একটা
মাতাল করা আর অতীত-আর্তি (nostalgia) ভরা সকাল
কলকাতাতে বর্ষা সবে
পা দিয়েছে – কখন অঝোরে , কথন টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। কখন
আবার রোদের তেজে চাঁদি ফেটে যাচ্ছে । কিন্তু আজ সকালটা (আমার
সকাল হয় ৭।৩০ টাতে ) অন্য মনে হল। বারান্দাতে বসে ছিলাম।আকাশে
মেঘ আর তার সাথে কেমন একটা মন কেমন করা মিষ্টি হাওয়া – তাতে
“চেনা দিনের গন্ধ”। হাওয়া আমার মাতাল বুকে “চামর দোলাচ্ছিল”।কেমন
একটা নেশা লেগে গেল। পুরনো দিনে ফিরে যাবার একটা অদম্য ইচ্ছা
আমাকে বাড়িতে থাকতে দিল না। জীবন সঙ্গিনী তখন গৃহ কর্মে ব্যাস্ত
– কিন্তু আমার উতলা মনের স্পন্দনটা বুজল । বলল “আমি যেতে পারছি
না কিন্তু তুমি মনের এই দুর্লভ তাগিদ miss কোরোনা।যতক্ষণ খুশী
যেখানে খুশী ঘুরে এস”।বুজলাম কথাটা মন থেকে বলছে – ৪০ বছরের
ঘনিষ্ঠতা থেকে সে তার পাগল স্বামীকে পুরোপুরি বুঝতে পেরেছে ।
নিজেকে ভাগ্যবান মনে করে বেড়িয়ে পরলাম।
আমাদের বাড়ীর কাছের বড়
রাস্তা দিয়ে আগে ট্রাম চলত – গত ৪ – ৫ বছর থেকে বন্ধ হয়ে গেছে।
কেন জানি মনে হল, বাস বা মেট্রো বা ট্যাক্সির থেকে ট্রাম এই
পাগলের মনের ছন্দে বেশী তাল মেলাতে পারবে। তাই প্রথমে হেঁটে
গড়িয়াহাট ট্রাম ডিপোতে গেলাম। এখান থেকে ধরমতলার ট্রাম শুরু
হয়। তাই একেবারে ফাঁকা ট্রামের এক পাশের single seat এ আরাম
করে বসলাম। ট্রামের গতি আমার মনের মতই অলস – হেলে দুলে সে চলতে
লাগল।আমার মত তার ও কোন তাড়া নেই – ঝিরঝিরে বৃষ্টির সোঁদা গন্ধ
– এটা কল্পনাতে – পীচের রাস্তাতে আসলে তার চিহ্ন নেই – কিন্তু
অনুমানে সে ফাঁক ভরিয়ে আমার মন সেই গন্ধে তখন বিভোর। বাস বা
মেট্রোর মত এখানে অফিস যাত্রী নেই – আমার মত কিছু অবসরপ্রাপ্ত
মানুষ ছাড়া কারো সময়ের এই অপচয় করার কথা ভাবা কল্পনার বাইরে।
প্রায় ৪৫ মিনিট লাগল ধরমতলা
পৌঁছতে। ট্রাম থেকে নেবে K C Das এ ঢুকলাম । সেখানে মিহিদানা
রসগোল্লা সিঙ্গারা আর চা সাঁটিয়ে সিগারেট ধরালাম । আমি খুব বেশী
হলে ৬ মাসে একটা সিগারেট খাই – কিন্তু আজ পর পর দুটো খেলাম।
এদিক ওদিক কিছুক্ষণ ঘুরে শ্যামবাজার এর ট্রামে উঠলাম । এটাও
ধরমতলা থেকেই ছাড়ে – তাই আবার সেই single seat পেতে কোন অসুবিধা
হল না।কলেজ স্ট্রীটের presidency college এর সামনে চলন্ত ট্রাম
থেকে নাবলাম। ৭০ বছর বয়সে এটা বেশ একটু বাড়াবাড়ি জেনেও পুরনো
কলেজ পাড়াতে এসে এটা না করে পারলাম না।
প্রথমে গেলাম দাসগুপ্তর বইয়ের দোকানে । সেখানে সুজন দাশগুপ্তের
“আসল খুনির সন্ধানে” কিনলাম। রাস্তাটা পার হয়ে আমার পুরনো কলেজ
presidency র গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরটা অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম।
ভিতরে কেন ঢুকলাম না – সেটা অনুমান করে নিন – এ নিয়ে কিছু লিখে
নিজেকে বিপদে ফেলার ঝুঁকি নিচ্ছি না। অতীত-আর্তি (nostalgia)
তখন আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তাই ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে
ছাতা মাথায়ে বই পাড়াতে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম । ফিরে আসবার কথা
ভাবছিলাম তখন কফি হাউসের দিকে চোখ পড়ল। না ঢুকে থাকতে পারলাম
না। পাখার নিচে একটা টবিলে বসে কফি আর কাটলেট চাইলাম । চারিদিকে
কলেজের ছেলে মেয়েরা – তার মধ্যে এই ৭০ বছরের যুবক। কিন্তু তবু
নিজেকে বেমানান লাগল না। এখানে সবাই আড্ডা মারতে আসে – তাই কফি
আর কাটলেট পেতে বেশ সময় লাগল। আমারও কোন তাড়া নেই – তাই বসে
বসে নিজের কলেজ জীবনের দিন গুলোর মধ্যে হারিয়ে গেলাম। কাটলেটটা
সুখাদ্য বলা শক্ত - তবু nostalgia তাকে খারাপ লাগতে দিল না।
অনেকক্ষণ পর এখান থেকে বের হয়ে কলেজ স্কোয়ার এর দিকে এগুলাম।
সামনে গিয়ে পুটিরামের কথা মনে পরে গেল। তাই পার্ক এর বাঁ দিক
দিয়ে ঘুরে পুটিরাম এ হাজির হলাম। এখানে সাঁটলাম দুটো ল্যাংচা
।
এবার ফেরার পালা । আবার
ট্রামে সেই ধরমতলা – সেখান থেকে আর এক ট্রামে গরিয়াহাট ডিপো
। তারপর হেঁটে বাড়ী।
জীবন সঙ্গিনী জিজ্ঞাসা করলো “এখন কি কিছু সময় নিজের মত থাকতে
চাও?”। কি করে আমার মনের কথা বুঝল জানি না। আবার অনেকক্ষণ বারান্দাতে
একা বসে রইলাম – দুপুরের খাবার গিন্নী সেখানেই দিল কোন কথা না
বলে। খাওয়া শেষ হবার পরে চেয়ার এ বসেই ঘুমিয়ে পরলাম। ঘুম ভাঙ্গল
যখন দেখলাম চায়ের কাপ নিয়ে চুপ করে সহধর্মিণী দাঁড়িয়ে আছে।
আজকের সব কথা লেখার একটা বিশেষ তাগিদ অনুভব করলাম । তাই আজই
কারণ বারি সেবন করতে করতে এটা লিখে ফেললাম। nostalgia নিজের
কাছে উপভোগ্য – কিন্তু এই লেখা পড়া অন্যদের ওপর অত্যাচার কিনা
জানি না। তবু লিখেই ফেললাম।
বিজন
বন্দ্যোপাধ্যায়
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)