বিশেষ
সংখ্যাঃ রবি-স্মরণ - শ্রবণে, শ্রাবণে
চলতি বাস্তবের ছোঁয়া
বিকাশ
বসু
‘অরণ্যের
দিনরাত্রি’ তে দীপ্তি ত্রিপাঠির নাম উল্লেখ অপরিহার্য ছিল না,
গল্পের দিক থেকে। লেখক যে বানানো কোন গল্প বলতে বসেননি, বন্ধুদের
সঙ্গে তাঁর দিনরাত্রি কেমন কাটছে সেই সংবাদটুকুই দিচ্ছেন এমনি
এক ভাব ফোটাতে এই চলতি বাস্তবের এক টুকরো ছোঁয়া দিলেন গল্পের প্রথমেই।
এই এক টুকরোতেই অনেক কাজ হয়ে গেল। উপন্যাস লেখার পোশাকি ভাবটা
চলে গিয়ে সে জায়গায় গল্প বলার ঢঙে একটা আটপৌরে ভাব এল।
সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায় অন্যত্র ও এই রীতির সাহায্য নিয়েছেন। যেমন তাঁর ‘অর্জুন’
উপন্যাসে চিত্রাভিনেতা জুটি উত্তম-সুচিত্রার নাম তো আছেই, ‘রাইকমল’
ছবির নায়িকা কাবেরী বসুর উল্লেখ আছে। এঁদের কারো নাম উল্লেখ গল্পের
দিক থেকে অমোঘ বা অপরিহার্য ছিলনা, অথচ এর ফলে গল্প জীবনের অনেক
কাছাকাছি চলে এসেছে। সেটাই লেখকের অভিপ্রেত।
রবীন্দ্রনাথ
ও তাঁর শেষের দিকের লেখায় এই রীতির সাহায্য নিয়েছেন। ইংরেজী সাহিত্যলালিত
এক আধুনিক কবির বাংলা ব্যাকরণ পড়ে শিলঙে ছুটি কাটানোর মত অত্যাশ্চর্য
ঘটনায় পাঠক একটু চমকে ওঠে, অমিতের চরিত্রের অপূর্বতা আরো একটু
বিশদ ও প্রত্যক্ষ হয়। সেটা লেখকের একটি উদ্দেশ্য। সেইসঙ্গে সুনীতি
চাটুজ্জে – অর্থাৎ একজন জীবিত ভাষাবিদের নামোল্লেখে লেখকের কলারীতিগত
আর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হয়। সেই বিশেষ কলারীতির নাম দেওয়া যেতে
পারে – ‘চলতি বাস্তবের ছোঁয়া’।
এক্ষেত্রে
বোধহয় একটা নিয়ম আছে – যেখানে সত্য নাম উল্লেখ অসমীচীন, অশোভন
সেখানে কল্পিত নামই বিধেয়। যেমন শেষের কবিতায় সুনীতি চাটুজ্জে,
অবনী ঠাকুর, আইনস্টাইনের আসা-যাওয়া, কিন্তু রাজনীতিকের বেলা কল্পিত
নাম তারিণী তলাপাত্র – কারণ তাঁর সম্পর্কে মন্তব্যটি সুমধুর নয়।
‘শেষের
কবিতা’য় এই রীতির একটু বাড়াবাড়িই হয়েছে বলতে হবে। দেখা যায় উপন্যাসের
অন্য এক নায়ক শোভনলাল যায় রবীন্দ্রনাথের কাছে, তাঁর খাতা থেকে
মুষ্টিভিক্ষা করে আনে, (ছোট কবিতা বা কবিতার টুকরো টাকরা, রেখে
দেয় নায়িকা লাবণ্যের দৃষ্টির নাগালের মধ্যে, যদি সে তুলে নিয়ে
কৃতার্থ করে শোভনলালকে।
এদিকে
শিলং পাহাড়ে এসেও অমিত সেই ‘একের অভাবে’ সমান বিরহী, কিন্তু তার
সেদিনকার বিচিত্র পোশাকে তাকে ঠিক অবনী ঠাকুরের আঁকা যক্ষের মত
দেখতে হল না – মনে হতে পারত রাস্তা তদারক করতে বেরিয়েছে ডিস্ট্রিক্ট
ইঞ্জিনীয়ার। লক্ষণীয়, যে কোন বিরহী যক্ষ নয়, অবনী ঠাকুরের আঁকা
যক্ষ, কেন-না শিল্প সংস্কৃতির জগতে তা ছিল এক বিশেষ ঘটনা।
তারপর
নায়িকা লাবণ্যর বাবা অবনীশ দত্তকে সমালোচনার জন্য মডার্ন রিভিউ
থেকে লোভনীয় বই পাঠানো হয়। লাবণ্যর বাবা যে রকম পণ্ডিত মানুষ তাতে
মডার্ন রিভিউর সম্পাদক যোগ্য কাজে যোগ্য লোক বেছে ছিলেন তাতে সন্দেহ
নেই। তবে ব্যাপারটা সত্যি সত্যি নিশ্চয়ই ঘটেনি। ঘটনা নয়, তবে অবাস্তব
নয়। মোটামুটি ঘটমান বর্তমানের একটা ছবি পাওয়া যায়। অন্তত: চলতি
বাস্তবের ছোঁয়া তো বটেই, যে ছোঁয়া লেগে জীবন ও সাহিত্যের সীমারেখা
মুছে যায়।
খাঁটি
গল্পের মধ্যে এভাবে খাঁটি সমসাময়িক লোকজনেদের পেয়ে গেলে পাঠকদের
ভালোই লাগে। অবশ্য চলতি বাস্তবের এই ছোঁয়ার মধ্যে মিথ্যে গল্প,
বানানো কথা, পুরে দিলেও ক্ষতি নেই। বরং সেটাই বড় আর্ট। যেমন তিনসঙ্গীর
‘রবিবার’ গল্পের নায়িকা বিভার আদিত্যমামা গণিতের অধ্যাপক অমরবাবুকে
সাহায্য করবার উদ্দেশ্যে
“ওঁর
কষা একটুখানি প্রব্লেম পাঠিয়েছিলেন আইনস্টাইনকে, যা উত্তর পেয়েছিলেন
সেটা আমি (বিভা) দেখেছি।”
গল্পের
চরিত্র বাস্তব মানুষের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করছে ব্যাপারটা মিথ্যে
হলেও বেশ বিশ্বাসযোগ্য। রবীন্দ্রনাথ যখন এই গল্প লেখেন আইনস্টাইন
তখন রীতিমত জীবিত। গল্পের মধ্যে তদানীন্তন বাঙ্গালী গণিত অধ্যাপকদের
কেউ যদি তাঁর সঙ্গে চিঠি চালাচালি করেনই, অন্তত: সাহিত্যে দোষের
কিছু হয়না। বরং কিছু লাভ হয় সাহিত্যেরই – ঘটমান বর্তমানের স্বাদ
আসে গল্পে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আমলের বিশ্ববিখ্যাত জীবিত এক বিজ্ঞানীকে
ছোট্ট এক চরিত্র হিসেবে ঢুকিয়ে দিলেন তাঁর গল্পে। এভাবে তিনি যে
গল্পের বাস্তবকে সমসাময়িক বাস্তবের সঙ্গে মিলিয়ে এক করে গল্পে
নতুন স্বাদ আনলেন, তাকে কি বলব, ঘটমান বর্তমানের স্বাদই বলা যায়।
এই কারণে ‘ল্যাবরেটরী’ গল্পের নায়ক রেবতী ভট্টাচার্যের যে বিজ্ঞানী
এডিংটনের সঙ্গে চিঠি চলে তাতে তার নিজের কোন লাভ যদি নাও হয়, পাঠকের
লাভ যথেষ্ট।
এই
রীতিতেই ‘শেষ কথা’ গল্পে হেনরী ফোর্ড রীতিমত একটি চরিত্র। ফোর্ডের
মুখে কিছু সংলাপ ও পুরে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।
'ফোর্ড
চাপা হাসি হেসে বললে 'আমার নাম হেন্রি ফোর্ড, পুরাতন ইংরেজি নাম।
আমাদের ইংলণ্ডের মামাতো ভাইরা অকেজো, তাদের আমি কেজো করব - এই
আমার সংকল্প।'
একই
গল্পে বিশ্ববিখ্যাত ভাস্কর জেকব এপস্টাইন রয়েছেন, অবশ্য তাঁর মুখে
কথা নেই উপভোগ করার মত, তা হোক। নায়ক নবীনমাধবের নিজের কথাই বেশ
উপভোগ্য –
‘এপস্টাইন
পাথরে আমার মূর্তি গড়তে চেয়েছিল, সময় দিতে পারিনি।’
এদিকে
বাংলা অন্যান্য গল্পলেখকদের নায়করা অনেকদিন থেকেই রবীন্দ্রকাব্যের
ভক্ত এরকমই দেখা যায়। তারা নায়িকাদের রবীন্দ্রবাবুর কবিতাপাঠে
উৎসাহিত করে আসছেন ঠিক কবে থেকে? প্রভাতকুমারের গল্পে আছে – নায়িকার
অসুখের সময় নায়ক তাকে শুধু সেবা শুশ্রূষাই করেনা, রবীন্দ্রকাব্য
গ্রন্থাবলী পড়তে দেয়। সেও এক ধরণের শুশ্রূষা, তদুপরি নায়িকার চিত্তপ্রকর্ষ
ঘটানো বোধকরি নায়কের অন্যতম উদ্দেশ্য। গল্পটির রচনাকাল ১৩১৩ সাল।
তখনো রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পাননি।
নিজের
লেখায়, একমাত্র শেষের কবিতা ছাড়া, রবীন্দ্রনাথ নিজের নাম উল্লেখ
করেননি। তবে চার অধ্যায়ে তাঁর কবিতা ‘সেদিন চৈত্রমাস’ এসেছে অন্তু-
এলার এক চমকের চিত্র পরিচয় কাহিনীর নেপথ্য বর্ণনায়, শুধু কবির
নামটি অনুল্লেখিত। রবীন্দ্র কাব্য পাঠকের কাছে এও এক চলতি বাস্তবের
ছোঁয়া,। তাদের বুঝতে বাকি থাকেনা অন্তু-এলা রবি যুগের মানুষ।
জীবন
আর শিল্প সাহিত্যকে যতটা পারা যায় কাছাকাছি এনে ফেলা, এ বোধহয়
বিশেষ করে এ যুগেরই ব্যাপার। ঋত্বিক এই কাজ করেছেন তাঁর শেষ ছবিতে।
ঐ ছবিতে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গল্প ‘শিল্পী’র উল্লেখ
আছে। তিনি যে শিল্প সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন না, স্রেফ আটপৌরে জীবনকে
অগোছালো ধরে দিচ্ছেন, আগাগোড়া ঐ রকম ভাব নিয়ে ঋত্বিকের ছবিটি তোলা
– ও ছবি যেন গোটাটাই চলতি বাস্তব।
চলতি
বাস্তবের স্পর্শ দেবার জন্যই রবীন্দ্রনাথের কলমে এসে যায় আনন্দবাজার
পত্রিকা।
‘আনন্দবাজার’
হতে সংবাদ উচ্ছিষ্ট ঘেঁটে ঘেঁটে ছুটির মধ্যাহ্ন বেলা বিষম বিতর্কে
যায় কেটে – (এপারে – ওপারে / নবজাতক)
ওডিকোলন মুড়ে নিল এক পুরনো
আনন্দবাজারে । (বাসা বদল / সানাই)
সাজসজ্জাহীন
জীবন এভাবে গল্প কবিতায় উঠে এলে একটা বাড়তি রস পাওয়া যায়। বিভূতিভূষণ
বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শিবরাম চক্রবর্তীর বন্ধুত্ব উল্লেখ করার
মত কিছু ব্যাপার ছিলনা। তবু শিবরাম সুযোগ বুঝে সে বন্ধুত্বের উল্লেখ
করেছেন তাঁর এক গল্পে। গল্পের নাম – ‘গাছের বিড়ম্বনা’। আর গাছ
মানেই তো বিভূতিভূষণ। সেই গল্পে আছে –
‘তবে
গাছেদের কতটুকুই বা আমি জানি আমি। কবুল করতে হয় আমায় – এ সব জানতেন
আমার বন্ধু বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায় মশাই, গাছের ধার ধারতেন তিনি।
- তিনি এখন নেই’।
এ
এক বিশেষ কলারীতি, কখনো বাস্তবের মানুষের শুধু নামোল্লেখ করা,
কখনো সেই মানুষকে গৌণ চরিত্র হিসেবে উপস্থিত করা। রবীন্দ্রনাথ
শেষ বয়সে এই রীতিতে রীতিমত চলে এসেছিলেন, জীবন ও সাহিত্যের সীমারেখা
মুছে এক করে দিতে চেয়েছিলেন, শুধু গল্পে উপন্যাসে নয়, কবিতায়ও।
একটি
কবিতার শুরুই এই ভাবে – ‘তোমার শেষ গল্পের বইটি পড়েছি শরতবাবু’।
কবিতার নায়িকা শরৎচন্দ্রের পাঠিকা। শুধু তাই নয়, ঐ কবিতায় গোড়া
থেকে শেষ পর্যন্ত শরৎচন্দ্র একটি চরিত্র হয়ে থাকেন। শরৎবাবুর কলমের
জোরেই কবিতার সাধারণ মেয়ে (প্রত্যাখ্যাত নায়িকা) একদিন বিদেশ পাড়ি
দেয়, সেখান থেকে সত্যিকার জ্ঞানী গুণীদের স্বীকৃতি ছিনিয়ে নিয়ে
আসে, আর আমাদের অসাধারণত্ব লোভী নায়ক আচ্ছা জব্দ হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথের
এই ‘সাধারণ মেয়ে’ অবশ্য তার নিজের অভীপ্সাতেই শেষ পর্যন্ত অসাধারণী
হয়ে ওঠেন, তবুও নারীবাদী অপরাজেয় লেখক হিসেবে শরৎচন্দ্রের চরিত্রও
বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এ কবিতায় শরৎচন্দ্রের উপস্থিতি রীতিমত স্বাদু।
শরৎচন্দ্র যত শক্তিশালী লেখকই হন, তাঁর এক কলমের খোঁচায় সাধারণীর
অসাধারণী হয়ে ওঠা সম্ভব নয় জেনেও এমন এক ঘটনার কথা ভাবতে ভালো
লাগে।
জিনিষটা
আবার ঐ বিশেষ গঠনচাতুর্যের কারণে বিশেষ মজারও। আরো মজার হয় লেখক
যখন নিজের নামোল্লেখ না করে নিজেরই দোষগুণ, কীর্তি-অকীর্তির কথা
জানান পাত্র পাত্রীদের মুখ দিয়ে। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘শেষকথা’
গল্পের নায়িকা অচিরা বলছে নায়ক নবীনকুমারকে – ‘বাংলা সাহিত্য
বোধহয় আপনি পড়েন না। কচ ও দেবযানী বলে একটা কবিতা আছে। তাতে’
– ইত্যাদি।
এখানে
অচিরা এভাবেও বলতে পারত -‘বাংলা সাহিত্য বোধহয় আপনি পড়েন না।
রবিঠাকুর নামে একজন কবি আছেন। কচ ও দেবযানী নামে তাঁর একটা কবিতা
আছে। তাতে’ – ইত্যাদি।
এ
জিনিষ শেষ কথা গল্পে পাওয়া যায় না। কিন্তু ‘শেষের কবিতা’য় পাওয়া
যায়, যেখানে রবিঠাকুর রীতিমত চরিত্র, যেখানে গল্পকে চলতি বাস্তব
বলে ভ্রম হয়।
শেষপর্বের
লেখায় সমসাময়িক, পাঠকের পরিচিত, মানুষের আনাগোনা ও নামোল্লেখ রবীন্দ্রনাথের
কলমে অতি সহজ ব্যাপার হয়ে এসেছিল, তবে আদিতেই এর শুরু। ‘চোখের
বালির’ বিনোদ বৌঠান যে উপন্যাস পাঠ করেন তা হয় ‘বিষবৃক্ষ’ না হয়
‘কৃষ্ণকান্তের উইল’। ‘নষ্টনীড়ে’ ও তাই। তাঁর বহু গল্পের পরিবেশ
ঠাকুরবাড়ীরই পরিবেশ, আর সেই পরিবেশে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন এক সদা-উল্লেখিত
লেখক, তাঁর উপন্যাসগুলি ছিল সেখানে পাঠ্যবস্তু ও আলোচনার প্রধান
বিষয়। অন্যভাবে বলা যায় বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন তাঁদের বাড়ির অনুপস্থিত
সদস্য। একারণ আদি পর্বে রবীন্দ্রনাথের গল্প-উপন্যাসে প্রায়শই বঙ্কিম
একটি চরিত্রের মত আনাগোনা করেন। সমসাময়িক বাস্তবতাকে ধরে দেবার
জন্যেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গল্পে, উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্রের জায়গায়
কোন কল্পিত লেখকের বা উপন্যাসের বানানো নাম ব্যবহার করেননি।
‘নষ্টনীড়ের’
সঙ্গে ‘দর্পহরণ’ গল্পের এক অর্থে বেশ মিল। ঠাকুরবাড়ীর অন্দরমহলে
সাহিত্যচর্চা – তাই নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রতিযোগিতা ও মান
অভিমান, এই নিয়ে গল্প। এই গল্পে ‘বঙ্কিমবাবু’ নামটি পাওয়া যায়,
কিন্তু যে মাসিক পত্রের উদ্যোগে গল্প প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়,
তার নাম ‘উদ্দীপনা।’ বঙ্গদর্শন বা অবোধবন্ধু নয়। এসব ক্ষেত্রে
বোধহয় সমকালীন কোন মাসিক পত্রের নাম ব্যবহার শোভন ও সঙ্গত নয় বলে
কবি ধরে নিয়েছেন, বানিয়ে নিয়েছেন এই ‘উদ্দীপনা’ নাম। তাঁর দীর্ঘ
গল্প’সে’ তে কিন্তু ‘রঙমশাল’ পত্রিকার উল্লেখ আছে। তাছাড়া তাঁর
গল্পে ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকার নামও পাওয়া যায়। চলতি বাস্তবের অংশ
হিসেবেই। যেমন –‘কেউ কোথাও নেই, ভাবছি আনন্দবাজারে বিজ্ঞাপন
দেব। (হারিয়ে যাওয়া সে কে খুঁজে আনার জন্য)
রবীন্দ্রনাথ
শেষ বয়সে ‘সে’ নাম দিয়ে রহস্যময় দারুণ এক মজাদার চরিত্র বানিয়ে
এই লম্বা গল্পটি লিখেছিলেন। এখন যে মানুষ ‘সে’ , যার সঙ্গে গেছোবাবার
দেখা হয়, তার সঙ্গে রয়েছে এমন কয়েকটি চরিত্র যারা একেবারে সমসাময়িক
মানুষ। এই গল্পে পুথির পাতা ও জীবনের পাতা যেন লুটোপুটি। ‘সে’
র এক বন্ধু হলেন সুধাকান্তবাবু যে ‘সে’র কাছ থেকে মোচার ঘণ্ট তৈরি
শিখতে চায়। এদিকে এই গল্পে আর এক চরিত্র সুকুমার –
‘সুকুমার
চাইলে সে ছবি আঁকা শেখে নন্দলালবাবুর কাছে’।
তারপর
‘সে’
গান শুনতে যায় দিনদার ওখানে, দিনদা তখন তাকিয়া ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে!
(দিনেন্দ্রনাথ
কি সত্যি সত্যি তাকিয়া ঠেস দিয়ে ঘুমোতেন, আমার জানা নেই)।
ডাঃ
নীলরতন সরকার এই গল্পের একটি চরিত্র। এখানেও তিনি ডাক্তার হিসেবে
বাস্তব জীবনের মত সমান সফল। তবে চিকিৎসা পদ্ধতির বোধহয় কিছুটা
পরিবর্তন ঘটেছে। ‘সে’র যখন টিকি গেল কেটে নীলরতন সরকার তখন সন্ন্যাসী
দত্ত বজ্রজটী মলম লাগিয়ে সেই টিকি ব্রহ্মতালুর সঙ্গে জুড়ে দিলেন।
‘সে’ গল্পের যে বাস্তবতা, তা আজগুবি বাস্তবতা – সেইজন্যই সম্ভবত:
সত্যিকারের নাম-ধামের এমন বাধাবন্ধনহীন মিশেল, চলতি বাস্তবতার
ছোঁয়ার এমন নিঃশেষিত ব্যবহার।
লেখক পরিচিতি - বিকাশ বসু (১৯৩৪ – ২০১২) - বাংলার সুখ্যাত প্রাবন্ধিক,
গল্পকার ও কবি। এই লেখাটি তাঁর গ্রন্থ (বিকাশ বসু গদ্যসংগ্রহ,
প্রতিভাস থেকে প্রকাশক ও সত্ত্বাধিকারির অনুমতিগ্রহণ পূর্বক পুনঃপ্রকাশিত।
প্রতিভাস এর যোগাযোগ – ফোন - +(91)-33-25578659,
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।