বিশেষ সংখ্যাঃ রবি-স্মরণ - শ্রবণে, শ্রাবণে
'মৃত্যুর রূপ' জীবনে, সৃষ্টিতে
আনন্দ
দাশগুপ্ত
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের (১৮৬১-১৯৪১) মৃত্যু-দর্শন গড়ে ওঠে তাঁর প্রায়-তেইশ বছর
বয়সে লোকান্তরিতা নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবীর মৃত্যু (১৮৮৪) থেকে,
কবির তেরো বছর দশমাস বয়সে প্রয়াতা মাতা সারদা দেবীর মৃত্যু (১৮৭৫)
থেকে নয়।
রবীন্দ্রজীবনীকার
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বর্ণিত ও বহুল প্রচলিত ৮ বৈশাখ, ১২৯১
বা ১৯ এপ্রিল ১৮৮৪ তারিখটি তথ্য সমর্থিত নয়। মৃত্যু তারিখটি নিয়ে
বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ এই যে, আত্মহত্যাকারিণীর মৃত্যু-সংবাদটি
কোনো সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। কাদম্বরী দেবীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার
সময়ে সোমেন্দ্রনাথ, দ্বিপেন্দ্রনাথ এবং অরুণেন্দ্রনাথের সঙ্গে
রবীন্দ্রনাথও শ্মশানে উপস্থিত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সবিস্তারে
প্রত্যক্ষ করা এবং তাঁর সর্বসত্তাকে নাড়া দেয়া এই মৃত্যুটি থেকে
পাওয়া প্রথম শোক অপরিস্রুত রূপ পরিগ্রহ করে ‘পুষ্পাঞ্জলি’ শীর্ষক
সমসাময়িক রচনায়, যা রবীন্দ্র-রচনাবলীর সতেরো নম্বর খণ্ডের ৪৮৬-৯৬
পৃষ্ঠা পর্যন্ত পাওয়া যাবে। কাদম্বরী দেবীর স্মৃতি-সুরভিত এই সব
অনুচ্ছেদ, কবিতা বা গান লেখা হয়েছিলো শোকের গমকে গমকে বিভিন্ন
সময়ে, তাঁর মৃত্যুর তিনমাসের মধ্যে- যদিও ছাপা হয়েছিলো এক বছর
পর ‘ভারতী’র বৈশাখ ১২৯২ সংখ্যায়। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদর্শন বা
তত্ত্বজ্ঞান উপলব্ধ হবার অবকাশ তখনও হয়নি বলে লেখাগুলোতে যথেষ্ট
সাহিত্যগুণ বর্তায়নি। এ-কারণেই লেখক ‘পুষ্পাঞ্জলি’কে তাঁর কোনো
গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করেননি।
মৃত্যুশোকের
এই ফুটন্ত ‘ইমোশন রেকালেক্টেড ইন ট্র্যাঙকুইলিটি’’ হয়ে
প্রশান্ত রূপ লাভ করার পরেই কেবল পরিণত রচনা উপহার দিতে পারে।
যেমন, ‘পুষ্পাঞ্জলি’র কিছু রচনা পঁয়ত্রিশ বছর পর ‘লিপিকা’র ‘সন্ধ্যা
ও প্রভাত’, ‘সতেরো বছর’, ‘প্রথম শোক’-এ পরিণতি লাভ করে রবীন্দ্রনাথের
গদ্যকবিতার পূর্বসূরি বলে উদযাপিত হয়েছে। মৃত্যুর অভিঘাত নির্ভর
করে সম্পর্কের গভীরতার উপরে। রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো।
এর একটি প্রমাণ পাওয়া যায় হাতের কাছেই। কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর
ঠিক একমাস তেইশ দিন পরেই একই বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন রবীন্দ্রনাথের
সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ (যিনি সেকালের ইংরেজী পড়ানোর তরঙ্গভঙ্গ করে
ঠাকুরবাড়ির বালকদের বাঙলা শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন) মাত্র চল্লিশ
বছর বয়সে। অথচ তাঁর এই অকালমৃত্যুটি সম্পর্কে কোনো প্রতিক্রিয়া
ব্যক্ত করেননি রবীন্দ্রনাথ।
সম্ভবত:,
মৃত্যু যে জীবনকে মুক্ত ও সত্যরূপে দেখার একটি জানালামাত্র, সেটি
তিনি এরই মধ্যে উপলব্ধি করে ফেলেছিলেন। তাঁর সেই উপলব্ধিকে স্বচ্ছ
থেকে স্বচ্ছতর করে তুলেছিলো মহর্ষি পরিবারের আরো তিনটি মৃত্যু-
ভ্রাতুষ্পুত্রী (হেমেন্দ্রনাথের কন্যা) সুকণ্ঠী অভিজ্ঞা দেবীর
মৃত্যু (১৮৯৬), ভ্রাতুষ্পুত্র (বীরেন্দ্রনাথের পুত্র) সুসাহিত্যিক
বলেন্দ্রনাথের মৃত্যু (১৮৯৯) এবং রবীন্দ্রনাথের ‘লালবাড়ি’র স্থপতি,
ভ্রাতুষ্পুত্র (দ্বিজেন্দ্রনাথের তৃতীয় পুত্র) নীতীন্দ্রনাথের
মৃত্যু (১৯০১)। সম্ভবত এই জন্যই নতুন বৌঠানের মৃত্যুতে রবীন্দ্রনাথের
মধ্যে যে-সাময়িক ‘একটা সৃষ্টিছাড়া রকমের মনের ভাব ও বাহিরের আচরণ’
দেখা দিয়েছিলো, স্ত্রীর মৃত্যুতে (১৯০২) তাঁর মধ্যে সে-ধরনের কিছু
দেখা যায়নি- এমনকি মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুর মাত্র দশ মাস পর নববিবাহিতা
দ্বিতীয়া কন্যা বারো বছরেরও কমবয়সী রেণুকার মৃত্যুতেও (১৯০৩) না।
জীবনস্মৃতি
গ্রন্থের 'মৃত্যুশোক' প্রবন্ধে প্রিয়জন হারানোর বেদনা ব্যক্ত করেছেন
রবীন্দ্রনাথ। তিনি লিখেছেন যে তাঁর মায়ের যখন মৃত্যু হয়, তখন তাঁর
বয়স অল্প, মায়ের যখন মৃত্যু হয়, তখন তিনি ঘুমচ্ছিলেন। পরদিন সকালে
যখন তিনি মৃত্যুসংবাদ শোনেন তখন তিনি 'সে কথাটার অর্থ সম্পূর্ণ
গ্রহণ করতে পারেননি।' তিনি দেখেছিলেন মায়ের দেহ, সুসজ্জিত দেহ
খাটের ওপর শোয়ানো। 'জীবন থেকে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করে তাঁর
চোখে পড়েনি।' তিনি লিখেছেন,
“যে ক্ষতি
পূরণ হইবে না, যে বিচ্ছেদের প্রতিকার নাই, তাহাকে ভুলিবার শক্তি
প্রাণশক্তির একটি প্রধান অঙ্গ, শিশুকালে সেই প্রাণশক্তি নবীন
ও প্রবল থাকে, তখন সে কোনো আঘাতকে গভীরভাবে গ্রহণ করে না, স্থায়ী
রেখায় আঁকিয়া রাখে না।' কিন্তু তাঁর ২৪ বছরের সময় 'মৃত্যুর সঙ্গে
যে পরিচয় হইল, তাহা স্থায়ী পরিচয়।' তিনি লিখলেন, 'অধিক বয়সে
মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই।' এই মৃত্যুর
মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো একটা শূন্যতা অনুভব করলেন। 'যাহা আছে
এবং যাহা রহিল না, এই উভয়ের মধ্যে কোনোমতে মিল করিব কেমন করিয়া!'
তিনি লিখলেন, 'শূন্যতাকে মানুষ কোনোমতেই অন্তরের সঙ্গে বিশ্বাস
করতে পারে না। যাহা নাই, তাহাই মিথ্যা, যাহা মিথ্যা তাহা নাই’।”
একবার
কঠিন রোগ থেকে মুক্তি লাভের পর একখানা চিঠিতে তিনি লিখেছেন,
‘‘মৃত্যুর
ভিতর দিয়ে ফিরে আসা সকলের ভাগ্যে ঘটে না। যদি ঘটে, তবে অন্তত
তখনকার মত অহমিকা শিথিল হয়ে আসে কতখানি স্থায়ী হয় বলতে পারিনে।
প্রিয়জনের মৃত্যুর পর বৈরাগ্য আসে নিজের মৃত্যুর সময় দেখি যে
সব জিনিস অত্যুক্তি করেছে। মৃত্যুর ব্যথা দেখে তাকে যেন অশ্রদ্ধা
না করি।’’
মৃত্যু
বেদনা মানুষকে ক্ষণিকের জন্য হলেও দুনিয়ার প্রতি অনাসক্ত করে তোলে
এ সত্যই ফুটে উঠেছে কবির কথায়। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হওয়া উচিত
নয় বলে তিনি উপদেশ দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুক নিয়ে মৃত্যু ভাবনা
নিয়ে অনেক লিখেছেন। রোগে বার্ধক্যে তিনি অপরাজিত। মানুষের ভালবাসার
অকৃপণ উৎস তাকে এমন অপরাজেয় শক্তি যুগিয়েছে। বিদায় তাকে নিতেই
হবে। কিন্তু মানুষের প্রতি তার এই ভালবাসা যেন তাঁর বিদায়কালে
মৃত্যুর পথে আগলে দাঁড়াবে। প্রতীক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিশ্চয়ই
কবির মনে মৃত্যু সম্পর্কে ধারণারও পরিবর্তন ঘটছে। কবির গীতিমাল্যের
কবিতা কয়টিতে ইন্দ্রিয় জগত ও ইন্দ্রিয়াতীত জগতের সীমান্ত-প্রদেশ
সম্পর্ক। ইন্দ্রিয়জগৎ প্রান্তে অথচ ইন্দ্রিয়াতীত জগৎ আরম্ভ হবার
আগে যে অনির্দিষ্ট অলক্ষ্যপ্রায় জগৎ আছে তারই প্রসঙ্গ বর্ণিত হয়েছে
ওই সব কবিতায়। জীবনকে আটকিয়ে রাখা যায় না বা যাবে না। তিনি লিখেছেন,
‘জীবনেরে
কে রাখিতে পারে, আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।'
তিনি
অন্য জায়গায় বলেছেন,
‘অনন্তকে
তো অন্তের মাঝে পেয়েছি-জীবনকে এই সীমান্তেই বন্দি করার ইচ্ছা লোলুপতা
মাত্র-অপারেশন করে কি হবে-যে নিয়মে ঝরে যায় শুকনো পাতা, খসে পড়ে
ফল, সেই নিয়মে স্বাভাবিকভাবে আমি ঝরে যেতে চাই।'
এ
সব সত্য কবি জীবন দিয়ে বুঝেছেন।
দার্শনিক
ও রবীন্দ্রভক্ত মোহিতচন্দ্র সেনের কন্যা উমা দেবী, যার ডাক নাম
বুলা-তাঁর মৃত্যুর পরে মৈত্রেয়ী দেবীকে লেখা কবির এ চিঠি।
‘‘কল্যাণীয়াসু,
বুলা
একবারেই নেই একথাটা তোমার মন কোনমতেই স্বীকার করতে চাচ্ছে না,
তখন তাকে স্বীকার করবার দরকারটা কী? থাকা ব্যাপারটার কত বৈচিত্র্যই
আছে। কখনো ঘুমিয়ে থাকি কখনো জেগে থাকি কখনো কাছে থাকি-কখনো দূরে
থাকি-কখনো দৃশ্যে কখনো অদৃশ্যে তার সঙ্গে আরো একটা কথা যোগ করে
দিতে দোষ কি-অর্থাৎ কখনো এ লোকে কখনো অন্য লোকে-কখনো মর্ত্য
শরীরের অবস্থায় কখনো এ-শরীরের অতীত অবস্থায়। তুমি বলবে নিশ্চিত
জানিনে যে। এ জন্যেই ইন্দ্রিয়ের প্রমাণকে না মেনে আকাঙ্ক্ষার
প্রমাণকেই তো মানা ভালো। পৃথিবীতে সব আকাঙ্ক্ষার সার্থকতা ঘটে
না। একথা সত্য, তেমনি একথাও সত্য যেসব সত্যের যুক্তি আমাদের
হাতে নেই, তাই যাকে নিশ্চিত বলে জানি, সেও ভ্রান্ত হতে পারে।
মৃত্যুকে বিলয় বলে মনে করছি খুব সম্ভব তার কারণ এই যে, সে যে
বিলোপ নয় তার প্রমাণগুলো আমাদের হাতের কাছে নেই-হয়তো কেবল বৃথা
বিলাপ করেই মরছি। মা পাশের ঘরে গেলে শিশু যেমন মায়ের অবলুপ্তি
কল্পনা করে এও হয়তো তেমনি। আমি একথা বলি যখন দ্বন্দ্বর মধ্যেই
আছি তখন না-য়ের চেয়ে হ্যাঁ-কে মানাই ভালো। মৃত্যু যদি চরম সত্যই
হয় তাহলে আক্ষেপ করা বৃথা। যদি সত্য না হয় তাহলে ততোধিক বৃথা-অতএব
মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করে দেখা যাক তারপরে হয় এ পক্ষে নয় ও
পক্ষে তর্কের সমাধান হবে-আমি নিজে শান্ত মনে তার অপেক্ষা করছি
এবং এই বিশ্বাস ধরে রাখছি যে মৃত্যুর পরেই অস্তিত্বের সম্পূর্ণ
প্রতিবাদ হ্যাঁ করে নেই।
ইতি-
শুভাকাঙ্ক্ষী শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’
২৫শে ডিসেম্বর, ১৯৩১;”
মৃত্যু-দর্শনের
প্রশ্নে দ্বিধাদ্বন্দ রবীন্দ্রনাথের নিজের মনেও অবশিষ্ট ছিলো,
যা তাঁর বিদ্যালয়টির কল্যাণরূপিণী পত্নীকে অসময়ে হারিয়ে বেড়ে উঠেছিলো
সঙ্গত কারণেই। প্রিয়জনদের নানারকম দুঃখ-সওয়া এবং দুঃখ-দেওয়া অকালমৃত্যুগুলি
প্রত্যেকটিই একটিমাত্র প্রশ্ন করে বসে আছে রবীন্দ্রনাথের মনে-
মানুষের জীবনে দুঃখের ভূমিকা কি? উত্তর খুঁজতে গিয়ে অনেক ভাবনাই
ভেবেছিলেন তিনি, কিন্তু গুছিয়ে নিতে পারছিলেন না যেন। অবশেষে তাঁর
‘শমী ঠাকুর’ এর মৃত্যু এতো দুঃখ নিয়ে এলো যে, কবি বুঝি বলে উঠলেন-
আরো দুঃখ! রাখবো কোথায়? আবার দুঃখও বুঝি রবীন্দ্রনাথকে বলে উঠলো-
আমাকে আবার রাখবে কি? আমি যে তোমার প্রাপ্য রাখার আধার। এরপর দুঃখকে
পুরোপুরি বুঝলেন কবি, তাঁর মৃত্যু-দর্শনের স্নিগ্ধতা কোজাগরী পূর্ণিমার
মতোই তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখলো। তিনি ছিলেন পুরোপুরি মানবকল্যাণে
নিবেদিত প্রাণ, তাই স্বজন বিয়োগ বেদনা বা মৃত্যুযন্ত্রণা এবং তজ্জনিত
জীবনবিমুখতা তাঁর কাছে হয়তো স্বার্থমগ্নতার ই অন্য এক রূপ। তাই
তিনি অবলীলাক্রমে গেয়ে থাকতে পারেন -
“মৃত্যু
সে ধরে মৃত্যুর রূপ, দুঃখ হয় হে দুঃখের কূপ, তোমা হতে যবে হইয়ে
বিমুখ আপনার পানে চাই॥“
নয়তো
মৃত্যু জীবনের অমোঘ পরিণতি, তা নিয়ে এত বিচলিত হওয়ার কোন কারণ
নেই,
“"তোমার
অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই-- কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু,
কোথা বিচ্ছেদ নাই ॥
সৈয়দ
মুজতবা আলি তাঁর 'বড়বাবু' গ্রন্থে 'মৃত্যু' নামে একটি হৃদয়গ্রাহী
প্রবন্ধ লিখেছেন। তিনি বর্ণনা করেছেন কিভাবে রবীন্দ্রনাথ একে একে
অতি আপনজন হারিয়েছেন। প্রাণাধিকা বৌদিকে হারানোর পর বড়ভাই গত
হলেন, পিতা গত হলেন। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী মারা গেলেন প্রায় ৩০
বছর বয়সে যখন কবির বয়স ৪১। এরপর মারা গেলেন দ্বিতীয়া কন্যা রেণুকা।
বছর চারেক পরেই কলেরায় মারা গেলেন পুত্র শমীন্দ্রনাথ
১৩ বছর বয়সে। এর প্রায় বছর দশেক পরে মৃত্যুমুখে পতিত হলেন বড় মেয়ে
মাধুরীলতা। ৭১ বছর বয়সে কবি হারালেন তাঁর স্নেহের নাতি বিদেশে
অধ্যয়নরত নীতুকে।
কবি
একদিন মৈত্রেয়ী দেবীকে বলেছিলেন, 'তোমরা যাকে ভালোবাসা বল, সে
রকম করে আমি কাউকে কোনোদিন ভালোবাসিনি। বন্ধু-বান্ধব, সংসার, স্ত্রী-পুত্র
কোনো কিছুই আমি তেমন করে আঁকড়ে ধরিনি। ভেতরে একটা জায়গায় আমি নির্মম,
তাই আজ যে জায়গায় এসেছি, সেখানে আসা আমার সম্ভব হয়েছে। তা যদি
না হতো, যদি জড়িয়ে পড়তুম তা হলে আমার সব নষ্ট হয়ে যেত।' লেখক হিরন্ময়
ভট্টাচার্যের মন্তব্য, 'সাধারণ মানুষের ভালোবাসা এবং তাঁর ভালোবাসার
মধ্যে পার্থক্য এই যে তারা ভেঙে পড়ে, তিনি অসীম শক্তি দিয়ে নিজেকে
সংযত রাখতেন।' অনেক শোক, দুঃখ-তাপ পার হয়ে তিনি এই উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন
- তাই মৃত্যুকে সে পূর্ণতার অংশ বলে মেনে নিতে তাঁর আপত্তি নেই
। কবি সুকুমারের মৃত্যু উপলক্ষে তিনি লিখছেন -
“আমাদের
ঋষিরা বলেছেন, পরকে যে আত্মবৎ দেখেছে সেই সত্যকে দেখেছে। কেবল
কুটুম্বকে, কেবল দেশের মানুষকে আত্মবৎ দেখা নয়, মহাপুরুষেরা
বলেছেন শত্রুকেও আত্মবৎ দেখতে হবে। এই সত্যকে আমি আয়ত্ত করতে
পারি নি বলে একে অসত্য বলে উপহাস করতে পারব না, একে আমার সাধনার
মধ্যে গ্রহণ করতে হবে। কেননা পূর্ণস্বরূপের বিশ্বে আমরা ফাঁক
মানতে পারব না। এই কথাটি আজ এত জোরের সঙ্গে আমার মনে বেজে উঠেছে
তার কারণ সেদিন সেই যুবকের মৃত্যুশয্যায় দেখলুম সুদীর্ঘকাল দুঃখভোগের
পরে জীবনের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর মতো অত বড়ো বিচ্ছেদকে,
প্রাণ যাকে পরম শত্রু বলে জানে, তাকেও তিনি পরিপূর্ণ করে দেখতে
পেয়েছেন। তাই আমাকে গাইতে অনুরোধ করেছিলেন--
আছে
দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে,
তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।
নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্যলেশ,
সেই পূর্ণতার পায়ে মন স্থান মাগে॥
-----
তাঁকে গান শুনিয়ে ফিরে এসে সে রাত্রে আমি একলা বসে ভাবলুম, মৃত্যু
তো জীবনের সব শেষের ছেদ, কিন্তু জীবনেরই মাঝে মাঝেও তো পদে পদে
ছেদ আছে। জীবনের গান মরণের শমে এসে থামে বটে, কিন্তু প্রথম থেকে
শেষ পর্যন্ত তার তাল তো কেবলই মাত্রায় মাত্রায় ছেদ দেখিয়ে যায়।”
রবীন্দ্রনাথের
মৃত্যু-দর্শনের প্রেক্ষণবিন্দুতে আছে একটি বোধ, তা হলো- মৃত্যু
তার শোক ও দুঃখের মাধ্যমে জীবনের- সত্যের, মুক্তির ও শক্তির- ত্রয়ীরূপকেই
ফুটিয়ে তোলে। সুতরাং সুখের মতো দুঃখকেও স্বাগত জানাও, স্বাগত জানাও
জীবনের মতো মৃত্যুকেও। নিজেকে বলো -
‘আমি
মৃত্যু-চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে / যাব আমি চলে ।'
কিন্তু
এসব কিছুর পরও ‘আঁধার রাতের এক একলা’ রবীন্দ্রনাথ আবিষ্কৃত
হন। বিষণ্ণ প্রজ্ঞায় তিনি খুঁজে পান না কাউকে, কোনো এক শিপ্রানদীতীরে
‘পূর্ব জনমের প্রথমা প্রিয়ারে’ তিনি আর খুঁজে পান না।
সাহিত্যের ক্যাথারসিস ছেড়ে একজন রবীন্দ্রনাথ তখন আকাশ পেরোনো নিঃসঙ্গতা
নিয়ে বুকের কাছের বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেন। আকাশ তখন অন্ধকার,
বাতাসের ব্যাকরণে সূর্যমুখী সুখ, কবিতার খাতায় হরিণীর পোট্রেট,
সকল শব্দেরা প্রাঙমুখী.. ..।
লেখক
পরিচিতি - ডঃ আনন্দ দাশগুপ্ত - প্রথম জীবন কেটেছে প্রবাসে, পাটনাতে।
১৯৮৬ সাল থেকে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থায় অধ্যাপনায় রত, বর্তমানে
ব্যাঙ্গালোরে একটি সরকারী সংস্থায় কর্মরত। সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা
থেকে লেখালেখি শুরু অনেকদিন ধরেই। প্রকাশিত হয়েছে কবিতার বই, এছাড়া
বিভিন্ন প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু পত্র-পত্রিকাতে, এই সময়,
কৃত্তিবাস, ইত্যাদি। সম্পাদিত গ্রন্থ - স্বাধীনতা।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।