গান:
গানের ধারা- নানান পথে
অবসরের সম্পাদক মশায়ের
মারফত্ কোন একজন কয়েকটি বিশেষ গায়নশৈলীর ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলেন,
যথা - শ্যামাসঙ্গীত, কীর্তন, গজল, ঠুংরী ইত্যাদি। তা বেশ কয়েক
মাস হয়ে গেছে। জানি না, সে ভদ্রলোকের আগ্রহ এখনও আছে কি না;
হয় তো তিনি তাঁর জ্ঞাতব্য ইতিমধ্যে সংগ্রহ করে ফেলেছেন।
প্রথম যখন এই অনুরোধটি
পাই, তখন, বলতে কি, বেশ দ্বিধাই হয়েছিল এবং এখনও আছে। আমার অবস্থা
অনেকটা সত্যজিত রায়ের সেই বিখ্যাত চলচ্চিত্র 'নায়ক'- এর মুখ্য
চরিত্র অরিন্দমের মতন। প্রবীণ, নীতিবাগীশ সহযাত্রীর প্রশ্ন '
মদ্য পানে কী হয়?' এর জবাবে অরিন্দম বলে 'সেটা যে না খেয়েছে,
তাকে কী করে বোঝাই বলুন, আমার তো ভাষা নেই। যদি বলেন তো অভিনয়
করে দেখাতে পারি।' ব্যাপারটি ঠিকই; রসের কথা ভাষায় বোঝানো যায়
না। ঠাকুর বলেছেন- ঘি কি রকম তা কি কথায় বোঝানো যায়? কী রকম
ঘি - না হদ্দ ঘি। খাদ্যরস যেমন চেখে বুঝতে হয়, সাহিত্যে রস যেমন
পড়ে বুঝতে হয় - সঙ্গীত রস তেমন শুনে অনুভব করতে হয়। সঙ্গীতরস
শ্রুতি এবং অনুভবের ব্যাপার- লেখা পাঠের চেয়ে অনেক বেশী ফলদায়ক
শোনা, মন নিবদ্ধ করে শোনা এবং বার বার শোনা। বিভিন্ন গান আমি
প্রচুর সংখ্যায় শুনেছি এবং এখনও শুনে থাকি। তার থেকে আমার নিজের
মনে এই সব গায়নশৈলীর সম্বন্ধে কাজ চলার মত একটা ধারণা হয়েছে,
যা রসগ্রহণের কাজে লাগে। সেইটাই সকলের সঙ্গে ভাগ করে নেই।
এ প্রসঙ্গে জেনে রাখা ভালো
যে উপরের তালিকা ঠিক ভাবে বলতে গেলে কণ্ঠসঙ্গীত সম্বন্ধেই প্রযোজ্য
কারণ এই সব গানের ক্ষেত্রে বাণীর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
আপনি গীটারে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বাজাতে পারেন, কিন্তু সেটা
রবীন্দ্রসঙ্গীত হবে না - রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর হবে কারণ বাণী,
যা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সম্পদ তা অনুপস্থিত। ঠিক সে ভাবেই, শ্যামাসঙ্গীত,
কীর্তন, গজল ইত্যাদি যন্ত্রসঙ্গীতে বাজালে তা পূর্ণাঙ্গ হবে
না সুরেই থেকে যাবে- কারণ বাণী নেই। উপরের লেখা প্রতিটি ধরনের
সঙ্গীত তার নিজস্ব বাণীর ধরণের সঙ্গে জড়িত। আপনি রামপ্রসাদী
সুরে গাওয়া গান শুনে থাকতে পারেন 'যেও না শ্যাম নদীর ধারে, আমি
দাঁড়িয়ে আছি পুকুর পাড়ে' (গানটি ব্যাপিকা বিদায় নাটকে সবিতাব্রত
দত্ত গেয়েছিলেন, ষাটের দশকে রংমহল প্রেক্ষাগৃহে দেখেছিলাম; গানের
কথা সঠিক মনে নেই) কিন্তু এটি রামপ্রসাদী বা শ্যামাসঙ্গীত হবে
না কারণ বাণীটি শ্যামা মাতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত নয়। আবার রামকুমার
চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া 'ও গো কমলিনী, চেয়ে দেখ ধনি- পদে চিন্তামণি
গড়াগড়ি যায়' গানটি শ্যামাসঙ্গীতই হবে কারণ এতে শ্যামা মায়ের
লীলা বর্ণিত, যদিও বিদ্রুপাত্মক রহস্য আছে বাণীতে। ছেলে মাকে
যেমন ভালোবাসে, ভক্তি করে- তেমনি আবার দুরন্ত আবদার, দাবীও করে।
প্রথমেই আসি শ্যামাসঙ্গীত
প্রসঙ্গে। দেখতে হবে তিনটি ব্যাপার আছে কি না। বাণী অবশ্যই হতে
হবে শ্যামা মায়ের মহিমা নিয়ে। অপূর্ব বাণী রেখে গেছেন রামপ্রসাদ
সেন, কমলাকান্ত, দাশরথি, রামদুলাল (নন্দী), ভাবুক, প্রেমিক প্রভৃতি
স্বনামধন্য ভক্তরা যে ধারা শেষ হয়েছে নজরুল-এ এসে। এর পরেও আরও
অনেক গীত রচনা হয়েছে তবে সে সব গানের বাণী অত সমৃদ্ধ নয়। এর
পর আসে সুরের কথা। বেশীর ভাগ গানই সহজ সুরে বাঁধা, তবে রাগসমৃদ্ধ
অনেক গানও আছে। সচরাচর যে সব রাগে চটুল গান গাওয়া হয়, যথা পিলু,
খাম্বাজ ইত্যাদি রাগে শ্যামাসঙ্গীত পাওয়া যায় না। একটি বিশেষ
সুরের ধাঁচ আছে যা রামপ্রসাদী নামে পরিচিত। অনেক গানই সকলে শুনে
থাকবেন এই প্রচলিত সুরে যেমন- 'মন কেন মায়ের চরণ ছাড়া', 'মন
তুমি কৃষিকাজ জানো না' প্রভৃতি। এমন কি, রবীন্দ্রনাথও এই প্রচলিত
সুরে গান বেঁধেছেন- 'শ্যামা, এবার ছেড়ে চলেছি মা' (বাল্মীকিপ্রতিভা),
'আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে' (গীতবিতান- স্বদেশ পর্যায়) প্রভৃতি।
তালের অনুসঙ্গ হিসেবে তবলা (প্রয়োজনে মৃদঙ্গ বা পাখওয়াজ), খোল
আর মঞ্জিরা থাকে। তালের মধ্যে অধিক সংখ্যক গানই কাহারবা (৮ মাত্রার
তাল) বা দাদরা (৬ মাত্রার তাল) বা তেওড়া (৭ মাত্রার তাল) তালে
বাঁধা। তবে ত্রিতাল, একতাল, ঝাঁপতাল ইত্যাদি তালও ব্যবহার হয়।
এর সঙ্গে থাকে ভক্তি, ভালোবাসার আবেগ মেশানো। এই বিশেষ আবেগ
সকলের কণ্ঠে আসে না, কারও আবার প্রাণে দাগ দেবার মত করে আসে।
বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য দুটি নাম- ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ও তাঁরই
ছোটো ভাই পান্নালাল ভট্টাচার্য।
এবার আসি শ্যামাসঙ্গীতের
শিল্পীদের প্রসঙ্গে। শিল্পীদের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়- কিন্তু
তাঁদের কণ্ঠ তো পেতে হয় রেকর্ড থেকে যা শ্যামাসঙ্গীতের ব্যাপারে
আমাদের কান তৈরী করে। রেকর্ডের যুগ আরম্ভ হবার পর যে কয়েকটি
নাম উঠে আসে তার মধ্যে সব চেয়ে পরিচিত ভবানী দাস ও মৃণালকান্তি
ঘোষ- এঁদের গাওয়া গান এখনও পাওয়া যায়। এর পরের যুগের সব চেয়ে
পরিচিত নাম আগেই দিয়েছি- ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য ও পান্নালাল ভট্টাচার্য।
অসামান্য এবং অসংখ্য গান গেয়ে গেছেন, যে সব গানের রেকর্ড সৌভাগ্যক্রমে
এখনও পাওয়া যায়। এর পরের যুগে আসেন হীরালাল সরখেল, অনুপ ঘোষাল,
অনুরাধা পুড়ওয়াল, পণ্ডিত অজয় চক্রবত্র্তী, রামকুমার চট্টোপাধ্যায়,
মান্না দে প্রমুখ শিল্পীরা। আরও অনেক শিল্পী অতীতে ছিলেন এবং
বর্তমানেও আছেন- সবার নাম এখানে উল্লেখ করলাম না।
একটা কথা আছে- উপদেশের
চেয়ে উদাহরণ ভালো (example is better than precept)। এ ব্যাপারে
ঠাকুর পরমহংসদেব সব চেয়ে দামী কথা বলেছেন- পাঁজিতে লেখে এ বছর
বিশ আড়া জল। কিন্তু পাঁজি টিপলে শালা এক আঁজলা জলও বেরোয় না।
তাই কয়েকটি শ্যামাসঙ্গীতের উদাহরণ এখানে দিলাম শ্যামাসঙ্গীতের
ধরন ধারন বোঝার জন্য।
প্রথমেই রামপ্রসাদ সেনের
রচনায় আসি। দুটি গান এখানে পেশ করছি:
প্রথম গানটির সুর রামপ্রসাদি-
শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য -'মন
রে কৃষিকাজ জান না'
এর পরের গানের শিল্পী পান্নালাল
ভট্টাচার্য, সুর প্রচলিত - 'চাই
না মাগো রাজা হতে '
এর পরের গানটির রচয়িতা
দাশরথি রায়, সুর প্রচলিত, শিল্পী পান্নালাল ভট্টাচার্য - 'দোষ
কারও নয় গো মা '
চতুর্থ গানের রচয়িতা রামদুলাল
(নন্দী), সুর প্রচলিত, গানটির একটি রেকর্ড পান্নালাল ভট্টাচার্যের
আছে -
'জেনেছি
জেনেছি তারা'
পাঁচ নম্বর গানের বাণী
কমলাকান্ত (ভট্টাচার্য), সুর প্রচলিত, শিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী
- 'যতনে
হৃদয়ে রেখো'
এর পরে গানের কথা ও সুর
প্রচলিত, শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য- 'কোন হিসাবে হর হৃদে'
শেষ গানটির কথা ও সুর নজরুলের'
শিল্পী পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী - 'শ্মশানে
জাগিছে শ্যামা'
এবারে বলি কীর্তনের কথা। কীর্তি শব্দ থেকে, যার মানে যশ বা খ্যাতি,
কীর্তন এসেছে। কারও গুণ বা যশ, মূলত ঈশ্বরের গুণ বা লীলা বর্ণনা,
কৃষ্ণের লীলা, চৈতন্যদেবের লীলা বর্ণনা গানের মাধ্যমে প্রকাশ
করাই হ'ল কীর্তন। এমন কী শ্যামাসঙ্গীতকেও কালীকীর্তন বলা হয়।
শিখেরা গুরুদ্বারে যে ভজন সঙ্গীত করে থাকেন সেও কীর্তন। ভজনের
এটি একটি ধারা। তফাতের মধ্যে ভজন একক ভাবে গাওয়া হয়ে থাকে আর
কীর্তন প্রায়শঃই সম্মোলোক ভাবে গাওয়া হয়। চৈতন্য দেব বলেছেন
নামগানে সর্বজীবের অধিকার তাই কীর্তন সর্বসাধারণের গান। এবং
কীর্তনের যে ধারাটি, বিশেষ করে বাংলায় চলে আসছে ষোড়শ শতাব্দী
থেকে, তার প্রবর্তক হিসেবেও চৈতন্যদেবের নামই করতে হয়। একজন
থাকেন মুখ্য গায়ক যাঁকে বলা হয় কীর্তনিয়া- বাকীরা দোহার। এই
দোহারেরা কীর্তনিয়ার গেয়ে যাওয়া লাইনটি পুনরাবৃত্তি করে, মাঝে
মাঝে। এ ব্যাপারে কাওয়ালী গানের সঙ্গে এর মিল এবং মনে রাখবেন
কাওয়ালী গানেরও উত্পত্তি ঈশ্বর ভজনা থেকে, যদিও ফিল্মের কল্যাণে
অধুনা কামজ প্রেমের ভাবও ঢুকে পড়েছে বেশ কিছু কাল ধরে। গানের
মধ্যে আবেগের প্রাধান্য। একই শব্দগুচ্ছ ঘুরে ফিরে আসে, হয় তো
সামান্য কিছু পরিবর্ধন করে যেটাকে আখর বলা হয়ে থাকে। আনুষঙ্গিক
তালবাদ্য হিসাবে ব্যবহার হয় খোল, ঢোল, (শিখেরা তবলাও ব্যবহার
করেন), করতাল, মৃদঙ্গ, মঞ্জিরা, শাঁখ প্রভৃতি। ভাবাবেগ কীর্তনে
খুবই বেশী এবং উদ্দাম ভাবাবেগে গানের লয় দ্বিগুণ চতুর্গুণ হয়ে
থাকে। তাল অবশ্যই সহজ তাল যথা- কাহারবা এবং দাদরা, যা সাধারণের
পক্ষে আয়ত্ত করা সহজ। তবে আরও অনেক তালের প্রয়োগও আছে। একই গানের
মধ্যে দুই বা তিনটি তাল থাকতে পারে। গানের পদ সংখ্যা বেশী থাকে
অন্য ভক্তিসঙ্গীতের তুলনায়। অনেক কীর্তন গায়কের মধ্যে আমার মনে
সবার আগে আসে কৃষ্ণচন্দ্র দে (ইনি অন্ধ ছিলেন এবং মান্না দের
কাকা) ও ছবি বন্দ্যোপাধ্যায় - এই দুইটি নাম। কৃষ্ণচন্দ্রের রেকর্ড
পাওয়া শক্ত- ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের রেকর্ড এখনও পাওয়া যায়। আরও
অনেক শিল্পী ছিলেন রথীন্দ্রচন্দ্র ঘোষ, রাধারাণী দেবী, গোবিন্দগোপাল,
মাধুরী দেবী প্রভৃতি- আছেনও নিশ্চয় আরও অনেকে।
এবারে কয়েকটি কীর্তনের
নমুনা শুনুন।
প্রথমে শিল্পী কৃষ্ণচন্দ্র
দে:
'ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা বঁধু ওইখানে থাকো'-
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে কৃষ্ণচন্দ্র দে অনেক পালা কীর্তন
রেকর্ড করেছিলেন যা একটি ৭৮ আর. পি. এম. রেকর্ডের দুটি পিঠ মিলিয়ে
থাকত। সেই রকম একটি পালা গান শুনুন নিমাই সন্ন্যাস ধর্মে দীক্ষিত
হয়ে সংসার এবং নবদ্বীপ ত্যাগ করে যাচ্ছেন এই ঘটনার উপরে:
'কুঞ্জ
সাজায়ে দে লো' ও '(আহা)
ওদিকে নিমাই চলে'
গত শতাব্দীর ষাট দশকের
চলচ্চিত্র রাইকমল হয় তো অনেকেই মনে রেখেছেন। সুর সংযোগ করেছিলেন
পঙ্কজকুমার মল্লিক এবং বেশ কয়েকটি কীর্তন ছিল যা বাণী ও সুরের
দিক থেকে কীর্তন সঙ্গীতের বিশ্বস্ত ধারায় রচিত। সেই রকম তিনটি
কীর্তন শুনুন :
'দেখে
এলাম তারে'
'তোমারই
গরবে গরবিনী হম'
'মন্দির
ত্যাজি'
রবীন্দ্রনাথ কীর্তনের ধাঁচে
বেশ কিছু গান রচনা করে গেছেন, যেমন 'ও হে জীবনবল্লভ', 'প্রভু
আজি তোমার দক্ষিণ হাত', 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই' প্রভৃতি।
মুশকিলের এবং দুঃখের কথা
হ'ল এই সব অপূর্ব গান এখন খুব একটা শোনা যায় না বা রেকর্ড দুäপ্রাপ্য।
শ্রোতাসাধারণের আগ্রহ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। ফলতঃ এ সব
অমূল্য সম্পদ হারিয়ে যাবার মুখে।
আগেই বলেছি গানের ইতিহাস,
ব্যাকরণ বা তত্বে আমার কিছুই দখল নেই। আমি কেবল আমার শ্রুতি-
অভিজ্ঞতা সবার সাথে ভাগ করে নিতে পারি। যাঁরা ইতিহাস বা তত্ব
খোঁজ করতে চান তাঁরা কয়েকটি ওয়েবসাইট ঘুরে দেখতে পারেন- যথা:
www.abasar.net, www.wikipedia.org প্রভৃতি। google খোঁজাখুঁজি
করলে আরও অনেক তথ্যভাণ্ডারের সন্ধান পাবেন।
পুষ্পেন্দু সুন্দর মুখোপাধ্যায়