বিবিধ
প্রসঙ্গ: বিজ্ঞাপন
সাধারণত
আমরা বিজ্ঞাপন দেখি পত্রপত্রিকায়, টিভিতে , রাস্তার ধারে হোর্ডিং-এ,
ল্যাম্প পোস্টে আঠা দিয়ে সাঁটা কাগজে। এইসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে
নতুন নতুন পণ্য বা প্রডাক্টের সঙ্গে পরিচিত হই । তবে দেখতে না
চাইলে এগুলো উপেক্ষা করা যায়। হোর্ডিং না দেখে রাস্তায় চলা যায়,
বিজ্ঞাপন বাদ দিয়ে পত্রিকা পড়া যায়। শুধু টিভি-তে কমার্শিয়াল
এলে একটু সমস্যা। দেশের টিভি-তে এগুলির বাড়াবাড়িতে আসল শো পদে
পদে বিঘ্নিত হয় বলে অনেকেই ক্ষুব্ধ হন, কিন্তু এদের দৌলতেই টিভি
স্টেশন চলে এবং শো যাঁরা করছেন - তাঁদের অর্থপ্রাপ্তি হয়। বিদেশে
টিভি-তে বিজ্ঞাপন বা কমার্শিয়ালের দৌরাত্ব অপেক্ষাকৃত কম। যাঁরা
সেখানে টিভি দেখে অভ্যস্ত, তাঁদের দেশের টিভি দেখতে বিরক্তিটা
একটু বেশী হয় - বিশেষ করে ঘন ঘন একই বিজ্ঞাপন দেখতে। তবে বারবার
একই কমার্শিয়াল বা বিজ্ঞাপন দেখে আমাদের বিরক্তি হলেও, ভবিষ্যতে
ঐ জাতীয় কোন জিনিস কেনার সময়ে এগুলি কিছুটা আমাদের প্রভাবিত
করে - নইলে এত বড় বিজ্ঞাপনের ব্যবসা গড়ে উঠত না।
বিদেশে অনেক
সময়ে ইনফোমার্শিয়াল দেখান হয়। এগুলো এক আধ মিনিটের কমার্শিয়াল
নয়। বহুক্ষণ ধরে কোন কোম্পানি তাদের পণ্য গল্পের ছলে বা সেলিব্রেটিদের
দিয়ে নানান লোকের ইণ্টারভিউয়ের মাধ্যমে তুলে ধরে। এদেশেও সেটা
মাঝে মাঝে দেখি - যেরকম যে সিনেমা শিগগিরি মুক্তি পাবে - সেটাকে
ঘিরে অভিনেতা, পরিচালক, ইত্যাদিদের নিয়ে একটা শো। এগুলো টিভি
কর্তৃপক্ষ ভালো ছবি বলে নিজেদের অর্থব্যয় করে দেখাচ্ছেন বলে
মনে করার কোনও কারণ নেই। এটাও বিজ্ঞাপন - যদিও অনেক সময়েই সেটা
পরিষ্কার করে বলা হয় না। আমেরিকায় এ ধরণের প্রোগ্রামের আগে এটা
যে একটা বিজ্ঞাপন সেটা জানানো বাধ্যতামূলক। অনেক দেশেই সেরকম
কোনও আইন নেই।
বিজ্ঞাপনের
আরেকটা বড় মাধ্যম চলচ্চিত্র। যে গাড়ি নায়িকা চালাচ্ছেন - সেই
গাড়ির লোগো-র উপরে ক্যামেরা ফেলা , যে কম্পিউটার অফিস দৃশ্যে
ব্যবহার করা হচ্ছে - সেটাকে ফোকাস করা , ইত্যাদি হামেশাই ঘটছে
এবং তার জন্যে টাকার লেনদেনও ঘটছে বহু ক্ষেত্রে। একাধিক কোম্পানির
সঙ্গে চুক্তি করে অনেক ফিল্ম প্রডিউসার সেইসব কোম্পানির পণ্য
ছবিতে দেখাচ্ছেন বা ছবির প্রমোশনে তাদের নাম ব্যবহার করছেন।
বাংলা ছবিতেও সেই প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০১০ সালে হলিউডে
বিভিন্ন কোম্পানি ১.৮ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে নিজেদের তৈরি জিনিস
সিনেমায় দেখাতে এবং ফিল্মে প্রচারে নিজেদের যুক্ত করতে। সুদর্শন
নায়কের হাতে একটি সিগারেটের প্যাকেট যেখানে ব্র্যান্ডের নাম
বেশ পড়া যাচ্ছে, বা কোনও বিখ্যাত ব্র্যান্ডের পানীয়ের বোতল যেটা
সহজেই চোখে পড়ে - এসব দৃশ্য বহু বছর ধরেই চলচ্চিত্রে দেখানো
হয়ে আসছে। এটি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বিখ্যাত নায়ক বা
নায়িকা সিনেমার চুক্তিতে এর জন্য আলাদা ভাবে টাকা দাবি করছেন।
যাঁরা সিনেমাকে আর্টের
মাধ্যম বলে মনে করেন, তাঁরা অবশ্যই এ ব্যাপারে বিরক্ত। বিপণনের
সাপ্তাহিক পত্রিকা হ্যারিসন'স রিপোর্ট এ নিয়ে সবচেয়ে আগে সোচ্চর
হয়। ১৯১৯ সালের কমেডি ছবি দ্য গ্যারাজ-এ রেড ক্রাউন গ্যাসোলিন
ব্র্যান্ড দেখানোর জন্যে পত্রিকাটি সমালোচনা করে। গত শতাব্দীর
২০ দশকে করোনা টাইপরাইটার ফার্স্ট ন্যাশনাল পিকচার্সের সঙ্গে
একটা চুক্তি করে নানান ছবিতে তাদের টাইপরাইটার দেখাতে শুরু করে।
এ নিয়ে যথেষ্ট হৈচৈ হয় হ্যারিসন'স রিপোর্টে। প্রসঙ্গত এর উল্টোটাও
এক আধ সময়ে ঘটে। ছবিতে কোন বিশেষ ব্র্যান্ড অপ্রীতিকর ভাবে ব্যবহার
করা হয়েছে বলে সেই ব্র্যাণ্ডের নির্মাতারা প্রযোজককে ছবি থেকে
সেই অংশ বাদ দিতে বাধ্য করেছেন - এমন খবরও শোনা গেছে। সেক্ষেত্রে
ছবির নির্মাতাদের আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে।
খেলাধুলা বা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়
বিজ্ঞাপনের ব্যবহার আমরা প্রচুর দেখি। খেলার মাঠে নানান ব্যানারে,
খেলোয়াড়দের পোষাকে, টুর্নামেন্টের নামে, ইত্যাদি নানা ভাবে।
কিছু প্রতিযোগিতা আছে, যেখানে সোজাসুজি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় না,
কিন্তু যেসব কোম্পানির স্বার্থ সেসব প্রতিযোগিতায় জড়িত থাকে,
তাদের সুবিধার্থে প্রতিযোগিতার ফলাফল নির্ণীত হয় বলে অনেকে সন্দেহ
করেন। উদাহরণস্বরূপ বিউটি কনটেস্ট বা সুন্দরী প্রতিযোগিতার কথা
বলা যেতে পারে। সুন্দরী প্রতিযোগিতার সঙ্গে প্রসাধন ব্যবসার
একটা গভীর যোগ আছে। এইসব প্রতিযোগিতা মেয়েদের প্রসাধন সম্পর্কে
সচেতন করে তোলে - ফলে প্রসাধন কোম্পানিগুলির ব্যবসা বাড়ে। বেশ
কিছুদিন হল তৃতীয় বিশ্বের আর্থিক সচ্ছলতার সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার
নানান প্রতিযোগী সুন্দরীশ্রেষ্ঠার সম্মান পেতে শুরু করেছে। ফলে
তৃতীয় বিশ্বেও প্রসাধন কোম্পানিগুলি তাদের পণ্য বিপণনের একটা
বড় সুযোগ পাচ্ছে। তাই এই সম্মানলাভের পেছনে বড় বড় প্রসাধন কোম্পানির
হাত আছে কিনা - সে নিয়ে কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করছেন।
এই সময়টা বাঙালীদের পুজোর
সময়। বিভিন্ন কোম্পানি নেমে পড়েছে শ্রেষ্ঠ মণ্ডপ, শ্রেষ্ঠ প্রতিমা,
ইত্যাদির নির্বাচনে। আনন্দিত উদ্যোক্তাদের দেখা যাচ্ছে টিভি-তে,
জানা যাচ্ছে পুরস্কার-দাতা কোম্পানির নাম। যেসব প্যান্ডেল শ্রেষ্ঠ
পুরষ্কার পেয়েছে, সেখানে আমজনতা হাজারে হাজারে গিয়ে উপস্থিত
হচ্ছে। মায়ের পুজো উপলক্ষ করে এইসব কোম্পানি একটু প্রচার করার
সুযোগ পাচ্ছেন। জনগণ খুশি, কোম্পানিগুলি তো আরও খুশি। রিলিজিয়ান
আর ক্যাপিটালিজম একেবারে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)