পঞ্চাশ দশকের মাঝামাঝি
বি.ই. কলেজের আর্কিটেকচারের একটি ছাত্র গীটারে টুংটাং করে নতুন
নতুন গান বেঁধে গাইতেন আর সুকণ্ঠ বন্ধুদের দিয়ে কলেজের অনুষ্ঠানে
গাওয়াতেন। সে যুগটা ছিল আধুনিক বাংলাগানের স্বর্ণযুগ। হেমন্ত,
ধনঞ্জয়, মানবেন্দ্র, শ্যামল, সতীনাথ, সন্ধ্যা, আলপনা, প্রতিমা
- সবাই তখন মধ্যগগনে। তাই নতুন গানের পশরা নিয়ে অরুণেন্দু দাস
কলেজের বাইরে যাওয়ার কথা মুহূর্তের জন্যেও ভাবেন নি। কিন্তু
অরুণেন্দুর এই গানগুলি কলেজের কিছু কিছু ছাত্রকে এতটাই অনুপ্রাণিত
করেছিল যে, পঞ্চাশ বছর বাদেও কাউকে কাউকে সেইসব গান ভাঙ্গা ভাঙ্গা
গলায় দেশেবিদেশে গাইতে শুনেছি। অরুণেন্দু নিজে এক জায়গায় লিখেছেন,
"গানগুলো রচিত হয়েছিল গীটারের ওপর আঙুল চালানোয় পারদর্শিতা
অর্জনের উদ্দেশ্যে। তখনো সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে পাশ্চাত্ত্য
সঙ্গীতের কোনো ধারারই তেমন অনুপ্রবেশ ঘটে নি। অথচ ছয়তারের সন্মোহিনীর
প্রভাবে মজেছি কেউ কেউ। নতুন কোনও কর্ড সিকোয়েন্স, স্ট্রামিং
বা পিকিং-এর কায়দা কোথাও দেখলে বা শুনলে সঙ্গে সঙ্গে লেগে যেতাম,
কানে লাগা কোন গানের সুর ও ভাবের অনুকরণে নয় অনুসরণে বাংলায়
কথা গুছিয়ে তুলতে, যাতে করে ছয়তারের সঙ্গতে নিজেরা নিজেদের মত
করে সহজ ভাবে গাইতে পারি।"
ষাট
দশকের শেষের দিকে অরুণেন্দু ইংল্যাণ্ডে চলে যান। সেখানে গিয়ে
আমেরিকা ও ইংল্যাণ্ডের লোকসঙ্গীতের সঙ্গে পরিচিত হন। অক্সফোর্ডশায়ারের
মার্কেট টাউনের একটা ফোক ক্লাবের সদস্য হয়ে গীটার বাজানোর কিছু
কিছু নতুন কায়দা আয়ত্ত করেন। তারপর শুরু হয় সেইগুলিকে বাংলার
ভাবে মজিয়ে সংগীত রচনা। বাইরে গানের প্রচার নিয়ে অরুণেন্দু কোনওদিনই
উৎসাহিত ছিলেন না, নিজের তাগিদে গান বেঁধেছেন, বন্ধুবান্ধবের
সঙ্গে বসে সেগুলো গেয়েছেন - এই পর্যন্ত। কোনও খ্যাতনামা গায়ককে
দিয়ে গানগুলি গাইয়ে সিডি করালে নিঃসন্দেহে এগুলির প্রচার হত।
কিন্তু তা তিনি করেন নি।
অরুনেন্দুর গান হয়তো কোনওদিনই
বন্ধুবান্ধবদের বাইরে পৌঁছতো না। কিন্তু কোথাও অরুণেন্দু দাসের
কথা শুনে ১৯৮৬/৮৭ সালে প্রয়াত গৌতম চট্টোপাধ্যায় ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ
করেন। মহীনের ঘোড়াগুলি নামে তাঁর ভেঙ্গে যাওয়া একটি দলের নামে
চারটি গানের সংকলনের প্রত্যেকটিতেই তিনি অরুণেন্দুর গান ব্যবহার
করেন। মহীনের ঘোড়াগুলি-ই এ-যুগের বাংলা ব্যাণ্ডগুলির পূর্বসূরী।
কিন্তু সেই দল যখন তৈরি হয়েছিল, বাঙালীর মনপ্রাণ তখনও ঐ ধরণের
গান শোনার জন্য প্রস্তুত হয় নি। তাই যতটা সাফল্য দলটির প্রাপ্য
ছিল, ততটা তারা পায় নি। তবু বাংলা ব্যাণ্ডের ইতিহাসে মহীনের
ঘোড়াগুলি-র একটি বিশিষ্ট স্থান আছে। শুধু অরুণেন্দু দাসের পরিচয়
বি.ই. কলেজের সমসামায়িক গুটিকতক ছাত্র আর অরুনেন্দুর কিছু গুণমুগ্ধ
ভক্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এই ভক্তগোষ্ঠী অবশ্য সঙ্গতভাবে দাবী
করেন, যেসব জীবনমুখি গান আজ অনেকের মুখে মুখে ফিরছে, সে-ধরণের
গান চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে অরুনেন্দু দাসের গীটার থেকে একের
পর এক বেরিয়ে এসেছিল।
নিচে অরুণেন্দুর চারটি
গানের লিঙ্ক দেওয়া হল।
(১) কে কে যাবিরে (একটি
নাইজেরিয়ান লোকসঙ্গীতের অনুসরণে)
পয়সা যদি নেই পকেটে ভাবনা
কি আছে !
কিনতে মানা
চড়তে মানায়
ভীড়ে মেশার আনন্দের কি আসে যায়।
ওরে কে কে যাবিরে
কে কে যাবিরে
কে কে যাবিরে তোরা আয় । (আংশিক)
(২) দিশে হারা যে মোর মন
দিশেহারা যে মোর মন কিসে
সার্থক এ জীবন
খুঁজে ফিরি কোথা নেবো ঠাঁই
চারিদিকে সবাই মোর কেউ ভালো কেউ মন্দ ঘোর
আপন মান যেচে সেথা বেড়াই।
ভেবেছিলেম এগিয়েছি যে অনেক
হয়ে বাসনা মোর একের পরে এক
মনে হঠাৎ যেন আজ হল খেয়াল
কেটেছে কাল ভেসে শুধুই আমার স্রোতেরই দোলায়
ও গঙ্গা তুমি চলেছো ঢেউয়ে ঢেউয়ে কোথায়
(আংশিক)
(৪) আমার প্রিয়া
কোন মেয়ে অবুঝ
কেউ অতি অগভীর
কেউ বড় বেশি শান্ত
কেউ সবেতে অধীর
আমার প্রিয়া ঝর্ণা খুশির, পানীয় নেশার
কানে মোর শোনায় সদাই সে আমার, আমার, আমার। (আংশিক)