প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

শিলাইদহ

শিক্ষিত বাংলাভাষাভাষীদের তিনটি তীর্থস্থান-- জোড়াসাঁকো, শান্তিনিকেতন আর শিলাইদহ। কৈশোরে আর যৌবনেই প্রথম দুটোয় ঘোরা হয়েছে। নিছক পুণ্যসঞ্চয় বললে কেউ বিশ্বাস করবেন না, সত্যি কথাটাই বলি, যৌবনধর্মের গুঁতোই ছিল প্রবল। শেষ তীর্থদর্শনের জন্য অপেক্ষা করতে হোলো অনেকদিন, তাতে ক্ষতি নেই কিছু, তখন বৃদ্ধা বেশ্যা তপস্বিনী, সাধ আর সাধ্যের চমৎকার মিল। পাকিস্তানের কালে তো যাবার কোনো প্রশ্নই উঠতো না, মুক্তিযুদ্ধের পরেও ওঁদের সব সামলে সুমলে নিতে লেগেছে কয়েক বছর। এর মধ্যে শিলাইদহের কুঠিবাড়ি লুটপাটের হাত থেকে রেহাই পায়নি-- আসবাবপত্র তো বটেই, ইঁট-কাঠও চুরি হয়েছে। ওদিকে আবার ওয়াহেদুল হক ও সন্জীদা খাতুন ভাঙা হারমোনিয়াম ঘাড়ে করে বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাপারটা ভালো করে চাউর করেছেন। আমার কিছু বাংলাদেশী রবীন্দ্রভক্ত বন্ধুদের কাছে শোনা যে তাঁদেরই কয়েকজন এদিক-ওদিক করে ওঁদের তৎকালীন প্রেসিডেণ্ট এরশাদ চৌধুরীকে শিলাইদহে নিয়ে আসেন। এরশাদ সাহিত্যপ্রেমী ছিলেন বলে জানা যায়, তিনি হতশ্রী শিলাইদহ দেখেই শিলাইদহকে জাতীয় সম্পত্তি ঘোষণা করেন। শিলাইদহের নবজন্ম।

ঢাকা থেকে সোজাসুজি গাড়িতে শিলাইদহে যাবার ব্যবস্থা হতে আরো কয়েক বছর লাগলো। আমরা শেষে তীর্থে পোঁছলাম ২০০৪ সালে-- কাঠখড় কিছু পুড়লো, কিন্তু লাভের তুলনায় সে অতি সামান্য। সকালে এক সাঁজোয়া সাইজের গাড়িতে ঝুড়ি ভরা খাদ্যাখাদ্য আর আকণ্ঠ সুরেলাসুরেলা গান নিয়ে রওনা হওয়া গেল। কোন পথে গেছি তা খেয়াল করিনি, পথের ধারে বেসুর ছড়িয়ে পথিককে বিরক্ত করার মজাতেই তখন মশগুল। তবে বার্জে চড়ে পদ্মা পারাপারটা মনে রাখার মতো। পদ্মা এখনও কীর্তিনাশা, পাড়ের আধমাইলটাক রাস্তা পাকা করা যায়না, করলেও টেঁকে না। কাঁচা রাস্তা দিয়ে লাফাতে লাফাতে বার্জে চড়া, সেখানে কয়েকটি তরুণ হাতপা ছুঁড়ে বার্জ ভর্তি করলো গাড়ি দিয়ে, আপিস টাইমের বাসের মতো, কর্মকুশলতা একেবারে আন্তর্জাতিক মানের। বার্জ ছাড়লো ঘড়ি ধরে, বোধহয় আট-দশটা এমন বার্জ আছে, কলুর বলদের মতো চক্কর দিয়ে যাচ্ছে। 'এপার-ওপার করো তুমি', সরকারই চালান। বার্জ ছাড়ার পরেই ফিরি করা খাবারের ধুম, সেদ্ধ ডিম থেকে বিরিয়ানি-- অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই কোনো। হকারদের বেশির ভাগের বয়েসই আট-দশ বছরের মধ্যে, দিনের ওই সময়টায় তাদের আরো বেশি মানাতো ইস্কুলে; তা আর কী করা যাবে। শীতের পদ্মা, কিন্তু অতি তেজস্বিনী, 'খল জল ছল ভরা তুলি লক্ষ ফণা', দস্তুরমতো লোমহর্ষক। যাই হোক, ঢিকিস ঢিকিস করে ওপারে পৌঁছনো গেলো, আবার কাঁচা থেকে পাকা রাস্তায় উত্তরণ।

এবার পাকা রাস্তা। ঠিক পাকা নয়, কাঁচাপাকা। ব্যাপারটা এইরকম। বর্ষাকালে রাস্তার কিছু কিছু জলে ভেসে যায়। বর্ষার শেষে সরকার বিভিন্ন জেলা বা উপজেলার চালকদের (পঞ্চায়েৎ হবে কি?) টাকা দেন রাস্তা সারাই করতে। তাই দিয়ে কিছু কিছু জেলা রাস্তা সারান, আবার কিছু কিছু জেলা নাস্তা সারেন। এ সবদেশে সবকালেই ঘটে থাকে, হয়তো জলের বদলে বরফ। তো এই গাড়ির ঝাঁকানিতে অন্নপ্রাশনের ভাত অবধি হজম হয়ে গিয়েছিল তাই এই কুষ্টিয়ার সড়কের ওপর একটা হোটেল আছে, নামটা মনে পড়ছে না, ধাবা ক্লাসের কিছু, সেখানে মুর্গির ঝোল, ভাত আর পরমান্ন খেলাম। সে কথা এখানে তোলার কারণ হোলো, সে যে কী অমৃত সে কী বলি। এইরকম ওস্তাদ হালুইকরের হাতে জবাই ও প¹ হয়ে আমাদের মতো সদ্ব্রাহ্মণের ভোগে লাগার আশায় বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মুরগি কেন স্বেচ্ছায় প্রাণ দিচ্ছে না, সেটা গবেষণার বিষয়। রাস্তার ধারের চায়ের দোকানে বার দুয়েক দাঁড়াতে হোলো শিলাইদহের পথনির্দেশ নেবার জন্য এবং চমৎকৃত হওয়া গেল যে সাধারণ মানুষও শিলাইদহের খবর রাখেন-- 'অ, কুটি বারি খুঁজতে আসেন?', 'আরে অইত, আমাগো গুরুদেভের মকাম', ইত্যাদি। তার মধ্যে একটি অন্তত আমড়াতলার মোড়ের নির্দেশ নয় এটা নিশ্চিত, কেননা একসময় ঠিক পৌঁছে গেলাম শিলাইদহে।

পৌঁছে একেবারে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। শিলাইদহ কুঠিবাড়ি যেন তক্তকে করে নিকানো, শীতের দুপুরে ঝলমল করছে। মৌসুমী ফুলের বাগান শীতের ফুলে ফুলে ভরা। পথে প্রাঙ্গণে কোথাও একটুকরো পাতাও পড়ে নেই। গেটের বাইরে খুচরো-খাচরা জিনিষের দোকানও ঝকঝকে। সেখানে পাঁচটাকায় শিলাইদহের ছবির বই পাওয়া যায়, রবি ঠাকুরের ছবি, একতারা, খঞ্জনী, খড়ম, এতোদিন পরে সব ঠিক মনে নেই। দুঃখের বিষয় কফি টেবিল সাজাবার বই নেই কোনো, থাকলে ভালো হোতো। ধারে কাছে তেমন কোনো লোকজন নেই, এ ব্যাপারটা দেখে একটু ধোঁকা লাগলো। মুরুব্বি চেহারার একজন এবারে এসে বললেন, কোন মন্ত্রী আশু সরেজমিন পরিদর্শনে আসবেন বলে কথা আছে, সেই কারণে আজ কুঠিঘর সাধারণের অগম্য। অবশ্যই মন্ত্রীদের আগমন সাধাসিধে আসা নয়, আবির্ভাব, এবং সে আবির্ভাব নিশ্চয় জনহিতার্থ। যেমন ধরুন সুব্যবস্থা দেখে মুগ্ধ হয়ে কর্মীদের পুরস্কার দেবেন; অথবা এই সুযোগে কুঠিবাড়ির ঝাড়পোঁছ হয়ে গেল ভালো করে; এমনকি সংশ্লিষ্টদের কিছু অর্থানুকূল্যও ঘটতে পারে। যাইহোক, সঙ্গে বাংলাদেশী বন্ধুরা যাঁরা ছিলেন, তাঁদের চিন্তিত দেখলাম না। একটু এদিক ওদিক করার পর কুঠিবাড়ি ঘুরে দেখার বাধা তো কিছু হোলো না। আমরা থাকতে থাকতে মন্ত্রী পৌঁছলেন না; তাতে ভক্তরা খুব মুষড়ে পড়েছেন বলেও মনে হোলো না।

গড়াই আর পদ্মা নদীর সঙ্গমে ছিল এক ঘূর্ণি (দহ) আর কাছাকাছি ছিল নীলকর সাহেব শেলির কুঠি। এই থেকে শিলাইদহ গ্রাম, এখনকার কুষ্টিয়া শহরের দশ-বারো মাইলের মধ্যে হবে। বিরহিমপুরের জমিদারীর সঙ্গে কুঠিবাড়িও ঠাকুরপরিবারের দখলে আসে। পদ্মার দৌরাত্ম্যে যখন পুরনো কুঠিবাড়ি লোপ পাবার ভয় দেখা দেয়, তখন তারই মালমশলা নিয়ে নতুন (বর্তমানের) কুঠিবাড়ির পত্তন। রবীন্দ্রনাথ ১৮৯১-১৯০১ প্রায় নিয়মিত এবং পরেও-- যদিও অত ঘন ঘন নয়-- এখানে সপরিবার, সবান্ধব এসে সময় কাটিয়ে গেছেন। দেখেছেন, শিখেছেন, লিখেছেন-- তার খতিয়ান অন্যত্র পাওয়া যাবে। যে বাংলাভাষায় কথা বলে, পড়ে, লিখে বড়ো হলাম, জীবনটাই কাটিয়ে ফেললাম, সেই বাংলা গদ্যের ভাষার জন্ম এখানে, 'ছিন্নপত্রাবলী' তার সাক্ষী। কুঠিবাড়িটি এক বিশাল বাগান-ঘেরা বাংলো-ধরনের দোতলা ইটকাঠের পাকা বাড়ি। একতলায় ঢাকা দালান আর দোতলায় ঢাকা বারান্দা আছে, দোতলায় খানিকটা খোলা ছাদও আছে। তেতলায় ছাদ, চিলেকোঠা আর বার্মিজ ধাঁচের চন্দ্রাতপ, তার চারদিক খোলা। রবীন্দ্রনাথের কালে এখানে বসে সোজা পদ্মা দেখা যেতো, এখানে বসে রবীন্দ্রনাথ যে কবে কবে এবং কতো শত "ইঁদুরের দাঁত মেজে" দিয়েছেন তার হিসেব পাওয়া যায় না। ঢেউ-খেলানো নীচু পাঁচিল দেওয়া বাড়ির হাতায় কেয়ারি করা গাছ আর ফুলের বাগান, আবার রবীন্দ্রনাথের একটি আবক্ষ প্রস্তরমূর্তিও আছে। বাইরের বাগানে নানা জাতের গাছ, তার মধ্যে আম কাঁঠাল আদি ফলের গাছও দেখা যাবে। দুটো পুকুর, বাড়ির সংলগ্ন যেটা সেটা বাঁধানো ঘাটের, তালাও বলা যায়। আমি যখন গিয়েছিলাম তখন বাড়ি আর পাঁচিল, দুয়েরই রঙ ছিল লাল, লালবাড়ি। কিন্তু পরে দেখি বাংলাদেশের রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা নানান আপত্তি জানান, তার ফলেই মনে হয় বাড়িটি এখন ঘি রঙের, মূর্তিটি আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ সরকার এখানে বেশ কয়েকজন বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত গাইড রেখেছেন। তাঁদের দুজন এলেন আমাদের সঙ্গে, অনেক তথ্য ও কিছু তত্ব দিলেন, তার বেশির ভাগই ভুলে মেরেছি। যেমন জানালেন যে বড়ো বড়ো পরবের দিনের ছুটিতে সরকার বাংলাদেশের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের শিলাইদহ ঘুরে যাবার ব্যবস্থা করেন। সেই উপলক্ষ্যে এক বিরাট জনসমাগম হয়, কিছু সংখ্যাও দিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলি সেই মহাভারতের অর্বুদ-নির্বুদের মতো। তাঁরাই লুটপাটের কথা বললেন, বললেন যে কোন মাল কোথায় লুকিয়ে আছে, স্থানীয় লোকেরা এসবের খবর রাখতেন, কাজেই পুনরুদ্ধারের জন্য সরকার যখন বিশেষ পুরস্কার দিলেন, তখন অনেক কিছু ঘরের ছেলে আবার গুটগুট করে ঘরে ফিরে এলো। প্রায় সবই উদ্ধার করা গেছে, কেবল পাওয়া যায়নি রবীন্দ্রনাথের বজরা পদ্মা। পুরস্কারের লোভে একজন নাকি একটি বজরা হাজির করেছিলেন কিন্তু তার নকলত্ব অবিলম্বে প্রমাণিত হয়ে যাওয়াতে ওদিকে আর অগ্রসর হওয়া যায়নি। মডেল হিসেবে রেখে দিলে মন্দ হোতোনা হয়তো। পদ্মা নদী অবশ্য এখন অনেক সরে গেছে (দু-আড়াই মাইল বললেন কি?)। এটি পদ্মা নদীর তৃতীয় অভিযান।

একতলায় কাছারি, বৈঠকখানা ইত্যাদি ছিল, তার কিছু কিছু নমুনা এখানে রেখেছেন-- যথা প্রমাণ সাইজের ও ওজনের ক্যাশবাক্স-- আর বাকিটায় প্রদর্শনী বানিয়েছেন। রবীন্দ্র-অভিজ্ঞান তো ওঁদের হাতে তেমন বেশি নেই, তাই ছবির মাধ্যমেই যতোটা পারা যায়। ভারতীয় হাই কমিশন যে এই ছবি সংগ্রহে অকুণ্ঠ সাহায্য করেছেন সে কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করলেন। হয়তো প্রদর্শনীটি আরো নয়নমুগ্ধকর ভাবে সাজানো যেতে পারতো, কিন্তু ২০০৮ সালে শান্তিনিকেতন রবীন্দ্রভবনে যে কলঙ্ক দেখে আসার দুর্ভাগ্য হয়েছিলো, তার থেকে লক্ষগুণ ভালো। রবীন্দ্রভবনে তখন নাকি সংস্কার চলছিলো; সে উৎপাত আজও শেষ হয়েছে কিনা জানিনা। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে যে ঘরগুলি সাজানোতে সশ্রদ্ধ যত্নের কোনো অভাব দেখলাম না। মন্ত্রী-আবির্ভাবের দুর্যোগ এড়িয়ে দেখি এক দঙ্গল স্কুলের ছেলেমেয়েরা কী ভাবে ঢুকে পড়েছে আর প্রদর্শক তাদের দেখাচ্ছেন: " এই যে দ্যাহো ভিশ্বভিখ্যাত ভিজ্ঞানী এলবারট আইন-এসটাইন, এই দ্যাহো আমাগো গুরুদেভ সেই ভিজ্ঞানীর সহিত ভিশ্বরহস্য লইয়া গবীর আলাফে মগ্ন হইয়া আসেন।" 'উরুশ্চারণ'-টা ঠিক শান্তিনিকেতনী নয়, কিন্তু গলায় গর্বের সুরটিতে খামতি নেই কোনো। আসলে রবি ঠাকুর মুরগিটিকে বাংলাদেশের ঠিক ঘরের মুরগি তো বলা যায় না, তাই তাঁর কদর যে ডালের চেয়ে একটু বেশি হবে এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। পশ্চিম বাংলায় তিনি শুধু ঘরেরই নন, বুর্জোয়া তার ওপরে আবার পাতি। আরে ছ্যাঃ!

দোতলা অন্দরমহল, বসার ঘর, শোবার ঘর এই সব আছে। শোবার ঘরের খাট পালঙ্ক, আলমারি সব আছে, প্রদর্শক বললেন এ সবই রবীন্দ্রনাথের আমলের। বসার বেতের ইজিচেয়ারটি আছে, মনে দেখে মনে হোলো কোনো একটি ছবিতে এই চেয়ারটিই দেখেছি। তবে অতি দৈন্যদশা, কাঠ ভাঙা, বেত পচে গলে পড়ছে। কর্তৃপক্ষ ওইভাবেই রেখেছেন, সারাই করতে গেলে খোল নলচে কিছুই আর থাকতো না। 'তবে তাই হোক', কিন্তু যাতে আরো জীর্ণ না হয় হয়তো তার ব্যবস্থা করা যেতো। নাবার ঘরটিও সাজানো আছে তবে প্রবেশ নিষেধ; নাবার ঘর দর্শনে দর্শকদের মধ্যে একটু আনন্দের আতিশয্য দেখা দিচ্ছিলো বলে বোধ হয়। এটি ঠিক 'সেই' নাবার ঘরটি নয়, সেই যে 'বড়ো বেদনার মতো'-র নাবার ঘর; সেটি সাজাদপুরের। এটি তারই কাছাকাছি। দোতলার ছাদে গিয়ে চমৎকৃত হওয়া গেলো। মাঝারি সাইজের জলজন্তুর মতো ডাঙায় চিৎপাৎ হয়ে রয়েছে সেই বিখ্যাত 'জলি বোট '। রথীন্দ্রনাথ লিখছেন: "[শিলাইদহে] সন্ধে হলেই অন্য সব কাজ ফেলে গান শোনার জন্য সবাই সমবেত হতেন। ... সুরেনদাদার [সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর] হাতে এসরাজ থাকত। জলিবোট খুলে মাঝ-দরিয়ায় নিয়ে গিয়ে নোঙর ফেলে রাখা হত। তারপর শুরু হত গান-- পালা করে বাবা ও অমলাদিদি [অমলা দাশ] গানের পর গান গাইতে থাকতেন।" এত লোক, তার ওপর এসরাজ, তার তুলনায় বোটের মাপ ছোট মনে হোলো,; তবে তেঁতুলপাতার চেয়ে বড়ো, আর ঠাকুরবাড়ির লোকেরা সুজন ছিলেন বলে শুনেছি। তাতেই চলবে।

নিরাশ হতে হোলো ছাদে যাবার চেষ্টায়। দোতলা থেকে তেতলায় ওঠার সিঁড়িটিতে নাকি ফাটল দেখা দিযেছে, সেই কারণে এই সতর্কতা। ছাতেই সেই বার্মিজ ঢঙের চন্দ্রাতপ, প্যাভিলিয়ন, কবির অনেকটা সময় কেটেছিল এইখানে। অদেখা ইয়ারোর কিছু স্বপ্ন নিয়েই ফিরতে হোলো, তবে এভাবে দেখলে ব্যাপারটা হজম করা যায়। এর প্রতিকার করা আজকের প্রযুক্তি কৌশলের কাছে কিছুই নয়, বাংলাদেশে বহু ভালো প্রযুক্তিবিদ আছেন, আশা করি সরকার এতোদিনে সব ঠিক করে তেতলা ওঠার পথটা খুলে দিয়েছেন। অসুবিধের মধ্যে গাইডরা সবসময় জিউলির আঠার মতো সঙ্গে ছিলেন, এই এঁদের কাজ, এতে আপত্তি করা যায় না। তাছাড়া যাঁর শবদেহ থেকে শ্মশ্রু উৎপাটিত হয়েছে, তাঁর মশারীর চাল যে চুরি হবে না, সে গ্যারাণ্টি কে দেবে। তবে একটু সময় একলা থেকে স্মরণ করতে পেলে ভালো লাগতো।

বাইরের আমবাগানই 'দুই বিঘা জমি'-র প্রেরণা, প্রদর্শক জানালেন, যদিও উপেনের সেই গাছটি অনেকদিন গতাসু। বাড়ির সংলগ্ন যে পুকুরটি, সেটির পাড় এখন বোধহয় পুরোপুরি বাঁধানো। রবীন্দ্রনাথের কালে এপাড়ের ঘাটটি বাঁধানো ছিল কুঠিবাড়ির বাসিন্দাদের জন্য। আর অন্য পাড়টা কর্মচারীদের ব্যবহারের জন্য কবি বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন। এদিকের ঘাটে এখন কিছু বসার জায়গাও করে দেওয়া হয়েছে। সেইখানে বসে বিশ্রাম নেওয়া, ছবি তোলা, অনুপস্থিত মন্ত্রীর মুণ্ডপাত (অবশ্যই মার্কিন ইংরেজিতে) ইত্যাদি কিছু অবশ্যকর্তব্য করা হচ্ছে, দেখি এক অন্ধ গায়ক সদলে এসে গান শুরু করলেন আমাদের জন্যই। সদল অর্থে এক বালক, বারো-চোদ্দ বয়স হবে, কোমরে তার বাঁয়া আর তবলা টাঙানো, আর একজন মাঝবয়সী লোক, সে বেহালা বাজায়। গায়ক নিজে বাজান মন্দিরা। তা তাঁরা ভালোই গাইলেন, গুটি বিশেক গান তো হবেই। তার দুয়েকটা বাউল গান আর বাকী সবই রবীন্দ্রসঙ্গীত। স্বরবিতানের সঙ্গে সুরের অমিল শতকরা বিশভাগের বেশি নয় আর বাণীর কোনো অমিল নেই, এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। দেখতে দেখতে বেশ কিছু লোক জুটে গেল, ওই স্কুলের ছেলেমেয়েরা তো এলোই, গ্রামের বেশ কিছু লোক আর বাচ্চারাও হাজির। এদের মধ্যে গুটি তিনচার বাচ্চা আবার গায়কের সঙ্গে গলাও মেলালো। প্রদর্শক বললেন, এই গাইয়ে আমাদের গ্রামেই থাকে, আমাদের ছেলেমেয়েদের গানবাজনা শেখায়, গল্পগাছা শোনায়, আমরা কিছু দিই আর আপনারা এই যে দেন, তাতে চলে যায়। যে তবলা বাজাচ্ছে, সে অনাথ, ওরই সঙ্গে থাকে, পরস্পরের দেখাশুনা করে, আর ওই যে বাচ্চাগুলি গাইলো, তারা ওরই ছাত্র। এটা ভালোই হয়, বুঝলেন না, অন্ধ মানুষ ওকেও কোথাও গাড়িচাপা পড়ে মরতে হোলো না আর আমাদের ছেলেপুলেরাও নানা রকম বান্দরামি না শিখে ভালো গান শিখলো, ভালো কথা শিখলো, হয়তো বড়ো হয়ে কিছু একটা করতে পারবে। এই কথাটা জানার দরকার ছিল, শিলাইদহ-দর্শন, রবীন্দ্রনাথের-শিলাইদহ দর্শন পূর্ণ হোতো না, যদি এই কথাটা জানতে না পারতাম। 'যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন '।

ফেরার পথে আবার সেই বেসুর গান, এবার একটু উদ্দীপ্ত কণ্ঠ, আবার সেই শহীদ মুরগিদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন, আবার বার্জে চড়ে পদ্মাপার, আবার সেই বাচ্চা ছেলেদের ফিরি করা চা আর টা। ফেরার সময় নতুন ব্যাপার দেখি ঝাঁকা ভরা সদ্য-ধরা মাছ-- ইলিশ, গলদা চিংড়ি আরো কী কী সব মাছ-- ফেরি হচ্ছে। হাঁকের দাম, যাকে আমরা আমেরিকায় এম্ এস্ আর্ পি -- ম্যানুফাকচারারর্স সাজেস্টেড রিটেল প্রাইস-- বলি, সে বিশ-বাইশ হাজার টাকা থেকে শুরু। খুব ইচ্ছে থাকলেও শেষে দাম কতোয় নামে তা আর দেখা হোলো না, সঙ্গের মহিলারা এমন কড়কালেন যে 'আমারে কে নিবি ভাই সঁপিতে চাই' গেয়ে পালাবার পথ পাইনে।

প্রায় সাত বছর কেটে গেছে। ২০০৮ সালে ইন্টারনেটে পড়েছিলাম যে শিলাইদহের রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতি নিয়ে বাংলাদেশের কাগজে খুব লেখালেখি হয়েছে, উন্নতির প্রতিশ্রুতিও পাওয়া গেছে। সার্ধ শতবর্ষে বাংলাদেশের সরকার এবং মানুষেরা রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিরক্ষার জন্য অনেক কিছু করছেন, তার মধ্যে সাজাদপুর ও পতিসরের বাড়ির সংস্কারের কথাও পড়ছি। শিলাইদহ নিশ্চয় সে তালিকা থেকে বাদ পড়েনি। আমার বক্তব্য, যদি সময় করতে পারেন তাহলে একবার ঘুরে আসবেন। রবীন্দ্রনাথকে যদি পছন্দ করেন তাহলে শিলাইদহের কুঠিবাড়িও ভালো লাগবে। এখনো পর্যন্ত জোড়াসাঁকোতেই গিয়ে উঠতে পারলেন না বলছেন। কী আর করবেন স্যার, গির্জার বড়ো কাছাকাছি আছেন যে। এই প্রবাসী বা অভিবাসী হয়ে একবার দূরে চলে আসুন, 'কোলের ঝোলের বিপক্ষে দিকে দিকে গর্জিত হলেও' টুক্টুক্ করে জোড়াসাঁকো, এমন কি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালও দেখে ফেলবেন।

সুমিত রায়

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

 

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।