ভাষাদিবসে*
এক বাঙালী মায়ের ভাবনা চিন্তাভাবনা
বাঙালী অভিবাসীর
মেয়ে হিসেবে আমি যখন বড় হচ্ছিলাম, তখন আমার মনে হত অতীতকে জানতে
হলে বাংলা জানা প্রয়োজন। আমাকে বোঝানো হয়েছিল, যদি বাংলা বলতে
ও বাংলায় লিখতে-পড়তে পারি, তাহলে বাবা-মায়ের দেশকে ভালোভাবে
জানতে পারবো, এবং পূর্বপুরুষদের সূত্রধরে নিজেকে কিছুটা খুঁজে
পাবো। বাংলা ক্লাসে গিয়ে, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখে, ক্লাবের নৃত্যনাট্যে
অংশ নিয়ে, নানান বাঙালীবাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে, এবং বাড়িতে ইংরেজি
বলা চলবে না এই নিয়ম থাকায়, ছোট থেকেই আমি অনর্গল বাংলায় কথা
বলতে শিখেছিলাম। তারওপর ছোটবেলায় প্রায়েই কলকাতায় যেতাম বলে
নিজেদের সংস্কৃতি ও বাঙালিয়ানা সম্পর্কে আমার একটা ধারণা গড়ে
উঠেছিল। আমি বাঙালী তাই আমি আমি বাংলায় কথা বলি, আমি বাংলায়
কথা বলি, তাই আমি বাঙালী - আমার বাবা-মার কাছ থেকে পাওয়া মূল্যবান
নানা জিনিসের মধ্যে এটাও একটি।
আমি যখন মা হলাম, তখন অবশ্য
আমি বুঝলাম আমার এতদিনের চিন্তাধারা: বাংলা আমার অতীত এবং পূর্বপুরুষের
সংস্কৃতির সঙ্গে যোগসূত্র - এটা যথেষ্ট নয়। আমি বুঝতে পারলাম,
আমার ছেলেমেয়েরা আমার থেকে অনেক খারাপ বাংলা শিখে বড় হবে; বাংলায়
লিখতে পড়তেও শিখবে না; এমন কি নিজেদের বাঙালী বলেও ভাববে না।
আমাদের অভিবাসী সমাজের যেটা সবচেয়ে ভয়াবহ চিন্তা যে, তাদের ভাষা
ও সংস্কৃতি পরবর্তী প্রজন্মে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে - সেটাই
সত্য হবে। আর আমি নিজে কি করেছি? আমি নিজেই বাঙালী সম্প্রদায়ের
বাইরে গিয়ে একজনকে বিয়ে করেছি!
তবে সম্ভবত:, সেটাই বাঁচোয়া।
কোনও বাঙালী, এমন কি কোনও দক্ষিণ ভারতীয়কে বিয়ে না করে, একজন
জার্মান ইমিগ্র্যাণ্টের ছেলে বিয়ে করার ফলে বিয়ের পর পরই আমি
ভাবতে সুরু করলাম, আমাদের বাচ্চা হলে কী ভাবে তাদের বড় করব।
কী করে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে উঠবে। কী ভাবে তারা বাংলা-জার্মান-আমেরিকান
ঐতিহ্যকে নিজেদের মধ্যে মিশিয়ে নিতে পারবে? আমরা দুজনেই স্থির
সিদ্ধান্তে এলাম - সেটা হবে ভাষার মাধ্যমে। আমরা তাদের ভাষা
শেখাবো প্রবল আতিশয্য ও আগ্রহ নিয়ে। নিজেরা অভিবাসীদের ছেলেমেয়ে
হওয়ার দরুন আমরা জানি যে, ভাষা শেখা ও রপ্ত রাখা খুবই কঠিন।
আমাদের পরিচিত অনেকেই মাতৃভাষার উপর দখল হারিয়েছে, ফলে হারিয়েছে
নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগসূত্র। তবে আমরা ঠিক করলাম,
এই ভাষাশিক্ষা শুধু অতীতকে আঁকড়ে রাখার জন্য নয়, এটা হবে ভবিষ্যৎ-এর
জন্যে। জন্ম থেকে বাংলা ও জার্মান শিখে, আমাদের ছেলেমেয়েরা বড়
হবে বিশ্বনাগরিক হিসেবে। তাদের যোগসূত্র শুধু জার্মান এবং বাঙালীদের
সঙ্গে হবে না এই যোগসূত্র হবে আন্তর্জাতিক ও আন্তর্সাংস্কৃতিক
- যুক্ত থাকবে বিশ্বের সবার সঙ্গে। তাদের সাংস্কৃতিক স্বত্বা
আধা বাঙালী, আধা জার্মান ও বেশির ভাগ আমেরিকান হয়ে জগাখিচুড়ি
হবে না - বরং তাদের স্বত্বা প্রতিনিয়ত জোরদার হবে এই হিসেবে
যে তারা যতোটা বাঙালী, ততোটাই জার্মান, এবং ততোটাই আমেরিকান
এবং সর্বোপরি তারা এই বিশ্বের মানুষ।
যে পথ আমরা বেছেছি সেটা
সহজ নয়, কিন্তু এতে প্রাপ্তিও প্রচুর। যেহেতু আমার স্বামী শুধু
জার্মান ভাষায় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলে, আমার সাড়ে তিন বছরের
ছেলে আমাকে মাঝেমাঝে বোঝায়, "মামা, পাপাগাই মানে কাকাতুয়া।"
আর যেহেতু আমি শুধু বাংলায় ওদের সঙ্গে কথা বলি, অনেক সময়ে আমার
দেড় বছরের কন্যা তার বাবাকে বলে, "টুপি দাও, টুপি দাও",
তারপর আর না পেরে বলে, "পাপা হুট!" হ্যাঁzা, আমরা
প্রতি শনিবার একঘণ্টা ড্রাইভ করে ইউ.এন-এ জার্মান ক্লাসে বাচ্চাদের
নিযে যাই। এবং প্রতি রবিবার দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ করে নিউ জার্সির
একটা চমৎকার বাংলা স্কুল, মৃত্তিকা-তে যাই। এই বহুভাষাত্বর দর্শনে
বিশ্বাসী হওয়ার দরুন আমাদের নিজেদের অল্পবিস্তর অসুবিধাও হয়।
আমাদের ছেলেমেয়েরা যত দ্রুত ভাষা আয়ত্ব করছে, আমরা ততো দ্রুত
শিখে উঠতে পারছি না। আমাদের ছেলেমেয়েদেরই অনেক সময়ে আমাদের তর্জমা
করে বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমাদের নিজেদের ভাষাজ্ঞানও যে যথেষ্ট শক্ত
নয় সেটা ওদের প্রশ্নে মাঝেমাঝেই ধরা পড়ছে। আমরাও শিখছি। আমার
নিজের বাংলায় দক্ষতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আমি আমার বাবা-মাকে চাপ
দিচ্ছি শুধু বাংলায় কথা বলা নয়, বাচ্চাদের জন্য বই, ভিডিও আর
গানবাজনার সিডি দেশ থেকে জোগাড় করে আনতে। ইণ্টারনেটের দৌলতে,
আমি ইংল্যাণ্ড থেকে প্রচুর ইংরেজি-বাংলা বই পেয়েছি, পেয়েছি কলকাতায়
তৈরি ছোটদের জন্য বাংলা কার্টুন; আর রয়েছে বাংলা গান যা আমি
সবসময়েই চালাই, কারণ ওদের বড় করতে হবে বাংলাভাষার জগতে।
আমার এগুলো বলার উদ্দেশ্য
যে, আমি জানাতে চাই এটা করা সম্ভব।
আমার এগুলো বলার উদ্দেশ্য যে, আর কেউ আমার মত আছে কিনা খুঁজে
বার করা, যারা পেছনের দিকে না তাকিয়ে ভবিষ্যৎমুখী; যারা ভাষা
ও সংস্কৃতিকে দেখছেন পরিবর্তনশীল, কিন্তু অজস্র সম্ভাবনাময় সম্পদ
হিসেবে। আমি এগুলো বলছি, কারণ পৃথিবী ছোট হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু
সেটা যেন সম্পূর্ণ একরকম বা সমসত্ব না হয়ে যায় - ইংরেজি অন্যান্য
মাতৃভাষাকে ধ্বংস না করে। আমি এগুলো বলছি, আমার মা-বাবার জন্যে
- যারা দেখেছেন যে আমি বাংলা শিখি, আর আমার স্বামীর জন্যে -
যে খেয়াল রেখেছে আমি যেন সেটা ভুলে না যাই। আমি এগুলো বলছি,
কারণ আমি একজন মা; আমি আমার মাতৃভাষার জন্য লড়াই করতে চাই, কারণ
এই ভাষা শুধু আমার নয়, আমার বাচ্চাদেরও।
সায়ন্তনী
দাশগুপ্ত
ফেব্রুয়ারী ২১, ২০০৮
*১৯৫২
সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের চারজন তরুণ মাতৃভাষার জন্য
শহীদ হন। তাঁদের স্মরণে রাষ্ট্রসংঘ এই দিনটিকে 'আন্তর্জাতিক
মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে ঘোষণা করেছে।