টোরাণ্টোর
রঙ্গ বঙ্গ (সম্মেলন)
জুলাই ৫, ৬, ৭ ক্যানাডার
টোরাণ্টো শহরে এ বছরের বঙ্গ সম্মেলন হোলো, আমাদের ছেলেমেয়েরা
যাকে বলে বোঙ্গো, চলিত ভাষায় 33rd North American Bengali Conference(NABC)
কুট্টি গাড়োয়ানের মতে ইংরেজীতে "তেত্রিশতম উত্তর আমেরিকা
বঙ্গ সম্মেলন"। পাঁচ-দশ হাজার লোক নিয়ে এক বিরাট ব্যাপার,
টোরাণ্টোর "প্রবাসী বেঙ্গলি কালচারাল এ্যাসোসিয়েশনের"
সভ্যরা তাঁদের বন্ধুবর্গের সঙ্গে মিলে এই সম্মেলনটি নামিয়েছেন,
খুবই প্রশংসনীয় প্রচেষ্টা। আমি মাঝে মাঝে "বোঙ্গো"তে
গিয়ে থাকি, এবারেও এসেছি এবং ভারী মজা পেয়েছি। "যে কেহ
মোরে দিয়েছ সুখ দিয়েছ তাঁরি পরিচয়", সেকারণে "সবারে
আমি নমি", উদ্যোক্তাগোষ্ঠী এবং শিল্পীরা তো বটেই। সেই সম্মেলনের
কিছু খণ্ডচিত্র দেওয়া গেলো।
যাঁরা এই NABC বা উত্তর
আমেরিকার বঙ্গ সম্মেলনের ব্যাপারটা জানেন না, তাঁদের জন্য ছোটো
করে বলি: সেই আদিকালে যখন ট্যাঁকে দশ ডলার, বুকের একটি বোম্বাই
এক্স্রে আর পকেটে কলেজের প্রবেশপত্র নিয়ে এদেশে আসতাম তখন আমরা
শীতে হীহী করে কাঁপতে কাঁপতে ছবি টাঙিয়ে সরস্বতী পুজো দিয়ে শুরু
করেছিলাম। তারপর সত্তরের দশকে অভিবাসন আইনের এক ধাক্কায় বাঁধভাঙা
জলস্রোত, সেই থেকে আর থামাথামি নেই। দুর্গাপুজো, আমরাই রাঁধি,
আমরাই খাই, মাংসাশীদের জন্য কালীপুজো, তা থেকে কালীবাড়ী, সৌখীন
মন্দির, সেখানে বাস্তু আর গাড়ী থেকে রটন্তী কালী -- সব রকমের
পুজো পাওয়া যায়। এর মধ্যে আবার পেশাদার মন্দিরওয়ালারাও এসে গেছেন,
যথা আদ্যাপীঠ, ভারত সেবাশ্রম ইত্যাদি। এদিকে কিছু বিজ্ঞ লোক
দেখলেন পুজোআচ্চা হচ্ছে, সে তো ভালোই, কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি
যে গোল্লায় যাচ্ছে। আমরা ঝটিতি বানালাম বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ।
তাঁরাই একদিন, বেশ কিছুদিন আগে, তা প্রায় বছর পঁয়ত্রিশ হতে চললো,
প্রথম এক উত্তর আমেরিকা বঙ্গ সম্মেলন করলেন। শদুই সুধীজন এসেছিলেন
বোধহয়, সেই সাফল্যে উদ্বেল হয়ে সঙ্ঘ প্রতিশ্রুত হলেন যে বছর
বছর আবার একে ফিরিয়ে আনা হবে, গ্যারাজে রাখা দুর্গাপ্রতিমার
মতো ধুলোটুলো ঝেড়ে। তা সেই প্রতিশ্রুতি এঁরা রেখেছেন, কোনো বছর
ফাঁক পড়েছে বলে মনে পড়ে না। ব্যাপারটা এই রকম-- প্রতি বছর উত্তর
আমেরিকার একটা বড়ো শহরের বাঙালীদের কোনো ক্লাব চৌঠা জুলাইয়ের
(বা তার কাছাকাছি) ছুটিতে সম্মেলন করেন, টাকা তোলা, খরচ করা,
সম্মেলন চালানো এবং অচল করার সব ঝক্কি তাঁদের। বঙ্গ সংস্কৃতি
সঙ্ঘের প্রথম কাজ বছর বছর খুঁজে পেতে, ভালো করে যাচিয়ে বাজিয়ে
যথাস্থানে এই বংশটি ন্যস্ত করা, তারপর স্থানীয় কর্মকর্তাদের
উপদেশ দেওয়া এবং আসল কাজের কালে যথারীতি গণ্ডগোলের সময় উইংসে
দাঁড়িয়ে মজা দেখা। সেই শদুই সম্মিলিত এখন গোকুলে বেড়ে পাঁচ থেকে
পনেরো হাজারে দাঁড়িয়েছে, খরচের অঙ্কের কখনোই সঠিক সন্ধান পাওয়া
যায় না, এক-দু মিলিয়ন ডলারের কথা শোনা যায়। তবে এসব সংখ্যা একটু
নুন দিয়ে খেতে হয়, আমাদের ভারতবাসীদের একটু বাড়িয়ে বলার স্বভাব
সে তো সবাই জানেন, না জানলে মহাভারত খুলে দেখুন। টাকার খামতি
পড়ার কথা বরাবরই শুনি, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় দ্বিতীয়বার উপুড়হস্ত
হতে হয়েছে একবারই, তার থেকে আন্দাজ করা যায় যে লোকসানের কথাটা
হয় নিছক গাঁজা অথবা উদ্যোক্তারা নিজেরাই কিল হজম করে ফেলেন।
রজত বসু হলেন এক বহুদর্শী
সদানন্দ ফিজিসিস্ট, বঙ্গ সম্মেলনের পোকা, মঙ্গল গ্রহের সম্মেলনটিতে
যাবার দিন গুণছেন। রজত বললেন এই সম্মেলনের আর্থিক দিকটাও একটু
তলিয়ে দেখা দরকার। মাত্র একশো ষাট ডলারে একটি দম্পতীর তিনদিন
ধরে এতো ফূর্তির দাঁও আর কোথায় পাবেন। ব্রডওয়ের দিকে তাকাবার
দরকার নেই, তারা দিনে ডাকাতি করে, কিন্তু একটা মুভি দেখতেই দুজনের
খরচা গড়ে ষোলো ডলার, অর্থাত্ এই টাকাতে গুটি দশেক মাত্র মুভি
দেখতে পারবেন, তা ধরুন বিশ ঘণ্টার কাছাকাছি। এদিকে সম্মেলনে
দেখুন তিনদিনে চৌত্রিশ ঘণ্টার প্রোগ্রাম। দুটো মঞ্চ, তাই দুই
দিয়ে গুণ করুন, আটষট্টি ঘণ্টা-- টানা তিনদিনের নিরন্ধ্র ধামাকা।
এ তো মাত্র নাচগানের কথা, যাকে বলে পারফর্মিং আর্টস্, এর সঙ্গে
যোগ দিন সাহিত্য সভা, বিজনেস সেমিনার, রিইউনিয়ন, ফিলিম ফেস্টিভাল,
হেল্থ্ সেমিনার এমনকী গেঁড়ি গুগলিদের জন্য ইউথ সেমিনার বা
ওই ধরণের কিছু। সিঙাড়া আর মাছের ঝোল খাবার ব্যবস্থা আছে আর চূড়োর
ওপর ময়ূরপাখা, ঢালাও শপিঙের ব্যবস্থা। সেখানে গিন্নিরা শাড়ী-গয়না
পাবেন আর কর্তারা নিভৃত অবকাশের জন্য পাবেন পাওলি দামের ডিভিডি।
আর কী চাই। যদি ভেবে থাকেন প্রোগ্রামে কেবল ডি ক্লাস আর্টিস্ট
এনে আর "লোকাল ভোকাল" শুনিয়ে ঠকাবে, তাহলে ছাপা প্রোগ্রামটা
আরেকবার খুলে দেখবেন। শ্রেয়া ঘোষাল, লোপামুদ্রা মিত্র, মনোময়
ভট্টাচার্য, কৌশিকী চক্রবর্তী, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, তনুশ্রীশঙ্কর,
ইত্যাদি ইত্যাদি-- তারকাখচিত বলে খচিত! ভদ্রলোক ফিজিক্স বেচে
খান, তাঁর তথ্যে আর যুক্তিতে কি ভুল পাওয়া যেতে পারে? তবে হ্যাঁ,
এর সঙ্গে ওই ফিজিক্সেরই আর এক আইন মনে রাখতে হবে-- সেটি হোলো
প্রতি রূপোলী পাড়ের পেছনে কিন্তু কিছু কালো মেঘ থাকবেই থাকবে।
এইটা যাঁরা ভুলে যান তাঁদের ব্লগ লিখে হাহুতাশ করা ছাড়া আর গতি
থাকেনা। ফেসবুকে NABC 2013 পাতাটি খুলে দেখে নিতে পারেন।
সুরলোকে তরজার মতো হাটে
শাস্ত্রীয় সঙ্গীত একেবারেই বেমানান। এইটা খেয়ালে না রেখে কৌশিকী
চক্রবর্তীর গান শুনতে প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে পড়েছিলাম। সেখানে ধুন্ধুমার
ব্যাপার। ধরুন হাজার দুয়েক উপস্থিতদের মধ্যে কম করে সাতশোটি
বিভিন্ন কিন্তু অত্যন্ত জরুরী বিষয় নিয়ে তর্ক এবং আলোচনা চলেছে।
শব্দব্রহ্ম! কৌশিকী বয়সে তরুণী কিন্তু শাস্ত্রীয় গান গাইবার
অভিজ্ঞতা আছে, তিনি মিষ্টি হেসে মধুর কথাবার্তা বলে দর্শকদের
সঙ্গে হৃদ্যতা স্থাপনের চেষ্টা করলেন, "ভালো লাগলে হাততালি
দেবেন, হাততালি আমার ভালো লাগে" বলে শ্রোতাদের জড়িয়ে আনতে
চাইলেন, কিন্তু কা কস্য পরিবেদনা। তারপর নরম করে সন্ধ্যার নরম
যোগ রাগ ধরলেন, শৃঙ্গাররস, আলাপের পরেও যখন জনকল্লোলে রাগিণীর
খাবি খাওয়া বন্ধ হোলো না তখন বিস্তার-টিস্তার মাথায় তুলে রাগ
শেষ করে ধরলেন বেগম আখতারের প্রবাদপ্রতিম গান -- "পিয়া
ভোল অভিমান"। প্রেক্ষাগৃহের পিয়াদের বয়ে গেছে তাতে, তাঁরা
যত্পরোনাস্তি গোলমাল করে যেতে লাগলেন। শেষে যখন বড়ে গোলামের
বন্দিশ সেবন করিয়েও কাজ হোলো না তখন পরাস্ত কৌশিকী মিষ্টি হেসে
বিদায় নিলেন। অথচ আরেকটি মঞ্চ ছিলো, প্রোগ্রামের একটু রদবদল
হলেই কৌশিকীর শ্রোতারা সেখানে শান্তিতে গান শুনতে পারতেন, আর
এখানেও আম জনতার গোলমাল করাতে কেউ বাধা দিতো না। তবে একশো ষাট
টাকা দিলে ওই হাটুরে প্রোগ্রামই দেখতে হবে, এটি হোলো ওই রূপোলী
পাড়সংলগ্ন আরেকটি কালো মেঘ। আমাদের ছোটোবেলায় টালিগঞ্জ ব্রিজ
থেকে নেমে আদি গঙ্গার পাশের এক ছবিঘরের কথা মনে পড়লো, সেখানে
দশ পয়সায় চলচ্চিত্র দেখা যেতো। অবশ্য সেসব ছবির নায়িকা হতেন
ফিয়ারলেস নাদিয়া। সেখানে আবার জোয়ারের সময় মেজেতে জল আসতো, চেয়ারে
পা তুলে বসতে হোতো দুয়েকটি ইঁদুর কোলে নিয়ে। দশ পয়সায় আর কী
চান? এইরকম ব্যাপার আর কী। প্রসঙ্গত, কৌশিকীর পরিচয়লিপিতে (এবং
স্টেজের পরিচিতি) পিতা অজয় চক্রবর্তীর নাম দেখা গেলো না। তার
যাই কারণ থাকুক, ব্যাপারটা দুঃখের।
বিক্কলেজের রিউনিয়ন ছিলো
সকাল এগারোটায়। জ্যোতিদা সঞ্চালক, ইমেলের বন্যা বইয়ে প্রিরেজিস্ট্রেশন
করিয়ে রেখেছেন। এগারোটা বেজে এক মিনিটে পৌঁছে দেখি প্রচুর লোক,
সইসাবুদ কমপ্লিট, নিমকি-সিঙাড়ার সদ্গতি হচ্ছে। পরিবেশন করছেন
বিক্কলেজ-গিন্নিরা, অনেকদিন পর্যন্ত তাঁদের অনরারি প্রাক্তনী
করে নেওয়া হোতো। সাড়ে এগারোটায় গলাখাঁকারি দিয়ে সভা শুরু, পাওয়ারপয়েণ্ট
স্লাইড আর নানান তথ্যে ছয়লাপ। ঠিক সাড়ে বারোটায় জ্যোতিদা বক্তার
হাত থেকে মাইক কেড়ে নিলেন, তারপর বক্স লাঞ্চ, তার জন্য আগেই
দশ টাকা দিতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে একটা গল্প মনে পড়লো। ছাপান্ন
সালে সবে কলেজে ঢুকেছি, সেন্টিনারীর চাঁদা তুলতে পাঠানো হয়েছে
প্রাক্তন ছাত্রের বাড়ীতে। আটটাকায় ভোজের ব্যবস্থা, দাদা বললেন,
বলি আটটাকা তো নিচ্ছ, বতল-ফতল চলব্যা। তখনও চলেনি, এখনও চললো
না। বাক্স খুলে পেলাম রাধাবল্লভী, দুটি চপ, আলুর দম, বাটিতে
ছোলার ডাল, তাতে নারকেল কুচি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে এবং অমরাবতীভোগ্য
ক্ষীরকদম্ব আর দরবেশ। ক্ষণিক হলেও স্বর্গবাস তো বটেই, জ্যোতিদা
শতজীবী হোন। ভালো কথা, এর মধ্যেই ব্যাচ ব্যাচ করে ছবি তোলা হচ্ছে,
তাদের ক্যাপশন যাতে ঠিক ঠিক পড়ে তার এক অভিনব ব্যবস্থাও আছে।
সব একেবারে তেলানো মেশিনের মতো।
প্রেসিডেন্সি কলেজের রিইউনিয়ন
বেলা একটায়, হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে দেখি চারিদিক সুন্সান, কেবল
এক মহিলা প্রোষিতভর্তৃকার মতো শুকনো মুখে বসে আছেন আর ল্যাপটপে
এক পুরনো স্লাইড শো ঘুরেই চলেছে। তিনি সঞ্চালিকা। দশ মিনিট পরে
গলা খাঁকারি দিয়ে সাড়া পাওয়া গেলো: এই তো সবে দশ মিনিট হয়েছে,
অতো ব্যস্ত হচ্ছেন কেন। ডেড্ডা-ফেড্ডা নাগাদ সব এসে যাবে। প্রেসিডেন্সির
রিইউনিয়নে আমি নেহাত্ই চণ্ডাল, আইএস্সি পাস করেছি মাত্র,
কিন্তু আমার জীবনে এই কলেজের প্রভাব বিশাল। প্রায় ছয় যুগ আগে
ভবানীপুরের অতি ঘরোয়া বাঙালী মিত্র ইস্কুল থেকে প্রেসিডেন্সিতে
এসে দাঁত খুলে যাবার উপক্রম। সেই বিশ্ববিখ্যাত সিঁড়ি আছে, সেখানে
আজও সুভাষচন্দ্রের জুতোর ভূত ঘুরে বেড়ায়, ধুরন্ধর সব প্রফেসাররাও
আছেন তো বটেই, কিন্তু এখানেই সিগারেট খেতে শিখেছি, শিখেছি কান-লাল-করা
বহু বাংলা চারঅক্ষরী, প্রক্সি দেওয়া-নেওয়ার ব্যবসা, আর থার্ড
ইয়ার ও তার ওপরের কলহংসীদের সতৃষ্ণ নয়নে দেখে একলাফে কৈশোর থেকে
যৌবনে পৌঁছে গেছি। একসময়ে দেখি ছোট্টো ঘর মোটামুটি ভরে গেছে।
সবাই উঠে তাঁদের কাহিনী বললেন, বললেন ডাকসাইটে সব মাস্টারমশায়দের
কথা। আমি বললাম যে আমাদের কালে প্রতি ইয়ারে একটি করে মক্ষীরানী
থাকতেন, তাঁরা এলেই কলেজ আলো হয়ে যেতো। লিখিত কিছু ছিলো না,
হোতো না কোনো কলেজরানী প্রতিযোগিতা, কিন্তু সবার অজ্ঞাতেই তাঁরা
একদিন বৃতা হয়ে যেতেন আর সারা কলেজ হাঁ করে তাঁদের পথ চেয়ে থাকতো,
সুনীল গাঙুলীর নীরার জন্য যেমন অবস্থা হোতো কোলকাতা শহরের। ফোর্থ
ইয়ারে ছিলেন প্রার্থনাদি, প্রার্থনা বোস, থার্ড ইয়ারে দীপ্তি
ব্যানার্জি, আমরা তাঁকে জানতাম টুসটুসি বলে। আমার কালের সেকেণ্ড
ইয়ার পরে এই মক্ষীরানী পুলে দান করেছিলো কমলা নায়ার আর আমরা
দিয়েছিলাম সান্ত্বনা পাল। গায়ত্রী চক্রবর্তী ছিলেন কাছাকাছিই।
তাঁরা এতোদিনে নিশ্চয় ঠাম্মা-দিম্মা হয়ে কারো না কারো ঘর আলো
করে আছেন, আমি চোখ বুজলেই সেই চারুহাসিনীদের দেখতে পাই। এ শুনে
রিইউনিয়নে কিছু চোখ বাষ্পাচ্ছন্ন হোলো, সে আমি নিজে চোখে দেখলাম।
তারপর গান হোলো, অমিয়দা তো গাইলেনই, খালি গলায় শুভ্রা গোস্বামী চমত্কার
এক রবীন্দ্র-টপ্পা গাইলো, তারপর সামান্য নোটিসে বিশাখা কোমরে
আঁচল গুঁজে ওই ছোট্টো ঘরে চমত্কার নাচ দেখালেন। তারপর মিটিং
শেষ। ছবি তোলা নেই, চাও নেই।
আমি বিষণ্ণ হয়ে ফিরলাম,
সারাজীবন ভুল পথেই চলার কথা ভেবে। এই যে চার বচ্ছর ঘাড়ে টিস্কোয়যার
বয়ে, মেসের অখাদ্য খেয়ে, ছারপোকাদের রক্তদান করে ইঞ্জিনিয়ার
হলাম তার বদলে কি পেলাম। শৃঙ্খলা মানা মিটিং, দুটো রাধাবল্লভী
আর সিমেণ্টে একটু ভেজাল দেবার ঘুষের দুটো পয়সা। আর প্রেসিডেন্সিওয়ালারা
নাচলেন, গাইলেন, মন্ত্রী হলেন, আমলা হলেন, আমাদের মতো ইঞ্জিনিয়ারদের
চরালেন, কোটি কোটি টাকা তছরুপ করলেন, তার কিছু ঘরেও এলো। ঠিক
আছে পরের জন্মে দেখা যাবে, কিন্তু তখনও কি দেখা-না-দেখায় মেশা
মক্ষীরানীরা কলেজের চত্বর আলো করে বেড়াবেন?
প্রোগ্রামে 100 years of
Gitanjali অনুষ্ঠানের খবর পেয়ে প্রেক্ষাগৃহের দিকে যাচ্ছি, এমন
সময় ধাক্কা লেগে গেলো পোনুর সঙ্গে। পোনু আবার কে জিজ্ঞাসা করবেন
না, এখানে পোনুকে না চিনলেও চলবে। দেখি ছোকরা অত্যন্ত উত্তেজিত,
সেটি রোজকার ব্যাপার, কিন্তু নাক ভয়ানক ভাবে কুঁচকে আছে। বললে,
স্যার ওদিকে যাবেন না, ওদিক থেকে একটু পচা গন্ধ আসছে, একবালতি
দুধে একফোঁটা গোচোনা পড়ার গন্ধ। পোনুর ওই স্বভাব, হেঁয়ালিতে
কথা বলা। চেপে ধরাতে বললে গাইয়ে-বাজিয়ের দল একেবারে টপ ক্লাস,
চোনাটি হলেন এই প্রোগ্রামের দুই ভাষ্যকারের একজন, ন্যারেটর যাকে
বলে। এই ভদ্রলোককে দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জড়িয়ে প্রোগ্রাম করানো
আর শেয়াল দিয়ে মুর্গীর খাঁচা পাহারা দেওয়ানো-- ও একই ব্যাপার।
আর একটু ঝেড়ে কাশো। এই ইনি হলেন পশ্চিম বঙ্গের একজন খ্যাতিমান
লেখক,নাম করলে লোকে এক ডাকে চিনবে, বটতলার আশে পাশে ঘোরাফেরা
করেন। সম্প্রতি পথ ভুলে সরাসরি বটতলায় ঢুকে এক নায়ক আবিষ্কার
করেছেন, নাম রবীন্দ্রনাথ, তাঁর তো কীর্তির আর অন্ত নেই, এবং
সে কারণে এই লেখকের অপ্রকাশিত চটিতে লাগাবার পক্ষে আদর্শ। গল্পের
নায়কের সঙ্গে এই রবিবাবুর চরিত্র একেবারে খাপে খাপে মিশে যায়,
শুধু খ্যাঁদা-পেঁচী নামগুলি বদলে দেওয়া -- রবীন্দ্রনাথ, কাদম্বরী,
রাণু, ... সব ভালো ভালো নাম। আমাদের লেখক অবশ্যই তাই করেছেন,
এরকম দাঁও কি ছাড়া যায়। যদিও পরিষ্কার করে লিখে দিয়েছেন যে এই
যে সুইসাইড নোট তা গল্পের নায়িকা কাদম্বরী দেবী সত্যি সত্যি
লিখে যাননি, তবে যদি লিখতেন তাহলে এমনটি লিখতে পারতেন, কিন্তু
বাঙালী পাঠক তা শুনবে কেন। তারা বড়ো ঘরের কেচ্ছার খবর পেয়েছে,
তারা কাছা খুলে সেই সব বই কিনছে আর ইনি লাল হয়ে যাচ্ছেন। আমি
বললাম, তা উনি তো আর সেই চটি থেকে কিছু পাঠ করে শোনাচ্ছেন না,
তাহলে পালাচ্ছো কেন। বললে, না স্যার ইনি যে গীতাঞ্জলির সূত্র
ধরে রবীন্দ্রনাথের অর্শের গল্প শোনাবেন না তার গ্যারাণ্টি দিতে
পারবেন, য়যাঁ? পারবো না জানি, তাই পোনুকে বাংলাদেশী সিঙাড়া আর
চা খাওয়াতে নিয়ে যেতে হোলো, প্রোগ্রাম আর দেখা হোলোনা।
পোনুকে যাঁরা চেনেন তাঁরা
জানবেন যে তার কথা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয় তাই আমাদের এই বটতলার
লেখকই সেদিন স্টেজে রবীন্দ্রনাথের দাড়ি কামিয়ে দিচ্ছিলেন কিনা
জানার জন্য (কোনো কাগজে ন্যারেটরের নাম পেলাম না) সম্মেলনের
মাঝারি মাপের এক কর্তাকে ফোন করলাম। করে পোনুর কথার যাথার্থ্য
সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হওয়া গেলো, কিন্তু অকারণে ভীষণ তিরস্কৃত
হয়ে গেলাম। এ ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা, কেন আমি এ খবর চাই সেটা তাঁকে
জানাতেই হবে। শেয়ালের গল্পটা বলাম, ভীষণ রেগে গেলেন। প্রথমে
বললেন শোটা তো চমত্কার হয়েছে, শতকরা নিরানব্বই ভাগ দর্শকের
তাই মত । এই স্ট্যাটিস্টিক্স্ কোথায় পেলেন সেটা জানতে চাইলে
আরো রেগে গেলেন, বললেন ওঁর কাছে যদি একশো জন এসে এই শোয়ের কথা
বলেন তার মধ্যে নিরানব্বই জনই শোয়ের সাধুবাদ দেবেন এ ব্যাপারে
তিনি নিশ্চিত। আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে আমাকে এতো বকছেন কেন, আমি
তো শো খারাপ হয়েছে তা বলিনি। তখন বললেন যে আমি এই লেখক সম্বন্ধে
ভালো ধারণা পোষণ করি না, এটা ভালো নয়। যদিও আমি তাও বলিনি ওঁকে,
কিন্তু এটা জানলাম যে মেজবাবু এই লেখকের সাহিত্যকৃতি নিয়ে খুব
একটা ঘাঁটাঘাঁটি করেননি। এখন হোলো কী, মুর্গী খাওয়া শেয়ালের
জাতধর্ম, সে কারণে তার ওপর রাগ করা সাজে না কিন্তু তাকে যাঁরা
পাহারাদার নিযুক্ত করলেন তাঁদের একটু দায়বোধ থাকা উচিত ছিলো।
সস্তায় টিকিট কেটে কিছু বাসি তেলেভাজা খাওয়াটা মেনে নেওয়া যায়
-- যেমন জয়তী চক্রবর্তীর স্বরচিত রবীন্দ্রসঙ্গীত-- কিন্তু একেবারে
সেঁকো বিষ, এটা কি ঠিক হোলো?
বঙ্গ সম্মেলনের তেত্রিশ
বছরের ইতিহাস দেখলে আমাদের এখানকার অভিবাসী জীবন বিবর্তনের একটা
চলচ্চিত্র পাওয়া যাবে, যেমন হওয়া উচিত। আমাদের সমাজ বেড়েছে,
সমাজের সঙ্গতি বেড়েছে, সম্মেলনও তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।
গোড়ার দিকের বোল ছিলো আমাদের সংস্কৃতির ধারা এখানে বহমান রাখা,
তা সে আমরা নিজেরাই করতাম, দেশ থেকে গুণীদের এনে করবার রেস্ত
ছিল না। মধ্যে ধুয়ো উঠলো আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্মকে এই সংস্কৃতির
উত্তরাধিকারী করে যেতে হবে। সে ভবীরা এসব ছেঁদো কথায ভোলবার
নয়, তারা এ সম্মেলনের ধারে কাছেও ঘেঁষলো না। তবে আমরাও হতাশ
হবার পাত্র নয়, আমরা আস্তে আস্তে দেশ থেকে নামকরা শিল্পীদের
আনতে আরম্ভ করলাম, প্রথমে রবীন্দ্রসঙ্গীত, তারপর নাটকের দল,
আধুনিক গাইয়ে-- তারপর আস্তে আস্তে বাউল, পল্লীগীতি এমনকী শাস্ত্রীয়
সঙ্গীতও ঢুকে গেলো কখন ফুড়ুত্ করে। বছর দশেক বা পনেরো আগে
থেকে আমাদের সমাজে অনেক নতুন ধরণের মানুষ আসতে শুরু করলেন আর
সম্মেলনের আর্থিক ব্যাপারটাতেও বেশ ঘোরতর পরিবর্তন এলো। সেটা
কী, তা নিয়ে আরেকদিন আলোচনা করা যাবে, কিন্তু ফলং আমরা ওই দ্বিতীয়
প্রজন্ম-টজন্মের ছেঁদো কথা বাদ দিলাম, সম্মেলন হোলো "সন্মেলন"
(এই সম্মেলনের ছাপা নির্ঘণ্ট পশ্য) আর সংস্কৃতির ফোকর দিয়ে বলিউডি
নাচগানধামাকা ঢুকে গেলো। আমজনতা ভারী খুশী, এবং এই সব মেলার
সেইটেই আসল কথা।
শেষাংশ পরের
সংখ্যায়
সুমিত
রায়
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)