ভারতবর্ষে
গাড়ি চালানো
কিছুদিন আগে
ফেসবুক-এ ভারতবর্ষে গাড়ি চালানো নিয়ে একটা ছোট্ট লেখা বেরিয়েছিল।
লেখক একজন বিদেশী - নেদারল্যাণ্ডের বার্ন শহরের আর্কিটেক্ট।
বছর দুই চাকরিসূত্রে ভদ্রলোক ভারতবর্ষে কাটিয়ে গিয়েছিলেন - দেশের
হালচাল তাই মোটামুটি জানেন। ইদানীং বিদেশী যদু-মধু অনেকেই ভারতবর্ষে
চাকরি করতে আসেন। কেউ কেউ ভারতে এসে গাড়ি চালানোর বাসনাও রাখে।
সেই সব বিদেশীদের সতর্ক করাই ছিল লেখাটির উদ্দেশ্য। ইঞ্জিনিয়ারদের
কাছে যেরকম লেখা আশা করা যায় (নিজে একজন বলেই জানি!) - লেখাটা
সাজানো গোছানো নয়, খাপছাড়া কিছু তথ্যের (? - প্রশ্ন চিহ্ন দেওয়া
হয়েছে, কারণ অতিশয়োক্তি থাকলেও এগুলোর মধ্যে সত্যতাও বেশ কিছু
আছে।) সমষ্টি। ইঞ্জিনিয়ার বলেই বোধহয়, তথ্যগুলি যে সার্বরাষ্ট্রিক
নয় সেটা প্রথমেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে - ওঁর এই ক্ষুদ্র
নিবন্ধটি মোটামুটি ভারতবর্ষের সব প্রদেশের জন্যেই প্রযোজ্য শুধু
বিহার ছাড়া – কারণ বিহারে গাড়ীর বাইরে থাকাটাও খুব একটা নিরাপদ
নয়! নীচে লেখাটির যে অনুবাদটি দেওয়া হল, সেটা কোন মতেই আক্ষরিক
নয়, মোটামুটি লেখকের বক্তব্য অনুসরণ করে লেখা। চেষ্টা করেও লেখকের
নাম পাই নি। অনুবাদ প্রকাশের জন্যে যে অনুমতি পাই নি – বলাই
বাহুল্য।
---------------
ভারতের রাস্তার
নিয়মাবলী মোটামুটিভাবে ‘কর্মফল' দ্বারা নিয়ন্ত্রিত – ড্রাইভার
তার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাবে, কিন্তু ফলাফল নির্ভর করবে ইন্সিওরেন্স
কোম্পানির ওপর। যাক সে কথা...
প্রথমত,
রাস্তার কোনদিক দিয়ে গাড়ি চালাবেন ?
উত্তর হবে
দুদিক দিয়েই। শুরু করবে্ন বাঁদিক দিয়ে – যদি সেদিকটা ফাঁকা থাকে।
ফাঁকা না পেলে ডান দিক দেখুন – সেটা ফাঁকা কিনা। একটু ফাঁক পেলেই
সেখানে ঢুকে পড়তে হবে। তারপর চেষ্টা করে যেতে হবে যেদিকে একটু
ফাঁক আছে, সেখানে চট করে ঢুকে পড়া – অনেকটা দাবা খেলার মত। শুধু
খেয়াল রাখবেন আপনাকে যেতে হবে ঠিক কোনদিকে – মানে আপনার গন্তব্যস্থল।
এগোতে হবে নিজের সহজাত বুদ্ধি বা instinct-এর ওপর ভরসা রেখে
। রাস্তার নিয়ম মেনে চলতে গেলে অহেতুক দুর্গতি বাড়বে – বিশ্বাস
করুন মৃত্যুও ঘটতে পারে। বেশীর ভাগ ড্রাইভাররাই এদেশে অত হিসেব
করে গাড়ি চালায় না, মোটামুটি একটা দিক ঠিক করে নিয়ে সেইদিকে
ধাবিত হয়। না, না, ঘবড়াবেন না, নিরুৎসাহিত হয়ে নিজের ওপর আস্থা
হারাবেন না। মনে রাখবেন, পুনর্জন্ম শুধু ছিল না, এখনো রয়েছে
এবং অন্যান্য ড্রাইভাররাও আপনার থেকে কিছুমাত্র সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে
নেই।
পথচারী দেখলে গাড়ি থামাবার
চেষ্টা করবেন না। একটা মুর্খ যদি রাস্তা পার হতে চায় – সেটা
তার সমস্যা, আপনার নয়। বিবেক? বিবেকের তাড়নায় যদি একান্তই চান
- অবশ্যই থামাতে পারেন; তবে জেনে রাখবেন তার অবশ্যম্ভাবি ফল
কি হবে! পেছনের গাড়ি আপনার বিবেককে রেয়াত করবে না, সোজা এসে
ধাক্কা মারবে। এদেশের পথচারীরা ছেলেবেলা থেকেই শিক্ষা পেয়ে এসেছে
- গাড়ি যখন খু-উ-উ-ব আস্তে আস্তে চলছে বা কোনও মন্ত্রী আসছে
বলে একদম থেমে রয়েছে, তখনই শুধু রাস্তা পার হওয়া যায়। দুয়েকজন
ইডিয়ট যদি সেই সুশিক্ষা উপেক্ষা করে রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা
করে ... যাক গে, যারা মৃত - তাদের এইভাবে গালমন্দ করাটা অনুচিত।
হর্ন ইউরোপে কদাচিৎ ব্যবহার
করা হয় – এটা ঠিক। মাঝে মাঝে যখন হয় - সেটা প্রতিবাদ জানানোর
জন্যে। কিন্তু ভারতবর্ষে হর্নের ব্যবহার লাগাম ছাড়া। কেন জানি
না, সরকারী নির্দেশে ট্রাকের পেছনে লেখা থাকে ‘আওয়াজ দাও’ বা
‘হর্ন বাজাও’। যাদের অক্ষর পরিচয় নেই, তারাও হর্ন বাজায় - হর্সোচ্ছ্বাস,
বিভাব, বিরক্তি, রোমান্স বা কামভাব (এক্ষেত্রে প্যাঁক প্যাঁক
করে শুধু দুটো হর্ণ) প্রকাশের জন্যে। এছাড়াও হর্ণ বাজানো হয়
এবং সেটা খুবই যুক্তিসঙ্গত কারণে। উদ্দেশ্য, রাস্তায় শুয়ে থাকা
ঘুমন্ত গরুদের বিরক্তি উৎপাদনের করা - যাতে তারা উঠে রাস্তা
ছেড়ে দেয়।
ভারতবর্ষে গাড়িতে পড়ার
মত কিছু বই রাখা আবশ্যিক। মুখ্যমন্ত্রীর গাড়িবাহিনী যাবার সময়ে
ট্র্যাফিক জ্যামে আটকা পড়লে কিংবা রাস্তায় জমা বৃষ্টির জল না
সরা পর্যন্ত গাড়িতে বন্দি থাকাকালীন এই বইগুলো খুব কাজে লাগে।
ভালোকথা, মাঝে মাঝে চোখে পড়বে – নানা রকম আলো জ্বলছে নিবছে,
ভেতর থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ বেরোচ্ছে! মনে হতে পারে UFO দেখছেন
– আসলে তা নয়। এগুলো হচ্ছে তীর্থযাত্রীদের বাস। অদ্ভুত আওয়াজটা
আসছে, কারণ তীর্থযাত্রীরা ভেতরে বসে তারস্বরে ভজন গাইছে! ব্রহ্মস্থানে
তীর্থযাত্রীদের পোঁছে দেওয়ার জন্যে এই বাসগুলো চলে বিদ্যুৎগতিতে।
ফলে অনেক সময় পথেই অগ্রিম ব্রহ্মত্ব প্রাপ্তি ঘটে!
মাঝে মাঝে চোখে পড়বে –
one way street-এর সাইন। এগুলো দেওয়া হয় ড্রাইভারদের বিস্বাদ
জীবনে একটু ঝাঁঝ আনার জন্যে। এটাকে আক্ষরিক অর্থে ধরে শুধু একদিকে
চলতে হবে মনে করলে ভুল হবে। এটাকে বিচার করতে আধ্যাত্মিক ভাবে
– অর্থাৎ একই সময়ে দুদিকে যাওয়া যাবে না। সুতরাং নিশ্চিন্ত মনে
চলুন। আপনি যদি আইনভীরু ও খুঁতখুঁতে স্বভাবের লোক হন, তাহলে
সাইন মেনে ব্যাক গিয়ারেই গাড়ি চালান – অসুবিধার কিছু নেই।
এসব পড়ে কেউ কেউ হয়তো ভাবছেন
আমি একটু বেশী রকমের ছিদ্রান্বেষী । তাহলে দেশটা সম্পর্কে দুয়েকটা
পজিটিভ কথা বলি। গাড়ির গতি কমানো নিয়ে এরা খুবই সতর্ক। যেসব
অঞ্চলে লোকেদের বসবাস, সেখানে কোনও মতেই দ্রুত গাড়ি চালানো যায়
না। ওখানকার রাস্তায় প্রত্যেকটা বাড়ির জন্যে দুটো করে স্পিড-ব্রেকার
থাকে। এই উঁচু স্পিড ব্রেকারগুলো সৃষ্টি হয়েছে জল আর ড্রেনপাইপ
ঢাকা দেবার জন্যে। ওগুলোর ওপর সাধারণত পীচ ঢালা হয় না। কারণটা
ঠিক জানি না, তবে মনে হয় এর সঙ্গে কর্পোরেশনের হিসেব নিকেশের
ব্যাপার জড়িত। অডিট করার জন্যে বছরের শেষে পাইপ গুনতে ওগুলোকে
বোধহয় একবার করে তুলে নিয়ে যেতে হয় !
আপনার হার্ট উইক থাকলে
অন্য কথা, কিন্তু ভারতবর্ষে রাত্রে গাড়ি চালানো চেঙ্গিস খান টাইপের লোকের পক্ষে
একটা অন্তহীন আনন্দ-উত্তেজক অভিজ্ঞতা।
একদিক থেকে এটা রাশিয়ান রুলেট খেলা, ড্রাইভারদের মধ্যে কার বন্দুকে
গুলি আছে তার কোনও ধারণাই আপনার নেই! দূর থেকে যেটা দেখা মনে
হতে পারে অসময়ে দিনের আলো দেখা দিচ্ছে, সেটা আসলে একটা ট্রাক
ওয়ার্ল্ড স্পিড-রেকর্ড ভাঙ্গার জন্যে ক্ষেপণাস্ত্রের গতি নিয়েছে!
কাছাকাছি এলে তার সঙ্গে মোকাবিলার চেষ্টা না করে রাস্তা ছেড়ে
মাঠের মধ্যে নেমে পড়ুন, যতক্ষণ না দুর্যোগটা না মিলিয়ে যায়।
মনে রাখবেন, এখানে রাস্তার ধারে গাড়ি রাখার জায়গা থাকে
না। থাকে শুধু মাঠ, বা বড় বড় পাথরের চাঁই।
চোখ ধাঁধানো হাই-বিম দেখে
সেটাকে লো-বিম বা ডিম করার জন্যে গাড়ির হেডলাইট ব্লিঙ্ক করলে
ঘোড়ার ডিম হবে! ট্রাকের সেই ড্রাইভারের যদি হাই-বিম লো-বিমের
তফাৎটা জানাও থাকে, গাড়িতে ওঠার আগেই কয়েক পাত্তর বে-আইনী চোলাই
গিলে সে অন্য জগতে আছে! আপনি হয়তো জানেন না, ভারতে ট্রাক ড্রাইভাররা
সবাই নিজেদের মনে করে জেমস বণ্ড – তাদের খুন করার অধিকার রয়েছে!
এক সময়ে আপনি হয়তো দেখবেন
একটা তীব্র আলো – রাস্তা থেকে প্রায় ছফুট উঁচুতে। এটা কোন স্পেশালি
বিল্ট সুপার মোটর বাইক নয় – এটা একটা সাধারণ ট্রাক – শুধু একটা
হেড লাইট জ্বলছে। সাধারণত যেটা জ্বলে সেটা বাঁদিকের হেডলাইট।
তবে সেটা ডান দিকেরও হতে পারে। ঠিক কোনটা জ্বলছে জানতে চাইলে
কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করতে পারেন – তবে সত্যটা উপলব্ধি হবে
মরণের পরে।
ট্রাকের এইসব ব্যাপারগুলো
ঘটে কিন্তু রাত্রে – হাই ওয়েতে। দিনের বেলা, ট্রাকদের ভাল ভাবেই
দেখতে পাওয়া যায়। তবে এদেশে ট্রাক-ড্রাইভাররা কোনও সিগন্যাল
দেওয়াতে বিশ্বাসী নয়। বাঁচতে হলে আপনাকেই সর্বদা খেয়াল রাখতে
হবে তারা কোনদিকে যেতে চাচ্ছে। মাঝে মাঝে অবশ্য দেখবেন, পাশে
যে খালাসী বসে আছে - সে হাত বার করে উন্মাদের মত সেটা নেড়ে চলছে।
ভুলেও ভাববেন না ওটা বাঁদিকে যাবার সিগন্যাল। গরমের জন্য গা
ঠাণ্ডা করতে ঐভাবে ওরা হাত-পা নাড়ে।
এটা পড়ার পরেও যাদি আপনার
বাসনা থাকে ভারতবর্ষে গাড়ী চালানোর, তাহলে আমি বলব, রাত ৮ থেকে
১১-টার সময় চালান। ওই সময়ে পুলিশরা বাড়ি চলে যায়, আর নাগরিকরা
সংবিধান প্রদত্ত ‘গতি-স্বাধীনতা’ (freedom of speed - যা বাক-স্বাধীনতার
মতই একটা মানবিক অধিকার) উপভোগ করতে পারে।
পরিশেষে বলি, এসব সত্ত্বেও যান-দুর্ঘটনায়
মৃত্যুর হিসেবে ভারতবর্ষ কিন্তু আমেরিকা বা ইউরোপের থেকে পেছনে!
লেখক
– অজ্ঞাত
ভাবানুবাদঃ – সুজন দাশগুপ্ত
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।