প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

সাদা চোখে পুদুচ্চেরি

সকাল ১০টার কিছু আগে পুদুচ্চেরি স্টেশনে এসে পৌঁছলাম। আগে থেকেই আমাদের গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। আমরা স্টেশন থেকে সোজা পন্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রমের নিয়ন্ত্রিত থাকবার ব্যবস্থাপক অফিস, ‘বুরো সেন্ট্রাল’ হয়ে ‘নিউ সুইট হোমে’ চলে যাই আর স্নানাদি করে কিছু সময় পরে আশ্রমের ডাইনিং হলে দুপুরের খাবারের জন্যে হাজির হই। আশ্রমের খাবার ব্যবস্থা প্রায় তাঁদের সম্পূর্ণ খরচে হয় তাই জন-প্রতি মাত্র ২০টাকায় সারাদিনের প্রসাদ পাওয়া যায়। হোমগুলিতে যাঁরা থাকেন, তাঁদের জন্যে সেখান থেকেই খাবারের কুপন দেওয়া হয়।

মুরুগন, আমাদের ভাড়া করা ট্র্যাভলারের চালকের কথা মতো আশ্রম, সমাধি, সমুদ্রের ধার, এ সবই আমাদের হোমের কাছেই তাই প্রথমেই এখান থেকে ১৯কিমি. দূরের দ্রষ্টব্য, ‘অরোভিল’ দেখাতে নিয়ে গেল। ওখান থেকে ফিরে এসে কাছেই এক মন্দির দেখতে গেলাম। তার পর আশ্রম ও সমাধি দেখে সমুদ্রের ধারে অনেকটা সময় কাটিয়ে ডাইনিং হলে আবার হাজিরা দিলাম। প্রসাদ পাবার পর অবশ্য ‘হোমে’ সরাসরি না ফিরে স্থানীয় এক বাজার এলাকায় কিছুক্ষণ বেড়িয়ে আসলাম।

কী কী দর্শনীয় স্থান দেখলাম সেগুলির নামই মাত্র আপনাদের শোনালাম। এবার এদের বর্ণনা করার চেষ্টা করি একে একে। পন্ডিচেরি দর্শন মানেই অরবিন্দ ও ‘মাদার’ সম্পর্কীয় স্থানের দর্শন আর তাঁদের কথা বলা। আমার থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি এনাদের বিষয় জানেন অনেক অনেক জন মানুষ। তা সত্ত্বেও ভ্রমণ কাহিনির সম্পূর্ণতা দেবার খাতিরে আমি এই বিষয়ে কিছু জানাই।

“শ্রী অরবিন্দ আশ্রম” গঠন করেন শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ (পরবর্তী কালে শ্রীঅরবিন্দ নামে জগদ্‌বিখ্যাত হন) ২৪ নভেম্বর ১৯২৬ পন্ডিচেরিতে। আলিপুর জেলে বন্দী থাকাকালীন তাঁর পরিজ্ঞান বা vision লাভ হয় এবং সেই পরিজ্ঞান পৃথিবীর মানুষের মধ্যে প্রচার করার উদ্দেশ্যে এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠা করেন। তবে মাত্র এক মাসের মধ্যেই শিষ্যা ও ‘সহকর্মী’ মিরা আলফাসা (Mirra Alfasa), পরে বিখ্যাত হন ‘মাদার’ হিসাবে, তাঁকে আশ্রমের যাবতীয় ভার প্রদান করে নিজে অন্তরালে চলে যান। শ্রী অরবিন্দের ‘যোগ’ সাধনার মূলে আছে ‘সাধকের’ জাগতিক জীবন-যাত্রা ত্যাগ না করে ঈশ্বরের মধ্যে লীন হয়ে যাওয়া। এই লীন হয়ে যাবার জন্যে কোনও বিশেষ কর্ম পদ্ধতি অবলম্বন করার কথা তিনি বলেননি। তাঁর মতে যে যার নিজের মত ঈশ্বরের আরাধনা করবে এবং সমাজের ভালর জন্যে কাজ করে যাবে। আশ্রমে যোগদানের জন্যে কোনও বিশেষ সময় বা পদ্ধতি বা পথ অবলম্বন করতে হবে না। নিজেকেই উচ্চ স্তরে অন্য কারোর সাহায্য ব্যতিরেকে পৌঁছতে হবে। আমরা তাই আশ্রমে কোনও বিগ্রহ বা দেবতা দেখতে পেলাম না। আশ্রম মানে খালি শান্ত ভাবে বসে চিন্তা করার জায়গা, আশ্রম মানে মাঠে কাজ করা, আশ্রম মানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা দান আর গ্রহণ করার জায়গা। এবং আশ্রম নাগরিক সভ্যতার বাইরে কোনও ফাঁকা এক জায়গা নয়, বরণ, ব্যস্ত পথের ধারে, ব্যস্ত শহরের মাঝে এক বাড়ি। শ্রী অরবিন্দের সমাধি এক বাড়ির মাঝারি আকারের গাছ-পালা ছাওয়া উঠানের মাঝে আয়তকার বাঁধানো ১মি. মতো উঁচু বিভিন্ন ফুলে দৃষ্টিনন্দন ভাবে সাজানো বেদী। শান্ত পরিবেশ, স্বেচ্ছাসেবী সেবক-সেবিকারা লক্ষ রাখছেন যেন কোনও দর্শক শব্দ না করে। দর্শকদের মধ্যে অনেকে মাটিতে বসে, বেদীতে মাথা রেখে কিছুক্ষণের জন্যে ঋষীর ধ্যানে মগ্ন থেকে তাঁদের ভক্তির প্রমাণ রাখছেন। সমাধির ছবি তোলার নিষেধের কারণে সমাধির ছবি না তুলে বাড়ির বাইরের ছবি তুললাম। (চিত্র-১, অরবিন্দের সমাধি মন্দির)

চিত্র-১, অরবিন্দের সমাধি মন্দির

সময়ের সারণীতে অবশ্য আশ্রম ও সমাধির আগে অরোভিল দেখতে গিয়েছিলাম। এক্ষেত্রেও অরোভিলে কি দেখলাম জানানোর আগে এর বিষয়ে কিছু না বললে বর্ণনা সম্পূর্ণ হবে না।

‘মাদার’ প্রথম পন্ডিচেরিতে শ্রী অরবিন্দের দর্শনে আসেন প্রায় ৩৬ বছর বয়সে ১৯১৪ সালে। তার আগেই তিনি আধ্যাত্মিক বা পারমার্থিক জগতের উচ্চস্তরে অবস্থান করছেন। কিন্তু ঋষীর দর্শন হতেই তাঁর পরম-গুরুর সাক্ষাৎ পেয়েছেন বলে বুঝতে পারলেন। তবে তখনই বিশেষ কিছু কারণে পন্ডিচেরি পাকাপাকি ভাবে থাকা হয়ে ওঠে না, যা আরও প্রায় ৬বছর পরে এখানে ফিরে এসে করেন। ১৯২৬ সালে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করার এবং মাস-খানেক পরে আশ্রম পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। ধীরে ধীরে এই আশ্রম বিরাট আকার ধারণ করে ও বিশ্ববিখ্যাত হয়ে ওঠে।
ক্রমশ মাদারের মনে হতে থাকে শ্রীঅরবিন্দের নির্দেশিত পথে যোগ সাধনা ঠিক মতো করতে গেলে সঠিক পরিবেশের প্রয়োজন। তবে আমার মনে হয়েছে যে মাদারের এই ধারণা, তাঁর গুরুর মতবাদের পরিপন্থী (ভক্ত জনেরা আমায় ক্ষমা করবেন কেননা আমার এই কথা বা ভাবনা আবার তাঁদের ধারণা বা জ্ঞ্যানের সঙ্গে মেলে না)। অর্থাৎ, “পৃথিবীতে এমন এক স্থান হতে হবে যেখানের সম্বন্ধে কোনও রাষ্ট্র বলতে পারবে না যে, ‘এটা আমাদের অধিকৃত স্থান’। যেখানে সকল শুভেচ্ছা এবং সত্য অভীপ্সা সহ মানুষ স্বাধীন ভাবে পৃথিবীর নাগরিক রূপে কেবল মাত্র শাশ্বত সত্যের অনুগামী হয়ে থাকতে পারবে। এ হবে শান্তি, সমস্বরতা ও সামঞ্জস্যের এক স্থান যেখানে মানুষ তার লড়িয়ে মনোভাবকে কেবল মাত্র নিজের দুঃখ ও দৈন্যের কারণগুলোকে পরাজিত করার জন্যে, নিজের দুর্বলতা ও অজ্ঞানতাকে পরাভূত করার জন্যে, নিজের সীমাবদ্ধতা ও অসমর্থতাকে পার করার জন্যে ব্যবহার করবে ও যেখানে জীবনীশক্তি ও মানসিক উন্নতির চেষ্টা ভোগ-লালসা ও জাগতিক সুখ-সুবিধা পাবার থেকে প্রাধান্য পাবে”। এখানেই শেষ নয়, আরও অনেক ভাল ভাল উদ্দেশ্য ভরা ‘অরোভিল’ গঠনের লক্ষ হিসাবে বলা আছে, যা পড়তে পড়তে যে কোনও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ অভিভূত হয়ে যাবে এবং সেই স্থানে নিজের জীবন কাটাবার ইচ্ছা প্রবল ভাবে তাড়না করবে।

এই বিষয়ে আলোচনা করার মতো আমার জ্ঞান নেই, তাই কেবল মাত্র ‘অরোভিল’ গঠনের লক্ষের কথা জানিয়ে বলি যে মাদার ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ সালে এই স্থানের জন্ম দেন। এই দিন ১২৪টি রাষ্ট্র ও ভারতের তদানিন্তন ২৩টি রাজ্য থেকে যুবক-যুবতিরা এক মুঠো করে তাদের নিজেদের দেশের মাটি মানব একতার প্রতীকরূপি একটি কমলাকৃতি কলশে ভরে দেন। এই কলশ কেন্দ্র করে মহাবিশ্বের প্রতীকরূপি এক বিশেষ প্রকারের স্বর্ণ-গোলক তৈরি করা হয়েছে, যা মাতৃমন্দির নামে পরিচিত (চিত্র-২, মাতৃমন্দির, চিত্র-৩, মাতৃমন্দিরের ভিতরে ১ ও চিত্র-৪, মাতৃমন্দিরের ভিতরে ২ )।

চিত্র-২, মাতৃমন্দির

মাতৃমন্দিরের এবং শহরের স্থপতি ‘রজার অজের’, গোলকের উপর ১৪০০টি সোনার প্রলেপ দেওয়া বড় বড় চাকতি দিয়ে মুড়ে দিয়েছেন যা দূর থেকে অতি সুন্দর দেখতে লাগে। এই মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন হয় ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১। তবে কাজ আরম্ভ হয় অনেকটা পর, ১৯৭২ সালে। এর প্রধান স্তম্ভ চারটির গঠন শেষ হয় ১৭ নভেম্বর ১৯৭৩ সালের ১৯:২৫ মিনিটে, ঠিক তখনই মাদার তাঁর নশ্বর দেহ ত্যাগ করেন। মাতৃমন্দির কেন্দ্র করে পন্ডিচেরির আশ্রম থেকে প্রায় ১৯কিমি. দূরে বঙ্গোপসাগরের ধারে ‘অরোভিল’ শহর গঠনের মহাযজ্ঞ চলেছে, যার আয়তন ২৫.৬ বর্গকিমি. এবং এর চারটি অংশ থাকবে। শহর ঘিরে বনভূমি তৈরির কাজ অনেক এগিয়ে গেছে।

আমরা দেখলাম পন্ডিচেরি থেকে এখানে আসার পথের অবস্থা অনেক জায়গায় ভাল নয়। তার কারণ, আমার মনে হলো এই বছরের (২০১২) জানুয়ারির শেষের দিকে এই অঞ্চল দিয়ে বিধ্বংসী ও তীব্র ঝড় বয়ে যাওয়া। রাস্তার ধারে অসংখ্য নারকোল, কাজু ও অন্যান্য গাছ ভেঙ্গে পড়ে আছে দেখতে পেলাম ।

আমরা অরোভিল এসে এই বনভূমি প্রবেশ করার মুখে বিভিন্ন নাগরিক ব্যবস্থাদি দেখলাম, যেখানে আশ্রমের তৈরি বিভিন্ন শিল্প-কর্ম বিক্রয়ের ব্যবস্থা, রেস্তোঁরা, রিসেপ্‌সন সেন্টার, ইত্যাদি রয়েছে। বাড়িগুলি আশপাশের গঠিত বনভূমির সঙ্গে সুন্দর ভাবে মিশে আছে ।

রিসেপ্‌সন সেন্টার থেকে মাতৃমন্দির ‘ভিউ-পয়েন্ট’ যাবার জন্যে অনুমতি-পত্র নিয়ে নতুন তৈরি বন-ভূমির মধ্যে দিয়ে লাল-মাটির রাস্তা ধরে অন্তত ১কিমি. হেঁটে পৌঁছলাম।

সেখান থেকে মাতৃমন্দির দর্শন করলাম অনেকক্ষণ গাছের ছায়াতে ছোট ছোট নুড়ির আকারে লাল পাথর বিছানো ‘কার্পেটের’ উপর বসে। মন্দির ভিউ-পয়েন্ট থেকে প্রায় শ’খানেক মিটার দূরে ।

শুনলাম কেবল মাত্র সকালে মন্দিরে প্রবেশ করার জন্য অনুমতি দেওয়া হয়ে থাকে। আমাদের সে সুযোগ ছিল না তাই তা করা যায়নি। বাকি সময়ে এই ‘ভিউ-পয়েন্ট’ থেকেই মাতৃ-মন্দির দর্শনের নিয়ম। মন্দিরের ভিতরে শুনেছি এক কাচের গোলক রাখা আছে দল মেলা পদ্মের মত মেঝের কেন্দ্রের উপর এবং সমগ্র অন্দর ভাগে অপূর্ব সুন্দর কারু-কার্য করা আছে। ইন্টারনেটে কিরণ সাহানি নামে এক ব্লগারের ব্লগ থেকে দুটি ছবি উপস্থিত করেছি ‘মন্দিরের’ অন্দরাংশ বোঝাবার চেষ্টায়। চিত্র-৩-এ ভিতরে রাখা সেই কাচের গোলক আর চিত্র-৪-এ সমগ্র ভিতরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।

চিত্র-৩, মাতৃমন্দিরের ভিতরে ১

চিত্র-৪, মাতৃমন্দিরের ভিতরে ২

প্রায় ১৬:১৫ মিনিটে আমরা পন্ডিচেরি ফিরে এসে আশ্রম ও সমাধি দর্শন করি যেখানকার বর্ণনা আগেই করা হয়েছে।

(পরের সংখ্যা)

ড. শুভেন্দু প্রকাশ চক্রবর্তী

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।