ইতিহাসের
কথা:
সিসেরো (Cicero) - (সংক্ষিপ্ত জীবনী)
(প্রবন্ধের
সব সন-তারিখ খৃষ্টের জন্মের পূর্বে –পাঠকের সুবিধার্থে তারিখের
আগে খৃঃ পুঃ লেখা হয় নি)
Marcus Tullius Cicero
রোমের প্রজাতন্ত্রের শেষ অঙ্কের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। একাধারে
রাজনীতিবিদ, প্রসিদ্ধ আইনজীবী, অসাধারণ বাগ্মী, সুলেখক, কবি
ও দার্শনিক। প্রাচীন ল্যাটিন গদ্য সাহিত্যে এর অবদান এক স্বর্ণযুগের
সূচনা করে। গ্রীসের যেমন Demosthenes, প্রাচীন রোমে সিসেরো সেই
একই গোত্রের। রোমের ইতিহাসে এর বাগ্মিতা অবিস্মরণীয়। এর রচিত
দর্শনের প্রবন্ধ, কিছু বক্তৃতা, কিছু চাঞ্চল্যকর মামলার সওয়াল
এতকাল পরেও বিদ্যমান আছে। সাহিত্যিক মূল্য ছারাও সেযুগের রোমের
ইতিহাস জানতে, এই রচনাগুলোর অবদান অতুলনীয়। যদিও বাগ্মী এবং
আইনজীবী হিসেবে, সিসেরোর খ্যাতি, নিজেকে কিন্তু তিনি একজন বিশিষ্ট
রাজনৈতিক নেতা মনে করতেন এবং তার জন্য যথেষ্ট গর্বিতও ছিলেন।
রোমের পত্তন ৭৫৩ সালে।
শুরু হয়েছিল রাজতন্ত্র দিয়ে। ৫০৯ সাল থেকে প্রজাতন্ত্রের আরম্ভ।
চলে ২৭ সাল পর্যন্ত, তারপর আবার সম্রাট। সিসেরো এই প্রজাতন্ত্র
দিনের শেষ অধ্যায়ের এক খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব। প্রথম শতাব্দীর
অরাজকতা ও গৃহযুদ্ধের মধ্যে ও পরে জুলিয়াস সিজারেরের স্বৈরাচারের
সময়ে প্রজাতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখতে এর প্রচেষ্টা অতুলনীয়। দেশের
এক চরম সংকটকালে, প্রজাতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখতে আর জন-বিদ্রোহ শান্ত
করে দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনায় সিসেরোর ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
এর জন্য তাকে সে সময় দেশ-জনক (pater patriae) আখ্যা দেওয়া হয়।
Marcus Tullius Cicero’র
জন্ম ১০৬ সালে ইটালির আরপিনাম শহরে। আরপিনাম, রোম থেকে আনুমানিক
১০০ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ পূর্বে – পাহাড়ি অঞ্চলে। এই সুত্রে
রোমান নামকরণ নিয়ে একটু বলা উচিত। আমাদের কুলীন ব্রাহ্মনদের
গোত্র, মেল ইত্যাদির সঙ্গে রোমান নাম অনেকটা মেলে। নামের প্রথম
– Prenomen, যে নামে পরিবারে সকলের কাছে পরিচিত। এরপর Nomen
– বংশের নাম, শেষে Cognomen – বংশ শাখার নাম। এই হিসেবে, Tullius
বংশের Cicero শাখায় Marcus এর জন্ম। ল্যাটিনে Cicer (সিসের)
মানে ছোলা। সিসেরোর কোনও পূর্ব পুরুষ হয়তো ছোলার চাষি বা ব্যবসায়ী
ছিলেন, আর সেই থেকেই পরবর্তী বংশধরেরা সিসেরো নামে পরিচিত।
মূল গল্পের আগে রোমের তৎকালীন রাজনৈতিক কাঠামো সম্বন্ধে একটু
বলা দরকার। রোম প্রজাতন্ত্রের শাসনভার ছিল এক সেনেটের (Senate)
ওপর। সেনেটের সভ্য সংখ্যা ৬০০। সেনেটের সদস্য কিন্তু জনসাধারণের
নির্বাচন দ্বারা হতো না। সদস্যের অন্তর্ভুক্তি ঠিক হতো এক Censor
দ্বারা অথবা এক সেনেটের সাধারণ অধিবেশনে। কোনও সরকারী বেতন ছিল
না সদস্যদের, আবার তারা কোনও ব্যবসায়েও যুক্ত থাকতে পারত না।
তাই সদস্য হতে গেলে প্রাথমিক সর্ত হোল, ব্যক্তিগত ধনের পরিমাণ।
বিভিন্ন সময়ে এই স্থাবর এবং অস্থাবর ধনের নিম্নতম সীমা বাধা
থাকতো। এ ছাড়া আর একটা বড় যোগ্যতার পরিমাপ ছিল বংশপরিচয়। Patrician
(রোমের আদিবাসী, সম্ভ্রান্ত শ্রেণী) হতে হবে। যদিও পরে এই নিয়ম
শিথিল কোরে, ইটালির অন্যান্য অঞ্চলের ধনী ব্যবসায়ীদের মধ্যে
থেকেও কিছু সেনেটর নিযুক্ত হয়। সদস্যদের স্থায়িত্ব আমরণ। একবার
সদস্য হলে, কোনও গুরুতর অপরাধে না অভিযুক্ত হোলে, সদস্যপদ থেকে
বিচ্যুত হয় না।
সেনেটের প্রধান দুজন Consul।
সব অধিবেশন পরিচালনার দায়িত্ব এদের। কার্যকালের সময়সীমা এক বছর।
ভোটের মাধ্যমে সেনেটরদের মধ্য থেকে এদের নির্বাচন হতো। দেশের
দৈনন্দিন শাসন, বৈদেশিক নীতি ও যুদ্ধ ঘোষণার দায়িত্ব এদের ওপর।
এদের ওপরে Censor।Censor এর দেশ পরিচালনার কোনও দায়িত্ব ছিল
না। এদের মূল কাজ সেনেটর ও Consul দের ওপর নজর রাখা, আর জন সংখ্যা
গণনা পরিচালনা করা। এদের কর্মকাল ৫ বছর। Consulএর নীচে Praetor,
Questor আর Aedile। এদের সাহায্যেই Consul রাজ্য পরিচালনা করতো।
বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণে অথবা, দেশের আভ্যন্তরীণ গোলযোগের সময়,
সেনেট জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে, Consul কে সর্বময় কর্তা বা Dictator
করতো। কিন্তু আইন অনুযায়ী ৬ মাসের বেশী Dictator ক্ষমতায় থাকতে
পারে না, যদিও কিছু কিছু সময়ে এই ক্ষমতার অপব্যবহারের নিদর্শন
দেখা যায় – যেমন পম্পেইর সাথে গৃহযুদ্ধের পর সিজারের নিজেকে
আমরণ Dictator ঘোষণা করা, Mariusএর আর Sulla’র দলের রোমে দাঙ্গা
আর গণহত্যার পর, Sulla’র ১০ বছরের জন্য Dictator হওয়া।
সেনেটের কিন্তু আইন জারি
করার ক্ষমতা ছিল না। সেনেটে আইনের প্রস্তাব আনা হত এবং বিতর্কের
পর, সেই প্রস্তাবের বিল জনসাধারণের অনুমোদনের জন্য Plaebian
Councilএ পেশ করা হত। Plaebian Council জনসাধারণের আইনসভা। সমস্ত
গোষ্ঠীগুলোই এই সভার সদস্য। সব অধিবেশনেই সকল গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের
হাজির থাকতে হত। কোনও Patrician’র Plaebian Councilএ বক্তৃতা
দেওয়া বা অংশগ্রহণ করার অধিকার ছিল না।
Plaebian Councilএর প্রধান ১০ জন Tribune। যদিও এই ১০ জন সকলেই
একই ক্ষমতার অধিকারী, শাসনের সুবিধার জন্য এদের মধ্যে কাজের
ভাগ ছিল। এদের প্রত্যেকেরই veto দেওয়ার ক্ষমতা ছিল – প্রত্যেকেই
সভার অধিবেশন ডাকতে পারতো। পদাধিকারের বলে এই Tribune রা সকলেই
সেনেটের সদস্য।
আইন প্রণয়ন ছাড়াও, Plaebian
Councilএর বিচারের অধিকার ছিল। এই জন আদালতের নিয়ম একটু আলাদা।
বাদী এবং প্রতিবাদী দুদলের উকিল সভায় বক্তৃতার পর, ভোটের মাধ্যমে
দোষী কি নির্দোষী নিরূপিত হতো।
রোমে আদালত একটিই। একজন
Praetorএর হাতে আদালতের ভার থাকতো। তিনিই বিচারপতির ভূমিকা নিতেন।
সব মামলাতেই জুরি থাকতো। জুরির সংখ্যা মামলার গুরুত্ব অনুযায়ী
ঠিক করা হত। কোনও কোনও মামলায় জুরির সংখ্যা ২০০ জনও হতে পারত।
সাধারণত সেনেটর ও ধনী ব্যবসায়ীরাই জুরি হতো। আদালতের অধিবেশন
রোমান ফোরামের খোলা জায়গায় হতো। বিচারের রায় ঠিক হতো জুরিদের
ভোটে। দুপক্ষের সওয়াল ও সাক্ষী সাবুদ পেশ করার পর জুরিদের ভোট
নেওয়া হত –ভোটের ফল অনুযায়ী দোষী কি নির্দোষী সাব্যস্ত হতো।
জুরিদের ভোট পাওয়ার জন্য ঘুষের ব্যাপক প্রচলন ছিল। মামলায় দোষীর
বেকসুর খালাসের অনেক নজির পাওয়া যায়। বিচারপতির মুল ভূমিকা ছিল
আদালতের অধিবেশন পরিচালনা করা, আর জুরিদের রায় অনুযায়ী দোষীর
শাস্তি নির্ধারণ।
অনেকটা আমেরিকার সেনেটের
মতো, রোমের সেনেটেও দুটি রাজনৈতিক দল। রক্ষণশীল দল – Optimates
আর উদারপন্থী - Popularis। রক্ষণশীল দলই বেশীরভাগ সময়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ
আর তাদের সাথেই উদারপন্থীদের ক্ষমতার লড়াই। এই লড়াই বিভিন্ন
যুগে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের আকার নেয় আর শেষে প্রজাতন্ত্রের ইতি
ঘটায়। Popularis দের একটা বড় বল, Plaebian Council - প্রায় সবকালেই
এদের সমর্থক। এদের জোরেই, Grachii , Gaius Marius, Julius Caesar
– ভিন্ন ভিন্ন কালে রক্ষণশীলদের অনাচারের বিরুদ্ধতায় সক্ষম হন
।
এবার মূল কাহিনীতে আসা
যাক।
সিসেরোর ছাত্রাবস্থায় মেধাবী
ছাত্র হিসেবে খ্যাতি ছিল। ল্যাটিন এবং গ্রীক – দুই ভাষাতেই যথেষ্ট
ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। তখনকার যুগে রোমান সমাজে গ্রীক ভাষা
না জানলে শিক্ষিত বলে গণ্য করা হত না। ছাত্রাবস্থায় ইনি বেশ
কিছু বছর এথেন্সে কাটান। সেখানে গ্রীক কাব্য, নাটক ও দর্শন অনুশীলন
করেন। গ্রীসে থাকাকালীন বেশ কিছু গ্রীক দার্শনিকদের রচনা ল্যাটিনে
অনুবাদ করেন। এই গ্রীসেই তার বাগ্মিতার পাঠগ্রহণ।
রোমে প্রত্যাবর্তনের পর,
আইন শিক্ষার জন্য, খ্যাতনামা আইনজীবী Quintas Mucius Scaevola’র
অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে প্রায় ৫ বছর থাকেন। এই সময় বেশ কিছু
সহকর্মীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়, যারা আজীবন ঘনিষ্ঠ থাকেন। এই বন্ধুদের
মধ্যে সবচেয়ে নাম করা Titus Pomponius, যে পরে Atticus নামে
পরিচিত। এই Atticus কে লেখা চিঠিগুলো পুরনো ল্যাটিন সাহিত্যের
এক অমূল্য সম্পদ। নানা বিষয়ে এই চিঠি – দৈনন্দিন জীবন, রোমের
রাজনীতি, নিজের মামলার বিবরণ, জীবন দর্শন, রোমের অর্থনীতি, স্বরচিত
কবিতা ইত্যাদি।
সিসেরোর কর্মজীবনের শুরু
আইনজীবী হিসেবে। যদিও রাজনীতি করার ইচ্ছা প্রবল, কিন্তু সামরিক
বাহিনীতে যোগ দেওয়ায় প্রবল অনীহা। নিজেকে রোমের যুব সমাজের রক্ষণশীল
দলের অন্যতম প্রধান চিন্তাশীল বলে মনে করতেন। আনুমানিক ৮১ সালে
এক বিখ্যাত মামলায়,আইন জীবিকায় প্রথম নাম করেন। Sextus Roscius
নামে এক ব্যক্তিকে পিতৃহত্যার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু
মামলা অবধি অপেক্ষা না করে, তার পিতার জমি ও বসত বাড়ি সরকার
দখল নিয়ে নিলামে বিক্রি করে। সিসেরো আসামী পক্ষের উকিল নিযুক্ত
হন। আসামীকে বেকসুর খালাস করিয়ে, আসল খুনিদের নাম আদালতে প্রকাশ
করেন। Cornelius Sulla তখন রোমের Dictator। তার ঘনিষ্ঠ মহলের
Chrysogonous নামে একজন এই মিথ্যা মামলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।
সিসেরো প্রকাশ্য আদালতে এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন। Chrysogonousএর
আসল উদ্দেশ্য অভিযুক্ত ব্যক্তির পিতার জমি গ্রাস করা। সিসেরো
এই মামলার মধ্য দিয়ে প্রতিপন্ন করেন যে, Sulla’র ঘনিষ্ঠ লোকেরা
তার Dictatorshipএর সুযোগ নিয়ে দেশে যথেচ্ছার চালাচ্ছে। এই মামলায়
তিনি যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দেন। এতে Sulla’র কোপ দৃষ্টিতে পরেন।
ফলে নিজেকে বাচাতে কয়েক বছরের জন্য দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
৭৯ সালে সিসেরোকে গ্রীস,
এশিয়া মাইনর আর Rhode Islandএ ভ্রমণে দেখা যায়। গ্রীসে Atticusএর
সৌজন্যে অনেক দার্শনিকদের সান্নিধ্যে আসেন। এথেন্সে কয়েকমাস
Apollonius Molonএর কাছে বাগ্মিতারও পাঠ নেন।
দেশে প্রত্যাবর্তনের পর,
তার সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দান। Cornelius Sulla ছিলেন একজন Patrician।
তার নেতৃত্বে যে গৃহযুদ্ধ হয়, তার পরিণাম সাধারণের ব্যক্তি স্বাধীনতা
অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ ও অভিজাত Patrician শ্রেণীর ক্ষমতা লাভ। ফলত:
প্রজাতন্ত্রের নামে Oligarchy। সিসেরো যদিও Patrician না, Popularis
দলের সঙ্গেও তার মতের মিল ছিল না। তাই Patrician না হয়েও Optimateরা
তাকে নিজেদের লোক হিসেবে মনে করতো। ৭৫ সালের নির্বাচনে তিনি
২০ জন Questerএর একজন হন। তিনি Sicilyতে সরকারি তহবিলের পরীক্ষক
রূপে নিযুক্ত হন। তার কাজের সততা Sicily’র জনসাধারণের প্রশংসা
অর্জন করে। এরপর ধাপে ধাপে, তিনি ৬৯ সালে Aedile ও ৬৬ সালে Praetor
হন।
যদিও এসময় তিনি রাজনীতিতে
সক্রিয়, পাশাপাশি ভাবে আইন ব্যবসা চালিয়ে যান। এসময়কার তার সবচেয়ে
নামকরা মামলা, Gaius Verresএর বিরুদ্ধে। Gaius Verres Sicily’র
রাজ্যপাল ছিলেন ৪ বছর। Sicily রোমের এক বড় উপনিবেশ। সেই আমলে
প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের বিপুল ক্ষমতা, মোটামুটি ভাবে প্রদেশের
অধিবাসীদের দণ্ড মুণ্ডের অধিকর্তা। কেন্দ্রীয় তহবিলে অর্থ পাঠানো
ছাড়া, রোমের শাসন থেকে মুক্ত। Verres এর শাসনকাল Sicily’র একরকম
ব্যাপক লুণ্ঠন – মিথ্যা অভিযোগে ধনিদের সম্পত্তি গ্রাস, মন্দিরে
সঞ্চিত অর্থ ও অলঙ্কারাদি আত্মসাৎ, চাষিদের থেকে অমানুষিক কর
আদায়, ইত্যাদি। সারা Sicily অত্যাচারে হাঁপিয়ে উঠেছিলো । একমাত্র
নালিশের জায়গা রোম – কিন্তু রাজ্যপালের শাসনকালে, সেনেটের কোনও
এক্তিয়ার নেই তার বিচার করা অথবা কাজে হস্তক্ষেপ করা। এক উৎপীড়িত
ধনী ব্যবসায়ী রোমে পালিয়ে এসে সিসেরোর শরণাপন্ন হন। সিসেরো তাকে
আশ্রয় দেন এবং কিছুকাল পরে, Verres এর রোমে প্রত্যাবর্তনের পর
তার বিরুদ্ধে অনাচার, প্রজা উৎপীড়ন ও উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগ এনে
মামলা দায়ের করেন। তিনি নিজে সাক্ষী ও প্রমাণ সংগ্রহের জন্য
প্রায় তিন মাস Sicily’র বিভিন্ন অঞ্চল পরিদর্শন করেন। Verres,
ধনী ও সম্ভ্রান্ত Patrician।তাই Optimateরা তার ওপর সহানুভূতিশীল।
মামলা উঠিয়ে নেবার জন্য প্রভাবশালী নেতাদের ক্রমাগত চাপ আসে।
কিন্তু সিসেরো অনড়। মামলা সুরু হয় – সিসেরোর জ্বালাময়ী সওয়ালে
ও সাক্ষ্য প্রমাণাদিতে জুরি অভিভূত। জুরিদের উৎকোচ দিয়েও কোনও
সুরাহা হোল না। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখে Verres স্বেচ্ছায় নির্বাসনে
যান আর সরকার তার সম্পত্তি অধিগ্রহণ করে, Sicily’র উৎপীড়িতদের
মধ্যে অর্থ বিলিয়ে দেয়। এই মামলার সিসেরোর ভাষণগুলি ও বিবরণ
বিদ্যমান।
এই মামলার পর Optimate
দলের সাথে সম্পর্ক বেশ শিথিল হয়। তাই গতি নিতে হয় Pompeii এর।
তখন Pompeii এর ভাগ্যাকাশে সূর্য মধ্যগগণে। Spain, Cappadocia,
Pontus ও Syria’র যুদ্ধে জয়লাভ ও দেশসমুহকে রোম সাম্রাজ্যের
অন্তর্ভুক্ত করেন। তার অধীনে বিপুল সেনাবাহিনী। এই Pompeii এর
অনুগতদের সাহায্যেই ৬৩ সালের নির্বাচনে, সিসেরো কনসাল হন।
কনসাল থাকার বছর তার জীবনের সবচেয়ে প্রশংসাযোগ্য ঘটনা – Catilina
Conspiracy দ্বারা রোমের বিপর্যয় ঠেকানো। Lucius Sergius Catalina
সেনেটের সদস্য ও Patrician। এর পূর্বপুরুষেরা রোমের রাজা নুমার
বংশোদ্ভূত বলে দাবি করে। Catilina ও আরও কয়েকজন সেনেটর মিলে
বর্তমান কনসালকে হত্যা করে রোমের প্রজাতন্ত্রের উচ্ছেদ করার
এক গভীর ষড়যন্ত্র করে। বেশ কিছু Gladiator আর ইটালির বিভিন্ন
অঞ্চল থেকে সদ্য মুক্তি প্রাপ্ত দাসদের নিয়ে রোমের কিছুদূরে
এক সেনাবাহিনীও মোতায়েন করে। অনেকের মতে সিজার এবং Crassus এই
চক্রান্তে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত না হোলেও, এদের কাজে সায় ছিল।
সিসেরো সময়মত নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিয়ে চক্রান্তদের পরিকল্পনা
বানচাল করে দেন। চক্রান্তে যুক্ত চারজন সেনেটর গ্রেপ্তার হয়
ও সেনেটের এক অধিবেশনে এদের বিচার হয়। বিচারে মৃত্যুদণ্ড ধার্য
হয়। Catilina রোম থেকে পালিয়ে দলীয় সেনাবাহিনীতে আশ্রয় নেয়।
সেনেটের নির্দেশে দুই প্রাক্তন সেনানায়কের অধীনে দুই সেনাদলের
যুগ্ম আক্রমণে Catilina’র দল সমূলে বিনষ্ট হয় – যুদ্ধে Catilina
নিহত হয়। রোমকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের জন্য সেনেট কৃতজ্ঞতা স্বীকার
করে, সিসেরোকে দেশ জনক উপাধিতে ভূষিত করে।
এরপর ৪/৫ বছর উল্লেখযোগ্য
বিশেষে কিছু ঘটনা তার জীবনীতে দেখা যায় না। এর পরবর্তী উল্লেখযোগ্য
ঘটনা, ৬১ সালে সিসেরোর রোম থেকে নির্বাসন। ৫৮ সালে Publius Clodius
Pulcher নামে Plebianদের এক Tribune, সিসেরোর বিরুদ্ধে জনতার
আদালতে এক অনাচারের মামলা আনে। তার দাবী Catilina Conspiracyতে
অভিযুক্ত চার জন সেনেটরকে সিসেরো বিনা বিচারে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত
করেন। আদালতে এদের বিচার হয় নি – সিসেরো তার কনসাল পদের বলে
সেনেট মারফৎ যে প্রাণদণ্ড ঘটায়, তা আইন সম্মত নয়। জনতার বিচারে
সিসেরো দোষী সাব্যস্ত হয় – বিক্ষুব্ধ জনতা সিসেরোর বসতবাড়ি আগুনে
ভস্মীভূত করে। সিসেরোকে রোম থেকে নির্বাসিত করা হয়।
এর পরবর্তী দুবছর তিনি
গ্রীসে কাটান – বাল্যবন্ধু Atticus এর অর্থ সাহায্যে। Clodiusএর
ক্ষমতাচ্যুতি ও মৃত্যুর পর, সেনেট আবার সিসেরোকে দেশে ফিরে আসার
অনুমতি দেয়। দেশে ফিরে আবার তিনি রাজনিতিতে সক্রিয় হন। সেনেটকে
বাগ্মিতায় অভিভূত করে, সরকার থেকে নিজের পুরনো সম্পত্তি নাশের
জন্য ক্ষতিপূরণ পান।
৫১ সালে Cilicia’র রাজ্যপাল
নিযুক্ত হন ও দু বছর দেশের বাইরে কাটান। দেশে ফিরলেন অরাজকতার
মধ্যে। ৫০ সালেই Pompeii আর Caesar এর মধ্যে দ্বন্দ্ব জটিল হতে
শুরু করে। ৪৯ সালে যখন সিজার সৈন্যবাহিনী নিয়ে রোমের পথে ইটালির
শহরগুলো একের পর এক স্বীয় অধিকারে আনেন, সেসময় সিসেরো Pompeiiএর
দলের সাথে রোম থেকে পালান। সিজারের সঙ্গে অবশ্য তার নিজের কোনও
ব্যক্তিগত বিরোধিতা ছিল না। কেবল নীতিতে অমিল। রোম ছাড়লেন শুধুমাত্র
Pompeiiএর আনুগত্যের কারণে। ৪৮ সালে Pompeiiএর সেনার সঙ্গে Pharsalusএ
আসেন। সিজারের বাহিনীর কাছে পরাজয় তিনি যুদ্ধের আগেই উপলব্ধি
করতে পেরেছিলেন। সুহৃদদের মধ্যে অনেকে তাকে রোম ছাড়ার নির্বুদ্ধিতার
জন্য পরে তিরস্কারও করেছে। যুদ্ধে সিজারের জয় হয় আর Pompeiiএর
সমুদ্রপথে মিশরের দিকে পলায়ন করে। সিজার অবশ্য সিসেরোকে ক্ষমা
করেন। Plutarchএর বিবরণে সিজারের সিসেরোকে আলিঙ্গন করার কথা
পাওয়া যায়। সিসেরো রোমে ফিরে আসেন ও সেনেটে যোগ দেন।
সিজার রোমে Dictator থাকাকালীন,
সিসেরো সিজারের সাথে কোনও সংঘাতে যান নি। সিজারের নির্দেশ মাফিকই
কাজ চালিয়ে যেতেন। বোধহয়, আশা ছিল যে, পুরনো দিনের প্রজাতন্ত্র
আবার ফিরে আসবে। এ সময়কার সিসেরোর মামলার বিবরণে দেখতে পাওয়া
যায়, যে সব মামলায় সিজার নিজে বিচারপতির আসন গ্রহণ করেছেন, সিসেরোর
সওয়ালের আরম্ভ ও সমাপ্তি সিজার স্তুতি দিয়ে।
সিজার হত্যাকাণ্ডে ও হত্যার
ষড়যন্ত্রে সিসেরোর কোনও ভূমিকা ছিল না। কিন্তু এই কাজে তার সায়
ছিল। হত্যাকারীরা সবাই Optimate দলের। পরে সেনেটের অধিবেশনে
যখন Marcus Antonius ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমা করার প্রস্তাব আনেন,
সেসময় সিসেরোর ভাষণে সিজারের শাসনের নিন্দায় ও কাজের সমালোচনার
কটূক্তিতে ভরা। সিসেরোর এক রচনায়, ৪৫ সালে Marcus Antonius ও
Trebonius এর সিজার হত্যার এক ষড়যন্ত্রের কথা পাওয়া যায়। এর
সত্যতা যাচাই করা দুরূহ – তবে আর কোনও ঐতিহাসিকের রচনায় এর কোনও
রকম ইঙ্গিতও মেলে না।
সিজারের মৃত্যুর পর সিসেরো
আর Marcus Antonius রোমের দুই বিপক্ষদলের নেতা। Marcus Antonius
কনসাল ও সিজারের অনুগতদের নেতা। সিসেরো Antonius এর প্রতি কাজের
সমালোচক। Antonius যখন সিজার হত্যার অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রকারী
Decimus Brutus এর বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করে Gaulএর Mutina শহর
অবরোধ করেন, তখন সিসেরো Antoniusকে রোমের শত্রু বলে অভিহিত করেন।
এই প্রসঙ্গে একটু বলা দরকার যে, সিজার হত্যার প্রধান ষড়যন্ত্রকারীরা
হত্যার অব্যবহিত পরেই, বিভিন্ন অজুহাতে রোমের বাইরে চলে যায়।
সেনেটের অনুমোদন আদায় করে, অনেকেই ইটালির বাইরের প্রদেশগুলিতে
রাজ্যশাসনে নিজেদের নিযুক্ত করেন। যেমন Cassius সিরিয়ায়, Marcus
Brutus Macedoniaতে, Decimus Brutus Cisalpine Gaul প্রদেশে
ইত্যাদি।
এসময়কার সিসেরোর সেনেটের
ভাষণগুলি শুধু Antoniusএর ওপর বিষোদ্গারে ভরা। এই ভাষণগুলো Phillippics
নামে খ্যাত। এই Phillippics নামটা সিসেরোর নিজের দেওয়া – Demosthenes
এর অনুকরণে। Macedonia’র দ্বিতীয় Philip এর বিরুদ্ধের রচনা ও
বিভিন্ন ভাষণ সমূহ Demosthenes, Phillippics নাম দিয়ে সঙ্কলন
করেন।
এর পরের ঘটনা সমূহ করুন।
ফিলিপির যুদ্ধে Brutus ও Cassius এর পরাজয় এবং প্রাণ নাশের পর,
Octavian, Lepidus ও Antonius মিত্রতা । এই তিনজন একত্র ভাবে
রোম সাম্রাজ্য পরিচালনার ভার নেন – ইতিহাসের নাম Second Triumvirate।
এদের প্রথম কাজ – সিজার হত্যায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যুক্তদের
নামের তালিকা করা ও তাদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা। এই তালিকা (Proscription
List) রোমান ফোরামে সেনেটের বাইরে বিজ্ঞাপিত করা হয়। তালিকার
প্রথম নামই সিসেরোর ও ভাই Quintas এর। সিসেরো ইটালি থেকে পালানোর
চেষ্টা করেন। কিন্তু Macedonia গামী এক জাহাজে যাওয়ার পথে, ঘাতকের
হাতে প্রাণ হারান। তার ছিন্ন মুণ্ড ও দুই হাত ফোরামে প্রদর্শিত
হয় । Quintas রোমে নিজের বাড়িতেই নিহত হন।
সম্ভবত ৭৯ সালে সিসেরো
বিবাহ করেন। তার পত্নী Terentia ধনী Plebian পরিবারের কন্যা।
বিবাহের যৌতুকেই বোধহয় সিসেরোর অর্থাগম ও সেনেটে প্রবেশের অধিকার
মেলে। বিবাহের প্রথম সন্তান কন্যা – Tullia। বেশ কিছু বছর পর
পুত্র – Marcus জন্মায়। কন্যা Tullia তার খুব প্রিয়। কন্যার
সন্তান প্রসবের সময় অকালমৃত্যু তাকে নিদারুণ ভাবে আঘাত করে।
Atticusকে লেখা চিঠিতে কন্যা হারা পিতার করুন বিলাপ পাওয়া যায়।
সিসেরোর একই পুত্র - Marcus Tullius Cicero Minor। সিসের চেয়েছিলেন
যে পুত্র তার মতোই আইনজীবী হোক আর দর্শন নিয়ে চর্চা করুক। কিন্তু
পুত্রের ঝোঁক যুদ্ধবিদ্যায়। তিনি সেনাবিহিনিতে যোগ দেন ও বেশ
নাম করেন। Octavianএর আমলে Marcus Minor কনসাল হন। তিনি Octavianএর
এক সেনাধ্যক্ষ হিসেবে Actiumএর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। শেষ জীবনে
প্রথমা স্ত্রী Terentia’র সাথে সিসেরোর বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যায়,
সঠিক কারণ পাওয়া যায় না। সম্ভবতঃ ৪৫ কি ৪৬ সালে, তিনি আবার বিবাহ
করেন, বয়েসে অনেক ছোট, Publia নামে এক মহিলাকে।
সিসেরোর রাজনীতি ও দর্শনের ওপর লেখা বই, প্রায় স খানেকের মতো
বক্তৃতার সঙ্কলন ও হাজার খানেকের মতো চিঠি পাওয়া গেছে। বেশির
ভাগই ল্যাটিনে, তবে বইয়ের বেশ কিছু গ্রীক ভাষায়। রোমে Vandal
ও Gothদের ধ্বংসলীলা এড়িয়ে এবং ইউরোপের অন্ধকারময় মধ্যযুগ পার
হয়ে, কি করে যে এই রচনা গুলো আজও পাওয়া যায়, তা সত্যিই বিস্ময়কর।
রেনেসাঁসের যুগে ইটালিতে সিসেরোর চর্চা শুরু হয়। পেত্রার্ক সিসেরোর
পত্রাবলী অনুসন্ধান করে বার করেন – আর অনুলিপি করিয়ে দেশের বিভিন্ন
Catholic Monasteryতে রাখেন। Erasmus, Martin Luther, John Locke
সিসেরোর দার্শনিক রচনার দ্বারা অনেকাংশে প্রভাবিত।
সিসেরোর মৃত্যুর প্রায়
৪০ বছর বাদের এক ঘটনা। Octavian তখন Augustus – রোমের সম্রাট।
একদিন তার এক নাতিকে সিসেরোর এক বই পড়তে দেখেন। নাতি ভয়ে বই
লুকোনোর চেষ্টা করলেও সম্রাটের নজর এড়াতে পারে না। বইটি হাতে
নিয়ে Augustus কিছুটা পড়েই নাতি কে ফেরৎ দিয়ে বলেন “ ইনি আমাদের
যুগের একজন যথার্থ জ্ঞানী আর সত্যিকারের দেশপ্রেমী।“ সিসেরো
একজন আদর্শবাদী – সত্যিকারের প্রজাতন্ত্র রোমে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিলেন,
জীবন হারালেন শুধু পথ ভুলের জন্য।
শেখর
বন্দ্যোপাধ্যায়
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)