সুচিত্রা-উত্তমের
রহস্যগাথা - নতুন চোখে
গত শতাব্দীর
পঞ্চাশ আর ষাট দশককে বাঙলা রোম্যাণ্টিক সিনেমার স্বর্ণযুগে পৌঁছে
দিয়েছিল একটি সুবিখ্যাত জুটি - সুচিত্রা সেন (রমা দাশগুপ্ত, জন্ম:
১৯৩১) এবং উত্তম কুমার (অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায়, ১৯২৬ - ৮০)। এই
দুর্ধর্ষ জুটির প্রাধান্য এবং জনপ্রিয়তার মূলে ছিলো দুজনের সুন্দর
চেহারা, নাট্য-ক্ষমতা এবং ভারতীয় (বিশেষ করে বাঙালী) দর্শকদের
'যেমনটি চাই তেমনটি' পুরুষ ও নারীর চরিত্র-চিত্রণ। সেই চরিত্র
দুটি হল সুকুমার কৌমার্যের প্রতীক সত্যপরায়ণ আদর্শ পুরুষ এবং অতি-আদর্শবাদী,
সহ্যশীলা, দয়ালু, স্নেহময়ী মাতৃসমা নারী যে জীবনের মূল্য খুঁজে
পায় কোনও বীর যুবকের স্ত্রী, মা বা তার উপদেষ্টার ভূমিকায়। অন্যভাবে
বলতে গেলে, নীতি-পরায়ণ এবং সর্বদা আত্মোত্সর্গ করতে বা ত্যাগ স্বীকারে
প্রস্তুত নারীর চরিত্রে অভিনয় করে সুচিত্রা জনপ্রিয় করে তোলেন
হিন্দুনারীত্বের সারসত্যকে। উত্তমের চরিত্র যেন কঠোর-তপস্বী অzাডোনিস
- এমনিতে সংযত, কর্তব্যপরায়ণ, কিন্তু পৌরাণিক শিবের মত আদিম যৌনপুংগব
।
একদা
হলিউডের প্রখ্যাত পরিচালক বিলি ওয়াইল্ডার রোমান হলিডে-র (১৯৫৩)
নায়িকা অড্রে হেপবার্ন সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন যে, বিধাতা ওকে
সৃষ্টি করে ওর দুই কপোলে চুম্বন করেছিলেন। এই প্রশস্তিটা রূপসী
সুচিত্রারও প্রাপ্য। সুচিত্রা সেনের জয়যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৩ সালে
সাড়ে চুয়াত্তর মুক্তি পাবার পর থেকে। অভিনয়-জীবনে তিনি লক্ষ লক্ষ
পুরুষের হৃদয়হরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ফলে আমাদের দেশে, বিশেষ
করে বাংলার মাটিতে যা হয় - তাঁর জীবনীকারেরা, যেমন সাংবাদিক গোপালকৃষ্ণ
রায় (সুচিত্রার কথা) পূর্ব-বাংলার (অধুনা বাংলাদেশ) পাবনার এই
চিরন্তন নারীকে (femina perennis) প্রায় পুজোর আসনে বসিয়েছেন।
সোমা চ্যাটার্জীর মার্জিত, কিন্তু অতিকথন দুষ্ট সুচিত্রা-জীবনীতে
সুচিত্রার স্বর্গীয় (etheral) ও আলোকোজ্জ্বল (incandescent) সৌন্দর্য,
রাজকীয় ব্যক্তিত্ব, দরদী হৃদয় এবং সর্বোপরি নিগুঢ় আধ্যাত্মিকতার
বর্ণনা - নিতান্তই হাস্যকর উচ্চ-প্রশংসা। স্তুদিবাদ ও মামুলি উক্তির
আধিক্যে ঘোমটার আড়ালে গ্রাম-বাংলার নব-বিবাহিত কনেবৌয়ের মত আসল
রমাই ঢাকা পড়ে গেছে।
কলকাতার চলচ্চিত্রজগতে সুচিত্রা
সেনের আত্মপ্রকাশকে বিচার করতে হবে উত্তর-স্বাধীনতা কালে ভারতের
সমাজ ও সংস্কৃতির নিরিখে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত অভিবাসি ও
উদ্বাস্তুর তুমুল স্রোতে শহুরে ভদ্রলোক সমাজে পাশ্চাত্ব মনোভাব
তেমন করে দানা বাঁধতে পারে নি; বাঙালীদের মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ তখনও
পুরুষ-দমিত গোষ্ঠীতন্ত্রের ঐতিহ্যকে অাঁকড়ে ধরে রেখেছে। ফলত, আদর্শ
নারীর গুণাবলী অপরিবর্তীত রয়ে গেছে পুরুষ-শাসিত সমাজের ব্যবস্থা
মত - সহনশীলতা, আত্মোত্সর্গ এবং আত্মত্যাগের নিগড়ে। সৌভাগ্যক্রমে
সুচিত্রার পরিচালকেরা, যেমন অগ্রদূত (বিভূতি লাহা, ও সহযোগী),
যাত্রিক, অজয় কর, নির্মল দে, প্রভৃতি এই আদর্শ নারীর চরিত্রেই
সুচিত্রা সেনকে উপস্থাপন করলেন। যে ছবিটি সুচিত্রা সেনকে সাধারণের
কাছে প্রসিদ্ধি আনলো, সেটা হল অগ্নিপরীক্ষা (১৯৫৪)। ছবিটি চিরাচরিত
নারীবিদ্বেষী গল্পর উপর ভিত্তি করে - যেখানে স্বামীকে অর্পণ করা
হল সবরকমের সুযোগ-সুবিধা; রামায়ণের রামের মত তাঁকে দেওয়া হল হারানো
স্ত্রীকে নানান কঠিন পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যাবার অধিকার। এই
ভাবেই শুরু হল সুচিত্রা সেনের ফিল্ম-ব্যক্তিত্ব, যেটি পরে বহুবার
ব্যবহৃত হয়েছে।
১৯৫৬ সালে একটি রাত ছবিতে
সুচিত্রা অভিনয় করলেন একটি সরলমতী ফ্লার্ট সান্ত্বনার ভূমিকায়।
ভাগ্যচক্রে সান্ত্বনা তাঁর পূর্বপরিচিত সুশোভনের সঙ্গে গ্রামের
এক পান্থনিবাসে রাত কাটাতে বাধ্য হলেন। সেখানে সান্ত্বনা মাঝেমধ্যে
সুশোভনকে প্রেম-প্রেম ভাবভঙ্গী দেখালেও সুশোভন যখন ঘরের একটা মাত্র
বিছানায় শোবার প্রস্তাব দিলেন, সান্ত্বনা সজোরে জানালেন ওটা অন্যায়,
--- 'এটা ওদেশ নয়, এটা বাংলাদেশ।' বলাবাহুল্য সুচিত্রার বেশীর
ভাগ পছন্দসই চরিত্রই যৌন-অনুভূতি প্রকাশে অপারগ ধর্মধবজী নারীর।
উত্তম কুমার যে সময়ে মহানায়ক
হন, সে সময়ে তাঁর প্রতি জনসাধারণের আকর্ষণের বড় কারণ ছিলো লোকের
চোখে তিনি আদর্শ শহুরে ভদ্রলোক । যেসব ছবিতে উনি নায়কের ভূমিকায়
অভিনয় করতেন, চিত্রনাট্যকার আর পরিচালকদের প্রসাদে সেই চরিত্রগুলি
ছিলো আদর্শবান পুরুষের, যাঁরা নারীর আকর্ষণে বিচলিত হন না, কিন্তু
নায়িকাদের উপর শিশুর মত নির্ভরশীল। এটি বিশেষকরে সত্য ৫০ ও ৬০
দশকে - সুচিত্রা সেন নায়িকা হলে।
অগ্নিপরীক্ষা ( ১৯৫৪), শাপমোচন
(১৯৫৫), সাগরিকা (১৯৫৬), পথে হোল দেরি (১৯৫৭), হারানো সুর (১৯৫৭)
রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত (১৯৫৮), সপ্তপদী (১৯৬১), বিপাশা ৯১৯৬২),
গৃহদাহ (১৯৬৭), হার মানা হার (১৯৭১), নবরাগ (১৯৭১), আলো আমার আলো
(১৯৭২) এবং প্রিয় বান্ধবী (১৯৭৫) ছবিগুলিতে উত্তমকুমারের রোম্যাণ্টিক
আবেদনের মূলে রয়েছ একটি অবিবাহিত রক্ষণশীল পুরুষ (আলো আমার আলো
এর ব্যতিক্রম), যিনি যৌন ব্যাপারে উদাসীন - অর্থাত্, নিরীহ বাঙালী
হিন্দু আদম (Adam)। এই ধরণের চরিত্রের যেটা প্রয়োজন, সেটা হল তাকে
দেখভাল করা, অসুস্থ হলে সেবা দিয়ে সুস্থ করা, এবং পরিশেষে ধীরে
ধীরে সূক্ষ্মভাবে প্রিয়ার নজরে আনা। উত্তমের এই চরিত্রের সঙ্গে
সুচিত্রা সেনের মুখের মর্মস্পর্শী ভাব, নিখুঁত সৌন্দর্যের ডালা
এবং ভুবনমোহিনী হাসি দিয়ে সৃষ্টি হল রোম্যাণ্টিক জুটির ম্যাজিক-মশলা
- যা উদ্বেল করল সেই সময়ের (ঔপনিবেশিকোত্তর) বাংলা তথা ভারতীয়
হৃদয়কে।
সুচিত্রা-উত্তম জুটির প্রধান
বিশেষত্ব হল ওঁদের পরস্পরের কথোপকথনের ধারা। এটাকে আমি বলি 'রোম্যান্স
অন এ টি-পট'। এখানে চা হল প্রেমের তরল ওষধি - যেটিকে আরও মধুরতর
করা হয় যখন প্রথমজন বলেন 'আর চিনি লাগবে কি?' অথবা 'চিনি যথেষ্ট
হয়েছে তো?' আরেকটা পরিচিত দৃশ্য হল, মধ্যরাতে নায়কের বেডরুমে নায়িকার
আগমন এবং নায়িকার এই অসংগত আচরণে রুষ্ট হয়ে নায়কের ক্রোধপ্রকাশ।
সম্ভবতঃ এই ধরণের দৃশ্য প্রথম দেখা যায় প্রমথেশ বড়ুয়ার (১৯০৩-৫১)
দেবদাস ছবিতে। কলকাতার শিক্ষিত বাঙালী বাবুর নিজের পুরুষত্ব সম্পর্কে
ভীতি মূর্ত হয়ে ওঠে যখন ছেলেবেলার সাথি পার্বতী গভীর রাত্রে ঘরে
এসে হানা দেয় প্রেমিকের কাছে ধরা দিতে। প্রেমিকার এই আত্মসমর্পণে
হতবুদ্ধি নপুংসকের প্রত্যুত্তর হল মেয়েটির মাথায় ছিপের বাড়ি মারা
! পার্বতীর কপালে রক্তের ধারাকে দেখানো হল মাথার সিঁদূরের প্রতীক
হিসেবে।
উত্তমকুমারের রূপালী পর্দার
চরিত্র নারীদের প্রতি পুরুষদের এই ধরণের আচরণের উপর ভিত্তি করেই
গড়ে উঠেছে। ওঁর বেশীর ভাগ রোম্যাণ্টিক ছবিতে দেখা যায় নারীর সৌন্দর্য
ও আকর্ষণের প্রতি নিস্পৃহতা এবং প্রেমের কোনও প্রস্তাবে আতঙ্কগ্রস্ত
হয়ে বিরূপভাব প্রদর্শন। ওঁর এই প্রায়-নারীবিদ্বেষী আচরণ, অতি-ন্যায়বান,
অতি-রক্ষণশীল চরিত্রের জন্যেই উনি টলিউডের একজন অসাধারণ জনপ্রিয়
অভিনেতা হয়ে ওঠেন, কারণ এগুলোই আদর্শ বাঙালী ভদ্রলোকের চরিত্রগুণ
বলে ধরে নেওয়া হয়। অন্যপক্ষে, উত্তমকুমার বলিউডের নায়ক-চরিত্রে,
যেখানে পুরুষসিংহ নায়ক নেচে গেয়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছেন, সেখানে নিজেকে
মানিয়ে নিতে পারেন নি।
বাস্তবে বাংলা ছবিতেও যেখানে নায়ক সতেজ সাহসী মিশুকে প্রেমিক পুরুষ,
নিজের পুরুষত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং নিজে থেকে এগিয়ে গিয়ে প্রেম
নিবেদন করতে দ্বিধাগ্রস্ত নন - সেইসব চরিত্রে ওঁকে মানাতো না।
উনি চিরস্মরণীয় ওঁর চিত্তাকর্ষক চেহারা, মৃদুমন্দ্র স্বর, বাংলা
কথা বলার ধরণ ও নিখুঁত উচ্চারণ জন্যে - যদিও ওঁর ইংরেজি উচ্চারণ
দুষ্ট ও প্রায়শই হাস্যকর (জয়জয়ন্তী, ১৯৭১, আলো আমার আলো, নবরাগ)।
মাঝ চল্লিশ থেকে ৫৪ বছর বয়সে মৃত্যু হওয়া পর্যন্ত উত্তমের উচ্চারণ
তার সুস্পষ্টতা হারাতে থাকে (গুজব উনি মদ্যপানে আসক্ত হয়েছিলেন
- হয়তো সেই কারণে), ওঁর শরীরটাও আর টানটান ছিলো না এবং পরচুলা
যে পড়তেন সেটাও বোঝা যেতো। উনি তখন অভিনয় করতেন হালকা হৃদয়ের বয়স্ক
পুরুষের ভূমিকায় (ধন্যি মেয়ে, ১৯৭১, জয় জয়ন্তী, মৌচাক, ১৯৭৫),
অথবা ভিলেনের চরিত্রে (বাঘবন্দি খেলা, ১৯৭৫, স্ত্রী, ১৯৭২, আলো
আমার আলো, রাজা সাহেব, ১৯৮০), কিংবা আত্মঘাতি বিশ্বপ্রেমী (অগ্নিশ্বর,
১৯৭৫) হিসেবে।
সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয়
করে যে অসামান্য সাফল্য উত্তম পেয়েছিলেন, সেইরকম সাফল্য অন্য কোনও
নায়িকার সঙ্গে পান নি। অন্য সুন্দরী ও প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী, যেমন,
সুপ্রিয়া চৌধুরী (পূর্ব-পদবী মুখার্জী) বা অপর্ণা সেনের (পূর্ব-পদবী
দাশগুপ্ত) বিপরীত রোলও ওঁকে তেমন সাফল্য দিতে পারে নি। সুচিত্রা
সেনই উত্তমকে ম্যাটিনি আইডল করে তুলেছিলেন। সুচিত্রা না থাকলেও
উত্তম কুমার নিশ্চয় সুদক্ষ অভিনেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতেন - যদিও
অভিনয়জীবনের প্রথমে এক পরিচালক ওঁকে ফ্লপ মাস্টার জেনারেল নাম
দিয়েছিলেন। রূপলী পর্দায় সুচিত্রা সেনের সঙ্গে জুটি বেঁধেই উনি
বাংলা সিনেমার সোনার ছেলে হয়ে ওঠার সুযোগ পান।
নরসিংহ
প্রসাদ শীল
(সুজন
দাশগুপ্তের সৌজন্যে)
মূল রচনা
The Myth of Uttam-Suchitra Mystique: A Re-Vision-এর অনুবাদ।