপলব্ধির জন্য বহু ও বিচিত্র রূপে প্রকাশিত হলেন। দ্বিতীয়কে চাইলেন আনন্দের জন্য।
ব্রহ্মের অহৈতুকী তৃপ্তির জন্যই এমনটি হল। না হলে যে তাঁর আনন্দরূপটি প্রকাশ পায় না। বিশ্বসত্তার আপন মাধুরী আপন চক্ষে ধরা পড়ল। মানুষের মনের সামনে বিশ্বের সুন্দর রূপটি ফুটে উঠল। তাই উপনিষদের ঋষি বললেন:- 'মধুবাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ' (বৃহদারণ্যক)। বাতাসে মধু, প্রবাহিনীতে মধু। ব্র্হ্মের মূর্ত প্রকাশকে তিনি অভিবাদন জানালেন আনন্দরূপ এবং অমৃত বলে।

বিশ্বশক্তির উদ্দেশ্য কারণত্তকে এইভাবে স্থাপন করলেন উপনিষদের ঋষিগণ।

রবীন্দ্রনাথের একটি কাব্যাংশে (স্মরণ) উপনিষদ বর্ণিত এই ব্রহ্মবাদের একটি সুন্দর বর্ণনা রয়েছে-

যে ভাবে পরম এক আনন্দ উৎসুক
আপনারে দুই করি লভিছেন সুখ,
দুই এর মিলন- ঘাতে বিচিত্র বেদনা
নিত্য বর্ণ, গন্ধ গীত করিছে রচনা।

(চলবে)

কমলা রায়

সাহায্যকারী গ্রন্থ -- উপনিষদ, অখণ্ড সংস্করণ অতুলচন্দ্র সেন, সীতানাথ তত্ত্বভূষণ, মহেশচন্দ্র ঘোষ কর্তৃক অনূদিত ও সম্পাদিত

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।