মাইকেলেঞ্জেলোর
ডেভিড দর্শনে

অনেকের মতে
মাইকেলেঞ্জেলো (পুরো নাম মাইকেলেঞ্জেলো ডি লোডোভিকো বুয়ানাররোতি
সিমোনি) হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী। প্রতিভা প্রকাশের
মাধ্যম ছিল ভাস্কর্য, চিত্রশিল্প আর স্থাপত্য (কবিতাও লিখেছেন
তিনশতাধিক)-- প্রতিটিতেই তিনি উৎকর্ষের চরমে পৌঁছেছিলেন বলে
বিদগ্ধজনের বিশ্বাস। গতৈশ্বর্য, হতশ্রী পরিবারে আত্মসর্বস্ব
পিতার ঔরসে চিররুগ্না মাতার গর্ভে জন্ম নিয়ে শৈশবেই মাতৃহারা
হলেও মাইকেলেঞ্জেলো সত্যিকার ক্ষণজন্মা পুরুষ। জন্মেছেন যখন,.
তখন ইতালীয় সংস্কৃতি-সূর্যের পুনরোদয়, রেনেসাঁ, প্রায় মধ্যগগনে।
শিক্ষাকাল ও কর্মজীবনের বেশীর ভাগ কেটেছে ফ্লোরেন্স নগরে। ফ্লোরেন্স
তখন অর্থ ও প্রতিপত্তিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সংস্কৃতিমনা মেডিচি
পরিবারের, বিশেষত প্রাণপুরুষ লোরেঞ্জো মেডিচির (তাঁর নামে এই
যুগটিকে ইতিহাসে লরেন্শিয়ান যুগ বলা হয়) আনুকূল্যে ইউরোপে খ্যাতির
শিখরে। সেসময় ফ্লোরেন্স প্রজাতান্ত্রিক (রিপাব্লিক), ব্যক্তি
স্বাধীনতায় বিশেষ বিশ্বাসী-- তৎকালীন ইউরোপে ব্যতিক্রম। মায়ের
মৃত্যুর পর ধাত্রী পরিবারে মাইকেলেঞ্জেলোর শৈশবের কিছু সময় কেটেছে,
তাঁরা ছিলেন ইতালীর বিখ্যাত শ্বেতপাথরের খনির শ্রমজীবী। সে সূত্রে
ছেলেবেলাতেই মাইকেলেঞ্জেলো মার্বেল পাথর চিনেছেন ভালো করে। এই
চেনাটি তাঁর পরবর্তী জীবনে খুব কাজে লাগবে।
কর্মসূত্রে যৌবনের শুরুতে
রোম যেতে হযেছিল, ১৫০১ সালের গোড়ায় মাইকেলেঞ্জেলো সেখান থেকে
ফিরে এলেন ফ্লোরেন্সে, তখন তাঁর বয়স সাতাশ বছর। স্বজনের আকর্ষণ
অবশ্যই ফেরার একটি কারণ কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণও
ছিল। সেটি হোলো প্রায় আঠারো ফুট উঁচু, কলঙ্কহীন শ্বেতশুভ্র একটি
মার্বেলখণ্ড। পঁয়ত্রিশ বছর ধরে কবে যোগ্য ভাস্করের হাতে পড়বে
এই আশায় ফ্লোরেন্সের গির্জার প্রাঙ্গণে পড়ে থাকার পর তার সদ্গতি
হতে পারে-- এই খবর পেয়ে মাইকেলেঞ্জেলো চলে এলেন। কর্তাদের কাছে
পেশ করলেন তাঁর নক্শা, তারপর পাথর ও পারিশ্রমিকের আশ্বাস পেয়ে
১৫০১ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর, সোমবার মাইকেলেঞ্জেলো পাথরে ছেনি
চালালেন। ইউরোপীয় সংস্কৃতির পণ্ডিতেরা এই দিনটিকে শ্রদ্ধার সঙ্গে
স্মরণে রাখেন। ইতালীয় রেনেঁসা এদিন অন্যতর, মহত্তর স্তরে পৌঁছলো--
"হাই রেনেসাঁ"-- বলে মানা হয়। প্রসঙ্গত, এই সময়ের
কাছাকাছিই আর এক দিক্পাল লেনার্দো দা ভিঞ্চি তাঁর অমর শিল্পকীর্তি,
যথা মোনা লিসা ও দি লাস্ট সাপার সৃষ্টিকর্মে হাত দেন। কাজ শেষ
হোলো ১৫০৪ সালের মে মাসে, চারদিন ধরে চল্লিশ জন জোয়ান মিলে পথে
কাঠ আর রোলার পেতে, খিলেন ভেঙে ডেভিডকে পৌঁছে দিল পিয়াৎজা দেল্লা
সিনোরিয়া চত্বরে। আটই সেপ্টেম্বর শুভ উদ্বোধন, এবং সে দিন থেকেই
এই মূর্তিটি হয়ে গেলো ফ্লোরেন্সবাসীদের প্রাণের ধন।

মাইকেলেঞ্জেলো একবার বলেছিলেন
যে তিনি পাথর কুঁদে মূর্তি বানান না, তিনি তাদের করেন 'প্রস্তরশৃঙ্খলোন্মুক্ত'।
প্রায় আড়াই বছর পরিশ্রমের পর মাইকেলেঞ্জেলো প্রস্তর-কারাগার
থেকে যাকে মুক্তি দিলেন তার নাম হোলো "ডেভিড", হিব্রু
বাইবেল মতে ইস্রায়েল রাজ্যের দ্বিতীয় অধিপতি, কোরানেও উল্লেখ
আছে। রাজা হবার আগে তাঁর তরুণ বয়সের একটা কাহিনী প্রচলিত আছে,
অনেকেরই জানা, কিন্তু এই ভাস্কর্যের ভিত্তি বলে আবার লিখে দিই।
একসময় ফিলিস্টিন আর ইস্রায়েলবাসীদের মধ্যে সমরক্ষেত্রে মোকাবেলা
হয়। ফিলিস্টিনদের দিকে এক দৈত্যকায় যোদ্ধা ছিল, তার নাম গোলায়াথ।
তারি দর্পে ফিলিস্টিনরা বলে যদি একক যুদ্ধে কোনো ইস্রায়েলি একে
পরাস্ত করতে পারে তাহলে ফিলিস্টিনরা আর আক্রমণ না করে চলে যাবে।
গোলায়াথের চেহারা দেখে কোনো ইস্রায়েলি সাহস করে এগোয়নি, কেবল
সবে তারুণ্যে উপনীত ডেভিড এই আহ্বানে সাড়া দেন। রণক্ষেত্রে নেমে
গোলায়াথ কিছু বোঝবার আগেই ডেভিড গুলতি থেকে পাথর ছুঁড়ে তার কপালে
আঘাত করে তাকে ভূপাতিত করেন এবং তারপর স্বহস্তে তাকে বধ করে
তার মাথা কেটে ফেলেন। প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে ফিলিস্টিনরা চলে
যায়। মাইকেলেঞ্জেলো ডেভিডের এই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রূপটি
গড়েছিলেন, তখনকার ফ্লোরেন্সবাসীরা পছন্দ করতো এই রূপটি। কারণ
বোধহয় দানবনাশী এই বলদৃপ্ত তরুণের মধ্যে ফ্লোরেন্সবাসীরা দেখতে
চাইতো নিজেদের-- তখনকার ইতালীর অন্যান্য স্বার্থান্ধ, প্রাচীন
মত ও পথের অবলম্বী, একনায়কতন্ত্রী প্রদেশগুলির মধ্যে ব্যতিক্রমী
এক নবীন, সতেজ চিন্তার ও কর্মের জীবনপথের নবজাগরিত পথিক হিসেবে।
এই গোলায়াথঘাতী ডেভিডের আরো দুটি প্রতিমূর্তি মেডিচিরা তৈরী
করিয়েছিলেন, দুটিই ব্রোঞ্জের, দুটিই তৎকালীন প্রসিদ্ধ ভাস্করের
তৈরী। একটি ডোনাতেল্লোর আরেকটি ভেরোচ্চিওর (অপ্রাসঙ্গিক হলেও,
এই ভাস্কর্যের আদল দিয়েছিলেন তরুণ লেনার্দো দা ভিঞ্চি), দুটিতেই
নগ্নমূর্তি কিশোর ডেভিডকে দেখানো হয়েছে গোলায়াথবধের পর, পদপ্রান্তে
দৈত্যের ছিন্নমুণ্ড, হাতে খোলা তরোয়াল।
মাইকেলেঞ্জেলো কিন্তু সরে
গেলেন এই প্রচলিত রীতি (এবং তার সঙ্গে জড়ানো বীভৎস রস) থেকে।
তাঁর গড়া মূর্তিটি এক পূর্ণযৌবন নগ্ন তরুণের পূর্ণ অবয়ব। সতেরো
ফুট উঁচু কিন্তু সেই তুলনায় একটু পাতলাই বলতে হবে। দাঁড়িয়ে আছেন
ডান পায়ের ওপর সমস্ত শরীরের ভার রেখে, শ্লথ বাঁ পা একটু এগিয়ে।
কাঁধ ও কটি সমান্তরাল নয়, ঊর্ধ্বাঙ্গের পেশী টানটান, S-অক্ষরের
আভাস আছে একটু। ভাস্কর্য-ভাষণে এটিকে বলা হয় contrapposto, বহু
প্রচলিত, মানবদেহের পক্ষে নিখুঁত ভঙ্গী। তাঁর বাঁহাতও টানটান
কিন্তু ডান হাত শ্লথ, শুধু বদ্ধ মুষ্টির দৃঢ়তা বোঝা যাচ্ছে স্ফীত
শিরার ইঙ্গিতে। ডানহাতের মুঠিতে গুলতির হাতল, গুলতির ফিতে পিঠ
দিয়ে উঠেছে, থলিটি বাঁ কাঁধে ধরে রেখেছে বাঁ হাত। দুই চোখ পূর্ণ
উন্মীলিত, নাসিকারন্ধ্র স্ফীত, ভ্রূমধ্য পেশী কুঞ্চিত, দৃষ্টি
দূরান্বেষী। সারা মুখ যেন ফেটে পড়ছে-- উত্তেজনায়, আশঙ্কায় না
কি অভাবনীয় কিছুর প্রত্যাশায়? বাঁ পায়ের একটি নখ ভাঙা দেখিয়েছেন
মাইকেলেঞ্জেলো। শুনলাম মাঝে মধ্যে ডেভিড যখন পৃথিবীর অন্যত্র
বেড়াতে যান তখন একটা প্লাস্টারের নকল দিয়ে অ্যাকেডেমিয়ার দর্শকদের
ভুলিয়ে রাখা হয়। নখটি থাকে আস্ত, "তাই দিয়ে যায় চেনা"।
মূর্তির বিবরণ প্রসঙ্গে বলে রাখা যায় যে কিছু কিছু অঙ্গের--
যথা মাথা ও ডান হাত-- মাপ বাকী কাঠামোর তুলনায় একটু বড়ো দেখায়।
কাজ শুরু করার কালে মূর্তিটিকে গির্জার চূড়ার কাছাকাছি তুলে
রাখার পরিকল্পনা ছিল তাই এই স্থাপত্যের চাতুরী। পাথরটির ওজনের
কথা ভেবে পরে সে চিন্তা পরিত্যক্ত হয়, ভাগ্যিস!
এতো গেল টেকনিকের কথা।
এতো বড়ো পাথর নিয়ে কাজকর্ম করার যা প্রযুক্তি দরকার, তা তখন
সুলভ। আসল প্রশ্ন হোলো এই মূর্তির সার ভাবটি কী, মাইকেলেঞ্জেলো
কী বলতে চেয়েছেন এর মাধ্যমে, কী মনে আসে এটি দেখলে? সে প্রসঙ্গে
যাবার আগে আজ মূর্তিটি যেভাবে রেখে দেখানো হয়েছে তা নিয়ে দুয়েক
কথা বলা দরকার।
মূর্তিটি এখন রাখা আছে
ফ্লোরেন্স শহরে, "অ্যাকাডেমিয়া গ্যালারি"তে, ছোটো
একটি গম্বুজের নীচের কেন্দ্রস্থলে (কেতাবী নাম ট্রিবিউনা), একটি
লম্বা দালান বা হলওয়ের প্রত্যন্তে। পিয়াৎজার যেখানে মূর্তিটির
প্রথম প্রতিষ্ঠা, এখন সেখানে একটি অনুকরণ রাখা আছে খোলা আকাশের
নীচে, রোমমুখী, ভেচ্চিও প্রাসাদের প্রবেশদ্বারের সামনে। একটু
খেয়াল করলে দেখা যায় যে অ্যাকাডেমিয়া প্রদর্শনী স্থানটি ক্রুশাকার,
মূর্তিটি আছে তারই দুটি অঙ্গের জোড়ের কেন্দ্রস্থলে। এই ক্রুশের
লম্বা অংশটিতে (হল অফ স্লেভ্স্) মাইকেলেঞ্জেলোরই খোদাই করা কিছু
মূর্তি আছে, সবকটিই অসম্পূর্ণ। তার মধ্যে চারটি এসেছে ডেভিড-ভাস্কর্যের
অনেক পরে বায়না করা "ক্রীতদাস", Slaves, আখ্যার ছয়-মূর্তির
একটি গুচ্ছ থেকে (বাকী দুটি প্যারিসে লুভ্র্ যাদুঘরে আছে, আমি
দেখেছি), বাকীটি বই-হাতে সন্ত ম্যাথুর মূর্তি। বলেছি যে মাইকেলেঞ্জেলো
মূর্তিগুলি শেষ করেননি কিন্তু প্রতিটি মূর্তি এমনভাবে গড়েছেন
যে দেখলে মনে হয় যে প্রতিটিতে একটি করে প্রাণসত্তা পাথরের বন্ধন
ভেঙে বার হবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের
তো কোথাও না কোথাও ঈশ্বর বা খ্রিস্টকে ঢোকাতেই হবে, তাই ক্রুশের
অনুভূমিক অংশে যীশু, মেরীমাতা ইত্যাদি কিছু অয়েলপেণ্টিং আছে।
ঠিক আছে, কোই বাৎ নেই, কিন্তু তার মধ্যে ফুড়ুৎ করে ভেনাস ও কিউপিড
গোছের কিছু নগ্নিকা কেন প্রবেশ করেছে তা বুঝতে পারলাম না-- বোধহয়
মিউজিয়ামের খদ্দের বাড়াবার জন্য।

এখন ভাস্কর্যটির সারাৎসার
প্রসঙ্গে ফেরা যাক। মনে রাখতে হবে যে সময় মাইকেলেঞ্জেলো মূর্তিটি
তৈরী করলেন, সে সময় ফ্লোরেন্সের ভারী দুঃসময়। লোরেঞ্জো মারা
গেছেন, সাভোনারোলা নামে এক ধর্মান্ধ মূর্খ ফ্লোরেন্সকে ধর্মীয়
অনুশাসনের পাশে বেঁধে রাখতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেই জনরোষের
শিকার হয়ে বিদায় নিয়েছে। লোরেঞ্জোর উত্তরাধিকারী পিয়েত্রো ফ্লোরেন্স-আক্রমণকারী
ফরাসী সম্রাটের সঙ্গে শলা করার সন্দেহে জনরোষে নির্বাসিত, কিন্তু
নির্বাসনে থেকেই সে ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য নানান চক্রান্ত করছে।
রোমের পোপ কুখ্যাত বর্জিয়া পরিবারের লোক, নিজের কোলে ঝোল টানতে
সদা উদ্যোগী, সে ফ্লোরেন্সের, বিশেষত তার শাসনব্যবস্থার সর্বনাশ
করার প্যাঁচ কষে যাচ্ছে। ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে বড়ো গর্ব তার প্রজাতন্ত্র,
রিপাবলিক, সে রিপাবলিকের কাঠামো নড়বড়ে হয়ে আসছে। ঘরে-বাইরে,
দুদিকেই ফ্লোরেন্স ঘোর সমস্যার সম্মুখীন। এই সময়ে মাইকেলেঞ্জেলো
উদ্বোধন করলেন তাঁর অমর ভাস্কর্যের। তিনি নিজে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন
তা তাঁর সেই সময়ের লেখা ডায়েরীর পাতাতে পাওয়া যায়:
"[ডেভিড] সে পৌরবীর,
সে একটি সতর্কবাণী-- 'এ রাজ্যকে ন্যায়ানুগভাবে চালনা করতে হবে,
নির্ভয়ে রক্ষা করতে হবে, তা সে যেই রাজ্যচালনার ভার নাও না কেন!'
সজাগ দৃষ্টি, বৃষস্কন্ধ, প্রাণহারীর হাত, শরীর অফুরান শক্তির
উৎস-- অন্যথা হলে সে আঘাত হেনে শাস্তি দিতে উদ্যত।"
মাইকেলেঞ্জেলোর কালে ইউরোপে,
বিশেষ করে লোরেঞ্জোর ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর মাধ্যমে এক পুরানো
গ্রীক দর্শনের নবজাগরণ ঘটছিল, তার নাম নিওপ্লেটোনিজম। মাইকেলেঞ্জেলো
ছিলেন সেই মতের এক সার্থক সাধক, বিশেষত তাঁর যৌবনে। এই দর্শনে
সৌন্দর্যের মূল্য ছিল অবিসম্বাদী; "সত্যই সুন্দর, সুন্দরই
সত্য" মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন এই দার্শনিকরা এবং সুন্দর
মানব যে সুন্দরতম সেই ঈশ্বরেরই প্রকাশ, এই তত্ত্ব তাঁরা প্রচার
করতেন। এদিকে সেসময়ের খ্রিস্টধর্মের পরিপ্রেক্ষিতটাও দেখা যাক।
প্রায় হাজার বছরের ধর্মান্ধতা আর কুআচারের ক্লেদ জমে মধ্যযুগীয়
খ্রিস্টধর্মে তখন মানবের স্থান অতি নীচে। সে পৃথিবীতে দুটিমাত্র
ভাগ-- একভাগে সন্তেরা বাস করেন, সেখানে আনন্দ, সৌন্দর্য, শান্তি।
আরেক ভাগে সাধারণ মানুষ, আদিম পাপভারে (অরিজিন্যাল সিন) জর্জরিত,
অক্ষম, অজ্ঞান। তারা ঈশ্বর ও তাঁর সন্তান (এবং অবশ্যই তস্য তস্যের
দল, নচেৎ গির্জার ভাণ্ডার আর ধর্মযাজকদের খাঁই পুরবে কী করে)
কাছে সদা অবনত, সদা ক্ষমাপ্রার্থী-- তারা কদাকার, বিকলাঙ্গ পশুমাত্র।
এই শতাব্দীর পর শতাব্দী জমে ওঠা কুচিন্তার মূলে আঘাত হানলো নবজাগরণ,
রেনেসাঁ। তারা বললে, না না, মানুষ সুন্দর, সে বুদ্ধিমান, সে
বিশ্বরহস্য অনুধাবন করতে পারে, সে বিজ্ঞ, সে স্রষ্টা, সে সুকর্ম
দিয়ে মোক্ষলাভ করতে পারে, সে অনুকম্পার ভিখারী নয়। এর সঙ্গে
মাইকেলেঞ্জেলো যোগ করে দিলেন তাঁর নিওপ্লেটোনিস্ট বিশ্বাস--
তিনি তাঁর মানুষ ডেভিডকে করলেন মানুষী মানদণ্ডেই অসামান্য সুন্দর,
আর সেই সুন্দরই হোলো সত্য। ধর্মের গোঁড়ামি আর অবিচারে প্রস্তরীভূত
মনুষ্যত্বকে যেভাবে আনন্দময় জয়ধ্বনি দিয়ে মুক্তি দিলেন মাইকেলেঞ্জেলো,
তা আমার মনে হয় অনন্য, এবং শুধু এই কারণেই তাঁর কৃতি চিরজীবী
হতে পারে।
ডেভিড-গোলায়াথের
যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ঠিক কোন মুহূর্তটি শিল্পী ধরে রাখলেন
তাঁর ভাস্কর্যে-- এ নিয়ে আলোচনার অবকাশ আছে। ডেভিডের সর্বশরীরে
প্রবল উত্তেজনা প্রকাশিত-- সেই সাক্ষ্য ধরলে পাল্লাটা ঝুঁকছে
"যুদ্ধের অব্যবহিত আগে"-র দিকে। যুদ্ধে নামবেন এ সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয়ে গেছে, এখন আরব্ধ কাজের শুরু-- এই দুই ঘটনার মধ্যের
মুহূর্তটির ছবি। ভ্রূ সঙ্কুচিত, দুই চোখ যুদ্ধক্ষেত্রে গোলায়াথ
কোথায় তার সন্ধান করছে-- এ মূর্তি জয়ীর আনন্দোচ্ছল মূর্তি নয়,
এ এক চিন্তাশীল, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ কর্মবীরের প্রস্তর আলেখ্য। এ মানুষকে
ভালো না বেসেই পারা যায় না, সে সেদিনের মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতা
আর কুসংস্কারের রাত্রি প্রভাতেই হোক আর আজকের হানাহানির যুগেই
হোক, যখন মানুষের মনুষ্যত্ব নিয়ে চিন্তিত হবার পর্যাপ্ত কারণ
দেখা যাচ্ছে।
ইন্টারনেটে জনৈক প্রফেসর
হাস্টন
এক চমৎকার তথ্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বলছেন
যে ১৮৭৩ সাল থেকে, যখন ডেভিড-ভাস্কর্যটি বাইরের পিয়াৎজা থেকে
ভিতরে অ্যাকাডেমিয়ায় বর্তমান পরিবেশে আনা হয়, সবাই ডেভিডকে কেবল
এক পাশ থেকেই দেখে আসছেন, কেননা সামনের দৃষ্টিপথটি এক বিশাল
স্তম্ভের দ্বারা রুদ্ধ। পুরো মূর্তিটিকে যদি ঘড়ির কাঁটার দিকে
আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেওয়া যেত তাহলে ঠিক হোতো। সম্প্রতি স্ট্যানফোর্ড
বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে অন্যান্য ভাস্কর্যের সঙ্গে এই ভাস্কর্যটিরও
ত্রিরৈখিক ছবি কম্প্যুটারে দেখা যায়। উৎসাহী পাঠক
এইখানে ক্লিক করে দেখতে পারেন। তার সাহায্য নিয়ে ডেভিডকে
সামনে থেকে দেখলে (অর্থাৎ দানব গোলায়াথ যা দেখতে পেতো; ভার্চুয়াল
ভিউ) একেবারেই অন্যরকম দেখায়। এখানে দেখি ডেভিড উত্তেজিত, কিন্তু
উত্তেজনা সংহত করে সে আপাত প্রশান্ত মূর্তিতে গোলায়াথের প্রতীক্ষা
করছে-- মুখের ভাবে খানিকটা অবজ্ঞা, খানিকটা প্রত্যয় আর খানিকটা
শঙ্কা। অ্যাকাদেমিয়ার কর্তৃপক্ষ কেন এই ভাবে মূর্তিটি দেখাবার
সিদ্ধান্ত নিলেন তার নান্দনিক আর রাজনৈতিক কারণ নিয়ে হাস্টন
কিছু বলেছেন তবে তা আমাদের লেখার পক্ষে একটু গুরুভার হয়ে যাবে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ থেকে আর একটি তথ্য আবিষ্কৃত
হয়-- সেটি হোলো যে ডেভিড তির্যক্চক্ষু, ট্যারা, চিকিৎসকদের ভাষায়
এক্সোট্রপিক। ব্যাপারটি বুঝতে এতদিন লাগলো তার কারণ এই যে বিশাল
মূর্তির নীচে দাঁড়িয়ে দেখলে এর হদিশ পাওয়ার কোনো উপায় নেই--
এটিকে সামনে থেকে গিয়ে সরাসরি চোখাচোখি দেখতে হবে। বিশেষজ্ঞদের
মতে এটি মাইকেলেঞ্জেলোর শৈল্পিক কৌশল। মাটিতে দাঁড়ানো দর্শক
যদি মূর্তির বাঁ দিক থেকে
আসেন তাহলে দেখবেন যে তার বাঁ চোখটি চেয়ে আছে দর্শকের দিকে বা
তার মাথার ওপর দিয়ে গোলায়াথের দিকে; গুলতি ছুঁড়তে গেলে যেমনটি
হওয়া উচিত। গুলতির ঝুলিটি কিন্তু এমনভাবে রাখা আছে যে ডান চোখটি
দেখা যাচ্ছে না। আবার দর্শক যদি ডানদিকে থেকে মূর্তির কাছে আসেন
তাহলে নাকের আড়ালে বাঁ চোখটি দেখা যাবে না, কিন্তু ডান চোখটির
দৃষ্টি সুদূরপ্রসারী-- শক্তি, বুদ্ধি ও তীক্ষ্ণতার সমন্বয়, আরব্ধ
ভাবমূর্তিটির যা হওয়া প্রয়োজন। আর সরাসরি দেখলে এই তির্যকতা
বোঝা যাবে না। মাইকেলেঞ্জেলো এক ঢিলে তিন পাখি মেরেছেন; সেইজন্যই
তিনি মাইকেলেঞ্জেলো। ইন্টারনেটে
এইখানে এবিষয়ে বিশদ বিবরণ দেখা যেতে পারে। তবে একেবারে গোড়ায়
যখন মূর্তিটি পিয়াৎজায় সর্বসাধারণের দৃষ্টিগোচর করে রাখা হয়
তখনকার দুয়েকটি মন্তব্য থেকে জানা যায় যে তাঁরা মূর্তিটির পার্শ্বচিত্রে
"ভয়ানক" রসের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন (ইতালীয়তে তের্রিবিলিতা)
কিন্তু সামনের দৃশ্যে নয়। মূর্তিটির মধ্যে রক্ষাকবচের শক্তি
আছে বলে ভেবেছিলেন কেউ কেউ।
উত্তেজিত পেশীরাশির সঙ্গে
শ্লথ পেশীগুচ্ছের সমন্বয় ঘটিয়ে বিচার করলে এও বলা যায় যে দৃশ্যটির
কাল গোলায়াথ বধের অব্যবহিত পরে। মানুষের মধ্যে যা শুভ, যা শিব,
তার জয় হয়েছে, দানব পরাস্ত। মানুষ তার আত্মশক্তির ওপর বিশ্বাস
ফিরে পেয়েছে, সে এখন চেয়ে আছে ভবিষ্যতের অসীম, অনাবিল প্রতিশ্রুতির
দিকে। "নূতন ঊষার সূর্যের পানে চাহিল নির্নিমিখ"।
অ্যাকাডেমিয়ার বিশাল হলঘরে পাঁচটি অসমাপ্ত ভাস্কর্যের পরে ডেভিডের
মূর্তি রাখা আছে বলেছি। তারা সবাই যেন প্রস্তরের বন্ধন ছিন্ন
করে মুক্তি পাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে
দেখলে মনে হয় এ হোলো মানবসভ্যতারই ইতিহাস-- পাশবিক জড়ত্ব থেকে
মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস। এবং সেই মর্মস্পর্শী ঐকান্তিকতার ফলে
এসেছে মনুষ্যত্বের মুক্তি ডেভিডের রূপে-- আত্মবিশ্বাসে অবিচল,
পুরাতনকে বিদায় দিয়ে সম্ভাবনাশীল ভবিষ্যতের মোকাবেলায় প্রস্তুত।
প্রসঙ্গত ম্যাথুর মূর্তিটির হাতে পুঁথি আছে, সে কী অজ্ঞানের
প্রস্তর ভাঙার জ্ঞান শলাকা? সমস্ত ব্যাপারটা এইভাবে ভেবে নিতে
পেরে আমার খুব ভালো লাগলো। এ কথা অবশ্যই মাইকেলেঞ্জেলো ভাবেননি,
তিনি অসমাপ্ত মূর্তিগুলির কাজ শুরু করেছিলেন অনেক পরে। অ্যাকাডেমিয়ার
কর্তাদের মনে কি এই অভিসন্ধি ছিলো?
ডেভিড-ভাস্কর্যের বহু অনুকরণ
বহু জায়গায় প্রদর্শিত হয়। গির্জা, ছাত্রাবাস... ইত্যাদিতে এমন
প্রামাণ্য (!) নগ্নমূর্তির প্রদর্শন সঙ্গত কিনা এ নিয়ে তকরার
সেই গোড়ার দিন থেকে চলেছে, চলবে। শুচিবায়ুগ্রস্তদের জন্য ইন্টারনেটে
এক কোম্পানী মূর্তির সঙ্গে ডুমুর পাতার (ফিগ লিফ) আচ্ছাদকও বিক্রী
করে, অবশ্যই অর্থমূল্যে। মহারানী ভিক্টোরিয়ার হৃদ্স্পন্দন অব্যাহত
রাখার জন্য ডেভিডকে (এই নকলটি মহারানীকে ইতালীর রাজনৈতিক উপহার)
একটি ডুমুর-কৌপীন পরতে হয় এবং অত্যন্ত অশ্লীল আর্ট বলে নিন্দামন্দও
শুনতে হয়। সৌভাগ্যের কথা যে আজকের পৃথিবীতে সবাই অন্তত ডেভিডের
নগ্নতা মোটামুটি মেনে নিয়েছেন এবং অন্যত্র মনঃসংযোগ করেছেন।
ডেভিড-ভাস্কর্য
নিয়ে অনেক গবেষণার কথা ইন্টারনেটে পড়ছি। একটি হোলো গুলতির গঠন
ও প্রয়োগ নিয়ে। গড়নটি যে প্রচলিত গুলতির থেকে আলাদা, সে নিয়ে
সন্দেহ নেই। ডান হাতে ধরা T-আকৃতির হাতল আর কুঁচনো কাপড়ের বদলে
চওড়া ফিতের ব্যবহার দেখে অনেকে সন্দেহ করেছেন যে গুলতিটি খুব
একটা কাজের নয় এবং যে ভাবে মাইকেলেঞ্জেলো তার হাতে গুলতি ধরিয়েছেন
সেভাবে জোরে পাথর ছোঁড়া অতি কঠিন। তারপর, পাথর রাখার থলি কোথায়
গেল? শেষের দুটি প্রশ্ন ভাবলে মূর্তিটি গোলায়াথ-বধের পরের দৃশ্য
বলে মনে হয়। আরেকটি প্রশ্ন: ডেভিড ইহুদী তরুণ কিন্তু সুন্নত
হয়নি-- কেন? এ প্রশ্নের বহু উত্তর, যেটি সবচেয়ে সত্যের কাছাকাছি
মনে হয় সেটি হোলো এই যে রেনেসাঁর শিল্পীদের মধ্যে এভাবেই নগ্ন
পুরুষ আঁকার চল ছিলো, উদাহরণ শিশু যীশুর প্রায় সব ছবি বা মূর্তি।
যে প্রশ্নটির অমনিতরো বহু উত্তর পাওয়া যায়, কিন্তু সঠিক উত্তরটি
বৈজ্ঞানিক উপায়ে নির্ণীত, সেটি হোলো ডেভিডের জননেন্দ্রিয়ের আপাত
ক্ষুদ্রতা। ইতালীর দুজন চিকিৎসক দেখিয়েছেন যে প্রবল উত্তেজনা
জননেন্দ্রিয়ের সঙ্কোচন ঘটায়; মাইকেলেঞ্জেলো
তা জানতেন এবং সেই তথ্যটি ব্যবহার করেছেন।
মাইকেলেঞ্জেলো আরো কয়েক
শত মূর্তি গড়েছেন বা অর্ধসমাপ্ত রেখে গেছেন। ডেভিডের আগে খোদিত
"পিয়েটা"-- যীশুর মৃতদেহ কোলে মেরীমাতার মূর্তি--
আর এক আশ্চর্যজনক সৃষ্টি। রাখা আছে ভ্যাটিকান সিটির সেণ্ট পিটার্স
গির্জায়, কিছুদিন আগে এক উন্মাদের আক্রমণে ক্ষতিগ্রস্ত হবার
পর দর্শকদের থেকে দূরে কাঁচের বাক্সে সুরক্ষিত করে। ডেভিড-কে
যেমন কাছে গিয়ে দেখা যায় (যদিও আজকাল দর্শকদের তল্লাসীর ভিতর
দিয়ে যেতে হয়), তেমনটি নয়। ১৯৬৪ সালে নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ডস্ ফেয়ারে
দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল কাছ থেকে, সহজ কিন্তু অতি মনোগ্রাহী পশ্চাৎপটে।
এবার গির্জায় শ্বাসরোধকারী ভীড়ে, দূরে কাঁচের আড়ালে মূর্তি অতি
নিষ্প্রভ দেখালো।
ডেভিড দেখার অভিজ্ঞতা সঙ্গে
করে ওপারে নিয়ে যাবার মতো।
সুমিত
রায়
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)