তির্যক
দৃষ্টি – সুকান্ত ভট্টাচার্য ও রানার
আমি যখন ক্লাস এইটে
পড়ি, তখন আমাদের বাংলা পাঠ্য বইয়ের কবিতা সঙ্কলনের মধ্যে ছিল
সুকান্ত ভট্টাচার্যের “রানার”। এটি গান হিসেবে আমাদের কাছে এত
পরিচিত ছিল যে কবিতা হিসেবে পড়াটাই ছিল মুশকিল। পড়তে গেলেই চোখের
সামনে ভেসে উঠতো ছোটবেলায় কলকাতার উপকণ্ঠে শারদীয়া জলসার স্মৃতি।
এক গৌরাঙ্গ নবীন যুবা খালি গায়ে, পায়ে নূপুর, হাতে লাঠি ও পিঠে
বোঝা নিয়ে নেচে চলেছে -- পেছনে রেকর্ডে সলিল চৌধুরীর সুরে হেমন্ত
মুখার্জীর গলায় গানের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে।
ব্যাপারটা মনে পড়ল
কিছুদিন আগে দূরপাল্লার গাড়ী চালানোর সময়। গৃহিণী হেমন্তর একটা
সিডি বাজাচ্ছিলেন, যার মধ্যে ছিল রানার গানটি। অসাধারণ সুরেলা
গলা। হঠাৎ কিন্তু একটা লাইনে খটকা লাগলো -- “রানার রানার কী
হবে এ বোঝা বয়ে?”
আমাকে লাইনটা বেশ ভাবিয়ে তুলল। সত্যিই তো, এ বোঝা বয়ে রানারের
কী হবে? ঘরে তার প্রিয়া যে একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগছে, তারই
বা কী হবে? সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটা চিন্তাও মাথায় এলো। রানার
যদি বোঝা না বয়, তবে সে খাবে কি করে? যদিও কবির বর্ণনায় রানার
অর্ধভুক্ত – ক্ষুধিত রানারের ঘরেতে অভাব আছে; সে নিজে ক্ষুধার
ক্লান্তিতে ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাচ্ছে – তবুও বোঝা না বইলে রানার তো
সম্পুর্ণ অভুক্ত থেকে যাবে। সেটা কি কারুর কাম্য?
এইসব বিপরীত চিন্তাধারার
টানা-পোড়েনের মধ্যে আমার হঠাৎ করে ইংরেজিতে যাকে বলে একটা “এপিফ্যানি”
হল। আমার মনে হল রানার কবিতাটি যেন বাঙালীদের অপরিণত অর্থনৈতিক
চিন্তাধারার মূর্ত প্রতীক। মানে আমরা রানারের অত্যধিক কায়িক
শ্রমের কথা ভেবে কষ্ট পাই; তার রাত্রিকে অল্প দামে কেনা হয়েছে
বলে বিপন্ন বোধ করি। আথচ রানার যে কাজটি করে চলেছে – নানা লোকের
বিভিন্ন অনুভূতিতে লেখা চিঠি বয়ে নিয়ে গিয়ে, বহু লোকের কাছে
তাদের প্রয়োজনীয় অর্থ পৌঁছে দিয়ে – সেটির যথাযোগ্য ও সশ্রদ্ধ
মূল্যায়ন করি কি? ঘর্মাক্ত কলেবর রানারের ক্লান্তশ্বাসের প্রতি
কবির সহানুভূতি বাঙালীর সংবেদনশীল মনকে নাড়া দেয়। কিন্তু আমরা
কি ভাবি যে এই কাজটি প্রতি যুগে জনস্বার্থে কাউকে না কাউকে করতেই
হবে? আর সে লোকটি খবরের বোঝা নিয়ে রাতে দৌড়েই যাক বা ভ্যান কিংবা
ট্রাক চালিয়েই যাক, তার প্রিয়াকে একা শয্যায় সে রাতটি কাটাতেই
হবে?
শ্রমিকের প্রতি দরদ, অথচ শ্রমের প্রয়োজনীয়তা বা মূল্য সম্পর্কে
নিস্পৃহ নীরবতা – এর ভেতর দিয়ে রানার কবিতায় ফুটে উঠেছে উচ্চবর্ণ
মধ্যবিত্ত বাঙালীর শ্রমবিমুখতার প্রতিচ্ছবি। আমার এ মন্তব্য
তৎকালীন বাঙালী সমাজের চিন্তাধারার বিষয়ে; কবির ওপর দোষারোপ
নয়। সুকান্ত ভট্টাচার্য যখন মারা যান, তখন তার বয়স একুশও হয়নি।
(বেঁচে থাকলে তার বয়স একুশ হত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভের দিন।)
তখনকার বঙ্গ সংস্কৃতির ওপরে বড় প্রভাব ছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের।
তারই ছায়া আমরা দেখতে পাই রানার কবিতায় – ভোরের পূর্বকোণ লাল
হওয়ার বার্তা বারংবার পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার মাধ্যমে। কবি
এ বিষয়ে নিশ্চিত যে সেই লাল আলোর স্পর্শে রানারের দুঃখের কাল
কেটে যাবে। কিন্তু কেন বা কীভাবে সেটা হবে, তার অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা
বাঙালী চিন্তাবিদরা পরিষ্কার করে কখনই দেয় নি। রানার কবিতাটি
তাই আমার কাছে বাঙালীর অপরিপক্ক অর্থনৈতিক মানসিকতার এক অসামান্য
প্রতিফলন। এতে শ্রমিকের প্রতি রোম্যান্টিক আবেগ রয়েছে, কিন্তু
শ্রমের মর্যাদার কোনো উল্লেখ বা সম্মানিকতা নেই। বরং প্রচ্ছন্ন
রয়েছে উচ্চবর্ণ বাঙালীর শ্রম সম্পর্কিত ধারণা – যে ব্যাপারে
বিভূতিভূষণের রূপো কাকার কথাই বেশি করে মনে পড়ে, “বামুনের ছেলে
হয়ে কি লাঙ্গল চষতি যাবা?”
অমিতাভ
বাগচী
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)