খেতাব
এক বন্ধুকে
সেদিন বলেছিলাম আমি দাদার সঙ্গে দেখা করতে যাবো।
"সৌরভ গাঙ্গুলি! তার সঙ্গে তোমার কি দরকার পড়ল?"
আজকাল পশ্চিমবঙ্গে 'দাদা' মানে সৌরভ গাঙ্গুলি। 'দিদি' মানে মমতা
ব্যানার্জী।
এই রকম ‘ব্র্যাণ্ড
’ সৃষ্টি কি ভাবে হল জানি না। ব্র্যাণ্ড বলতে সাধারণ ভাবে বোঝায়
কোনও জিনিস বা পরিষেবা যা কোনও একটি বিশেষ কোম্পানীর সঙ্গে যুক্ত।
সাধারণ নাম কখনও ব্র্যাণ্ড হয় না। যেমন, jacuzzi একটা ব্র্যাণ্ড
– যার সাধারণ নাম hot tub। মাঝে মাঝে অবশ্য ব্র্যাণ্ডের ব্র্যাণ্ডত্ব
ঘুচে সেটা একটা সাধারণ নামে পরিণত হয় – যেমন, অ্যাসপিরিন, জিপার,
জেরক্স, ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে তার উল্টোটা ঘটেছে। সাধারণ নাম মর্যাদা
পেয়ে হয়ে গিয়েছে একটা ব্র্যাণ্ড। এই সুকঠিন কাজটি কোনো মার্কেটিং-এর
বিশেষজ্ঞের চেষ্টা ছাড়াই হয়েছে – এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। মনে
হয় এগুলোর শুরু সাংবাদিকদের দু-চার ছত্র লেখা থেকে। সেগুলোই নানান
জায়গায় ছাপা হয়ে বাঙালী মানসে এখন চিরস্থায়ী (?) হয়ে বসেছে। এ
বিষয়ে যদি কোনও গবেষণা হয়ে থাকে আমার সেটা জানা নেই। পাঠকদের কেউ
যদি এ ব্যাপারে আলোকপাত করেন, তাহলে সত্যিই উপকৃত হব। তবে কিনা
এই নাম-পরিচিতি আবার হারিয়েও যায়। ষাট দশকে উত্তমকুমারকে সিনেমাজগতের
পত্র-পত্রিকায় কেউ কেউ 'গুরু' বলে বলে চালাবার চেষ্টা করেছিলেন।
সে নাম ধোপে টেঁকে নি। পরে অবশ্য তাঁর পরিচিতি হয়েছে 'মহানায়ক'
হিসেবে। সুচিত্রা সেন হয়েছেন 'মহানায়িকা'। যোগ্য সম্মান – সেই
নিয়ে প্রশ্ন নেই। দুজনেই এখন গত। দুজনেরই মহাপ্রয়াণ বা মহাপ্রস্থান
ঘটেছে।
আমাদের কাছে
'শ্রীশ্রী মা' হলেন সারদাদেবী। সবারই মা আছেন, কিন্তু 'শ্রীশ্রী
মা' একজনই। তবে ভক্তরা মাঝে মাঝে এক 'শ্রী' ব্যবহার করেই ক্ষান্ত
হন।, যদিও আমার ধারণা দু-শ্রীই চলে বেশী । বি-শ্রীটা চলে না ,
ওটা বাঙালীদের কাছে কালীমাতার জন্য রিজার্ভড। এই প্রসঙ্গে 'ঠাকুর'
বলে কাউকে উল্লেখ করলে সেটা শ্রীরামকৃষ্ণকে বোঝাবে। বিশেষ করে
"ঠাকুর বলতেন" বললেই কথামৃত, এবং সেখান থেকে রামকৃষ্ণ।
ভাষান্তরে 'মা'
পালটে যায়। পণ্ডিচেরিতে 'মাদার' বললে একজনকেই বুঝতে হবে, তিনি
হলেন Blanche Rachel Mirra Alfassa । শুধু পণ্ডিচেরি কেন, অন্যান্য
জায়গাতেও শ্রীঅরবিন্দের ভক্তবৃন্দের কাছে তিনিই হলেন 'মাদার'।
ইদানীং দেখছি ক্যালকেশিয়ানদের অনেকে 'মাদার' বলতে টেরেসাকেও ভাবে।
তামিলনাডুতে 'আম্মা' বললে বুঝতে হবে শুধু জয়ললিতাকে – অন্য কাউকে
নয়। হিন্দি 'মাতাজী' নিয়ে একটা সমস্যা হবার সম্ভাবনা ছিল, এখন
আর সেটা নেই। এক সময়ে ইন্দিরা গান্ধীকে 'মাতাজী' বলা হত (হয়তো
বা একটু ঠাট্টা করেই)। তাঁর মৃত্যুর পর সে নামেরও মৃত্য ঘটেছে।
এখন 'মাতাজী' (বা 'শ্রী মাতাজী') হলেন নির্মলা দেবী। সন্দেহ থাকলে,
গুগল সার্চ করে দেখুন - সারা বিশ্বে তাঁর পরিচিতি। আপনারা হয়ত
ভাবছেন 'বোন'টা বাদ যায় কেন? বোনেরও একটা ব্র্যাণ্ড আছে, কিন্তু
পশ্চিমবঙ্গে নয়। উত্তর প্রদেশে 'বহেনজি' হলেন মায়াবতী।
ব্র্যাণ্ডকে
পেটেণ্ট করা যায় না, যেটা করা যায় সেটা হল ট্রেডমার্ক। এখানে সমস্যা
হল, নামগুলো যেহেতু সাধারণ এগুলোকে ট্রেডমার্ক করা যাবে না। ফলে
তার জন্যে আমাদের ভুগতে হবে। আমরা চিরদিন সুভাষচন্দ্রকে 'নেতাজী'
বলেছি। সারা ভারতবর্ষে তিনিই একমাত্র নেতাজী হয়ে থাকুন মনেপ্রাণে
চেয়েছি। এখন দেখছি উত্তরপ্রদেশে মুল্যায়ম সিং-এর অনুগামীরা দিব্বি
তাঁকে 'নেতাজী' বলে ডেকে আমাদের দাবী নস্যাৎ করছে! এটা কিন্তু
বাঙালীদের অধিকারের ওপর হিন্দিভাষীদের হস্তক্ষেপ। আমার এখন ভয়
হচ্ছে নেতাজীর নামে আমাদের এই যে এতগুলো প্রতিষ্ঠান – মিষ্টান্নভাণ্ডার
থেকে শুরু করে ওষুধের দোকান, মুদির দোকান, রাস্তা, স্কুল, কলেজ,
বাড়ি, বাগান, পল্লী – হঠাৎ একদিন উত্তরপ্রদেশবাসীরা সেগুলো নিজেদের
বলে দাবি না করে বসে! আমাদের একমাত্র আশা নেতাজী একদিন ফিরে আসবেন
– বাঙালীদের এত বড় অসম্মান তিনি কখনোই হতে দেবেন না। অবিশ্বাসী
পাঠক হয়ত প্রশ্ন তুলবেন, তা কি করে হয়, নেতাজী তো জন্মেছিলেন ১১৭
বছর আগে! আমি উলটে তাকে জিজ্ঞেস কোরব - ত্রৈলঙ্গস্বামী কতদিন বেঁচেছিলেন
শুনি – ৩০০ বছরের বেশী না?
আমাদের ভাগ্য
'দেশবন্ধু'কে কেউ চুরি করে নি, 'দেশপ্রিয়' বা 'দেশপ্রাণ'কেও নয়।
তার একটা সম্ভাব্য কারণ, দেশ- বন্ধু, প্রাণ, প্রিয়... ইত্যাদি
হল উচ্চারণ ও বানান সঙ্কটকারক উপাধি। জিভের জড়তা এবং বানান ভীতির
জন্যে এগুলোর ওপর লোকে বেশী নজর দেবে না। নামগুলো চুরি হয় নি ঠিকই,
কিন্তু নেতাজীর রাজনৈতিক গুরু এই দেশবন্ধু কে ছিলেন - এ প্রজন্মের
অনেকেই জানে না। দেশপ্রিয় বা দেশপ্রাণের কথা ছেড়েই দিলাম। চিত্তরঞ্জন
দাশ নামটাই হারিয়ে যেত যদি না ওঁর নামে একটা ক্যান্সার হাসপাতাল
বা রাস্তার নাম না থাকত! দেশবন্ধু নামটা টিঁকে থাকত শ্রেফ একটা
পার্কের নাম হিসেবে। যেমন রয়েছে প্রিয়া সিনেমার পাশে দেশপ্রিয়
পার্ক। ক’জন যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্তের কথা জানে! দেশপ্রাণ বীরেন্দ্র
শাসমলের অবস্থা তো আরও শোচনীয়। ...
এই পর্যন্ত
লিখে কলকাতাবাসী আমার এক বন্ধুকে পড়তে দিতেই সে ধমক দিয়ে আমার
ভুল শুধরে দিল। "এটা কি লিখলে! কলকাতাতেই যতীন্দ্র মোহন অ্যাভেনিউ
রয়েছে, দেশপ্রাণ শাসমল রোডও রয়েছে। শুধু কলকাতা নয়, পানিহাটি,
কাঁথি – আরও অনেক জায়গায় বীরেন্দ্রনাথ শাসমল-এর নামে রাস্তা আছে।
যতীন্দ্র মোহনের নামেও রাস্তার কমতি নেই। বাঙালী অত আত্মবিস্মৃত
জাতি নয়!"
বাঁচা গেল।
তার মানে নামগুলো অন্তত হারিয়ে যাবে না, যদিও এঁরা কে ছিলেন, কি
করতেন, কেন তাঁরা আমাদের এতো শ্রদ্ধার পাত্র – সেগুলো হয়তো মনে
থাকবে না। নাই বা থাকল।
যাঁরা পুরনো জিনিস আঁকড়ে থাকতে ভালোবাসেন, তাঁরা হয়তো প্রশ্ন তুলবেন,
তাহলে পুরনো নামগুলো, যেমন, বেলতলা রোড বা ঝামাপুকুর লেন - এদের
নাম পালটে এক একজন মহাপুরুষের নাম রেখে লাভটা কি? আগের নামের সঙ্গে
যে ইতিহাসটা জড়িত ছিল - সেটাকে নষ্ট করা ছাড়া?
উত্তরে, তাঁদের আমি একটা প্রশ্ন করব, মহাপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধা
জানানোর অন্য কোনও উপায় আছে কি? নতুন রাস্তা বা পার্ক বানানোর
জমি কোথায়, নতুন বাড়িই বা কটা তৈরি করা যায়! সেইজন্যেই তো একই
বিল্ডিং-এ সকালে যোগমায়াদেবী, দুপুরে আশুতোষ, আর রাত্রে শ্যামাপ্রসাদ
কলেজ করতে হয়েছে। এ নিয়ে প্লিজ ঝামেলা করবেন না।
যাক সে কথা,
ফিরে আসি পুরনো প্রসঙ্গে। 'দীনবন্ধু' নামটা বেঁচে আছে শান্তিনিকেতনের
লোকেরা বিস্তর লেখালেখি করে বলে। তাদের কল্যাণে অ্যাণ্ড্রুজ সাহেব
লোকটি কে বিদ্বজনেরা অন্তত জানেন। কিন্তু তাও মাঝেমাঝে গুলিয়ে
যায়। নামকরা লোকরা অনেকে শুধু প্রথম নামেই পরিচিত, যেমন বঙ্কিমচন্দ্র,
শরৎচন্দ্র, দীনবন্ধু। এই দীনবন্ধু হলেন সে যুগের লেখক দীনবন্ধু
মিত্র – 'নীল দর্পণ' লিখে খ্যাতনামা হয়েছিলেন। দীনবন্ধুর এই সমস্যা
মিটবে না, যত দিন না এঁরা দুজনেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাচ্ছেন।
সৌভাগ্যক্রমে (?) তার আর বেশী দেরি নেই।
নেতাজীকে নিয়ে
ইদানীং ঝামেলা শুরু হলেও 'বিশ্বকবি'কে এখনো কেউ আসন থেকে টলাতে
পারে নি। বিশ্বকবি একজনই – তিনি রবীন্দ্রনাথ। তবে রবীন্দ্রনাথের
আরও দুটি নাম অল্প-বিস্তর টিঁকে আছে - কবিগুরু এবং গুরুদেব। বিশেষ
করে শান্তিনিকেতনের প্রাক্তনীদের কাছে উনি চিরকালের গুরুদেব। আমার
ব্যক্তিগত ধারণা কবিগুরু নামটা হয়তো থেকে যাবে, কিন্তু গুরুদেব-কে
ধরে রাখা মুশকিল হবে। আজকাল এত জন গুরু এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছেন-
কেউ না কেউ ঠিক একদিন সেটা দাবি করে বসবেন। সম্প্রতি "দাড়িদাদু"
খেতাবটাও বেশ চালু হয়েছে, গুরুদেব-টেবের থেকে অনেক ঘরোয়া ব্যাপার।
এটা টিঁকে গেলে তাঁর অপকৃষ্ট নৈতিক চরিত্র নিয়ে আজকাল বটতলার প্রামাণ্য
জীবনী, থুড়ি উপন্যাস, যা প্রকাশ হচ্ছে তার damage control-টা আর
একটু সহজ হবে।
বিশ্বকবির আসনে
রবীন্দ্রনাথ বসে আছেন এটা লিখলাম বটে, কিন্তু সেটারও কোনো গ্যারাণ্টি
নেই। এই আসনটি রক্ষা করতে হলে আমাদের সদা-সতর্ক থাকলে হবে। এই
তো কিছুদিন আগেই একজন প্রশ্ন তুলেছিলে, রবীন্দ্রনাথকে কেন 'বিশ্বকবি'
বলা হবে? ভাবুন আস্পর্ধা! ভাগ্যিস টেগরাইটিস-আক্রান্ত এক ভদ্রলোকের
সেটা নজরে এসেছিল। প্রশ্নকারীকে 'বিশ্ববখাটে' আখ্যা দিয়ে ব্যাপারটা
ধামা চাপা দিতে সক্ষম হয়েছিলেন - অবশ্য বিশ্ববখাটের অসীম বিরক্তিভাজন
হয়ে। তবে এটা অস্বীকার করা যাবে না, বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি
সীমিত হয়ে আসছে। ইদানীং বিশ্বের প্রথম দশজন কবির মধ্যে পাবলো নেরুদা,
রুমি আর লি পো স্থান পেলেও রবীন্দ্রনাথ পাচ্ছেন না ।
আসলে আমাদের
প্রচারের অভাব। হিন্দি ভাষাভাষীরা এ ব্যাপারে থেকে আমাদের চেয়ে
অনেক বেশী এগিয়ে। দেখুন বিশ্বের দরবারে বলিউড কিরকম হলিউডের পাশে
স্থান করে নিয়েছে! প্রচারের এই অক্ষমতার জন্যেই 'বাঙলার বাঘ' আশুতোষ
মুখুজ্জে বাঙালীর কাছে হারিয়ে গেলেন। 'বাঙলার বাঘ' বলতে এখন শুধু
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার! মাস্টারদা, দাঠাকুর, দয়ার সাগর, কান্তকবি
– আরও কত যে নাম আমরা ভুলে বসে আছি! তবে 'বিদ্রোহী কবি'কে আমরা
ভুলি নি। 'বিদ্রোহী কবি' এখনো সেই কাজী নজরুল ইসলাম – এপার ওপার
– দুই বাংলাতেই। ভুলি নি 'স্বামিজী'কে । ধর্মের জগতে অজস্র স্বামিজী
থাকলেও প্রথমেই মনে আসবে স্বামী বিবেকানন্দকে। স্বামীজী বলেছিলেন
বলে কেউ কিছু বললে, সেটি বিবেকানন্দের বাণী বলেই আমরা ধরে নেব
- বক্তা রামকৃষ্ণ মিশনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত থাকুন বা
না থাকুন। আর 'মহাপ্রভু' যদি ব্যঙ্গোক্তি না হয় ("সে মহাপ্রভুর
কথা আর বোলোনা") তাহলে কয়েকশো বছর ধরে আজও তিনি চৈতন্য।
নাম খেতাব নিয়ে
এত কচকচি করার পর মনে হচ্ছে আসল জিনিসটাই তো লেখা হল না। এই পরিবর্তনশীল
জগতে কোনও কিছুই স্থির থাকবে না – একাধিক মাতাজী আসবেন, আসবেন
একাধিক মহাপ্রভু। টাইটেল বা খেতাব দিয়ে তাঁদের ধরে রাখার চেষ্টা
করাটাই অর্থহীন। আর সত্যি কথা বলতে কি, তার কি কোনও দরকার আছে?
নাম খেতাবের বাইরে গিয়ে অনির্দিষ্ট নানান শব্দগুচ্ছ দিয়েও তো লক্ষ্যভেদ
সম্ভব। বিশ্বের অর্ধেক লোকের আখ্যা "ওগো শুনছো" বা "কোথায়
গেলে" হতে পারে, কিন্তু আমি-আপনি-ওর-তার কাছে এই নাম্নী যিনি,
তিনি কিন্তু অনন্যা।
সুজন
দাশগুপ্ত
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
– এই লেখায় অগ্রজপ্রতিম সুমিত রায়ের পাঠানো বেশ কয়েকটি লাইন ব্যবহার
করেছি।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর
ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর
নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।