প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

নাস্তিকতা প্রসঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বিদ্যাসাগর কি নাস্তিক ছিলেন? প্রশ্নটি বার বার মনে ফিরে আসে। এই কারণে ফিরে আসে যে, আশৈশব আমরা শিখেছি ঈশ্বরচন্দ্র নামক বাহ্যত ইস্পাত কঠিন পুরুষটি আসলে দয়া ও বিদ্যার সাগর। কিন্তু বহু খোঁজাখুঁজোর পরে একটি প্রায় না জানা বিষয় পাওয়া গেছে তা হল ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ঘোর যুক্তিবাদী এবং নাস্তিক। ভাববাদী দর্শনের কুৎসীত বিষ, ধর্মীয় উন্মাদনা, যেভাবে আমাদের চৌকাঠ থেকে খিড়কিতে উঁকি মারছে তখন মনে হয় একবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নাস্তিক ও যৌক্তিক দিকটা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন।

বাঙালীর হৃদয়ে বিদ্যাসাগর নামটি আজও অনন্য ও বিস্ময়কর ! চাল নেই, চুলো নেই, ধন কৌলিন্য নেই, মাসিক ছ-টাকা বেতনের সওদাগরী অফিসের এক কেরাণীর ছেলে প্রধানত সংস্কৃত শিক্ষার পুঁজি ও ইংরেজীর ব্যবহারিক জ্ঞান নিয়ে সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি আন্দোলনের শীর্ষে আরোহন করলেন, হিমালয় সদৃশ উন্নত মস্তক পুরুষ হিসেবে বাঙালী জাতির প্রকৃত জনকের মর্যাদা পেলেন ক এ এক বিরলতম ঘটনা। টুত্লো পণ্ডিতের ঘরের ছেলে শাস্ত্রীয় শিক্ষাকে সম্বল করে কি ভাবে শ্রেষ্ঠ মানবতাপ্রেমী, নিরীশ্বরবাদী ও যুক্তিবাদী সমাজ সংস্কারক হয়ে উঠলেন তা এখনও গবেষণার অপেক্ষায়। স্থিতাবস্থা ও অন্ধকারপন্থীদের নির্মম নিন্দা-মন্দ সত্বেও জীবিতকালেই বিদ্যাসাগরের ছবি বিক্রী হত।(১)

বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান মনস্কতার অকাট্য প্রমাণ, ধর্ম সম্পর্কে তাঁর নিস্পৃহ মনোভাব। শ্রীরামকৃষ্ণ কোনও ভাবেই বিদ্যাসাগরের মুখ থেকে ঈশ্বর সম্বন্ধে কোনও স্থির বিশ্বাস বা ভক্তির একটি কথাও আদায় করতে পারেন নি। যতদূর জানা যায় তিনি কোনও ধর্মযাজকের কাছে ঘেঁষেণ নি, মন্দির যান নি, পুজো আর্চা জপতপও করতেন না। কিন্তু তিনি মানবতায় উদ্বুদ্ধ দয়ার সাগর। এত সব সত্বও স্বয়ং বিবেকানন্দ ভগিনী নিবেদিতাকে বলেছেন, শ্রীরামকৃষ্ণের পরেই তাঁর গুরু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।(২) পাঠ্য বিষয় দর্শন সম্পর্কে তাঁর উক্তি - কতগুলো কারণে সংস্কৃত কলেজে বেদান্ত ও সাংখ্য আমাদের পড়াতেই হয় -----কিন্তু সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্ত সে সম্পর্কে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই '। (৩)

শুধু তাই নয় আচার্য কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্যের লেখা থেকে জানা যায় - ঐবিদ্যাসাগর নাস্তিক ছিলেন, একথা বোধ হয় তোমরা জানো না, যাঁহারা জানিতেন তাহারা কিন্তু সে বিষয় লইয়া তাঁহার সঙ্গে বাদানুবাদে প্রবৃত্ত হইতেন না -----।(৪) অত্যন্ত সখেদে বিদ্যাসাগর কালজয়ী কয়েকটি মন্তব্য করেছিলেন, তা নিচে বিধৃত হল:
'দেশের লোক কোনও শাস্ত্র মানিয়া চলে না, লোকাচার ইহাদের ধর্মও' - আজীবন এই ছিল বিদ্যাসাগরের ধারণা, তাই তিনি লোকাচার স্বরূপ কুসংস্কার থেকে ধর্মকে মুক্ত করতে গিয়ে সংশয়বাদী হয়ে ওঠেন।(৫) ' দুঃখের বিষয় আমি এ বিষয়ে ব্যালেনটাইনের সঙ্গে একমত নই।-----শাস্ত্রে যার বীজ আছে এমন কোনও বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনলে সেই সত্য সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা জাগা দূরে থাক, তার ফল হয় বিপরীত। ----শাস্ত্রীয় কুসংস্কার আরও বাড়তে থাকে, তারা মনে করেন যেন শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রেরই জয় হয়েছে। বিজ্ঞানের জয় হয় নি।'(৬)
উত্তরকালের Raionalist বা যুক্তিবাদীদের জন্য তিনি এক মহামন্ত্র দিয়ে গিয়েছিলেন যা যুগে যুগে যুক্তির আকাশে ধ্রুবতারর মতো জ্বলজ্বল করবে। উক্তিটি ছিল, 'ধর্ম যে কি তাহা মানুষের জ্ঞানের অতীত এবং বর্তমান অবস্থায় ইহা জানিবার কোনও প্রয়োজন নাই।' (৭)

এবার আসা যাক বিদ্যাসাগরের ধর্মাভাবনা সম্পর্কে তাঁর জীবনীকাররা কি বলেছেন সেই আলোচনায়। চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় একস্থানে উল্লেখ করেছেন, 'তাঁহার নিত্যজীবনের আচার-ব্যবহার, ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন অবস্থাবান হিন্দুর অনুরূপ ছিল না, অপরদিকে নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের পরিচয়ও কখনো পাওয়া যায় নাই'। পাশাপাশি আরও এক জীবনীকার বিহারীলাল সরকার অভিমান ভরে লিখেছেন, 'দুঃখের বিষয় অধ্যাপকের বংশে জন্ম লইয়া ব্রাহ্ম্ণ পণ্ডিতের সন্তান হইয়া, হৃদয়ে অসাধারণ দয়া, পরদুঃখ কাতরতা প্রবৃত্তি পোষণ করিয়া হিন্দু শাস্ত্রের প্রতি, হিন্দু ধর্মের প্রতি তিনি আন্তরিক দৃষ্টি রাখিলেন না কেন? ইহাতে হিন্দুর অনিষ্ট হইয়াছে। হিন্দু ধর্মে আঘাত লাগিয়াছে। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণের বংশধর বিদ্যাসগর উপনয়নের পর অভ্যাস করিয়াও ব্রাহ্মণের জীবনসর্বস্ব গায়ত্রী পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছিলেন'।

২২শে জানুয়ারি, ১৮৫১ বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হন। এর অল্প কয়েকমাস পরে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও কায়স্থরা কলেজে প্রবেশাধিকার পায়। আগে কলেজে পড়ার অনুমতি ছিল শুধু ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের। এক বছরের মধ্যে যে কোনও হিন্দু সন্তান কলেজে ভর্তি হতে পারবে। এই মর্মে নিয়ম জারি করা হয়। (৮)

এ প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। বিদ্যাসাগর সমস্ত ভারতীয় দর্শন মন্থন করে ' পরাশর সংহিতা ' থেকে একটি মোক্ষম শ্লোক উদ্ধার করেছিলেন, 'নষ্টে মৃতে প্রব্রজিতে ক্লীবে চা পতিতে পতৌ / পঞ্চস্বাপৎসু নারীনাং পতিরণ্যে' - বিধবা বিবাহ বিহিত ও কর্তব্য কর্ম। বিধবা বিবাহের যৌক্তিকতা শাস্ত্রীয় ও সামাজিক এই মর্মে ব্যাখ্যা করে ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন ১৮৫৬ সালে 'Marriage of Hindu Widows' । ২৬ শে জুলাই ১৮৫৬-তে বিধবা বিবাহ বিল পাশ হয়। (৯)

ভেবে অবাক হই, প্রায় দেড় শতাধিক বছর আগে আজকের তুলনায় আরও আঁধার যুগে ভাববাদী দর্শনের কুৎসীত বিষবৃক্ষের শিকড়ে ঈশ্বরচন্দ বিদ্যাসাগর যেভাবে আঘাত করার হিম্মত দেখিয়েছিলেন, আমরা একবিংশ শতাব্দীতে পৌঁছে তাঁকে কিংবা তাঁর কৃতকর্মকে সামান্যতমও মনে রাখার চেষ্টা করেছি কি?

বিশ্বদীপ ভট্টাচার্য্য

তথ্যসূত্র:
(১) অনন্য বিদ্যাসাগর - শ্রী অনুনয় চট্টোপাধ্যায়
(২) বিজ্ঞান মনস্কতা ও জনস্বাস্থ্য চেতনা - শ্রী অমিয় কুমার হাটি
(৩) পশ্চিমবঙ্গ বিদ্যাসাগর সংখ্যা - ১৪০১
(৪) পশ্চিমবঙ্গ ১৪০১, পৃষ্ঠা - ৩৭২
(৫) অনন্য বিদ্যাসগর
(৬) অনন্য বিদ্যাসাগর
(৭) ঊনবিংশ শতাব্দীর যুক্তিবাদী ও বিদ্যাসাগর - শ্রী গৌতম চট্টোপাধ্যায়
(৮) পশ্চিমবঙ্গ ১৪০১, পৃষ্ঠা - ৩৭৫
(৯) শিক্ষা ও সামাজিক আন্দোলনে বিদ্যাসাগর - শ্রী তাপস কুমার চক্রবতী

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।