প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

ইতিহাসের কথা: রানী-কাহিনী

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে রাজাদেরই রমরমা। ইতিহাসের পাতায়, পাহাড়ের গায়ে ও কবির কাব্যে পরম ভট্টারক শ্রীমন্মহারাজদের বীরগাথা অথবা কদাচিৎ পরাজয়সংবাদ। এতসবের মাঝে রাজমহিষীদের খুব একটা দেখা মেলে না। কিন্তু তারা সবাই যে অন্তরালবর্তিনী হয়ে থাকতেন তা নয়। তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন পতিব্রতা, বীরাঙ্গনা, কেউ ষড়যন্ত্রকারী বা কেউ ব্যভিচারী। প্রাচীন ভারতের আপাত-উপেক্ষিতা কয়েকজন রাজমহিষীর কথা ইতিহাসের ধূসর পাতা থেকে এখানে তুলে ধরলাম।

আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে, সেই ষোড়শ মহাজনপদের যুগে, মগধের রাজা বিম্বিসারের চার রানীর খোঁজ পাওয়া যায়। তারা ছিলেন কোশলরাজ প্রসেনজিতের (পালি – পসেনদি) বোন কোশলদেবী, লিচ্ছবী দুহিতা চেল্লনা, বৈদেহী বাসবী ও মদ্ররাজকন্যা ক্ষেমা। এদের মধ্যে ক্ষেমা পরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে প্রব্রজ্যা নেন। বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রু বৃদ্ধ পিতাকে কারাগারে বন্দী করে যখন নিজে রাজা হন, তখন বন্দী বিম্বিসারকে সেবা করতেন রানী চেল্লনা (মতান্তরে কোশলদেবী)। গল্পে আছে যে তিনি বন্দী রাজার জন্য নিজে খাবার নিয়ে যেতেন চুলের ভেতর লুকিয়ে। তারপর একদিন অজাতশত্রু দেবদত্তের (ভগবান বুদ্ধের ভাই) প্ররোচনায় বিম্বিসারকে হত্যা করলেন। নিজের সন্তান চোখের সামনে স্বামীকে হত্যা করছে, এই দৃশ্য এক পতিব্রতা নারী সইতে পারেন নি। স্বামী-বিয়োগের শোক সহ্য করতে না পেরে চেল্লনাও প্রাণত্যাগ করেন। ইতিহাসের পাতায় চেল্লনা আজ উপেক্ষিতা, এক রানী মাত্র। অজাতশত্রু পরে অনুতপ্ত হয়ে বুদ্ধের শরণ নিয়েছিলেন বটে কিন্তু তিনি কি জানতেন এইভাবেই সন্তানের হাতে তার নিজেরও মৃত্যু হবে ও তার উত্তরপুরুষেরা সকলেই তার মত পিতৃহন্তা হবে?

অজাতশত্রুর তার এক রানী ছিলেন তার আপন মামাতো বোন, প্রসেনজিতের মেয়ে বজ্জিরা। ঘটনাটা এরকম – বোনের সাথে বিম্বিসারের বিয়েতে কোশলরাজ প্রসেনজিত কাশীগ্রাম নামে একটি ভূখণ্ড বিম্বিসারকে যৌতুক হিসেবে দেন। অজাতশত্রু পিতাকে হত্যা করার পর প্রসেনজিত সেটা ফেরত চান ও সেই নিয়ে তার সাথে এক লম্বা যুদ্ধ চলে অজাতশত্রুর। শেষে সন্ধির শর্ত হিসেবে অজাতশত্রু প্রসেনজিতের মেয়ে বজ্জিরাকে বিয়ে করেন ও বিয়ের যৌতুক হিসেবে সেই ভূখণ্ড রেখে দেন।

রাজারা যে সর্বদা রাজকুলে বিয়ে করতেন তা নয়। প্রসেনজিতের এক রানী ছিলেন মল্লিকা নামের এক ষোড়শী, শ্রাবস্তীর মুখ্য মালাকারের কন্যা। তিনি কোশলরাজের প্রিয় রাণী ছিলেন ও অল্পবয়সেই মারা যান। রানী মল্লিকা পরিব্রাজকদের জন্য এক বিশাল বিশ্রামাগার (মতান্তরে Hall of Public Debate) তৈরি করিয়েছিলেন, যা মল্লিকা বিশ্রামাগার নামে পরিচিত ছিল।

কিন্তু প্রসেনজিতের জীবনে বিড়ম্বনা নিয়ে এসেছিলেন অন্য এক রানী। প্রসেনজিত জানতেন না যে পট্টমহিষী বাসবীকে (পালি বাসব খতিয়) যেদিন তিনি রাজপ্রাসাদে এনেছিলেন সেদিনই ভাগ্যদেবতা তার জীবনের শেষ অঙ্ক লিখে দিয়েছিলেন। বুদ্ধের অনুরক্ত প্রসেনজিত, বুদ্ধের যে বংশে জন্ম, সেই শাক্যবংশের এক কুমারীকে বিয়ে করতে চেয়ে শাক্যদের কাছে দূত পাঠান। শাক্যরা প্রসেনজিতকে তাদের সমকক্ষ মনে করে নি। তাই নিজেদের বংশের কন্যা না পাঠিয় বাসবীকে রাজার কাছে পাঠান, যিনি ছিলেন আসলে দাসী কন্যা। প্রসেনজিত এই গোপন কথা না জেনে শাক্যবংশীয় ভেবে তাকে বিয়ে করেন। অনেক বৎসর পরে, তাদের যুবক সন্তান বিধুদ্ধব তার মাতুলবংশের সাথে পরিচয় করতে চায়। স্বভাবতই রানী বাসবী তাকে বাধা দেন। ভাগ্যচক্র কে খণ্ডায়! মায়ের বারণ সত্ত্বেও মাতুল শাক্যদের কাছে গিয়ে বিধুদ্ধব আসল কথা জানতে পারেন। শাক্যদের কাছে উপহাসের পাত্র হন তিনি। অপমানিত প্রসেনজিত বাসবী ও বিধুদ্ধব দুজনকেই রাজপুরী থেকে নির্বাসিত করেন। তারপর একদিন, যখন প্রসেনজিত তথাগত বুদ্ধের কাছে, তখন ক্রুদ্ধ বিধুদ্ধব সু্যোগ বুঝে নিজে সিংহাসন দখল করেন। বৃদ্ধ নিরাশ্রয় প্রসেনজিত তখন তার শেষ ভরসা কন্যা বজ্জিরার কাছে ছুটে যান আশ্রয়ের জন্য। হয়ত সেদিন তার মনেই পড়েনি অজাতশত্রুর সাথে যুদ্ধের তিক্ততার কথা। সেদিন মগধের রাজধানী রাজগৃহে পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। রুদ্ধ হয়েছিল নগরীর দ্বার। রাজার শ্বশুরের জন্যেও তা খোলা হয় নি। প্রসেনজিত সেই রাতে নগর প্রাকারের পাশেই প্রাণত্যাগ করেন। জীবনের কি বিচিত্র গতি! জীবনের শেষ রাতে খোলা আকাশের নীচে, পৃথিবীর কোলে শেষ নিঃশ্বাসের আগে তিনি কি রানী বাসবীকে ক্ষমা করেছিলেন? ইতিহাস নীরব।
বিধুদ্ধব পরে নিজের অপমানের প্রতিশোধ নিতে শাক্যবংশ ধ্বংস করেছিলেন। সেটা অন্য গল্প, তোলা থাক।

এত হিংসার মাঝে, এক রাণীর প্রতি তার স্বামীর গভীর ভালোবাসার উদাহরণও ইতিহাসে আছে। অজাতশত্রুর এক উত্তরপুরুষ রাজা মুণ্ড’র পট্টমহিষী ভদ্রাদেবীর হঠাৎ মারা যান। রাজা মুণ্ড রাণীর বিরহশোকে কাতর হয়ে প্রিয় মহিষীর মৃতদেহ ছাড়তে চান নি, নিজেও প্রাণত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। সে সময় নারদ নামের কুক্কুটরাম বিহারের এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসী তাকে মৃত্যুশোক থেকে পরিত্রাণ করেছিলেন।

প্রাচীন ভারতের রানীরা যে সবাই ভারতীয় ছিলেন তা নয়। তাদের মধ্যে অন্ততঃ একজন অ-ভারতীয় ছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের এক রানী ছিলেন যবনকন্যা। চন্দ্রগুপ্ত মগধের রাজা হবার পর গ্রীক সেনাপতি সেলুকাসের সাথে যে যুদ্ধ হয় তাতে সেলুকাস পরাজিত হন এবং গ্রীক লেখকদের ভাষায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাথে ‘বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন’ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে সেলুকাসের মেয়েকে বিয়ে করেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পুত্র যুবরাজ বিন্দুসারের বা প্রপৌত্র অশোকের শিরায় গ্রীক রক্ত ছিল না।

বিন্দুসারের সন্তান সম্রাট অশোকের মা ছিলেন রানী সুভদ্রাঙ্গী। কথিত আছে যে, সুভদ্রাঙ্গীকে কোনো কারণে বহুদিন রাজা বিন্দুসারের থেকে দূরে রাখা হয়েছিল। পরে রাজার সান্নিধ্যে এসে তিনি এক পুত্র লাভ করেন তার সমস্ত দুঃখ দূর হয়। সেজন্য সন্তানের নাম রাখেন অশোক। কিন্তু অশোক ‘দেবানাম প্রিয় প্রিয়দর্শীর’ যুবা বয়সে যে এক প্রিয়দর্শিনী তার জীবনে এসেছিলেন, তার খবর ক’জন রাখেন?

রাজপুত্র অশোক তখন উজ্জয়িনীর শাসনকর্তা। সেখানেই পরিচয় ও প্রেম স্থানীয় শ্রেষ্ঠীকন্যা সুন্দরী বিদিশাদেবীর (নামান্তর দেবী) সাথে। তিনি শাক্যবংশের কন্যা, তাই তার অন্য নাম শাক্যকুমারী। তার পূর্বপুরুষ বিধুদ্ধবের হাতে নিধনের থেকে বাঁচতে কপিলাবস্তু ছেড়ে উজ্জয়িনী আসেন। অশোক বিদিশাদেবীকে বিয়ে করেন। মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রা নামে তার দুই সন্তানও জন্মে। কিন্তু রাজা হবার পর তাকে রাজমহিষীর সম্মান দিয়ে পাটলিপুত্রে নিয়ে আসেন নি। বিদিশাদেবী বৌদ্ধ ছিলেন, তিনি উজ্জয়িনীতেই থেকে যান। সম্ভবতঃ অশোকের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পেছনে তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব ছিল। অশোকের রানীদের মধ্যে পট্টমহিষী ছিলেন অসন্ধিমিত্রা (কোন কোন পণ্ডিতের মতে ইনিই বিদিশাদেবী), ও দ্বিতীয়া মহিষী ছিলেন কারুবকী। পদ্মাবতী ও তিষ্যরক্ষিতা (পালি তিষ্যরক্ষা) নামে অশোকের আরও দুই রানীর নাম পাওয়া যায়। তিষ্যরক্ষিতা ছিলেন অসন্ধিমিত্রার সহচরী, সম্রাট তার প্রেমে পড়ে তাকেও বিয়ে করেন। কেমন লেগেছিল মহারানী অসন্ধিমিত্রার, সম্রাট তিষ্যরক্ষিতাকে বিয়ে করাতে? তিনি কি সহজে মেনে নিতে পেরেছিলেন তার একদা তাম্বূলকরঙ্কবাহিনী তিষ্যরক্ষিতাকে রানী হিসেবে? ইতিহাস তার খবর রাখেনি। পরে অসন্ধিমিত্রার অকালে মৃত্যু হলে তিষ্যরক্ষিতা মহাদেবী হন। তিষ্যরক্ষিতার নামে গুরুতর অভিযোগ আছে যে তিনি ঈর্ষার বশে বোধিবৃক্ষ ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন (অলৌকিক ভাবে তা রক্ষা পায়) ও ষড়যন্ত্র করে রাজপুত্র কুণালকে অন্ধ করে দিয়েছিলেন। এক বৌদ্ধগ্রন্থ অনুযায়ী অশোক শেষজীবনে একে প্রাণদণ্ড দেন।

সম্রাট অশোকের শিলালিপিতে একই বার মাত্র একজন রানীর কথা উল্লেখ করা আছে। তিনি হলেন দ্বিতীয়া মহিষী কারুবকী, রাজপুত্র তীব্রর মাতা। কোনো ঐতিহাসিকের মতে তিষ্যরক্ষিতারই অন্য নাম কারুবকী (ছবি ১ - কারুবকী - অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চোখে)। সম্রাট অশোকের পুরসুন্দরীদের নূপুরনিক্বণ যে প্রাসাদের অলিন্দে ধ্বনিত হত, প্রায় পাঁচশো বছর পরে সেই রাজপ্রাসাদ ফা-হিয়েন দেখে আশ্চর্য হয়ে বলেছিলেন এই প্রাসাদ মনুষ্যনির্মিত হতে পারে না, নিশ্চয় দৈব নির্মিত। সম্রাট অশোক ও তিষ্যরক্ষিতার প্রেমের জের টেনে বলি, অন্তঃপুরিকার সাথে রাজাদের প্রেমের ঘটনা ইতিহাসে আরও আছে। ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্‌’ নাটকে মৌর্যদের পরবর্তীকালের শুঙ্গ রাজা অগ্নিমিত্র (শুঙ্গ বংশের প্রতিষ্ঠাতা পুষ্যমিত্রর পুত্র) প্রেমে পড়েছিলেন মালবিকা নামে এক নৃত্যপটীয়সী অন্তঃপুরিকার।

‘স্বপ্নবাসবদত্তা’য় বৎসরাজ উদয়ন অবন্তীরাজকন্যা বাসবদত্তার প্রেমে পড়েছিলেন। অবন্তীরাজ চণ্ডপ্রদ্যোত উদয়নকে ষড়যন্ত্র করে বন্দী করেন। বন্দী অবস্থায় বাসবদত্তার সাথে সাক্ষাত ও প্রেম। এবং শেষে প্রদ্যোতকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বাসবদত্তাকে নিয়ে পলায়ন। রাজকন্যা পেলেও উদয়ন অর্ধেক রাজ্য অবশ্য পান নি। অবন্তী প্রায় দুই শত বৎসর পরে মৌর্য আমলে মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
শুঙ্গবংশের শেষ রাজা দেবভূমির আবার রানীর ফাঁড়া ছিল। কুচক্রী মন্ত্রী বাসুদেবের প্ররোচনায় এক দাসীকন্যা রাণীর ছদ্মবেশে তাকে শয়নগৃহে হত্যা করে। রাজশয্যায় পুষ্পমালা হাতে রানীর স্থানে ছুরিকা হস্তে এক হত্যাকারিণীকে দেখে দেবভূমির মনে কি হয়েছিল, তা নিয়ে ইতিহাসে নেই।

প্রাচীন ভারতের রাজমহিষীরা যে প্রয়োজনে শক্ত হাতে রাজ্যের হাল ধরতে পারতেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন দক্ষিণ ভারতের সাতবাহন বংশের রানী নয়নিকা। স্বামী প্রথম সাতকর্ণী রাজপুত্রদের নাবালক রেখে মারা যাবার পর রানী নয়নিকা রাজপ্রতিভূ হয়ে রাজ্য শাসন করেছিলেন। এই ভারতগৌরব বীরাঙ্গনা, যাত্রী ও বণিকদের জন্য নানাঘাট গুহা তৈরি করে তাতে সাতবাহন বংশের রাজাদের পরিচয়সহ মূর্তি খোদাই করিয়েছিলেন। এইসব মূর্তি ও গুহালিপি ভারতের ইতিহাসের অমূল্য দলিল।

এই সাতবাহন বংশের আর এক রানী ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। তিনি হলেন গৌতমী বলশ্রী। প্রায় দুই হাজার বৎসর আগে সাতবাহন সাম্রাজ্য তার অতীত গৌরব হারিয়েছিল। একদা দক্ষিণাপথের বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতিরা পরিণত হয়েছিলেন করদ রাজা। সেই সময় সাতবাহন রানী গৌতমী বলশ্রী তার সন্তান শালিবাহনকে উদ্বুদ্ধ করেন তাদের পিতৃপুরুষের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে। শালিবাহন পেরেছিলেন সেই কাজ করতে ও পরে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী নাম গ্রহণ করেছিলেন। সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে চলেছিলেন তার উত্তরসূরিরা বাশিষ্টীপুত্র পুলমায়ী ও যজ্ঞশ্রী সাতকর্ণী। রানী মায়েরা অমর হয়ে থাকতেন, তাদের সন্তানদের নাম ও কীর্তির মাঝে।

গুপ্তসম্রাটদের বেশীর ভাগ লিপিতে রাজার সাথে সাথে পূর্ণ মর্যাদার সাথে রাণীর নাম আছে। চন্দ্রগুপ্তের রানী ছিলেন লিচ্ছবি দুহিতা কুমারদেবী। চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রার একপিঠে রাজার সাথে কুমারদেবীর ছবি আছে (ছবি ২ – চন্দ্রগুপ্ত ও কুমারদেবী)। গুপ্তসম্রাটদের বেশীর ভাগ লিপিতে রাজার সাথে সাথে পূর্ণ মর্যাদার সাথে রাণীর নাম আছে। চন্দ্রগুপ্তের রানী ছিলেন লিচ্ছবি দুহিতা কুমারদেবী। চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রার একপিঠে রাজার সাথে কুমারদেবীর ছবি আছে। লিচ্ছবিদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক গুপ্তবংশের পক্ষে এক গৌরবের ব্যাপার ছিল। কুমারদেবী ও চন্দ্রগুপ্তের সন্তান সমুদ্রগুপ্ত নিজেকে লিচ্ছবিদৌহিত্র বলে পরিচয় দিয়েছেন, গুপ্তপৌত্র হিসেবে নয়। দত্তদেবী ছিলেন সমুদ্রগুপ্তের পট্টমহিষী। অশ্বমেধ যজ্ঞে মহারানীর বড়ো ভূমিকা ছিল, তাই সমুদ্রগুপ্তের অশ্বমেধ মুদ্রায় রাজা ও অশ্বের সাথে আছে দত্তদেবীর ছবি।

দত্তদেবী ও সমুদ্রগুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য। তার সাথে মহারানী ধ্রুবদেবীর বিয়ে নিয়ে রচিত হয়েছিল ‘দেবী চন্দ্রগুপ্ত’ নাটক। নাটক অনুযায়ী সমুদ্রগুপ্তের পর রাজা হয়েছিলেন রামগুপ্ত, যিনি ছিলেন অকর্মণ্য। তিনি শকদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সন্ধির শর্ত হিসেব মহারানীকে শক রাজার কাছে পাঠাতে সম্মত হন। গুপ্তবংশের পক্ষে এই শর্ত খুব অপমানজনক লেগেছিল সমুদ্রগুপ্তের অন্য সন্তান দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের। তিনি তখন নিজে মহারানীর ছদ্মবেশে শত্রু শিবিরে গিয়ে শক রাজাকে হত্যা করেন ও রাজসিংহাসন অধিকার করে নিজেই মহারাণীকে বিয়ে করেন। এই মহারানীই ছিলেন ধ্রুবদেবী (নামান্তর ধ্রুবস্বামিন্‌)। কুবেরনাগ নামে বিক্রমাদিত্যের আরো এক রানীর খোঁজ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন নাগ জাতির কন্যা, সম্ভবতঃ রাজনৈতিক কারণেই তাকে বিয়ে করেন বিক্রমাদিত্য।

রানী কুবেরনাগের কন্যা ছিলেন প্রভাবতী, যিনি বিয়ের পরে হয়েছিলেন বাকাটক রাজবংশের মহারানী। ইনিও ইতিহাসে স্বমহিমায় বিরাজিত, এর নামেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক দলিল আছে। ধ্রুবদেবী ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সন্তান ছিলেন কুমারগুপ্ত। তার অনেক রানীর মধ্যে একজন ছিলেন কদম্ববংশের রাজকন্যা অনন্তদেবী। কুমারগুপ্তের সন্তান ছিলেন স্কন্দগুপ্ত। কিন্তু অনন্তদেবী স্কন্দগুপ্তের মা ছিলেন না। কুমারগুপ্তের কোন রানী স্কন্দগুপ্তের মা ছিলেন তা জানা যায় নি।

গুপ্তসাম্রাজ্যের অবস্থা তখন টলোমলো। কুমারগুপ্তের আমলে একবার হুন আক্রমণ হয়ে গেছে ও স্কন্দগুপ্ত সেই আক্রমণ প্রতিহত করে হুনদের হাত থেকে ভারতভূমিকে রক্ষা করেছেন। এবার এসেছে পূষ্যমিত্র নামে আর এক শক্তিশালী শত্রুর আক্রমণ। স্কন্দগুপ্ত চঞ্চলা রাজলক্ষ্মীকে শান্ত করার জন্য এক রাত্রি ভূমিশয্যার শয়ন করে যুদ্ধযাত্রা করেন ও যুদ্ধে জয়লাভ করেন। (গল্পকথা নয়, স্কন্দগুপ্তের ভিটারী শিলালিপিতে আছে।) ‘হুনকেশরী’ স্কন্দগুপ্তের কোন রানীর নাম ইতিহাসে নেই। হয়তো সারা জীবন যুদ্ধবিগ্রহে কাটিয়ে রাজমহিষী আনার সময় হয় নি এই ভারতমাতার এই বীর সন্তানের। অজস্র সেনা মধ্যে রক্তবর্ণ যুদ্ধশিবিরে বসে সেনাপতিদের সাথে যুদ্ধকৌশল স্থির করার সময়, গুপ্তসাম্রাজ্যের অধীশ্বরের কি একবারও নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয় নি? স্কন্দগুপ্ত নিঃসন্তান থাকায়, তার পরে গুপ্তবংশের রাজসিংহাসনে বসেছিলেন তার সৎ ভাই পুরুগুপ্ত, অনন্তদেবী ও কুমারগুপ্তের সন্তান।

এবারে এক কলঙ্কিনী ষড়যন্ত্রী রানীর কথা আনব। শিশুনাগ বংশের শেষ রাজা কালাশোক কাক-বর্ণের ক্ষৌরকার ছিল এক সুদর্শন যুবক। কালাশোকের মহারানী তার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়ে। রানীর সাথে ষড়যন্ত্র করে, একদিন কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে ক্ষৌরকর্মের সময় সেই ক্ষৌরকার রাজাকে হত্যা করে। তারপর রাজসিংহাসন হস্তগত করা ও রাজপুত্রদের যমালয়ে পাঠানো তো সহজ কাজ। এই নহাপিত কুমারই ছিলেন নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহাপদ্ম নন্দ, যার উত্তরপুরুষ ধননন্দকে সরিয়ে মগধের সিংহাসনে বসেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। এই কলঙ্কিনী রানীর নাম ইতিহাসে খুঁজে পাই নি। তবে যেহেতু মহাপদ্ম নন্দ শূদ্র ছিলেন, পুরাণগুলিতে তার নামে প্রচুর গালমন্দ করা আছে।
প্রাচীন ভারতীয়রা সবকিছুর মধ্যে শ্রেণীবিভাগ করতেন, তাই রানীদেরও শ্রেণীবিভাগ ছিল। শতপথ ব্রাহ্মণে (১৩.৫.২) অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠানে চার ধরনের রাণীর উল্লেখ আছে, যথাক্রমে মহিষী, বাবতা, পলাগলী ও পরিব্রীকৃতি। মহিষী ছিলেন রাজার প্রথম বিবাহিতা ও সম্মানে রানীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠা, বাবতা রাজার সর্বাপেক্ষা প্রিয়, পলাগলী সম্ভবতঃ কোন রাজভৃত্যের কন্যা ও পরিব্রীকৃতি উপেক্ষিতা। যে রানী উপেক্ষিতা, হয়ত রাজপ্রাসাদে তার ঠাঁই হয় নি, তারও প্রযোজন হত রাজার অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন করতে।

শাস্ত্রে চার রানীর কথা থাকলেও তা না মেনে যে রাজারা রাজনৈতিক কারণে বহুবিবাহ করতেন, ইতিহাসে তার প্রচুর উদাহরণ আছে। একাধিক জাতকের গল্পে রাজাদের ষোল হাজার রাণীর কথা আছে। বিম্বিসারের পাঁচশত রানী ছিল এরকম কোথাও লেখা আছে। বৌদ্ধশাস্ত্রে আছে বিন্দুসারের সতের জন রানী ছিল ও তাদের একশত এক জন সন্তান ছিল। কিন্তু কোন এক রাজার এই শত শত রানী থাকা অবাস্তব ও নিশ্চয় অতিশয়োক্তি।

কেমন লাগত সেযুগের মহিলাদের, রাজনৈতিক পাশা খেলার ঘুঁটি হয়ে বহুবিবাহিত এক অচেনা অজানা মানুষের রানী হতে? কে জানে।
বর্তমানের গৃহিণীদের জন্য লিখি যে মৌর্যযুগে রাজকোষ থেকে রানীর জন্য ভাতা নির্দিষ্ট করা ছিল। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে আছে রানী পেতেন সর্বোচ্চ ভাতা ৪৮,০০০ পণ, যা ছিল প্রধান পুরোহিত, প্রধান মন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতির বেতনের সমান। সেই তুলনায় সাধারণ মজুরের বেতন ছিল মাত্র ৬০ পণ। প্রাচীন যুগে রাজারা রাজসূয় যজ্ঞ করতেন। সেই যজ্ঞে যে রত্ন আহুতি দেবার নিয়ম ছিল, তা সমান ভাগে প্রাপ্য ছিল প্রধান সেনাপতি, প্রধান পুরোহিত ও পট্টমহাদেবীর।

কিন্তু কেমন দেখতে ছিলেন সেযুগের রানীরা? প্রাচীন ভাস্কর্যের যক্ষিণী মূর্তির মতো (ছবি ৩ – বাহরুত যক্ষী - ১ম/২য় শতাব্দী খ্রীষ্টপূর্ব – শুঙ্গ আমলের ) আয়তলোচনা, শিখরিদশনা, মৃণালভূজ, ক্ষীণকটি, পীনোদ্ধোতা, জঘন-জঙ্ঘা, ‘ন্যগ্রোধপরিমন্ডলা’? কে জানে? যখন জানা নেই, তখন কল্পনা করে নিতে দোষ কোথায়? হয়ত কল্পনায় বিম্বিসার অশোকের ধুসর জগতে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে, একদিন কারো সাথে দেখা হয়েও যেতে পারে যার চুল অন্ধকার বিদিশার নিশার মত আর মুখে আছে শ্রাবস্তীর অপরূপ কারুকার্য।

উপসংহারে লিখি যে, ইতিহাস কি কেবল রাজা আর রাণীদের জন্য? সেই সাধারণ মানুষের কথা, বিজয়ীর অসি নির্বিচারে যাদের রক্ত পান করেছিল, বিজয়ী সেনা যাদের যাদের শহর গ্রাম লুটপাট করে, চোখের জল ছাড়া সমস্ত কিছু কেড়ে নিয়েছিল, তাদের কথা ইতিহাসে কই? যারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দেখে ‘রাজছত্র ভেঙ্গে পড়ে’, যারা নির্বাক হয়ে শোনে যে ‘রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে’, যাদের প্রাত্যহিক জীবনধারণের যুদ্ধ দেখে ‘জয়স্তম্ভ মূঢ়সম অর্থ তার ভোলে’, তাদের ইতিহাস কে লিখবে?

দিলীপ দাস

(যেসব বই থেকে সূত্র সংগ্রহ করেছি তার তালিকা)
1. Agarwal, Asvin - Rise and Fall of the Imperial Guptas
2. Majumdar, R C (Ed)- History and Culture of the Indian People – Vol II (Age of Imperial Unity)
3. Mookerjee, Radhakumud - Asoka
4. Raphson, E J (Ed)- Cambridge History of India (Vol 1)
5. Raychoudhury, H- Political History of Ancient India
6. Rhys Davids, T W- Buddhist India
7. Shamasastry, R - Kautilya’s Asrthashatra (Translation)
8. Smith, V A - The Early History of India
9. Thaper, Romila – Asoka and the Decline of Mauryas

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।