ই-জঞ্জাল
সভ্যতার প্রারম্ভে
আগুনের ব্যবহার থেকে পৃথিবীতে দূষণের সূচনা। দূষণ থেকে দূষিত
পদার্থ । দূষিত পদার্থ জমা হতে হতে একদিন হঠাত্ নতুন সমাধান
- দূষিত পদার্থ পুনর্ব্যবহারযোগ্যকরণ। " জঞ্জাল থেকে লাভ"
ব্যাপারটায় মানুষের একটু বেশীরকমের আগ্রহ। তবে ভবিষ্যতের পুরাতত্ত্ববিদ
নিশ্চয় দেখবেন যে বিংশ শতাব্দির শেষ পর্যায়ে সারা বিশ্বে একধরনের
নতুন জঞ্জাল ছড়িয়ে থাকবে যার নাম ই-জঞ্জাল। প্রায় চল্লিশ বছর
আগে কম্পিউটার চিপ প্রস্তুতকারী সংস্থা ইনটেলের সহ-সর্বাধিকারী
দেখেছিলেন যে বিশ্বে কম্পিউটার তৈরীর ক্ষমতা বছরে দ্বিগুন হয়ে
যাবে। মুরের সূত্রের উপপাদ্য অনুযায়ী প্রতি দু বছর অন্তর প্রচুর
সংখ্যায় অব্যবহৃত কম্পিউটর জমা পড়বে। শুধু উপপাদ্য নয়, ঘটনাচক্রে
এটি সত্যি হয়ে উঠেছে। ইউ এস এন্ভারনমেন্টল প্রোটেকশন এজেন্সি
(ই পি এ) র মতে সামনের কয়েক বছর পর অন্তত তিনশ থেকে আটশো লক্ষ
কম্পিউটারের জীবন শেষ হবে। এই তালিকায় শুধু কম্পিউটার নয় আছে
আরও অনেক ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য। ২০০৯ সালে ডিজিটাল টেলিভিশন বাজারে
আসায় অন্তত ২৫০ লক্ষ পুরোনো টেলিভিশন যুগোপযোগী থাকবে না। গত
২০০৫ সালে ফ্যাশন প্রিয় আমেরিকায় ৯৫০ লক্ষ কাজ করছে এমন সেলফোন
বাতিল করা হয়েছিল। ই পি এ র পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০৫ সালে ১৫
থেকে ১৯ লক্ষ টন ওজনের বর্জ জমা হয় - যার তালিকায় কম্পিউটার
থেকে শুরু করে সেলফোন সবকিছুই ছিল। তথ্য অনুযায়ী শতকরা ৭০ ভাগ
বাতিল কম্পিউটার এবং মনিটর এবং শতকরা ৮০ ভাগ বাতিল টেলিভিশন
ল্যাণ্ডফিলে ফেলা হয়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ম অনুযায়ী এমন
ব্যাপকহারে ল্যাণ্ডফিল জমা করা নিষিদ্ধ কারণ এই সমস্ত ই জঞ্জালে
মার্কিউরি, আর্সেনিক প্রভৃতি রাসায়নিক দূষিত পদার্থ আছে। ইপিএর
তথ্য অনুসারে অব্যবহৃত টেলিভিশন, কম্পিউটার, সেলফোনের সংখ্যা
প্রায় ১৮ কোটি। তর্কের খাতিরে ধরা যায় এই ১৮ কোটি অব্যবহ্রত
ইলেকট্রনিক্স ল্যাণ্ডফিলে জমা না পড়ে লোকের বেসমেণ্টের শোভাবর্ধন
করছে, তবুও তা যথেষ্ট ক্ষতিকারক। তবে বিষ ছাড়াও ই-জঞ্জালে পরিমাণ
মত সোনা, রূপা এবং অন্যান্য মূল্যবান ধাতু থাকে, যেগুলি খনিতে
পাওয়া আকর থেকেও বেশী বিশুদ্ধ। সেই কারণে ঘনিয়ে এসেছে আরেক বিপদ।
বর্তমানে ২০ শতাংশেরও কম ই জঞ্জাল, পুনর্ব্যাবহারের জন্য পরিশোধিত
হয়। দুঃখের কথা এই যে রিসাইক্লিং কোম্পনী বা মিউিসিপালিটিতে
জমা করলেও এগুলি ক্ষতিকারক পদার্থের তালিকা থেকে বাদ পড়ে না।
তাহলে কি পরিণিতি হয় এদের। বাকী ৮০ ভাগ ই-জঞ্জালই বা যায় কোথায়।
তার আগে ই-জঞ্জালের পরিসংখ্যানের উপর চোখ বুলিয়ে নেওয়া দরকার।
টেলিভিশন ১৩.৪ শতাংশ
মনিটর ২৪.৫ শতাংশ
প্রিণ্টার , কিবোর্ড ২৬.১ শতাংশ
ডেস্কটপ ১৬.১ শতাংশ
ল্যাপটপ ২৬.১ শতাংশ
সেলফোন ১৯.২ শতাংশ
এগুলিতে যেসব বিষাক্ত ধাতু
থাকে সেগুলি হল লেড, বেরিয়াম, ক্রোমিয়াম, মর্কারি, বেরিলিয়াম
প্রভৃতি।
এবার আসা যাক প্রশ্নের
উত্তরে। এই যে বলা হল সোনা রূপা মূল্যবান ধাতু থাকে ই-জঞ্জালে।
এই প্রাপ্তি থেকে লালিত হয়েছে ই-জঞ্জাল চালান ব্যবসা। উন্নত
দেশ্গুলি থেকে প্রতিবছর টন টন ই-জঞ্জাল চালান হয় উন্নয়নশীল বা
অনুন্নত দেশে। আইনের চোখে ধূলো দিয়ে বা য্থার্থ আইনের অভাবের
সুযোগ নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘণ করে ঘানা, চীন, ভারত পাকিস্তান
প্রভৃতি দেশে বেড়ে উঠেছে ই-জঞ্জাল থেকে ধাতু নিষ্কাশন ব্যবসা।
১৯৮৯ খ্রীষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত ১৭০ জাতির বাসেল কনভেনশন অনুসারে
উন্নত দেশ্গুলির দরকার উন্নয়নশীল দেশ্গুলিকে ক্ষতিকারক দূষিত
পদার্থের পরিবাহন সম্পর্কে অভিহিত করা । যদিও বিভিন্ন পরিবেশ
উন্নয়ন সংস্থা এবং অনুন্নত দেশের প্রতিনিধিদের মতে এ একটি দুর্বল
আইন এবং ১৯৯৫ সালে প্রতিবাদের জেরে "বাসেল ব্যান"
নামে একটি নতুন আইন সংযোজন হয় যাতে দেশ্গুলিতে ক্ষতিকারক দ্রব্যের
পরিবাহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদিও বাসেল নিষেধাজ্ঞা এখনও কার্যকরি
করা হয় নি। তবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এটিকে তাদের নিজেদের আইনের
সাথে সংযোজন করে। এতকিছু সত্ত্বেও টন টন ই-জঞ্জাল প্রতিবছর ইউরোপের
বন্দরগুলি দিয়ে উন্নয়নশীল দেশ্গুলির বন্দরে ঢোকে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে
অবশ্য ই-জঞ্জালের আইনী প্রাধান্য অনেক কম । হাইতি ও আফ্গানিস্তান
ছাড়া আর মাত্র এই দেশ বাসেল কনভেনশনে স্বাক্ষর করলেও তেমন কোনও
আইনি ব্যবস্থা নেয় নি। বাসেল ব্যান নেটওয়ার্ক নামক একটি প্রতিরোধী
সংস্থার প্রতিনিধি জিম পাকেটের মতানুযায়ী আমরা উন্নতদেশের নাগরিকরা
এইসকল প্রযুক্তির সুফল ভোগ করি কিন্তু যন্ত্রগুলি খারাপ হলে
আমরা উন্নয়নশীল দেশ্গুলির দিকে এর কুফল ঠেলে দিই। এশিয়া মহাদেশে
হাইটেক জগতের বেশীরভাগ জিনিস তৈরী হয় এবং এগুলি নষ্ট হলে আবার
ফিরে আসে। বহুদিন ধরে চীনদেশ এই হাইটেক জগতের কারখানা বলে বিবেচিত
হয় এসেছে। চীনের বন্দরগুলি যেন সারা পৃথিবীর ইলেকট্রনিক জঞ্জাল
জড়ো করার প্রবেশপত্র। করোনা ভিশন নামক টেক্সাসস্থিত পুনর্ব্যবহার
কার্যকরী সংস্থার অধিকর্তা ভ্যাণ্ড আল নরউড যদিও আধুনা চীনে
পাঠানোর বিরুদ্ধে তবে তাঁর মতে অন্যান্য পুনর্ব্যবহার কার্যকারী
সংস্থাগুলি মনে করে এটি পরিবেশের অবস্থার উন্নতি করবে কারণ শুধু
যে এইসকল উন্নত যন্ত্র পুনর্ব্যবহার যোগ্য হবে তাই নয়, এতে করে
অর্থনীতিতেও ভাল ফল পড়বে। তবে ২০০২ সালে বি এ এন এর প্রকাশিত
একটি তথ্যচিত্র ভ্যাণ্ডালের এই ধারনা মাটি করে দেয়। চীনের একটি
ছোট শহর উইউতে তোলা এই তথ্যচিত্রে দেখানো হয় হাজার হাজার পরিবারের
বাচ্চা বুড়োসহ বয়সের সদস্য কম্পিউটারের তার এবং সারকিট গলিয়ে
তামা ও সীসা বের করার মত বিপজ্জনক কাজে লিপ্ত। বি এ এনের এই
তথ্যচিত্র সারা বিশ্বকে সচকিত করে। তবে চীন সরকার ব্যবস্থা হিসেবে
ই-জঞ্জালের নিষেধতালিকা বৃদ্ধি করেন এবং চীনের স্থানীয় সরকারগুলিকে
এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকরী করা আদেশ দেন। চীনে হাইটেক আবর্জনা আমদানী
শুরু হয় ১৯৯০ সালে এবং ২০০৩ সালে সেই আমদানী সর্বোচ্চ চূড়ায়
পৌঁছায়। তারপর ২০০৫ সালে নিষেধাজ্ঞা জরি করে এটি কমানো হয়। চীনে
এইসব জায়গাগুলির বাতাসে সবচেয়ে বেশী ডাই-অক্সিন পাওয়া যায়। পিছিয়ে
নেই ঘানা, পাকিস্তান এবং ভারতবর্ষ। ভবিষ্যতে আকরা, তাইজাও, করাচী,
দিল্লী প্রভৃতি স্থান ই-জঞ্জালের প্লাবণ থেকে বাঁচানোর একমাত্র
উপায় হল ই-জঞ্জালের নিয়মানুগ দায়িত্বপূর্ণ সুষ্ঠ পুনর্ব্যবহারযোগ্যকরণ
নীতি।
মৈত্রী
রায় মৌলিক