বিশেষ
সংখ্যাঃ রবি-স্মরণ - শ্রবণে, শ্রাবণে

এলেম
নতুন দেশে
পল্লব
চট্টোপাধ্যায়
১ -
প্রস্তাবনা
এক
পাড়াতুতো দাদার পড়ার বইয়ে কবিগুরুর লেখা একটি অদ্ভুত রচনা কৌতূহলবশত:
পড়ে ফেলেছিলাম, 'একটা আষাঢ়ে গল্প'। এক দেশের রাজপুত্র-কোটালপুত্র-সদাগরপুত্র
মিলে এক অচেনা দ্বীপে উদ্ভট কিছু মানুষের সন্ধান পায়, যারা তাসের
পরিচয় নিয়ে থাকে এক জীবন্মৃত জাতি হয়ে। সহজেই বোঝার গল্প, কিন্তু
কিছুই বুঝিনি তখন। যখন সময় এলো, দেখি সিলেবাস, বই সব বদলে গেছে।
তার বছর দুই পরে 'তাসের দেশ'এর রেকর্ড আসে বাড়িতে। ওমা, দেখি এতো
সেই গল্প, একটু বদলে গীতি-নাটকের রূপ দেওয়া হয়েছে। নাটকটার মধ্যে
একটা অভিনবত্ব ও উন্মাদনা ছিল, যার ফলে ওটা আমার প্রিয় গীতি-নাট্য
হয়ে দাঁড়ায়।
বছর
দু-তিন পরের কথা। তখন আমি ইঞ্জিনিয়ারিংএর দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা
দিয়ে বসে আছি আর অবসর সময়ে বোনের গানের শিক্ষিকার কাছ থেকে এক-আধটা
স্বরবিতান চেয়ে নিয়ে এসে আমার প্রিয় গানগুলি তোলার চেষ্টা করছি।
ব্যাপারটা সহজ নয়, তখন তো আর ইয়ু-টিউবের যুগ ছিলনা যে ইচ্ছেমত
যে কোনো গান শুনে নেব আর ক্যারাওকে দিয়ে গাইব। যা হোক, আমার উত্সাহে
ঘাটতি ছিল না।
তখন
আমাদের পাড়ার বন্ধুবর্গের মধ্যে একটা উঠতি বয়সের বখাটে-মার্কা
প্রবৃত্তি দেখা দিয়েছিল, তাই এখানে কারো আসল নাম উল্লেখ করছি না,
ভালো-মন্দ নির্বিশেষে। তবে পরিবেশ ও সুযোগ পেলে যে তারা ভালো কাজ
করে দেখিয়ে দিতে পারে, তার প্রতিশ্রুতি সে বারই পেয়েছিলাম, একটা
অবাক করা অনুভূতির মধ্যে দিয়ে। একদিন সকালে দুলালদের বারান্দায়
আড্ডা দিচ্ছি। ও বলছিল ওর খুড়তুত বোন নীতা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে
এসেছে দুর্গাপুর থেকে, গরমের ছুটিটা এখানেই কাটাবে। মেয়েটা ভালো
নাচে, মাস-ছয়েক আগে ওরা 'তাসের দেশ' স্টেজ করে এসেছে দুর্গাপুরে।
সবাই মিলে চেষ্টা করলে এখানকার রবীন্দ্র-পরিষদের স্টেজে ওটা নামানো
যাবে না? আমি তো শুনে লাফিয়ে উঠলাম, কেন হবে না? এখন তো সবার ছুটি।
পাড়ার লোকেদের যদি সাহায্য পাওয়া যায়, বিশেষ করে বন্ধুদের, তাদের
ভাই-বোন-মা-বাবাদের, চেষ্টা করতে দোষ কি!
ব্যস,
সেই মুহূর্তে একটা টাস্ক ফোর্সের ‘কোর টীম’ তৈরি হয়ে গেল। দুলাল
যোগাড়ে ছেলে, তাছাড়া ও লিটল থিয়েটার গ্রুপে নাটক করে, ও অভিনয়
আর ছেলেমেয়ে যোগাড় করার দায়িত্ব নিল। মাইল তিন দুরে থাকে আমাদের
আরেক বন্ধু ভুট্টা, অদ্ভুত নাম হলেও দারুণ আবৃত্তি করে। লম্বা-চওড়া
কালো চেহারা, ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গত রবীন্দ্র-জয়ন্তী অনুষ্ঠানে
যখন 'কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কি পাও' আবৃত্তি করেছিল, মনে
হয়েছিল স্বয়ং অমিত রায় নেমে এসেছে শিলং পাহাড় থেকে। সেই প্রথম
মেয়েদেরকে পাবলিকলি 'সিটি' মারতে দেখেছিলাম। তা ভুট্টা তো এককথায়
রাজপুত্র করতে রাজি। আর একটু দুরে থাকে তীর্থ, বয়স একটু কম, আবৃত্তিতে
তারও জুড়ি ছিল না, সে রাজি হলো সদাগরের রোলে। কিন্তু ওরা তো কেউ
নাচতে পারে না! তখন ঠিক হলো, নাচের পার্টি থাকবে আলাদা, তারা শুধু
'লিপ' দেবে।
গান-আবৃত্তি-অভিনয়
হবে ব্যাক-স্টেজ থেকে। কিন্তু এটা কি করা উচিত, পরামর্শ নিতে ছুটলাম
বিলুকাকুর কাছে। ওনার বাবা বিশ্বভারতীর অধ্যাপক ছিলেন, পুরো শান্তিনিকেতনীয়
পরিবেশে মানুষ, তিনি শুনে বললেন, এরকম তো হয় বলে শুনিনি। যদিও
তাসের দেশ গুরুদেবের শেষ বয়সের রচনা, তবু মনে আছে, নন্দলাল, শান্তিদেব,
দিনুদা, অমিতাদি, মোহরদি এনারা নাচ গান অভিনয় সব একসাথে করতেন।
পরে গানের দল আলাদা হলো। মনে পড়ে তাসের দেশের রিহার্সেলে জর্জদার
উদ্দাম 'বাঁধ ভেঙ্গে দাও' এর সাথে কেলু নায়ার ছাড়া আর কেউই নাচতে
পারছিলেন না, শেষমেষ গানটার থেকে শান্তিদা জর্জদাকেই বাদ দিয়ে
দিলেন। যাহোক, ওনার সামনে নীতা আর ওনার মেয়ে বুড়ি রাজপুত্র-সদাগরের
অভিনয় করে দেখল, সাথে ভুট্টা-তীর্থর সংলাপ, দেখে বিলুকাকু মুগ্ধ।
বা:, এটা তো বেশ হচ্ছে, চলুক তাহলে।
ব্যস,
আমাদের আর পায় কে! গানে থাকলাম পুরুষকন্ঠে আমি, মিন্টু আর শান্ত।
আমার গলা তেমন নয়, তবে স্টেজে উতরে যাব, এ ভরসা ছিল। সঞ্জয়দাকে
ধরেছিলাম, ওসব ছেলেমানুষিতে আমি নেই, বলে কেটে পড়লেন। দুটি বাচ্চা
ছেলে, জয় ও বুবাই(দুলালের ভাই) দের রাখা হলো পঞ্জা- ছক্কার রোলে।
ওরা বেশ জমিয়ে তুলল, পিছন থেকে সংলাপ পড়ছিলাম আমি আর দুলাল, ঠিক
রেকর্ডের মতই কেটে কেটে। প্রথম দিকে নাচের ছেলে-মেয়ে যথেষ্ট পাওয়া
যাচ্ছিল না, কিন্তু পরে দেখা গেল, এত মা-বাবা তাঁদের বাচ্চাদের
নিয়ে আসছেন যে বাছাই শুরু করতে হলো। তবু একজন হোমরা-চোমরা রাজা
দরকার, নাচতেও হবে না তাকে। একদিন আমাদের উপরতলার শ্রীমতি বাগচী
এসে বললেন, 'ওই রোলটা রবি ঠাকুর আমাকে ভেবেই লিখেছিলেন', এবং সত্যি,
তিনি বেশ মানিয়েও গেলেন। রুইতনের জন্যে নেওয়া হলো তাপ্তী বলে একটি
মেয়েকে- নাচে ভালো, মিষ্টি চেহারা, কিন্তু মুখে সদাই একটা কান্না-কান্না
ভাব। আর থাকলো দুলালের বোন তন্বী, দেখতে সাদামাটা, কিন্তু ক্লাসিকাল
নাচে পারদর্শী, ও থাকলো রুইতনী আর পত্রলেখার জোড়া ভূমিকায়; এদের
কথায় পরে আসছি।
২ - মহড়া
কথা
হলো রবীন্দ্র-পরিষদের সাথে। রবীন্দ্র-জয়ন্তীর আর দেরী ছিল না,
তাই স্টেজ পাওয়া গেল তার পরের রবিবারে। তাতে অবশ্য আমাদের ভালই
হলো, কিছুটা সময় পাওয়া গেল প্রস্তুতির। এবার দরকার একজন দক্ষ পরিচালকের,
যিনি ভুল-ভ্রান্তিগুলো ধরিয়ে দিতে পারবেন, অথচ কেউ গোলমাল পাকাতে
পারবে না। তাই এক সন্ধ্যাবেলা আমি প্রদীপকাকুর বাড়ি হানা দিলাম।
উনি ফিজিক্সে ডক্টরেট হলেও সর্বশাস্ত্রে পণ্ডিত, যেতেই বললেন,
আমি তো ক্ল্যাসিকালের ভক্ত, রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যাপারে তোর কাকিকে
ধর। কাকিমা স্নানে গেছেন, তাই তিনি গ্রামোফোনে একটা রেকর্ড চড়িয়ে
দিয়ে বললেন, শোন, রবি ঠাকুরের ওরিজিনাল গলা, এইমাত্র একজন শুনতে
দিয়ে গেল। শুরু হলো, 'গান কণ্ঠে নিলাম, আমার শেষ পারানির কড়ি'।
'গান গেয়ে তারে ভোলাব' পর্যন্ত হতেই ভেতর থেকে কাকিমার গলা
পেলাম, ওটা কে গাইছে, বন্ধ কর, ইস, রবীন্দ্রসঙ্গীতের বারোটা বাজিয়ে
দিলে। এমন সব লোকে আজকাল রেডিওতে চান্স পায়! বলতে বলতে বাইরের
ঘরে এসেই আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লজ্জায় পড়ে গেলেন। তাইত, এতো
গুরুদেবের গলা। ভাবুন দেখি, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর
মেয়ে, রবীন্দ্রসঙ্গীতের অসামান্য জ্ঞান, আর তিনি কিনা! যাক, বিশেষ
কিছু করতে হবে না শুনে শ্রীমতি মিনু ঘোষ পরিচালিকার দায়িত্ব নিতে
রাজি হলেন।
মহড়া
পুরোদমে চলছে। মিনুকাকিমা রুইতনকে ডেকে বললেন, নাচ তো সুন্দর হচ্ছে,
তা কাঁদ কেন মা জননী? পিছন থেকে একটি মেয়ে ফক্কুড়ি করে বসলো, কি
করি, আমার বদনই এমনি। সাথে সাথে হাসির হুল্লোড়। তন্বীকে কেউ ভুল
করেও সুন্দর বলবে না, তাই ছক্কা 'সুন্দরী, তুমিই আমাদের পথ দেখাও'
বলতেই সমস্বরে খুক-খুক কাশি শুরু হয়ে গেল। তার একটা সংলাপ ছিল,
'হঠাত মনে হলো আমি মালিনী'; তৎক্ষণাৎ মিন্টু নকল করে দেখালো, 'আমি
হেমা মালিনী!' এবার অনেক কষ্টে মেয়ের রাগ ভাঙানো হলো। তারপর হারমোনিয়াম
নিয়ে কাড়াকাড়ি। মৌ মেয়েদের বেশিরভাগ গানই গাইছে। সে আবার নিজে
হারমোনিয়াম না বাজিয়ে গাইতে পারে না, আবার সব গানের সাথে বাজাতেও
পারে না। সুতরাং আমি লীড করি, আর ওর গান এলেই হারমোনিয়াম কেড়ে
নেয় আমার কাছ থেকে। ঠিক করা হলো অনুষ্ঠানের দিনে দুখানা হারমোনিয়াম
থাকবে, যদি টিউনিং ম্যাচ করে।
ইতিমধ্যে
গায়কদের মধ্যমণি শান্ত বলে বসলো, দাদা, খোল না হলে কয়েকটা গান
মোটেও জমবে না। 'আমরা নূতন যৌবনেরই দূত', কীর্তনাঙ্গের
'বল সখী, তারই নাম আমার কানে কানে'- এসব গান তবলায় কেমন জোলো লাগছে|
অবশ্য গৌতম তবলা ভালই বাজাচ্ছে, তবু দুলাল কোত্থেকে বুড়ো নামে
একটা বাচ্চা ছেলেকে ধরে নিয়ে এলো- উ: কি হাতের কাজ ওই বয়েসে! লোধকাকু
ছিলেন খোলে ওস্তাদ, তা তিনি তো আর বসবেন না বালখিল্যদের মাঝে,
তাই ওনাকে একদিন রিহার্সেলে ডেকে আনলাম, একটু গাইড করার জন্যে
। উনি ভ্রূ কুঁচকে বললেন, একি হচ্ছে, 'আমরা নূতন যৌবনেরই.....'
তে দাদরা বাজাচ্ছো কেন? ওটা ষষ্ঠী তাল। বেচারা বুড়ো অতশত জানেনা,
তবে ২-৪ মাত্রা বুঝিয়ে দিতেই ধরতে পারল, গান জমে উঠল। শ্রীমতি
লাহিড়ী, অমন সফিস্টিকেটেড মহিলা, অথচ হরতনির সংলাপে আগাগোড়া বলে
গেলেন 'সমস্ত প্যাখম ছড়িয়ে দিয়ে', এবং শেষ পর্যন্তও ওটা
শোধরানো গেল না। একদিন ছক্কার রোল পড়তে পড়তে দুলাল বলে উঠল, আচ্ছা,
রবীন্দ্রনাথ ছক্কাকে দিয়ে কোট কেনা করিয়েছিলেন কেন বলতে পারিস,
শেষে এই গরমে কোট গায়ে নামতে হবে নাকি আমার ভাইটিকে! আমি অবাক
হয়ে বললাম, সেকি কোথায় আছে এরকম? কেন, 'এতকাল যে সব ওঠাপড়া
শোয়াবসার কোটকেনা নিয়ে দিন কাটাচ্ছিলুম, তার অর্থ কি?' শুনে
আর হেসে বাঁচি না। ছাপার ভুল-ও ছিল স্বরবিতানের টেক্সট-এ। ভাবছিলাম,
হরতনি কেন বলছে 'ঘরে থাকার মত অশুচিতা নেই'। রবীন্দ্র-রচনাবলী
দেখে শেষে 'ঘরে'-কে 'মরে' করে দেওয়া হলো।
সব
তো হলো, এবার চিন্তা সাজসজ্জা নিয়ে। তাসের সাজ চাই, সিল্কের কাপড়ে
হরতনের রানী, টেক্কা, ইস্কাবনের রাজা, গোলাম, দহলা, নহলা, চিড়েতন,
রুইতনের বিভিন্ন তাস আঁকতে হবে, ফেব্রিক রঙ্গে, অত খরচ কে যোগাবে!
আমার মাথায় এলো, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের জমা নেওয়া ড্রয়িং-শীট গুলো
তো পরে ফেলেই দেওয়া হয়, সেগুলো আনা যায় তো! যেই ভাবা সেই কাজ।
একদিন এক চেনা প্রফেসরকে ধরে পঞ্চাশ-ষাট খানা ব্যবহার করা কাগজ
নিয়ে এলাম। পাশের বাড়ির নিত্য আর মিন্টু পোষ্টার কালার নিয়ে বসে
গেল, হুবহু প্যাকেটের তাসের আদলে সবকটা তাস আঁকা হলো প্রতিটা দুটো
করে, ঠিক হলো শক্ত সুতোয় বেঁধে গলা দিয়ে বুকে-পিঠে ঝুলিয়ে দেওয়া
হবে যাতে পেছন থেকেও সবাইকে চেনা যায়। রাবণ গোস্বামী নামকরা ডেকোরেটর-কম-মেকাপম্যান,
নিয়েছেন সবাইকে সাজানোর দায়িত্ব। ওনার নাম নবকুমার, কিন্তু নাটকে
রাবণ করে এত বিখ্যাত হয়ে যান ভদ্রলোক যে লোকে ওনার আসল নামটাই
ভুলে গেছে। মজা হয়েছিল শো-এর দিনে, মাইকে কল করা হচ্ছে নবকুমার
গোস্বামী গ্রীনরুমে আসুন, উনি বসে শুনছেন, কিন্তু নড়ছেন না। আসলে
ব্যবহার না হওয়ায় নিজের নামটাই যে ভুলে গেছেন তিনি। আমাদের পাড়ার
ছেলেরা, যারা কোনদিন কোনো সাংস্কৃতিক কাজে থাকেনি কখনো, তারাই
দায়িত্ব নিল মঞ্চ ও আলোকসজ্জার। এবার আমরা মাঠে, থুড়ি, স্টেজে
নামতে তৈরি।
৩ - অনুষ্ঠান
শো-এর
আগের দিন ছিল স্টেজ রিহার্সেল। মোটামুটি উতরে গেল। ৪০'x৩০' এর
মঞ্চ, বাইরে খোলামাঠে দর্শক বসবে, বুকে দুরু-দুরু শুরু হয়ে গেছে।
নেমে আসছি, এক ভদ্রলোক হিন্দিতে প্রশ্ন করলেন, গল্পটা আমায় মোটামুটি
একটু বুঝিয়ে বলতে পারবেন? তিনি ধানবাদ থেকে প্রকাশিত হিন্দি দৈনিক
'আওয়াজের' সাংবাদিক ও কলা-সংস্কৃতি বিভাগের যুগ্ম সম্পাদক। আমি
ওনাকে যথাসম্ভব হিন্দি করে তাসের দেশের গল্প ও বক্তব্যটা বুঝিয়ে
দিলাম। তিনি খুশি হয়ে বিদায় নিলেন।
পরদিন
শো। সকাল থেকেই বেশ গরম। বিকেল পাঁচটার মধ্যেই আমরা মোটামুটি তৈরি
হয়ে পৌঁছে গেছি পরিষদে। দেখি শ'চারেক চেয়ার এসেছে। এদিকে কারো
খেয়াল নেই যে ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে না হলেও ধীরে ধীরে আকাশ
কালো করে ফেলেছে। আমরা একফাঁকে পরিষদের সেক্রেটারিকে ধরে একটা
অল্টারনেটিভ ব্যবস্থার ব্যাপারে অনুরোধ করে এলাম।
সন্ধ্যে
সাতটা নাগাদ পর্দাটা একটু ফাঁক করেই দেখি লোকে লোকারণ্য। আর শুধু
বাঙালি নয়, কবিগুরুর নাটক, বিহারের(এখন ঝাড়খণ্ড)বাংলা বর্ডারের
ছোট শিল্প-শহরটিতে বহু অবাঙ্গালিই বাংলা বোঝে। তাছাড়া নাচগানের
উৎসব দেখার লোভটাও ত আছে, ফলে ভিড় একটু বেশিই হয়েছে। অনুষ্ঠানের
একটু দেরী আছে, একফাঁকে দর্শকদের মধ্যে নেমে ক্যাজুয়ালি ঘুরে এলাম।
দেখি এককোণে চারপাঁচজন মস্তান-গোছের ছোকরা গুলতানি করছে-'আমরা
শালা চিল্লাবই। সব জায়গায় হুজ্জত করি, এরা কি কোনো ইস্পেশাল!'
একটু দূরে দেখি বাদল ওরফে পাগল চক্রবর্তী কাঁধে বিখ্যাত ঝোলাখানা
নিয়ে দাঁড়িয়ে। দেখে হেসে বলল, 'কমরেড, এগিয়ে যা, দেখি বুর্জোয়া
পাবলিক কে কি করতে পারে!' সামনের দিকে এসে দেখি, বাবা, বিলুকাকু,
প্রদীপকাকু, ভুট্টার বাবা, সবাই আড্ডা দিচ্ছেন। দেখে একটু ভরসা
হলো। এবার শুরু হবে শো, আমি ব্যাকস্টেজের ছোট পর্দাঘেরা জায়গাটিতে
হারমোনিয়াম নিয়ে বসলাম।
বাইরে
মেঘ ছেযেছে চারদিকে, তার মাঝে সমবেত নাচ 'খরবায়ু বয় বেগে,
চারিদিক ছায় মেঘে' দিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হলো। পরিবেশের
সাথে অদ্ভুত সামঞ্জস্যের ফলে দর্শকমনে রং ধরতে দেরী হলো না। তারপর
সুদীপের মিষ্টি বাঁশির একটা ধুনের সাথে, বোধহয় মন উদাস করা বারোয়া
ধরেছিল, প্রথম দৃশ্য শুরু হলো। সংলাপের সাথে অভিনয় জমে উঠেছে,
এমন সময় পত্রলেখার বেশে তন্বীর প্রবেশ। সদাগর বলে উঠলো- 'ওগো
পত্রলেখা, আমাদের রাজপুত্রের গোপন কথাটি হয়ত তুমিই আন্দাজ করতে
পারবে, একবার শুধিয়ে দেখো না'। তৃষ্ণাদি তন্বীর দিদি, গেয়ে
উঠলো, 'গোপন কথাটি রবেনা গোপনে'। এইবার হলো ঝামেলা। শান্ত গাইল,
'না,না, না, রবেনা গোপনে'; তারপর তৃষ্ণাদি 'গোপন কথাটি' বলার পর
অন্তরা ধরা হবে। তা না করে তিনি স্থায়িতে আবার ফিরে এলেন। পত্রলেখা
পাকা নাচিয়ে, একবার থমকে থেমেই তাল ধরে নিল, ফলে ব্যাপারটা ম্যানেজ
হয়ে গেল।
এরপর
রাজপুত্রের 'যাবই আমি যাবই ওগো বাণিজ্যেতে' গানের সাথে
উদ্দাম নাচে 'ঝড়ো হাওয়া কেবল ডাকে' বলতেই শুরু হয়ে গেল ঝড় ও বৃষ্টি,
নবীনা আসার আগেই শো থামিয়ে দিতে হলো। লাল্টু একফাঁকে দর্শকদের
অনুরোধ করে ঘোষণা করে দিল- আপনারা যাবেন না, নাটক হবে, নিশ্চয়
হবে। তারা পাড়ায় অপাংক্তেয় ছিল এ সব কাজে, এখন সুযোগ পেয়ে ছাড়তে
কেউই চায় না; অথচ বৃষ্টি থামার নাম নেই। এবার আমরা সেক্রেটারি
সুকুমারবাবুকে ধরলাম, ভিতরের হলে ব্যবস্থা করে দিতে হবে। উনি অভিজিতদা,
নিমাইদার সাথে কথা বলে সব করেই রেখেছিলেন, বললেন, ব্যবস্থা হয়েই
আছে, শুধু চেয়ারগুলো ঢোকাতে হবে। তবে জানই তো, স্টেজ একটু ছোট,
হলের ক্যাপাসিটি কম, তাছাড়া আলোর জোগাড় বেশি কিছু হবে না, দুটো
ফুটলাইট আর দুটো পেডেস্ত্রাল দিয়েই চালাতে হবে। কোই পরোয়া নেই,
বলে আমরা হাতে হাতে চেয়ার ঢোকাতে শুরু করলাম। প্রথম দৃশ্যে দর্শকরা
এত আচ্ছন্ন হয়ে গেছেন যে তাঁরা দাঁড়িয়ে ভিজছেন কিন্তু কেউ ফিরে
যাচ্ছেন না। এবার ভিতরের হল খুলে দেওয়া হলো। চারশ ক্যাপাসিটির
হলে অন্তত: ছ'শো লোক বসে-দাঁড়িয়ে ঘামতে লাগলেন, ভাগ্য ভালো, এত
দুর্যোগের মধ্যেও পাওয়ার ফেল করেনি!
না:,
এত সবের পরেও কিন্তু কারো উত্সাহে বিন্দুমাত্র ভাঁটা পরেনি, না
কলাকুশলীদের, না দর্শকদের। কবিগুরুও তা জেনেই লিখেছিলেন কিনা-
'একাকী
গায়কের নহে ত গান, মিলিতে হবে দুইজনে,
গাহিবে একজন খুলিয়া গলা,
আরেকজন গাবে মনে।'
সত্যিই
তো, এমন সমন্বয় না থাকলে কি কোনো শিল্প-কলা বেঁচে থাকতে পারে?
দর্শকদের
অনুরোধ, গোড়া থেকে শুরু করতে হবে। তা আর সম্ভব নয়, খর-বায়ুর দল
পোশাক বদলে ফেলেছে, তাদের এখন তাস সাজতে হচ্ছে। অগত্যা রাজপুত্র-সদাগরের
প্রথম দৃশ্য থেকে শুরু হলো। দ্বিতীয় দৃশ্যে তাসেরা নামতেই জমে
উঠলো পালা। তাসেদের অপরূপ পোশাক, তোলন-নামন আর যুদ্ধ দেখে দর্শক
আর হেসে বাঁচে না। পঞ্জা-ছক্কার কাটা-কাটা কথাগুলোও দেখি সবার
খুব পছন্দ হয়েছে। সুদীপের গলায় রাজা যখন ছড়া শোনালো-
'শান্ত
যেই জন। যম তারে নেড়ে চেড়ে ঠেলে-ঠুলে দেয় ফেলে, বলে, মোর নাহি
প্রয়োজন।’ -
তাতে
হাততালি এত পড়ল, আর এনকোর, এনকোর চেঁচামেচি শুরু হলো, যে ওটা ওকে
আরেকবার করে দেখাতে হলো। এমনকি ভুঁইকুমড়ো ডালের জায়গায় যে সদাগর
একটা আমপল্লব সমানে নাড়িয়ে গেল, সেটাও কেউ লক্ষ্য করলো না! আমার
দুটো একক গান ছিল এখানে রুইতনের নাচের সাথে, 'তোমার পায়ের তলায়
যেন গো রঙ লাগে' ও ‘উতল হাওয়া লাগলো আমার গানের তরণীতে', সুন্দর
উতরে গেল।
শেষদৃশ্যে
বুড়ো নিমতলায় রাজসভা বসেছে। একে একে সবাই আসছে। একি, ড্রয়িং শীটগুলো
সব গেল কোথায়? কারো খুলে পড়ে গেছে, কারো বা একটেরে হয়ে ঝুলছে।
পাবলিক হই হই করছে, এমন সময় রাজা বলে উঠলেন, 'সভ্যগণ, তোমাদের
আজ চেনা যায় না- সভার সাজ নেই, অত্যন্ত অসভ্যের মত!' তখন অন্য
তাসেরা সমস্বরে বলে উঠলো, 'দোষ নেই। ঢিলে হয়ে গেল আমাদের সাজ,
আপনি তা পড়ল খসে'। এবার খেয়াল হলো আমার। সত্যিই ত! তাসের সাজ পরে
ত কখনো মহড়া হয়নি, তাই শেষ দৃশ্যে ওগুলো খুলে ফেলতেও বলা হয়নি।
ভাগ্যিস সবাই বুদ্ধি করে নিজেরাই সব খুলে ফেলেছে। আর ভাগ্যিসই
বা বলব কেন? তার মানে এই দাঁড়াল যে ছোট-বড় সবাই তাসের দেশের থিমটা
ধরতে পেরেছে, আর তা বুঝেই অভিনয় করেছে, তাইনা সেটা এত প্রাণবন্ত
হয়েছে। এবার দর্শকরাও বুঝতে পেরে সাজ-সজ্জাহীন তাসেদের নতুন রূপকে
তালি দিয়ে স্বাগত জানাল। কিছুক্ষণ পরে বাঁধভাঙ্গা নাচের ঢেউয়ের
সাথে অজস্র হাততালির ঢেউ মিশে অনুষ্ঠান শেষ হলো।
হঠাত
খেয়াল হলো, ওই 'চিল্লানেওয়ালা' 'হুজ্জত-ওয়ালা' পার্টিটাকে তো দেখলাম
না, তারা কি ঠেকায় পড়ে প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করলো?
৪ - উপসংহার
পরদিন
মিনুকাকিমা দেকে পাঠালেন আমাকে আর দুলালকে। গেলে পর পাঁচখানা একশ
টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বললেন, নে, ধর, সাজসজ্জা, রিহার্সেল, আনুষঙ্গিক
খরচা আর পিডিআই এর GM এর তরফ থেকে পুরস্কার, সব মিলিয়ে সুকুমার
এটা দিয়েছে তোদের জন্যে। আর জানিস কি হয়েছে, আমি কথায় কথায় বলছিলাম
তাসের দেশের রাজপুত্রের চরিত্রটা রবীন্দ্রনাথ নেতাজিকে দেখেই লেখেন,
বইটাও ওনাকেই উৎসর্গ করেছেন। তাই শুনে উত্সাহিত হয়ে জয়-হিন্দ ক্লাবের
প্রেসিডেন্ট ধরেছে আমাকে নেতাজি-জয়ন্তীতে ওদের ক্লাবের মাঠে এই
নাটকটা নামাবার জন্যে, খরচাপাতি সব দেবে ওরা। ইতিমধ্যে আমরা এখানে
আছি খবর পেয়ে ভুট্টা তীর্থকে স্কুটারে বসিয়ে নিয়ে হাজির। কথাটা
শুনেই ক্ষেপে উঠে বলল, আমরা কি পাগল না প্রফেসনাল। সবাই ছাত্র,
পড়াশোনা আছে। তবে এই টাকাটা কাজে লাগবে। এতদিন কষ্ট করে অনেক সাইকেল
ঠেঙিয়েছি, সাজ-সজ্জার ড্রয়িং কাগজ তো কলেজ থেকেই এসেছে। এ টাকায়
এখন পোলাও-মাংস হবে, বলেই একটা নোট আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বলল,
ফেরার সময় নিতাই মোদককে এডভান্স করে দেব। আপনার বাগানটা কিন্তু
শনিবার সন্ধ্যেয় চাই, কাকিমা।
ইতিমধ্যে
লাল্টু, নিত্য, তোতা, গোল্লা, নীতা, তন্বী সবাই হাজির। দুজনের
হাতে দুটো কাগজ, বাংলা দৈনিক বসুমতী আর হিন্দি আওয়াজ। দেখি দুটো
কাগজেই ছেপেছে খবরটা, আমার হিন্দি অনুবাদ-সহ। মিনু কাকি লজ্জিত
হয়ে বললেন, দেখলে, কিছুই করলাম না, অথচ নামটা ছেপে দিল কাগজে!
দুলাল বলল, আমাদের ফিস্টির যোগাড় করে দিয়েছেন, আর কি চাই? তাছাড়া
আপনি না থাকলে অনুষ্ঠানটা হতই না হয়ত, সব খাওয়া-খাওয়ি করেই মরত।
ও ঠিকই বলেছে, পাঁঠার মাংস তখন কুড়ি টাকা কিলো, পাঁচশো টাকা সে
হিসেবে অনেক।
এর
পরের পর্বটার সাথে গলা আর পায়ের কম, হাত আর জিভের সম্পর্কটাই বেশি,
তাই আর এ নিয়ে বিশদ লিখলাম না। তবে শনিবার সন্ধ্যেয় মাংস-পোলাওএর
সাথে ভুট্টার গলায় দেবব্রতর গান একটা সারপ্রাইজ ছিল, সেটা সারপ্রাইজই
থাক বরং। আমার তখন আর অন্য কিছুতেই মন ছিল না। একটা নতুন দেশে,
যার নাম “রবি ঠাকুরের আপন দেশ”, তাতে পা রাখলাম সেটা মনে-প্রাণে
উপলব্ধি করে পুলকিত হচ্ছিলাম।
লেখক
পরিচিতি - পল্লব চট্টোপাধ্যায় - জন্ম ও বেড়ে ওঠা বিহার (অধুনা
ঝাড়খন্ডের) ধানবাদ কয়লাখনি ও শিল্পাঞ্চলে, সেখানে 'নানা জাতি,
নানা মত, নানা পরিধান' হলেও বাংলা ও বাঙালিদের প্রাধান্য ছিল একসময়।
১৯৮২ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনীয়ারিং
পাস করে পেট্রোলিয়াম লাইনে চাকুরী, বর্তমানে কুয়েত অয়েল কোম্পানিতে
কর্মরত। শখ-গান-বাজনা আর একটু-আধটু বাংলাতে লেখালেখি। কিছু লেখা
ওয়েব ম্যাগাজিনে (ইচ্ছামতী, আদরের নৌকো) প্রকাশিত ।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।