মতামত
- প্রথাগত শিক্ষা ও রাজনীতি
শিক্ষামন্ত্রী
ব্রাত্য বসুর মতে এমএ এমসসি পাশ করলেই তিনি বেশী শিক্ষিত, আর
অষ্টমশ্রেণী উত্তীর্ণরা অল্প শিক্ষিত - এরকম বিভাজন কখনোই কাম্য
নয়। নিজের বক্তব্যের প্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদাহরণ
দিয়ে ব্রাত্যবাবু বলেন, ‘যাঁর
জন্যে আমাদের ভাষা-সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে, তিনি কোনও কলেজ বা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাগ্রহণ করেন নি।’ (বর্তমান
১৮ অক্টোবর, ২০১২)
উত্তম কথা,
কিন্তু হঠাৎ এ ধরণের মন্তব্য শিক্ষামন্ত্রী কেন করতে গেলেন?
অনেকের অনুমান মন্তব্যটি করা হয়েছে ভাঙর কলেজের পরিচালন সমিতির
সভাপতি তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম প্রসঙ্গে। তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষক-শিক্ষিকার
প্রতি দুর্ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। আরাবুল ইসলামের পড়াশুনোর
গন্ডী অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত, কিন্তু তিনি দাপটে কলেজ পরিচালকের
ভূমিকা পালন করছেন। শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্য শুনে বিশিষ্ট অধ্যাপক
সুনন্দ সান্যাল বলেছেন, “শিক্ষামন্ত্রী তো রবীব্দ্রনাথ আর আরাবুলকে
এক পঙক্তিতে বসিয়ে দিলেন। এর চেয়ে বিস্ময়কর আর কি হতে পারে!”
(আনন্দবাজার পত্রিকা ১৮ অক্টোবর,
২০১২)।
প্রথাগত শিক্ষায়
ডিগ্রী পাওয়ার সঙ্গে প্রকৃত শিক্ষার কতখানি যোগ সে নিয়ে নিশ্চয়
আলোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু শিক্ষামন্ত্রী না চাইলেও এই বিভাজনের
একটা প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। চিন্তাভাবনা করেই স্কুল-কলেজে শিক্ষক
নির্বাচনের ক্ষেত্রে ডিগ্রী থাকাটা আবশ্যিক হিসেবে রাখা হয়েছে।
এ যুগে রবীন্দ্রনাথ কলেজের অধ্যাপকের চাকরির জন্যে দরখাস্ত করলে,
‘কোয়ালিফিকেশন’ নেই বলে বাতিল হয়ে যেতেন। কিন্তু ডিগ্রী অভিজ্ঞতা
ইত্যাদির পাট চুকিয়ে রাজনৈতিক দলগুলিকে যদি চাকুরি প্রার্থীর
যোগ্যতা যাচাই করার অধিকার দেওয়া হত, তাহলে কিছু অযোগ্য ব্যক্তির
অষ্টমশ্রেণী পর্যন্ত পড়েও অধ্যাপক হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকত।
যেসব ক্ষেত্রে
শিক্ষাগত যোগ্যতাকে উপেক্ষা করা হয়েছে, তার কুফল অল্প-বিস্তর
আমরা সবাই ভোগ করছি। কলেজ পরিচালন সমিতি সদস্যদের থেকে অনেক
বেশী দায়িত্ব হল বিধায়কদের। যাঁদের ওপর দেশের আইন প্রণয়নের গুরু-দায়িত্ব
দেওয়া হচ্ছে,তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতার কোনও মান সংবিধানে বেঁধে
দেওয়া হয় নি। ২৫ বছর (বা বিধান পরিষদের ক্ষেত্রে ৩০ বছর ) বয়সের
বেশী যে কোনও ভারতীয় নাগরিক বিধায়ক হতে পারেন। অথচ দেশের উন্নতির
ভার যাঁদের ওপর ন্যস্ত করা হচ্ছে তাঁদের আবশ্যকীয় গুণাবলীর মধ্যে
পড়বে নিজেদের সীমিত আঞ্চলিক গন্ডী ছাড়াও জাতীয় স্তরে ও বৃহত্তর
বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে ভালোমন্দ বিবেচনা করার ক্ষমতা, নীতি-নির্ধারণের
অভিজ্ঞতা, দেশের সংবিধান সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান ও বিভিন্ন
সমস্যা সমাধানে নতুন দিশা দেখানোর পটুত্ব। এগুলি মানুষ অর্জন
করে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।
এদেশের মত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও সেনেটের প্রার্থী হতে কোনও শিক্ষাগত
যোগ্যতা আবশ্যিক নয়। ঐ দেশটার কথা আনছি, কারণ মুখে ওদের যতই
গালমন্দ করি, মনে মনে ওদের অগ্রগতিকে স্বীকৃতি না দিযে উপায়
নেই । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেট-এ কিন্তু একজনও নেই যিনি
বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন নি । কলেজের পাঠ সমাপ্ত
করেন নি রাষ্ট্র স্তরেও এমন বিধায়কের সংখ্যা ও দেশে নগণ্য। সুষ্ঠু
ভাবে কর্তব্য পালন করতে হলে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন - এই
সত্যটা জানা আছে বলে ও দেশের রাজনৈতিক দলগুলি যাকে তাকে ভোটযুদ্ধে
প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায় না। জনসাধারণও জানে মতাদর্শে না মিললেও
ভোটপ্রার্থীরা মোটামুটি ভাবে তাঁদের কাজে দক্ষ।
এবার দেখুন
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা। myneta.info-র তথ্য
অনুযায়ী সাম্প্রতিক বিধান সভার নির্বাচনে ২৯৪ জন জয়ী হয়েছেন।
তাঁদের মধ্যে অষ্টমশ্রেণী পাশ ১৯ জন, দশমশ্রেণী পাশ ৩২ জন, দ্বাদশশ্রেণী
পাশ ৫১ জন, স্নাতক ৭৭ জন, বাদবাকিরা প্রফেশানাল বা স্নাতকোত্তর
ডিগ্রীধারী। বেশ কয়েকযুগ ধরে আমাদের দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার যা
হাল হয়েছে, তাতে স্নাতক আর অস্নাতকের মধ্যে জ্ঞানের তফাৎ কতটা
সে নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। সেটা আরেকটা প্রসংগ। যেটা আমার বক্তব্য
সেটা হল কারা ভোটে দাঁড়াবেন, সেটা ঠিক করেন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
তাঁরা ভেবেচিন্তে নির্বাচনে যোগ্য প্রার্থী দেবেন সেটাই আমরা
চাইব। স্কুল-কলেজের গণ্ডী যাঁরা পার হতে পারেন নি, তাঁরা সবাই
অযোগ্য – সে দাবীটা নিশ্চয় অসঙ্গত। কিন্তু এটাও অসঙ্গত যদি ভাবা
হয় অষ্টম, দশম, দ্বাদশশ্রেণী বা নামে মাত্র ডিগ্রী পাওয়া ব্যক্তিরা
একুশ শতকে বিশ্বায়নের যুগে আইন-প্রণয়নে বা দেশের সমস্যা সমাধানে
দক্ষতা দেখাতে সমর্থ হবেন।
আইন প্রণয়ন
প্রসঙ্গে একটা চরম উদাহরণ উল্লেখ না করে পারছি না। সম্প্রতি
হরিয়ানার খাপ পঞ্চায়েতের কার্যকলাপ নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে।
Times of Indiaর ২৯-শে অক্টোবর, ২০১২-র খবর -- একটা দুটো নয়,
তিরিশটি খাপ পঞ্চায়েতের নেতারা ঠিক করেছেন হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট
সংশোধন করে এক গোত্রের কিংবা এক গ্রামের ছেলেমেয়েদের বিবাহ বন্ধ
করা। তাঁদের ধারণা এটা কার্যকরী করা হলে 'অনার কিলিং' এবং মেযেদের
ভ্রুণহত্যা বন্ধ হয়ে যাবে। কেন? এই জন-প্রতিনিধিরা বিশ্বাস করেন,
লোকেরা তাদের মেয়ে সন্তানকে হত্যা করে এই ভয়ে যে তারা একদিন
সমগোত্রের ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যাবে! এই নিয়ে দরবার করতে প্রতিনিধিরা
দিল্লী যাচ্ছেন। প্রকৃত শিক্ষা থাকার বা আলোকপ্রাপ্ত হবার একটা
মূল্য বোধহয় আছে।
ডিগ্রীই কি
সব? তা নয়। রবীন্দ্রনাথের কথা বাদই দেওয়া যাক। যে মার্কিন মুলুকে
সেনেটে নির্বাচিত সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনো করেছেন, কেউ
কেউ হয়তো সে দেশেরই বিল গেটস, স্টিভ জবস বা মাইকেল ডেল-এর উদাহরণ
আনবেন। এঁদের কারোরই কলেজের ডিগ্রী নেই। কলেজের ডিগ্রিধারীদের
থেকে এঁরা কি কোনও অংশে ন্যুন? কখনোই নন। প্রথাগত শিক্ষার পাঠ
সমাপ্ত না করে এ যুগেও অনেকে মেধাবলে নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করতে
সক্ষম হয়েছেন । বিল গেটস কলেজের ডিগ্রী না পেলেও SAT-এ ১৬০০-র
মধ্যে ১৫৯০ পেয়ে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ হার্ভার্ড-এর মত কলেজে
যোগ দিতে পেরেছিলেন। কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে প্যানকেক সর্টিং-এর
যে algorithm সৃষ্টি করেছিলেন সেটা ৩০ বছর ধরে দ্রুততম সামাধান
হিসেবে সম্মান পেয়েছিল। মাইকেল ডেল ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস-এ
ঢুকেছিলেন, পড়াশুনোর পাঠ শেষ করেন নি। এটা যেমন সত্য, তেমনি
ডেল যখন স্কুলের ছাত্র,তখনই তিনি সংবাদপত্র বিক্রি করার একটা
অভিনব পদ্ধতি বার করেন সেটাও একটা ঘটনা। কলেজে ঢুকে কম্পিইউটার
আপ-গ্রেড কিট বানিয়ে ডেল একটা নতুন ব্যবসার সূচনা করেন। স্টিভ
জবস কলেজে মাত্র ছমাস পড়লেও মাত্র ২১ বছর বয়সেই তাঁর প্রতিভার
স্ফুরণ লোকেদের চোখে পড়েছিল।
পরিশেষে আবার
বলি – প্রথাগত শিক্ষার ডিগ্রী না থাকা, বড় কাজ করার ব্যাপারে
অন্তরায় নয়। কিন্তু সেটা না থাকাও কোনও কোয়ালিফিকেশন নয়। প্রথাগত
শিক্ষার নিরীক্ষে রবীন্দ্রনাথের যোগ্যতার সমাধিকারী হলেও রবীন্দ্রনাথ
হওয়া যায় না। শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা দুটোর ক্ষেত্রেই সেটা সত্য।
১৯৮৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের
ডিবেট-এ রিপাবলিক্যান প্রার্থী ড্যান কোয়েল একটি প্রশ্নের উত্তরে
বলেছিলেন I have as much experience in the Congress as Jack
Kennedy did when he sought the presidency। সেই শুনে ডেমোক্র্যাটিক
প্রার্থী লয়েড বেনস্টেন মন্তব্য করেছিলেন, Senator, I served
with Jack Kennedy. I knew Jack Kennedy. Jack Kennedy was a
friend of mine. Senator, you're no Jack Kennedy.
(প্রসঙ্গত
এই সমালোচনা শুধু বর্তমান শাসক দলকে উদ্দেশ্য করে নয়, আমাদের
দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে সমান ভাবে প্রযোজ্য।)
সুজন
দাশগুপ্ত
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)