বন্ধু
কে?
“তমেব বন্ধু
সখা তমেব” – লাইন টা বহুবার শুনেছি – সম্প্রতি ডিস্কো র আসরেও
এই লাইন দিয়ে গান ও শুরু হয়েছে। আমার পেঁচানো মনে এর থেকে একটা
প্রশ্ন আমাকে খোঁচা মারতে শুরু করেছে। “বন্ধু” আর “সখা” সমার্থক
কি? আমার মনে হয় দুটো আলাদা। সমার্থক না হলে বন্ধু কাকে বলব?
এই দ্বন্দ্ব থেকেই এই লেখার জন্ম।
শুরুতে একটা
কথা বলতে চাই । আজকাল যে পুরুষ বা নারী অভিনয় করে তাদের actor
বলা হয়। এটা আমি খুব তারিফ করি। লিঙ্গ বৈষম্য আমার পছন্দ না।
এই তালে তাল মিলিয়ে এই লেখাতে “বন্ধু” common gender । এখনও
ছেলেদের বান্ধবী আর মেয়েদের বন্ধু শুনলে অনেকেই বন্ধুত্ব ছাড়া
একটা অল্প আঁশটে গন্ধ অনুভব করেন। তাই সূচনাতেই এ কথা বলে রাখলাম।
এখনকার দিনে
কলেজের বন্ধুদের আড্ডা দেখলে সব থেকে যেটা আমার ভাল লাগে তা
হল সবাই সবাইকে “তুই” বলে – লিঙ্গ বৈষম্যটা খুঁজে পাই না। এই
সহজ আড্ডাতে সবাই সমান – আমাদের দিনের মত কারো কারো মনে “কুছ
কুছ” হয় না। আমার এই প্রচেষ্টাতেও সেই টা মনে রাখবেন।
কৃষ্ণ /
রাধার সখা (সখা আর সখি এই লেখাতে সমার্থক) সুদামা বা বিশাখা
কী তাদের বন্ধু ছিলেন ? আমার তা মনে হয় না । তারা সহচর – সব
সময় পাশে পাশে আছেন – সব রকম সাহায্য করেন এই অবধি। কিন্তু তারা
কি কিছুটা আজ্ঞাবহ ছিলেন না? আর আজ্ঞাবহ সহচরকে কি বন্ধু বলা
চলে?
ছোট বেলাতে
চাণক্য শ্লোক পড়েছিলাম -
উৎসবে ব্যসনেচৈব
দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে
রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।
আমি মন থেকে এটা একেবারেই
মানতে পারি না। আমাদের ছোট বেলাতে পাড়ার কিছু তথাকথিত “চ্যাঙড়া”
ছেলে রকে বসে আড্ডা দিত – তারা পাড়ার মানুষদের সব বিপদে হাত
বাড়িয়ে দিত – হসপিটালে নিয়ে যেতো , শ্মশানে নিয়ে যেত, সব বিপদে
পাশে এসে দাঁড়াত । তাদের অনেকের নামও আমরা জানতাম না।চাণক্য
এদের বন্ধুর আখ্যা দেবেন কিনা জানি না – আমি তাদের বন্ধু বলে
ভাবতে পারি নি।
প্রশ্নটা হোলো পাশে থাকলেই
কি সে মনের সঙ্গী ? আর মনের সঙ্গী না হলে সে কি বন্ধু বলার যোগ্য
? যে সব সময় পাশে থাকে – সব রকম বিপদে বুক পাতে – সেই আসল বন্ধু?
তাই কি? আমার কেন জানি মনে হয় – সেই রকম লোকেদের উপকারের প্রতিদান
দেওয়া কর্তব্য মনে হয় – কিন্তু কর্তব্যের বেশী কিছু না – প্রাণের
তাগিদ নাও থাকতে পারে। উত্তীয় শ্যামাকে কি বন্ধু মনে করতেন –
হয়ত করতেন কিন্তু উত্তীয়কে শ্যামা কি বন্ধু মনে করতেন? আসল বন্ধুর
ক্ষেত্রে মনের সঙ্গী কি দু দিক থেকেই হতে হবে না? এত প্রশ্ন
মনে আসছে যে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছি – তাই আপনাদের সাহায্য
চাই।
আমার মনে হয়, সব সময় সাহায্য
করা বা সব বিপদে পাশে থাকা বা মতের মিল বন্ধুত্বের মাপকাঠি না।
মনের মিলটাই আমার মনে হয় বন্ধুত্বের সব থেকে বড় কথা। দু পক্ষের
মনের অনুরণন না থাকলে তাকে নিজের বিশেষ একান্ত কথাগুলো বলে ভাল
লাগে না। আর তাই যদি না লাগে – তবে তাকে কি বন্ধু বলতে মন চাইবে?
আমার এও মনে হয় - বিনা দ্বিধাতে যার কাছে সাহায্য চাইতে পারি
আর যে প্রয়োজনে বিনা দ্বিধাতে “না” বলতে পারে - সেই বন্ধু। Oscar
Wild বলেছিলেন “true friends stab you in the front” । আমি এর
সাথে পুরোপুরি একমত। আর একটা লাইন মনে পরছে - Eric Segal এর
Love story থেকে “love means never having to say you are sorry”।
আমার মনে হয় – বন্ধুত্বর ক্ষেত্রেও এটা সমান প্রযোজ্য। বন্ধু
সেই যার সাথে ভেবে কথা বোলতে হয় না – মনের কথা সোজাসুজি মন থেকে
বলা চলে। Internet এ এই কথার সুর মিলিয়ে কিছু লাইন পেলাম –
১) “A friend is someone
who gives you total freedom to be yourself.”
২) “A friend is someone you can be alone with and have nothing
to do and not be able to think anything to say and be comfortable
in silence”– Sheryl Condie।
আমার মন এই দুটো কথা পুরোপুরি
সমর্থন করে। কোন নির্জন সমুদ্রের পাশে বা পাহাড়ের শেষ মাথাতে
বসে চুপ করে প্রকৃতিকে অনুভব করার সময় যে পাশে চুপ করে বসে থাকলে
আরও আরও ভাল লাগে – তাকেই কি বন্ধু বলব না?
আমার নিজের জীবনের একটা ঘটনা বলি। আমার চিরকালই কিছুটা সময় শুধু
নিজের জন্যে লাগে। এই সময় আমি একবারে একা থাকতে চাই। তখন আমি
অন্য কোন লোককে চাই না। এই রকম এক সময় দরজাতে বেল বাজল। খুলে
দেখি আমার এক সহপাঠী. আমি তাকে বললাম “তুই ফিরে যা – আমি এখন
একা থাকতে চাই”। কোন প্রশ্ন না করে বা কিছু মনে না করে সে ফিরে
গেল। একেই আমার বন্ধু মনে হয় - মনের না বলা কথাও যে বুঝতে পারে।
কোন একটা গল্পে পড়েছিলাম
– একটি মেয়ে আর দুটি ছেলে খুব বন্ধু (বন্ধু – সঠিক অর্থে)। এক
সময় মেয়েটির বিয়ের কথা শুরু হল। তার মা বাবা অবাক হয়ে দেখল দুই
বন্ধুই তাকে বিয়ে করতে রাজি না। প্রশ্ন করাতে যে উত্তর পেল সেটা
আমাকে ছুঁয়ে গেছে। “বিয়ে করলে এক খুব ভাল বউ পাব কিন্তু এক অমুল্য
বন্ধুকে হারাব। নিত্য জীবনের ছোট খাটো প্রয়োজনের চাপে বন্ধুত্বটা
হারিয়ে যাবে”। বউ কখনও বন্ধু হতে পারে কিনা – এ নিয়ে আলোচনা
করে বিবাহিত আমি বিপদে পড়তে চাই না - তাই এটা আর সবিস্তারে বলছি
না।
বন্ধু কে? এই নিয়ে আমার
মনে অনেক অনেক ধোঁয়াশা আছে। আমার এই প্রচেষ্টার প্রধান কারণ
আপনাদের সাথে আলোচনা করে এই প্রশ্নের কিছুটা উত্তর পাওয়া। তাই
আপনাদের মতামত আমার কাছে খুবই জরুরী। লেখাটা পাতে দেবার যোগ্য
কিনা – সেটা জানতে চাই না। বন্ধুকে চিনতে আপনাদের সাহায্য চাই।
মত আর অমত মিলে মতামত । আমি বিশেষ করে আপনাদের অমতের আশাতে রইলাম।
নিরাশ করবেন না।
ইতি
বিজন
বন্দ্যোপাধ্যায়