ভারতের সংরক্ষিত বন্য জন্তু
উদ্যান গুলির মধ্যে অসমের নগাঁও আর গোলাঘাট জেলাদ্বয়ের মধ্যে
বিস্তৃত “কাজিরাঙ্গা জাতীয় উদ্যান” অন্যতম প্রাচীন। তবে ১৯০৫
সালে স্থাপিত এই উদ্যানে দর্শনার্থীর প্রবেশের জন্য অনুমতি অনেক
পরে, ১৯৩৬ সালে দেওয়া হয়। ইতি মধ্যে হিমালয়ের কোলে অধুনা উত্তরাখণ্ডে
‘করবেট জাতীয় উদ্যানের’ পত্তন হয়ে যায়। তবে এই উদ্যানের বৈশিষ্ট্য
হলো ক্রমশ ‘অন্তিম পথ যাত্রী’ এক শৃঙ্গী গণ্ডারের সংরক্ষণ। এই
কাজে এই উদ্যান যথেষ্ট সফলতা লাভ করেছে মানতেই হবে। কেননা ১৯০০
সালে সমগ্র পৃথিবীতে, যদিও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই এর বাস, এর
সংখ্যা মাত্র ২০০ ছিল, আর ১৯০৫ সালে এই উদ্যানের স্থাপন কালে
অবিভক্ত অসমে, এর সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ থেকে ২০টি। আর এই বছরে,
অর্থাৎ ২০১২ সালে এই সংরক্ষিত উদ্যানেই তা হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে
৩০৪টি বেড়ে ২,২৯০টি। মাত্র কয়েকটি এই শ্রেণীর গণ্ডার নেপালের
চিতওনে পাওয়া যায়, পৃথিবীর আর কোথাও এদের বাস স্বাধীন ভাবে নেই।
এই উদ্যানের ইতিহাস এবং আরও কিছু তথ্য আপনারা জানতে পারবেন ভিডিওতে।
উদ্যানে আমরা একই দিনে
দুবার, সকালে প্রধান প্রবেশদ্বার কোহরা দিয়ে ও বিকালে বাগুরি
দিয়ে ঢুকে ঘুরেছিলাম। দুবেলাই আমাদের গাড়ির সারথি ছিলেন মধ্যবয়সী
শ্রীকেনারাম বোরা। ঘোরার মধ্যে লক্ষ করেছিলাম যে কেনারামবাবুর
অসমের লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে বেশ জ্ঞান আছে। উদ্যানের জন্তুদের
এবং সেখানকার গাছ-পালা সম্পর্কে জ্ঞান তো তাঁর জীবিকার জন্যে
থাকা স্বাভাবিক, যদিও তা উদ্যানের গাইডের দ্বারা প্রদর্শিত হবার
কথা, কিন্তু যে কোনও কারণে সরকারী গাইড আমরা দুবেলাই পাইনি।
যাই হোক তাঁর জঙ্গলের মধ্যে শিমুল ফুলের আর বৈশাখ মাসের বিহু
উৎসবের সময় মানুষের মনের সাযুজ্যের কথা গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ
করা আমাদের বেশ ভাল লেগেছিল, যদিও সুরের মূর্ছনা গানের মধ্যে
কিছু ছিল না। উদ্যানের গাছ-পালা-জীব-জন্তু দেখা ছাড়া এ এক বড়
পাওনা হয়েছিল আমাদের কাছে ।
২০০৬ সালে এই উদ্যান বাঘ্র
প্রকল্পের (Tiger Reserve) আওতায় আসে তার কারণ নাকি এখানে বাঘের
সংখ্যা ঘনত্ব শুধু ভারত নয়, পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক, প্রতি ৫
বর্গ কিমি.তে একটি, এবং ২০০০-এর বাঘ-সুমারি মতে মোট সংখ্যা ৮৬টি।
মনে হয় এখানে জলাভূমির আধিক্যের জন্যেই হয়ত বাঘের দর্শন পাওয়া
স্বাভাবিক নয়। তবে, সুন্দরবনেও সময় সময় বাঘ দেখতে পাওয়া যায়
স্থল ভাগ খুবই কম থাকা সত্ত্বেও অথচ এখানে কদাচিৎ বাঘ দেখার
কথাই শুনেছি। আমার সীমিত জ্ঞানে জানি যে সাধারণ ভাবে কোনও জঙ্গলে
বাঘ থাকতে গেলে সেখানে যথেষ্ট পরিমাণ বাঘের খাদ্য থাকতে হয়,
আর কে না জানে বাঘের সবথেকে প্রিয় খাদ্য হরিণ, বিশেষ করে চিতল
(spotted deer) এবং সম্বর। এখানে চিতল আছে বলে উদ্যানের পরিসংখ্যানে
বলে না এবং সম্বরের সংখ্যা দেওয়া আছে মাত্র ৫৮টি ।
চিতলের কথা উঠতে আমার আর
এক প্রকারের চিতলের কথা মনে পড়ে গেল, জলের প্রাণী, অর্থাৎ চিতল
মাছ। এখানে এক বিরাট ঝিল আছে এবং তাতে প্রচুর সংখ্যক চিতল মাছ
রয়েছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেক বার ওদের ঘাই দিতে দেখেছিলাম।
ভিডিও ছবি নিয়েছিলাম, কিন্তু বেশ হৃদয়গ্রাহী বা striking না
হওয়ার কারণে অনিচ্ছা সত্ত্বেও উদ্যানের বর্ণনার সম্পূর্ণতা দেবার
উদ্দেশ্যে এখানে ভিডিওটি উপস্থিত করলাম ।
এখানকার গাছ-পালার (Flora)
বৈচিত্র্যও কম নয়। ঘাস ও বড় গাছ প্রচুর আছে, যা যে কোনও জঙ্গলে
থাকবেই। ঘাসের মধ্যে Elephant Grass প্রচুর আর গাছের মধ্যে আধিক্য
শিমুলের ।
বড় জন্তুর মধ্যে হাতি
অন্যতম। এখানে এদের বংশ বৃদ্ধি করার মত পরিবেশ আছে এবং এদের
সংখ্যা প্রায় ২০০০। বাচ্চা সহ হাতি এখানে সহজেই দেখা যায়। উপস্থিত
ভিডিওতে আমাদের দেখা হাতি পরিবার দেখুন ।
আরও বড় প্রাণীর মধ্যে
এখানে প্রচুর সংখ্যক (১৬৬৬) বন্য মহিষের (Wild Water Buffalo)
ও কিছু (৩০) গৌর উল্লেখযোগ্য ।
পাখির কথা না উল্লেখ করলে
কাজিরাঙ্গার কথা বলা সম্পূর্ণ হবে না। প্রধাণত জলাভূমি হবার
কারণে প্রচুর স্থানীয় ও পরিযায়ী পাখি এখানে দেখা যায়। তবে পক্ষীরালয়ে
পাখি দেখা যত সহজে ও ভাল ভাবে হয়, তা এখানে হয় না। অবশ্য আমরা
মে মাসে গিয়েছিলাম বলেও সে রকম ভাল দেখতে পাইনি। তাও যা দেখেছি,
হেলাফেলা করার নয়। এখানে যে সব পাথি বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়,
তাদের নামের তালিকা দিয়ে কোনও লাভ নেই, আমরা যা দেখেছিলাম তার
ভিডিও আপনাদের দেখতে দিলাম ।
এই বার আসি কাজিরাঙ্গার
খ্যাতি প্রধাণত যে কারণে, সেই কথায়। শুরুতেই এক শৃঙ্গী গণ্ডারের
(Great Indian One-horned Rhinoceroses ) কথা বলেছি, এবং এর
দেখা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত উদ্যানের মধ্যে পেয়েছি। আমাদের
সেই দেখার কিছুটা অংশ আমি আপনাদের জন্যে উপস্থিত করছি ।
ভিডিওর মধ্যেই এদের সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য দেওয়া আছে। যদিও
কাজিরাঙ্গার ইতিহাসের কথা বলার সময় বলা হয়েছে তা হলেও আবার জানাই
যে ইউনেস্কো এই উদ্যানকে World Heritage Site আখ্যা দিয়েছে এক
শৃঙ্গী গণ্ডারের রক্ষা ও বংশ বৃদ্ধি করার সফলতার জন্যে। এদের
দর্শন আর জঙ্গলে ঘোরার জন্যে খোলা জিপ আছে, আর আছে মরশুমে হাতির
ব্যবস্থা। তবে হাতির সংখ্যা সীমিত হবার কারণে অনেক আগে থেকে
ব্যবস্থা করতে না পারলে বিফল মনোরথ হতে হবে। লজ থেকেই আপনি এই
সবের ব্যবস্থার খবর পেয়ে যাবেন।
অসমের রাজধানী গুয়াহাটি
থেকে গুয়াহাটি-জোড়হাট জাতীয় সড়ক ৩৭ হয়ে ২১৭কিমি. পূর্বে আর জোড়হাট
থেকে ৯৭কিমি. পশ্চিমে কোহরা চৈরালির উত্তর দিকে উদ্যান আর দক্ষিণ
দিকে অসম ট্যুরিসিমের দুই রেস্ট হাউস, ‘বনশ্রী’ আর কিছুটা ব্যয়সাপেক্ষ
‘বনানী’। চৈরালি থেকে এই দুইএরই অবস্থান প্রায় ৫০০মি. দূরে,
তবে পথের একদিকে ঘন বড় বড় প্রধানত চাঁপা গাছ আর অন্য দিকে চা
বাগান আপনাকে বেশ আনন্দ দেবে। এখানে এদের আরও একটি লজ আছে, ‘কুঞ্জবন’।
এগুনোয় বুকিং করতে হলে +৯১৩৭৭৬-২৬২৪২৩-এ ফোন করতে পারেন। গুয়াহাটি
রেল স্টেশনের লাগোয়া অসম টুরিসিমের অফিস থেকেও এখানে থাকার ব্যবস্থা
করতে পারেন, তবে মরশুমে, অর্থাৎ নভেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে
এখানে থাকবার জন্যে অনেক আগে থেকেই বুকিং করতে হবে। অসম ট্যুরিসিম
ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ‘অরণ্য-লজ’ আর প্রশান্তি-লজ’ আছে এখানে,
এদের ফোন নম্বর, +৯১৩৭৭৬-২৬২৪২৯। ব্যক্তিগত মালিকানায় বেশ কিছু
সংখ্যক ট্যুরিস্ট রিসর্ট গড়ে উঠেছে কোহরা ও তার আশপাশে। তবে
পূর্ব থেকে এদের বিষয়ে জানা না থাকলে থাকা সুখের না হতেও পারে।
এদের কয়েকটির নাম ও ফোন নম্বর উল্লেখ করছি। প্রত্যেকটির Code
+৯১৩৭৭৬, ও পরের প্রথম তিনটি সংখ্যা, ২৬২। ওয়াইল্ডগ্রাস রিসর্ট
(০৮৫), ধানসিরি লজ (৫০১), গ্রিন-রিড (৪১৭), ওয়াইল্ডলাইফ সোসাইটি
(৪৯৪), আশ্রয় (১৬৩)।
অসম ট্যুরিসিম আর ট্যুরিসিম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন অব অসমের
ওয়েবসাইট যথাক্রমে www.assamtourism.org ও www.assamtorismonline.com।
কাজিরাঙ্গা বা সামগ্রিক ভাবে অসমের বিষয় জানতে হলে এই সাইট সার্ফ
করা কাজের হবে।