বিষয় - সৌন্দর্য্য চেতনা
প্রশ্ন-বস্তুগত
সৌন্দর্য্য কি বস্তুনিষ্ঠ না মানবমনের বিভিন্ন ভাবের মাঝে প্র্রকাশিত
।
এ সম্পর্কে আমার মত- সৌন্দর্য্য বোধ মানুষের মনোগত । একটি সুন্দর
বস্তু দর্শনে মনে সেই বস্তু সম্বন্ধীয় যাবতীয় সৌন্দর্য্যে র
প্রতিফলন হয়৷ ফলে ভাবের উদয় হয়৷
এই ভাবই বস্তটির সৌন্দর্য্য জ্ঞানের জনক। এটি চূড়ান্ত ভাবে ভাববাদী
ধারণা (Idealistic concept )। এই ধারনা কীট্স শেলী প্রভৃতি
প্রবাদপ্রতিম কবিদের এবং রবীন্দ্র্রনাথের বহু কবিতায় ব্যক্ত
হয়েছে। এই subjectivism কে মানতে হলে প্রতি ব্যক্তিতে সৌন্দর্য্য
চেতনাও ভিন্ন হবে। যেমন একটি লাল গোলাপ দেখে সবার মনে একই ভাবের
উদয় হয়না। কেউ একটু বেশী সংবেদনশীল হয়ে পড়ে অন্য একজনকে গোলাপটি
অত গভীরভাবে নাড়া দেয়না। এখানে আবার একটি প্রশ্ন আসে – তাহলে
কি সৌন্দর্য্য চেতনার কোনো সাধারণিকরণ হয়না।
এই প্রশ্নের উত্তর খুবই
সংক্ষিপ্তভাবে দেবার চেষ্টা করব, জানিনা কতটা সমর্থ হব। প্র্র্রথমে
আমি গ্রীক দার্শনিক Aristotle এর নন্দনতত্ব সম্বন্ধে কিছু আলোচনা
করব।
Aristotle মনে করেন, যে কোনো শিল্পবস্তুর (work of art) বোধের
জন্য মানবমনের সংবেদনগুলির ভাবসকল মনের সঞ্চরনশীলতার ওপর নির্ভরশীল।
সংবেদনের এই বহিঃপ্র্রকাশ (emotional outburst) সকল মানুষের
মনে একটি তাৎক্ষণিক নান্দনিক আনন্দের(aesthetic pleasure) উৎপত্তির
কারণ। সংবেদনের এই সঞ্চরনশীলতাকেই Aristotle বলেছেন ‘catharsis’.
যেমন একটি নাটক দেখার পর সেই নাটকের কুশীলবদের আচরণে যে ভাব
ব্যক্ত হয় , তা দর্শকমণ্ডলীর মনেও সঞ্চারিত হয়। চরিত্র্রগুলির
সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য হলেও তারা নিজেদের identify করে ফেলে।
এই একাত্মবোধই দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে তাদের মনকে এক অতীন্দ্রিয়
আনন্দবোধের জগতে উত্তরণ ঘটা। Aristotle ‘tragedy”র সংবেদনগুলির
সম্যক ব্যাখ্যা “catharsis ‘ এর মাধ্যমেই দিয়েছেন। Tragedy র
প্রভাব মানুষের মনে যে দুঃখের অনুভূতি আনে তাকেও তিনি “aesthetic
pleasure’ বলেছেন। একেই ভারতীয় আলংকারিকরা বলেছেন রসানুভূতি।
Immanuel Kant এর নন্দনতত্ত্বেও
এই জাগতিক সম্পর্কহীন নিঃস্বার্থ সৌন্দর্যবকে “purposiveness
without purpose” বলা হয়েছে। সুতরাং, পাশ্চাত্য মতে আনন্দ ও
সৌন্দর্যের universalized একটা মাত্রা আছে, তবে তার মধ্যে অতীন্দ্রিয়তা
থাকলেও আধ্যাত্মিকতা নেই ।
এবার ভারতীয় নন্দনতত্বের
আলোচনায় আসা যাক৷
উপনিষদে আনন্দ ও ব্রহ্মকে একাত্ম করা হয়েছে৷ তৈত্তীরিয় উপনিষদে
“রসো বৈ সঃ” – এই শ্লোকে ব্রহ্মকে রসস্বরূপ ও আনন্দস্বরূপ বলে
বর্ণনা করা হয়েছে ৷
পরমেশ্বর সত্য , জ্ঞান , আনন্দস্বরূপ ৷ তিনি জগৎকর্ত্তা ৷ আমরা
তার অংশমাত্র৷ ভারতীয় চিন্তায় সৌন্দর্যতত্ব এই “আনন্দর” ধারণার
ওপর নির্ভরশীল ৷ রসের উৎস যেহেতু পরমেশ্বর , এবং তিনি আনন্দস্বরূপ
– তাই যা সু্ন্দর তাই আনন্দময় ৷
আমি ভারতীয় অলংকারশাস্ত্রের
রসের গভীর আলোচনায় যাচ্ছিনা – তবে ভরত, অভিনবগুপ্ত, আনন্দবর্দ্ধন,
জগণ্নাথ, বিশ্বনাথ কবিরাজ প্রভৃতি আলংকারিক গণই শিল্পময় সৌন্দর্যের
বোধকে রসপ্রতীতীর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন৷
কাব্যিক রসের রমণীয়তা (Plesurableness) কেউ স্বীকার করেছেন –
তাতেই তার তাৎপর্য ৷ কেউ আবার রসপ্রতীতীকে “ ব্রহ্ম-স্বাদসহোদর
“ ( Akin to the realisation of Brahman ) বলেছেন ৷ ভারতীয় সৌন্দর্যবোধে
অতীন্দ্রিয়তা এবং আধ্যাত্মিকতার একটা চমৎকার মেলবন্ধন ঘটেছে
৷
“ Aesthetic delight” বা
নান্দনিক চমৎকারিত্বকে পাশ্চাত্য বুদ্ধিজীবীরা একটি অনন্যসাধারণ
মাত্রা দিয়েছেন এবং এই চমৎকারিত্ব জাগতিক বস্তুর ইন্দ্রিয়গত
ধর্ম থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থাৎ কালোত্তীর্ণ ,অতীন্দ্র্রিয়
(transcendent ) । ভারতীয় দার্শনিকরা একেই লোকত্তর চমৎকারিত্ব
বলেছেন ।
পরিশেষে, আমি এটুকুই বলতে চাই যে, সৌন্দর্যবোধ যখন রসের পর্যায়ে
উত্তীর্ণ হয় তখন তার universal appeal থাকে ।
অজিতা
মুখোপাধ্যায়
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)