প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

আমেরিকায় বাঙালী অভিবাসীদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

প্রথম অংশঃ চিকনদার ও লস্কর

আমেরিকার ২০০৭-২০০৮-এর জনগণনা (আদমশুমারি) অনুসারে ১৯০,০৯০ জন বাড়িতে বাংলায় কথা বলে। এই সংখ্যায় যারা পাঁচ বছর বা তার থেকে ছোট তাদের ধরা হয় নি। আজকে সম্ভবত এই সংখ্যা ২০০,০০০ ছাড়িয়ে গেছে ।

প্রশ্ন, কবে এই বাংলা ভাষাভাষী অভিবাসীরা আমেরিকায় আসতে শুরু করে? এখন যে সব বাঙালী এই দেশে আছে তাদের উত্তর হবে, ১৯৬৫ সাল থেকে। উত্তরটা ভুল নয়, ওই সময়েই আমেরিকার অভিবাসন আইনের কড়াক্কড়ি কমে। এর আগেও পঞ্চাশ দশকে পড়াশুনো বা গবেষণা করতে অনেকে এসেছিলেন – সেটাও কেউ কেউ স্মরণ করবেন। অতীত নিয়ে যারা একটু নাড়াচাড়া করেন, তাঁদের আবার স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত কোনো কোনো নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের নাম মনে পড়বে। এঁরা দেশ থেকে পালিয়ে এসে এদেশে বসবাস শুরু করেন এবং এ এদেশ থেকেই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান। এটি হিসেবের মধ্যে ধরলে আমেরিকায় বাঙালীদের অভিবাসী হয়ে আসার ইতিহাস ৮০ বছর বা তার কাছাকাছি। আসলে কিন্তু বাঙালী এখানে বসবাস শুরু করে ১৩০ বছর আগে। উনবিংশ শতাব্দীর আশি দশকের প্রথমে গ্রামবাংলা থেকে কিছু পণ্য-বিক্রেতা এসেছিল সিল্কের এমব্রয়ডারি বা চিকন কাপড় বিক্রি করতে। তারা এসে নেমেছিল আমেরিকার পুব দিকের কয়েকটি বন্দরে। তারপর সত্তর আশি বছর বাঙালী অভিবাসীদের সংখ্যা কমেছে বেড়েছে। ১৯৬৫-তে আমেরিকার অভিবাসন আইন পরিবর্তিত হবার পর সংখ্যাটি স্থির গতিতে বাড়তে থাকে।

বাঙালী অভিবাসীদের প্রথম পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রায় অজানাই ছিল। MIT-র এক সহকারী অধ্যাপক বিবেক বল্ড জাহাজের অবতরণ তালিকা, অভিবাসন দপ্তরের তথ্য, সংবাদপত্রের খবর, চার্চের কাগজপত্র এবং বিয়ের রেজিস্ট্রি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আমেরিকার প্রথম বাঙালী অভিবাসীদের জীবনযাত্রার একটা পূর্ণাঙ্গ চিত্র অঙ্কন করেন। ২০১৩ সালে প্রকাশিত “Bengali Harlem and the Lost Histories of South Asian America” বইয়ে উনি বিস্তারিত ভাবে দেখান এই বাঙালী অভিবাসীরা কি ভাবে দুটি বিভিন্ন দলে আমেরিকায় এসে পৌঁছোয় এবং বসবাস শুরু করে। আমার এই প্রতিবেদনটি বিবেক বল্ডের সেই গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা ওপর ভিত্তি করে লেখা।

১৮৮৫ থেকে ১৯২৫ (?) - বাঙালী চিকনদারদের অভিবাসন

বিবেক বল্ডের গবেষণা অনুসারে ১৮৮৫ সাল থেকে অবিভক্ত বাংলার (এখন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ) হুগলী জেলাবাসী বাঙালী মুসলমানদের ছোট ছোট দল ট্রাঙ্ক ও বস্তাভর্তি এমব্রয়ডারি করা সিল্কের শাল, টেবিলক্লথ, বালিশের জামা ইত্যাদি নিয়ে নিউ ইয়র্ক, বাল্টিমোর, ইত্যাদি বন্দরে আসা শুরু করে। বাঙালী ফেরিওয়ালাদের সিল্কের এই জিনিসগুলি বলা হত চিকন বা চিকান; সেইজন্যে এই ফেরিওয়ালারা পরিচিত ছিল চিকনদার বা চিকানদার নামে। সেই সময়ে আমেরিকার শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত গোষ্ঠীর লোকদের প্রাচ্যের জিনিসের প্রতি একটা মোহ ছিল এবং সেগুলি দেখলেই কিনতে চাইত। এই বাঙালী ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে নিউ জার্সির সমুদ্র-তীরবর্তী বেড়ানোর বিভিন্ন জায়গা - অ্যাশবেরি পার্ক, অ্যাটলাণ্টিক সিটি, ইত্যাদিতে - তাদের পশরা নিয়ে জাঁকিয়ে বসল। প্রতি বছর কিছু ব্যবসায়ী তাদের গ্রামে গিয়ে নতুন আরও মাল ট্রাঙ্কে করে নিয়ে আসত। চিকনের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসা অন্যান্য জায়গাতেও ছড়িয়ে পড়তে লাগল। উত্তরের ধনি শহর নিউ ইয়র্ক থেকে ধীরে ধীরে দক্ষিণের নতুন উঠতি-শহর ল্যুইসিয়ানার নিউ অরলিয়েন্স-এ। যে কোনও কারণেই হোক, নিউ অরলিয়েন্সের প্রতি চিকনদার আকর্ষণ একটা বিশেষ মাত্রা পেল। বল্ডের হিসেব অনুযায়ী ১৯১০ সালে নিউ অরলিয়েন্সের কাছে ট্রেম-এ আট ঘর বাঙালী বসবাস করত। চিকনদারদের সংখ্যা পঞ্চাশ জন ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ভারত, চীন, মিশর ও অন্যান্য প্রাচ্য দেশগুলির প্রতি একটা আকর্ষণ নিউ অরলিয়েন্সের মারডি গ্রাস প্যারেডের কর্মকর্তাদের সব সময়েই ছিল। বাঙালী ব্যবসায়ীদের আনা সিল্কের জিনিসগুলি দিয়ে প্যারেডের বহু গাড়ি বা ফ্লোট সাজানো হত। ১৯১৭ সালে এই ব্যবসায়ীরা শুধু নিউ অরলিয়েন্সেই নয়, চার্লসটন (সাউথ ক্যারোলিনা), মেম্ফিস (টেনিসী), চাট্টানুগা (টেনিসী), গ্যালভেস্টন (টেক্সাস), ডালাস (টেক্সাস), বার্মিংহাম (অ্যালাবামা), অ্যাটলাণ্টা (জর্জিয়া) এবং জ্যাকসনভিল (ফ্লরিডা)-এ ছড়িয়ে পড়িল। এমন কি একটা সময়ে এই হুগলী-দল কিউবা-তে এবং অন্যান্য ক্যারেবিয়ান দ্বীপগুলিতে, পানামা ক্যানাল অঞ্চলে এবং কোস্টা রিকাতে গিয়ে হাজির হল।

বাঙালী চিকনের ব্যবসার মন্দা শুরু হয় সম্ভবত ১৯২৫ সাল থেকে। ১৯৩৫ সালে এটি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। হয়ত তার পেছনে ছিল ১৯৩০ সালের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’। হয়ত বা হুগলীতে তেমন করে চিকনও পাওয়া যাচ্ছিল না। কারিগররা চিকন বানানো ছেড়ে রুজিরোজগারের জন্যে অন্য কোনও পথ বেছেছিল। কারণ যাই হোক, এদেশে বাঙালী চিকন ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে এদেশের বৃহত্তর সমাজে মিশে হারিয়ে গেল।

১৯১০ থেকে ১৯৩০ (?) – বাঙালী লস্করদের অভিবাসন

চিকনদারদের আসার এক বা দুই যুগ পার না হতেই বাঙালীদের আরেকটা দল নিউ ইয়র্ক ও পূর্বাঞ্চলে আমেরিকার অন্যান্য বন্দরে নেমে বসবাস আরম্ভ করে। এরা হল ব্রিটিশ জাহাজ থেকে পালানো খালাসী। বল্ড পুরনো পত্রিকা ঘাঁটতে ঘাঁটতে এটা আবিষ্কার করেন। ১৯০০ সালের নিউ ইয়র্ক পোস্ট-এর একটি প্রতিবেদনে নিউ ইয়র্কে নাবিকদের ‘বোর্ডিং হাউস অঞ্চলে’ ভারতীয় খালাসীদের একটা ডেরার উল্লেখ ছিল। বল্ড-এর মতে – “যদিও এরা ছিল ভবঘুরে – একবার জাহাজে উঠছে একবার নামছে, ১৯১০ সাল নাগাদ এই খালাসীর দল নিউ জার্সি, পেনসিলভ্যানিয়া ও উপরে নিউ ইয়র্ক রাজ্যের মধ্যে ফ্যাক্টরিতে চাকরির খোঁজে ছড়িয়ে পড়ে। এই সব জাহাজ-পালানো খালাসীদের বেশীর ভাগই ছিল পূর্ববঙ্গের (আজকের বাংলাদেশ) শ্রীহট্ট, নোয়াখালি ও চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চল থেকে আসা বাঙালী মুসলমান। অল্প-শিক্ষিত এই বাঙালীদের ব্রিটিশ জাহাজে lascar (বাংলাতে লস্কর বা খালাসী) বা নিম্নশ্রেণীর শ্রমিক হিসেবে নেওয়া হত।

১৯১০ সাল থেকে জাহাজ-পালানো লস্করদের ক্ষীণধারা ক্রমে ক্রমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বেশ বড় আকার নেয়। বিশ বছর আগে এদের পূর্বসূরি চিকনদাররা পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটনের জায়গাগুলিতে থাকা শুরু করেছিল, এরা তার বদলে গেল উত্তরের শিল্প-প্রধান রাজ্যগুলোতে । চাকরি পেল ইস্পাত শিল্পে, জাহাজ মেরামতির কাজে, যুদ্ধ-সরঞ্জাম শিল্পে, গাড়ির যন্ত্রাংশ জোড়ার কারখানা ইত্যাদিতে। আমেরিকার তরুণ সম্প্রদায়ের অনেকেই যুদ্ধে যোগ দিতে গেছে, তাই শিল্পাঞ্চলগুলিতে তখন শ্রমিকের অভাব চলছে। সুতরাং অভিবাসী বাঙালী, পাঞ্জাবী এবং অন্যান্য ভারতীয়দের – হিন্দু মুসলমান ধর্ম নির্বিশেষে চাকরি পাওয়া কঠিন হল না ।

কেন বাঙালী লস্করদের জাহাজ পালিয়ে আমেরিকায় বসবাস বন্ধ হল – সেটা পরিষ্কার নয়। ১৯৩০-এর গ্রেট ডিপ্রেশন সম্ভবত মূল কারণ। আমেরিকার বদলে অন্য কোনও দেশের বন্দরে নেমে সেখানে ভাগ্যের অনুসন্ধান করাই বোধহয় বেশী আকর্ষণীয় বোধ হয়েছিল। চিকনদারদের মত জাহাজ-পালানো লস্কররাও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকার জন-অরণ্যে মিশে গেল।

প্রথম বাঙালী অভিবাসীদের জীবন ও বেঁচে থাকার লড়াই

এখন যে সব বাঙালী আমেরিকায় আছে, তাদের অনেকেই উচ্চ-শিক্ষিত। তাদের অর্থ আছে এবং সুন্দর সুন্দর বাড়িতে তারা থাকে। তাদের পক্ষে পক্ষে কল্পনা করা কঠিন কি ভাবে প্রথম দিকের এই অভিবাসী বাঙালীরা জীবন কাটাত – সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য তো দূরের কথা দৈনন্দিন কি পরিমাণ লড়াই করে তাদের বাঁচতে হত! এই নতুন অভিবাসীদের না ছিল অর্থ না ছিল তেমন শিক্ষা। মাসের পর মাস উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার মধ্যে ডেক বা স্টীরেজ-এ কাটিয়ে অথবা অত্যাচারী ব্রিটিশ অফিসার আর নাবিকদের অধীনে বয়লার রুমে দীর্ঘ সময় ধরে অমানুষিক পরিশ্রম করে তারা এখানে আসত। ব্রিটিশ শাসিত পরাধীন ভারতের নাগরিক হওয়ায় আমেরিকার মত ‘ফ্রি কাণ্ট্রি’ বা মুক্ত দেশেও তাদের সন্দেহের চোখে দেখা হত এবং আলাদা করে রেখে তাদের ওপর নজরদারী চলত। সবসময়েই ভয় ভয় থাকতে হত কবে ওদের আটকে রাখা হবে অথবা তাড়িয়ে দেওয়া হবে। তা সত্যেও এই সব লড়াকু, কৌশলী ও পরিশ্রমী লোকগুলো কর্তৃপক্ষর চোখে ধুলো দিয়ে অর্থোপার্জন শুরু করে, সাধারণ লোকের স্বীকৃতিও কিছুটা আদায় করে নেয়। একে অন্যকে সাহায্য করে নিজেদের ভিতটা শক্ত করে সংসারও পাতে কেউ। আমেরিকাতে মোট চিকনদার ও লস্করদের সংখ্যা মনে হয় না কখনো ১০০০ ছাড়িয়েছিল বলে। তবে এই সংখ্যাল্পতা তাদের আমেরিকায় বসতি করার সংকল্প থেকে বিচ্যুত করতে পারে নি। নতুন জগতের কঠিন বাস্তবের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে পরস্পরের সহযোগিতাকে পাথেয় করে তারা তাদের বসবাসকে পাকা করেছিল।

প্রথম বাঙালী অভিবাসীরা, বিশেষ করে চিকনদাররা সে সময়ের বহু পক্ষপাতদুষ্ট অভিবাসন আইন ও আচরণের শিকার হয়েছিল। ১৮৯০ দশকে তৈরি এই আইনগুলি কেন্দ্র, রাজ্য এবং আঞ্চলিক – সব স্তরেই ছিল পক্ষপাতদুষ্ট। তার ওপর যেহেতু চিকনদারদের অনেকে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে থাকতে গিয়েছিল, সেখানে বর্ণ-বিদ্বেষী “জিম ক্রো” আইন ও আচরণবিধি বলবৎ ছিল। সেই আইনে বাঙালী ব্যবসায়ীদের কালো বা ‘কালারড’ অঞ্চল বলে চিহ্নিত জায়গায় থাকতে হত।

চিকনদাররা যখন আসতে সুরু করে তখন ১৮৮২-র চাইনীজ এক্সক্লুশন অ্যাক্ট চালু হয়ে গেছে। এই বিধিতে চীন ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের লোকদের আমেরিকাতে কাজ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। আমেরিকার শ্রমিক সংগঠনগুলো বিদেশী শ্রমিকদের ব্যাপারে উত্তরোত্তর অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। ১৯০৩ সালে ক্যানাডা থেকে পাঞ্জাবী শিখরা যখন দল বেঁধে ওয়াশিংটন রাজ্যে এসে আমেরিকার কর্মীদের থেকে কম মাইনেতে রেল-রাস্তা নির্মাণ এবং কাঠ চেরাইয়ের কাজে যোগ দেওয়া শুরু করেছে, তখন শ্রমিক সংগঠনগুলি প্রবল প্রতিবাদে সোচ্চর হয়েছে। ১৯০৫ সালে স্যানফ্রান্সিস্কোতে এশিয়াটিক এক্সক্লুশন লিগ ও ১৯০৭ সালে ক্যানাডার ভ্যানকুবারে অনুরূপ একটি সংগঠন সৃষ্টি হওয়ার পেছনে ছিল জাপানী, কোরিয় ও ভারতীয় শ্রমিকদের আমেরিকার শিল্প ও কৃষি কাজ থেকে দূরে রাখা। ১৯০৭ সালে ওয়াশিংটনের বেল্লিংহামে-এ শিখদের ওপর হামলা করে প্রায় দুশো ভারতীয়কে তাড়ানো হয়।

বাঙালী চিকনদাররা নিজেদের কিছুটা আড়ালে রেখে এই ধরণের অত্যাচার থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিল। এরকম অত্যাচার ও অবমাননার মধ্যেও ভারতীয় অভিবাসীদের নাগরিক হবার রাস্তা খোল ছিল (কলকাতার এক কাবুলিওয়ালা আব্দুল দোল্লা ১৯১০ সালে ‘সাদা ককেশিয়ান’ হিসেবে আমেরিকার নাগরিকত্ব অর্জন করে; তারও আগে আব্দুল হামিদ ২০৮ সালে নাগরিকত্ব পায়)। ১৯১৭ সালে ইমিগ্রেশন অ্যাক্ট অফ ১৯১৭ পাশ হবার সেই রাস্তা বন্ধ হয়। ভারত ‘এশিয়ার নিষিদ্ধ এলাকা’-ভুক্ত হওয়ায় ভারতীরা মার্কিন নাগরিকত্ব লাভের জন্যে আবেদন করার অধিকার হারায়। ১৯২৩ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট মামলার ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম ভগৎ সিং থাণ্ড’ মামলার রায়ে শুধু সিং-কেই নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করে না, তার আগে যতজন ভারতীয় নাগরিকত্ব পেয়েছিল – সবাইর কাছ থেকে নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। ১৯২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরেকটা আইন পাশ করে কোন দেশ থেকে কত জনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে ঠিক করে, সেই দেশগুলির মধ্যে এশিয়ার কোনও দেশ ছিল না। এই আইনগুলিকে হাতিয়ার করে ভারতীয়দের প্রতি সরাসরি বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু হয়। ভারতীয়রা নিজের নামে বাড়িঘর বা কোনও স্থাবর সম্পত্তি কেনার অধিকার হারায়। সুপ্রিম কোর্টে একাধিক মামলায় এই আইন দুটি সংবিধান-বিরোধী নয় বলে রায় দেয়। তৎকালীন প্রেসিডেণ্ট টেডি রুজভেল্ট এই এশিয়া-বিরোধী আইনের প্রবল সমর্থক ছিলেন।

বল্ডের গবেষণার একটি বিষয় ছিল - কি করে এই বাঙালী চিকনদার আর লস্কররা সংসার পেতেছিল। যেহেতু এদের সাদা মেয়েদের বিয়ে করার অধিকার ছিল না এবং এদের থাকতে হাত কালো বা অশ্বেতকায়দের জন্য নির্দিষ্ট অঞ্চলে, তারা কালো, ক্রেয়ল বা মিশ্রজাতির মেয়েদের বিয়ে করত। বল্ডের গবেষণা এবং বই লেখা শুরুই হয়েছিল নিউ ইয়র্কের হার্লেমবাসী এইসব বাঙালী মুসলমানদের নাতিপুতিদের পূর্বপুরুষ কারা ছিল তাদের খোঁজ করতে গিয়ে। সেইজন্যেই তাঁর বইয়ের নাম, Bengali Harlem।

যেসব বাঙালী এখন আমেরিকাতে বসবাস করছেন, তাঁরা হয়তো একটু আশ্চর্য হবেন, এদেশের প্রথম অভিবাসীদের বেশীর ভাগই ছিল মুসলমান। সারা বইয়ে মাত্র দুটি হিন্দু নাম খুঁজে পাওয়া যায়। তার কারণ, যারা চিকন বানাতো তাদের বেশীর ভাগই মুসলমান। এছাড়া কালাপানি পাড়ি দেবার ব্যাপারে হিন্দুদের নানান বিধিনিষেধ ছিল। কাজটি করে তারা একঘরে হতে চাইত না।

আরও কতগুলো মজার তথ্য বল্ডের গবেষণায় জানতে পারা যায়। যেমন, শিখ, মুসলমান বা হিন্দু সবাইকেই সাধারণ লোক এবং প্রশাসন ‘হিন্দু’ (Hindoo) বলত। মুসলমানদের নিজস্ব পোশাককেও পত্রপত্রিকায় হিন্দু-পোশাক বলে উল্লেখ করা হত। এছাড়া, এই জাতের লোকদের ঠিক কোন গোত্রে ফেলা হবে – সে নিয়েও একটা গোলমাল হত। একবার এদের ধরা হত সাদা বা শ্বেতকায়, অন্য সময়ে অশ্বেতকায়। এছাড়া পূর্ব-ভারতীর (East Indian), প্রাচ্যদেশীয় (Oriental), এমন কি তুরস্কের লোক বলেও এদের উল্লেখ করা হয়েছে! মার্কিন মুলুকের দক্ষিণে কালোদের একেবারেই কেউ দেখতে পারতো না, কিন্তু এদের ‘হিন্দু’-দের প্রতি অতটা বৈরী ভাব ছিল না – তাদের প্রাচ্যের একটা exotic দেশ ভারত থেকে আসা মানুষ বলে গণ্য করা হত। পরিশেষে এরা ছিল নির্বিবাদী স্বল্প কয়েকটি মানুষ – নিজেদের কাজ নিয়ে লোকচক্ষুর খানিকটা আড়ালেই জীবনযাপন করত। আমেরিকার শ্রমিকদের কাজ হারানোর মত কোন অবস্থার সৃষ্টি করে নি। অন্যপক্ষে ১৯০৩ সালে যখন ক্যানাডা দলে দলে শিখেরা ক্যালিফোর্নিয়া ও আশেপাশের রাজ্যে এসে গুরুদ্বার স্থাপন করে একসঙ্গে বসবাস শুরু করে – তখন তারা আমেরিকার শ্রমিককুলের বিরাগভাজন হয়েছিল। এই কারণেই ঐতিহাসিকরা শিখদের আসার কাহিনী লিপিবদ্ধ করেছেন, কিন্তু বাঙালী চিকনদার আর লস্করদের কথা লেখেন নি!

বিবেক বল্ডের গবেষণা থেকে কিন্তু ভারতের অন্য প্রদেশ থেকে আর কারা এসেছিল সে খবর জানা যায় না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, উনি এই গবেষণা সুরু করেছিলেন কয়েকজন বাঙালী মুসলমানের পিতৃপুরুষের খোঁজ করতে গিয়ে। অন্যান্য রাজ্য থেকে ওই সময়কালে যদি কেউ এসে থাকে – তার খোঁজ হয়তো অন্য কোনও গবেষণা থেকে জানা যাবে।

দেবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায়
(সুজন দাশগুপ্তের সৌজন্যে)

মূল রচনাঃ ( “This Land is Your Land, This Land is My Land” - A Brief History of Bengali Immigrants in America.)


REFERENCES:

(1) Press Release from the US Census Bureau, April 27, 2010. For the specific table citing the number of Bengali speakers in the US in 2007-2008, see http://www.census.gov/hhes/socdemo/language/data/other/detailed-lang-tables.xls
(2) “Bengali Harlem and the Lost Histories of South Asian America” by Vivek Bald, Harvard University Press, Cambridge, MA, 2013
(3) “Asiatic Exclusion League”, Wikipedia. See http://en.wikipedia.org/wiki/Asiatic_Exclusion_League
(4) “1907 Bellingham Riots”, Seattle Civil Rights and Labor History Project, see http://depts.washington.edu/civilr/bham_intro.htm

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।