সব
দানই কি মহান ???
অনেক ছোটবেলা
থেকে শুনে আসছি দান মহান। মহাভারতে কর্ণের দানবীর বলে বিশেষ
খ্যাতি্র কথা পড়েছি । সেই বয়সে আরও অনেক দানের কথা শুনেছি মা
/ বাবার কাছ থেকে । তখন মন অনেক সরল ছিল। সব দানকে মহান আখ্যা
দিতে কোন দ্বিধা হয় নি। কিন্তু এই ৭০ ছুঁই ছুঁই বয়সে এসে মন
অনেক প্যাঁচালো হলে গেছে – সহজে কিছু মানতে রাজি হয় না। সব কিছু
যাচাই করতে চায় । দানের মহানতা নিয়ে মনের এই প্রশ্নগুলো আপনাদের
সাথে একটু আলোচনা করতে চাই আর এ ব্যপারে আপনাদের মতামত জানতে
চাই । আপনারা মতামত না জানালে এই লেখার উদেশ্য আর প্রচেষ্টা
সম্পূর্ণ বিফল হবে । তাই একান্ত আনুরোধ – আপনাদের মতামত অবশ্যই
জানান ।
আমার ধারণা বেশীর ভাগ মানুষ নিজের সব কিছু আগে ঠিক রেখে তবেই
দান করার কথা ভাবে – এবং তার কিছু প্রতিদান গ্রহীতার কাছ থেকে
আশা করে । এতে আমি দোষের কিছু দেখি না – কিন্তু দান কে আমরা
যে মহান আখ্যা দিয়ে থাকি – এই দান তার উপযুক্ত কিনা – সে বিষয়ে
আমার খূবই সন্দেহ আছে। কারণ এই দানে আমি দাতা - তাই আমি বড় এবং
তুমি গ্রহীতা তাই তুমি ছোট – এই আহমিকা আর দয়ার দুর্গন্ধ থাকে
না কি?
দাতা বেশির
ভাগ সময় যে প্রতিদান আশা করে – তা বিভিন্ন রকম হতে পারে। দান
এর পরিবর্তে গ্রহীতার কাছে কৃতজ্ঞতা আশা করা বোধহয় এর নুন্যতম
চেহারা। আমি যে তোমাকে দয়া করেছি সেটা তুমি স্বীকার না করলে
আমার অহমিকা শান্তি পাবে কি করে? এর আর একটু চড়া মাত্রা হল এটা
আশা করা যে তুমি আমার দয়ার কথা সকলকে বলবে – সার্বজনীন ঘোষণা
করা চাই। এ রকম দান আপণারা নিশ্চয় অনেক দেখেছেন আর মনে হয় আমার
সাথে একমত হবেন।
পুণ্য অর্জন দানের আর এক কারণ হতে পারে। তার সাথে থাকে ভগবানের
থেকে কিছু বিশেষ আনুকূল্য পাবার প্রত্যাশা । খুব ঠোট কাটা ভাবে
বলা যেতে পারে ভগবান কে ঘুষ দিয়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা / বা মরণের
পরে নরকে না গিয়ে স্বর্গে যাবার gate pass হাতানোর ধান্দা ।
এ ক্ষেত্রে গ্রহীতা গুরুত্বপূর্ণ নয় – নিমিত্ত মাত্র।
দানের কিছু ক্ষেত্রে আরও
একটা উদ্দেশ্য থাকে। কিছু দানের বদলে Income Tax এ ছার পাওয়া
যায় । এমনকি আমেরিকাতে good will কে জিনিষ দিলে একই সুবিধা পাওয়া
মেলে। এ ক্ষেত্রে দানটা tax planning এর দলে পরে।
এবার যা বলব তাতে অনেকে
ঘোর প্রতিবাদ করতে পারে। আমরা অনেকেই আমাদের পুত্র / কন্যার
শিশুকাল থকে সাবালক হওয়া অবধি তাদের সব কিছু নিজেদের দায়িত্ব
বলে মেনে নি। দান বললে অনেকের আপত্তি হতে পারে তাই একে আমি দেওয়া
বলছি। আপাতদৃষ্টিতে একে নিঃস্বার্থ দান মনে হয় – কিন্তু একটু
গভীরে গেলে অনেক ক্ষেত্রে একে investment বললেও খুব ভুল হবে
না।
কিন্তু ছেলে / মেয়ে যত
বড় হয় তত আমাদের দেওয়ার পিছনে অনেক সময় একটা সুপ্ত প্রত্যাশা
মাথা তুলতে চেষ্টা করে – এই দেওয়ার পরিবর্তে খুব কম করে অন্তত
তাদের ভালবাসা পাবার আশা – এমন কি অনেক সময় দাবীও করা হয় । প্রত্যাশা
আরও অনেক বেশীও হতে পারে – সত্যি বলতে সেটাই বেশী স্বাভাবিক
। মা ও বাবা আশা করে যে ছেলে / মেয়ে তাদের দেখবে এবং দরকারে
সব রকম সাহায্য করবে । এটা না হলে তারা খুবই নিরাশ হয় এমনকি
অনেক সময় বোলে থাকে যে তারা ছেলে / মেয়ের জন্যে সব করেছেন কিন্তু
তারা আজ সব ভুলে গেছে । এই আক্ষেপ অনেকে সকলের সামনেও করে ।
এমনকি তাদের অকৃতজ্ঞ বলতেও দ্বিধা করে না। অর্থাৎ তাদের investment
এর return তারা পেলেন না। নিজের বুকে হাত রেখে বলুন – আমি ঠিক
কিনা।
প্রতিদানের আর এক রূপ গ্রহীতার
জীবন পরিচালনার অধিকার । আমার প্রিয় লেখাক চানক্য সেনের লেখা
“ শুধু কথা” থেকে নানান উক্তি এর আগেও আমার লেখাতে উল্লেখ করেছি
। আবার তারই দারস্থ হচ্ছি। এর সবটাই এক আমেরিকান মহিলার সাথে
এক বাঙালি যুবকের কথোপকথন । বাঙালি যুবকের আমেরিকান মহিলাকে
বলা কিছু কথা না লিখে পারছি না।
“সাবওয়েতে একটা বিজ্ঞাপন পড়েছিলাম Make miracle – Give। পড়ে
মনে হয়েছিল, এ দেশটা দিতে জানে না। “
......... “তোমাদের চ্যারিটি আছে অনেক , দানে তোমরা অকৃপণ ,
কিন্তু you don’t know the art of giving।”
“তোমরা এক হাতে দিয়ে অন্য হাতে তুলে নিতে চাও । দেশে এক মার্কিন
মহিলার সঙ্গে আলাপ ছিল । কোন দুঃস্থ ভারতীয়কে কিছু সাহায্য করলে
দুটো সর্ত আরোপ করতেন – প্রথম, তার নির্দেশ মত সাহায্য ব্যয়
করতে হবে ; দ্বিতীয়, ব্যয় করা যে হয়েছে , তার নির্ভরযোগ্য প্রমাণ
দাখিল করতে হবে” ......। “ভেবে দেখ ... এই সর্তের পশ্চাতে কি
মানসিকতা আছে । প্রথম কথা – তোমার কাছে সাহায্য চেয়ে আমি তোমাকে
আমার জীবন পরিচালনা করবার অধিকার দিয়েছি । মূল কথা হল – if I
help – then I manage”
প্রশ্ন আসতে পারে এরকম
শর্ত না দিলে সাহায্যের অপব্যাবহার হতে পারে । এর উত্তরে লেখাক
বলেছেন “অপব্যাবহার যাতে না করি তার ব্যবস্থা করতে গিয়ে তুমি
(দাতা) আমাকে (গ্রহীতাকে ) নিষ্ঠুর ভাবে স্বরণ করিয়ে দিচ্ছ তুমি
সাহায্যকারী , আমি গ্রহীতা”। এটাও এক রকম দান – কিন্তু মহান
কি?
দানের আর এক রূপকে ব্যবসায়িক
দান বলা যেতে পারে । শুনেছি গুজরাটে কোন এক ব্যবসায়ী শহর থেকে
দূরে – যেখানে কোন মানুষের বাস নেই আর বাসের উপযুক্তও নয় – সেখানে
প্রচুর জলা জমি নাম মাত্র দামে কিনেছিলেন । পরে সেই জমির নানান
অংশ দান করতে শুরু করেন – কোনটা স্কুল করার জন্যে , কোনটা হাসপাতাল
করার জন্যে , কোনটা বিশ্ববিদ্যালয় করার জন্যে আর কোনটা বা shopping
complex ইত্যাদি করার জন্যে । সবই সম্পূর্ণ বিনামুল্যে – তার
থেকে উপার্জনের ওপর কোন দাবী না রেখে । এ অবধি একে মহান দান
মনে হতে পারে।
এত দান করেও পুরো জমির খুব অল্প ভাগই চলে গেলো – বেশি অংশ তখনও
তার নিজেরই রইল। কিন্ত এই সব দানের ফলে সরকারের খরচে রাস্তা
, পরিবহন ব্যবস্থা , জলের supply system ইত্যাদি সব গড়ে ঊটলো
। তাই সেই area মনুষ্য বসতীর শুধু উপযুক্ত নয়– বহুমুল্য হয়ে
উঠল । এবার সেই জলের দামে কেনা জমি ব্যবসায়ী বিক্রি করতে শুরু
করলেন – এবং বহু কোটি টাকা মুনাফা করলেন। প্রথমে যাকে মহান দান
মনে হয়েছিল – তা ব্যবসায়িক দান হয়ে দাঁড়াল । কিন্তু এও তো দান
?
সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থ দানকে
– যেখানে প্রতিদানের কোন আশা থাকে না – যেখানে দেওয়াটা দাতার
নিজের আনন্দ - আভিধান তাকে এক কথাতে কি বলে আমি ঠিক জানতাম না
– অনেক খুঁজেও সদুত্তর পাই নি। শেষ পর্যন্ত আমার মুস্কিল আশান
রজতদার দ্বারস্থ হলাম। এখানে নিরাশ হব না জানতাম – নিরাশ হতেও
হল না। রজতদা জানাল একে বলে সাত্ত্বিক দান । সাত্ত্বিক দানে
দেওয়াটা নিজের প্রাণের ইচ্ছা –সেখানে তার বদলে কিছু আশা করা
হয় না। বলাই বাহুল্য – সাত্ত্বিক দান খুবই কম । একটা খুব সহজ
উদাহারণ দেবার চেষ্টা করছি । কোনো ছেলে / মেয়ে যখন একেবারেই
শিশু তখন তাদের জন্যে খেলনা দিয়ে আসাটা নিজের আনন্দে করা হয়।
এটা সাত্ত্বিক দানের খুব সহজ উদাহারণ ।
সাত্ত্বিক দানের আর এক
সরল উদাহারণ দেবার চেষ্টা করছি । কোন নতুন পত্রিকা যেটা মাথা
তোলার চেষ্টা করছে - নতুন কিছু বলার জন্যে – কিন্তু যার আর্থিক
সঙ্গতি নেই – তাতে বিজ্ঞাপন দিয়ে তাতে শুধু লেখা FROM A WELL
WISHER। আপনারা নিশ্চয় এ রকম বিজ্ঞাপন দেখেছেন । এতে অন্য বিজ্ঞাপন
দাতাদের মতো নিজের বা নিজের Company নাম প্রচারের চেষ্টা নেই
– নিজেকে সম্পূর্ণ গোপনে রাখছেন। আপনাদের কি মনে হয় – এটা কি
সাত্ত্বিক দান?
শুনেছি পৃথিবীর সব থেকে ধনীদের মধ্যে একজন (নাম না বলাই ভালো
) অন্য এক ধনীর charity fund এ প্রচুর টাকা দান করেছিলেন । তিনি
খুব সহজেই নিজের নামে একটা charity fund খুলে নিজের মহিমা জাহির
করতে পারতেন – কিন্তু charity ই তার প্রধা্ন উদেশ্য ছিল । পরে
কোন ভাবে তার নাম বেরিয়ে পরে। এই দুই ধনীকে আপনারা অনেকেই হয়ত
জানেন। আমার মনে হয় – স্বাতিক দানের এটা আর একটা বড় উধাহরণ।
আরও এক রকমের দান আছে
। রবীন্দ্রনাথের ভাষাতে “গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।“ এই
দান কে কোন আখ্যা দেব – পাঠকরা জানালে আমি কৃতজ্ঞ থাকব।
বিজন
বন্দ্যোপাধ্যায়