গণতন্ত্রের
একটি আবশ্যিক প্রয়োজনীয়তা জননির্বাচিত প্রতিনিধি
আন্না
হাজারের কাছে আমরা সবাই কৃতজ্ঞ - মানুষের সেবা এবং প্রশাসনিক
কাজে স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা আনতে ওঁর নিরন্তর সংগ্রামের জন্যে।
এই মুহূর্তে লক্ষ লক্ষ লোক ওঁর মুখের দিকে চেয়ে আছে এ ব্যাপারে
অনুপ্রেরণা ও পথনির্দেশের খোঁজে। দায়বদ্ধতার অভাব, অব্যবস্থা,
ঘুষ, স্বজনপোষণ – এখন শুধু সরকারী সংস্থার মধ্যে নয় – শিক্ষাক্ষেত্র,
সাংস্কৃতিক-অঙ্গন, ধর্মপ্রতিষ্ঠান, এমনকি এনজিও-র মধ্যেও (যারা
নিজেদের এখন ‘সিভিল সোসাইটি’ বলে পরিচয় দেয় – অর্থদানকারী
বিদেশী এজেন্সিগুলির প্রচলিত নাম ব্যবহার করে) ছড়িয়ে পড়েছে।
আন্না
ভাগ্যবান কারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালাতে নানান শ্রেণীর
বহু লোক এবং সংস্থা উৎসাহী। ছোটখাটো দোকানদার থেকে শুরু করে
আই.টি-র বড় বড় কর্তা, চিত্রতারকা, অবসরপ্রাপ্ত আমলা এবং সাধারণ
গৃহবধূ – সবাই রাস্তায় নেমে পড়েছেন রাজনৈতিক শুদ্ধতা এবং সরকারী
দায়বদ্ধতা দাবী করে। কিন্তু এই আন্দোলন সংগঠন করার পেছনে প্রধান
ভূমিকা নিয়েছে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক জগতের নানান গুরু, যেমন
রবিশংকর এবং বাবা রামদেব – যাঁদের শিষ্য বা অনুরাগীদের সংখ্যা
বহু রাজনৈতিক দলের থেকে বেশী।
ব্যক্তিগত
ভাবে এই আন্দোলনের নেতারা এবং অংশগ্রহণকারীরা আমাদের নির্বাচিত
প্রতিনিধিদের (যাঁরা এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন) যেভাবে
হেলাফেলা করছেন, তাতে আমি উদ্বিগ্ন। আমাদের রাজনৈতিক নেতা
এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অমার্জনীয় অপরাধ আমি কখনোই বরদাস্ত
করি না। দলগত ভাবে তাঁরা আমাদের হতাশ করেছেন। কিন্তু একই ভাবে
আমাদের হতাশ করেছেন আরও অনেকে – বিচার-ব্যবস্থা, পুলিশ ও আমলার
দল এবং আমাদের বহু “ধর্মীয়-আধ্যাত্মিক” নেতৃবৃন্দ। এইসব বিশিষ্ট
লোকেরা রাজনীতিবিদ্দের থেকে কিছুমাত্র কম দুর্নীতিগ্রস্থ
বা অপরাধপ্রবণ নন । কোনও রাজনৈতিক নেতাই ঘুষ নিয়ে বা অপরাধ
করে ছাড় পেতে পারেন না – আমলা, পুলিশ এবং বিচার-ব্যবস্থার
সহায়তা ছাড়া।
এছাড়া
আমাদের মনে রাখা উচিত যে, আমাদের বহু শ্রেষ্ঠ এবং সৎ হিসেবে
পরিচিত নেতারা রাজনৈতিক দল থেকেই এসেছেন। মহাত্মা গান্ধী,
জয়প্রকাশ নারায়ণ, লোকমান্য তিলক, বাবা সাহেব আম্বেদকর – সবাই
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। আজকে যাঁকে মনে করা হয় বিহারে
সবচেয়ে উন্নয়নমূলক পরিবর্তন এনেছেন, তিনি হলেন সেখানকার মুখ্যমন্ত্রী
নীতিশকুমার। উনি বিহারে যা কাজ করছেন, সেটা আন্নার থেকে কিছুমাত্র
কম ঐতিহাসিক নয়। বাবা রামদেব নিজে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে
যুক্ত, কিন্তু তা সত্ত্বেও, তাঁকে এই (আন্নার) আন্দোলনের প্রধান
ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে।
আমরা যারা মহাত্মা গান্ধীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ, তাদের এতো পুণ্যবান
হওয়া সাজে না; নিজেকে পবিত্রতার প্রতিমূর্তি ভাব দেখিয়ে নির্বাচিত
প্রতিনিধিদের, যাঁরা এই আন্দোলনের শরিক হতে চান, বাদ দিয়ে
দূরে সরিয়ে রাখা। ‘ত্যাগ’-এর এই অহংকার – অর্থ এবং রাজনৈতিক
ক্ষমতা থেকে আসা অহংকারের থেকে কিছুমাত্র কম ভয়াবহ এবং ক্ষতিকর
নয়। যখন এই আন্দোলনে চিত্রতারকা এবং অন্যান্য সেলিব্রেটিরা
(যাঁরা সম্ভবত নিজেরাই কর-ফাঁকি দেন এবং নিজের সুবিধার জন্যে
আইন এড়ান) যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে, তখন নির্বাচিত
প্রতিনিধিদের আলাদা করে বাদ দেওয়া কেন – বিশেষ করে তাঁরা যখন
এই আন্দোলনের সামিল হতে চাইছেন?
আমাদের
মনে রাখা উচিত যে আমাদের মত লোকেরাই ‘সিভিল সোসাইটি’-র স্ব-নির্বাচিত
প্রতিনিধি। অনেক সময় এই স্ব-নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই জনসাধারণের
অসন্তোষ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের থেকে অনেক সোজাসুজি পরিষ্কার
ভাবে ব্যক্ত করতে পারে। সময় সময় দেখা গেছে যে নেতারা তা করতে
গেলে, এমন কি গান্ধীর মত বিখ্যাত নেতাকেও আমরা উপেক্ষা করেছি,
এমনকি উপহাস করেছি। তারমানে কি – সেই সব সময়ে জনসাধারণের সমস্যা
নিয়ে কথা বলার অধিকার কি তাঁরা পান নি?
আজকের
এই আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়ে জনগণের বিশাল সাড়া পাচ্ছেন,
তাঁরা যেন জন-প্রতিনিধিদের উপেক্ষা না করেন। এঁরা ভোটারদের
কাছে তাঁদের প্রতিনিধি হবার জন্যে যান এবং ভোটাদের প্রত্যাখ্যান
মাথা পেতে নেন। ভোটের সাহায্যে এইসব প্রতিনিধিদের হটিয়ে দেওয়া
যায়, কিন্তু স্ব-নির্বাচিত প্রতিনিধিদের তাড়াবার কোনও উপায়
নেই, তাঁরা আমাদের কথা শুনুন বা না শুনুন।
গণতন্ত্রপ্রথায়
যতই সমস্যা থাকুক নির্বাচিত প্রতিনিধিরা গণতন্ত্রের একটা অবিচ্ছেদ্য
অঙ্গ । সব জনপ্রতিনিধিদের তুলির এক আঁচড়ে কালিমালিপ্ত করা,
গণতন্ত্রের বিরুদ্ধেই যুদ্ধঘোষণা। সৎ রাজনৈতিক নেতাদের সংখ্যা
এনজিও বা বিচারকদের থেকে কম বা বেশী কোনটাই নয়। নিঃসন্দেহে
আমাদের দেশে গণতন্ত্রে প্রচুর সমস্যা - সৎ লোকদের ভোটযুদ্ধে
জেতা সহজ নয়। আমাদের ভোট-রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতারা অর্থ এবং
বাহুবলের দরুন যতটা উপকৃত হন, ক্ষতিগ্রস্তও হন ততটাই। কিন্তু
রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আমাদের অবজ্ঞা – গণতন্ত্রকেই অবজ্ঞা
করা। রাজনৈতিক নেতারা আন্না হাজারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চর
হবার আন্দোলনে যোগ দিতে পারবেন না , কারণ তাঁরা কালিমালিপ্ত
– এই ঘোষণা – আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অস্পৃশ্য করে
রাখা ছাড়া আর কিছু নয়।
দুর্নীতি,
ঘুষ নেওয়া শুধু রাজনৈতিক নেতা আর আমলাদের একচেটিয়া নয়। এটা
আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের পঞ্চায়েত
দুর্নীতির অগ্নিকুণ্ড। আমাদের জনগণ – ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে
– দুর্নীতিকে জীবনের একটা অঙ্গ বলে মেনে নিয়েছেন। ব্যক্তিগত
স্বার্থসিদ্ধির জন্যে এ ব্যাপারে উদাসীন, অর্থ এবং বাহুবল
আমাদের সমাজব্যবস্থাকে পর্যদুস্ত করেছে। আমরা নিজেরা দুশমনদের
ক্ষমতায় আসার জন্যে দায়ী। অনেকে যাঁরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আজ
দুর্নীতিপরায়ণ রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে চ্যাঁচাচ্ছেন, তাঁরা
নিজেরা অনেকেই কর-ফাঁকি দিচ্ছেন, গৃহ-সংক্রান্ত ও অন্যান্য
আইন ভঙ্গ করছেন, ভেজাল জিনিস বিক্রি করছেন, নানান ছলছুতোর
সাহায্য নিয়ে শাসনব্যবস্থাকে নিজের কাজে লাগাচ্ছেন। এঁদের
জন্যে কিন্তু পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার এই প্রয়াস
ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না। এঁদের মতই রাজনৈতিক নেতারা, যাঁরা অসাধু
উপায়ে এখন নির্বাচনে জয়ী হচ্ছেন, তাঁরাও হয়তো স্বচ্ছ নির্বাচন
প্রক্রিয়ার অংশীদার হতে চাইছেন।
লোকপাল
বিল বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই কিছু কিছু সমালোচনা হচ্ছে। যাঁরা করছেন
তাঁরা আন্নার মতই দুর্নীতির বিরুদ্ধে, কিন্তু তাঁরা একটা বিকল্প
কৌশলের পথ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করছেন। লোকপালকে কেবল একটি অধি-
(supra) প্রশাসনিক সংস্থা বানিয়ে এবং তাকে নিজের ইচ্ছেমত লোক
নিয়োগের পূর্ণ অধিকার দিলেই যে এই নতুন সংস্থা আমাদের আস্থাপূরণ
করে উঠতে পারবে– তার স্থিরতা নেই। উদাহরণস্বরূপ, সুপ্রীম কোর্টের
এবং হাইকোর্টের বিচারপতিদের নিয়োগের অধিকার সরকারের হাত থেকে
সরিয়ে নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের হাতে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু
তাতে দুর্নীতিপরায়ন বিচারপতিদের পদন্নোতি আটকায় নি – প্রধান
বিচারপতি পর্যন্ত পৌঁছেছে।
সমাজের
সর্বস্তরের লোকদের , যেমন, কৃষক, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, চাকুরীজীবি
– প্রত্যেকের ন্যায্য ক্ষোভ ও মতধারা হিসেবের মধ্যে আনতে হবে
– যদি সত্যিই আমরা দুর্নীতি ও অপরাধশূন্য ভারতকে সৃষ্টি করতে
চাই। সেই ভারতে ফেরি-অলা থেকে শুরু করে, কৃষক, দোকানদার, কল-কারখানার
মালিক সবাই তাঁদের কাজ করতে পারবেন ঘুষ না দিয়ে বা আইনের চোখে
ধুলো না দিয়ে।
এটা
মনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন যে, এই বিল-এর বর্তমান রূপ এত বৃহৎ
যে, এটি নিজের চাপেই ভেঙ্গে পড়তে পারে। আন্না নিজে জানেন যে,
বর্তমান প্রশাসন-ব্যবস্থা শুধু দুর্নীতিগ্রস্থ নয়, অকেজোও।
প্রশাসন-ব্যবস্থা, বিচারবিভাগ, পুলিশ এবং নির্বাচন-পদ্ধতির
আমূল সংস্কারের প্রয়োজন – যদি লোকপালকে সত্যি সত্যিই পাহারাদারি
করা এবং অন্যায় প্রতিকারের দায়িত্ব নিতে হয়।
উদাহরণস্বরূপ,
আমাদের মিউন্সিপ্যালিটির অফিস, পুলিশের থানা, সরকারি হাসপাতাল,
বিচারালয় – কোথাও উপযুক্ত শিক্ষিত এবং কর্ম-প্রণোদিত কর্মী
নেই, তাদের দৈনন্দিন কাজে দায়বদ্ধতা মাপা বা উৎসাহ-প্রদানকারী
কোনও ব্যবস্থা নেই। এই অবস্থায় কোনওমতেই লোকপাল বা রাজ্য-লোকায়েত
একা তাদের ওপর ন্যস্ত বিশেষ ক্ষমতার জাদুলাঠি ঘুরিয়ে অবস্থার
পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন না। এ ব্যাপারে কিছু কিছু কাজ ইতিমধ্যেই
হয়েছে। কিন্তু অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রিফর্মস কমিশন বিভিন্ন বিভাগে
যেসব সংস্কারের কথা বলেছেন, সেগুলি বহুবছর ফাইল-বন্দি হয়ে
ধুলোয় আচ্ছাদিত। প্রশাসনিক দক্ষতা সুদৃঢ় করতে সেইসব সংস্কারগুলি
লোকপাল বিল-এর সঙ্গে বিবেচনা করা আবশ্যিক। তা না করা হলে,
লোকপাল অজস্র অভিযোগের সুনামিতে হয় ভেঙ্গে পড়বে, নয় সেগুলিকে
ঝাড়ু দিয়ে সরিয়ে ফেলে পচনশীল আমলাতন্ত্রের আরেকটি অঙ্গে পরিণত
হবে।
মধু পূর্ণিমা কিশওয়ার
মূল রচনা Elected Representatives
are a Quintessential Requirement of Democracy –র অনূবাদ