নাম-মাহাত্ম্য
মহাকবি শেকস্পীয়ার বলেছিলেন
– ‘নামে কি এসে যায়’। কিন্তু মানুষের আর তাদের দ্বারা সৃষ্ট
ভাষার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখি – অনেক কিছুই যায় আসে। “ধম্মপুত্তুর
যুধিষ্ঠির” – এই শব্দবন্ধটির প্রয়োগ কিন্তু মোটেই কোন প্রশংসায়
পঞ্চমুখ হয়ে নয়, বরং তা কোন মানুষের নীতিবাগীশ স্বভাবকে নিন্দা
করার জন্য। ভাবখানা – সাক্ষাৎ ধর্মপুত্র হয়ে যুধিষ্ঠির যদি ভালকাজে
অধর্মের সাহায্য নিতে দ্বিধা না করেন, তো তুমি কোন ছার!!অত পুণ্য
কাজ করেও যুধিষ্ঠির কিন্তু ভাষা ক্ষেত্রে নামী হয়ে রইলেন তাঁর
যুদ্ধক্ষেত্রে একটি অ-যুধিষ্ঠিরীয় কর্মের জন্য। একই কথা প্রযোজ্য
‘ঘরশত্রু বিভীষণ’ এর ক্ষেত্রেও। তিনি কিন্তু মানবিক কাজ করলেন
– ধর্মের জন্য স্বীয় ভ্রাতাকে পরিত্যাগ করে ধার্মিক রামচন্দ্রের
সাথে যোগ দিলেন – বিধি বাম, তিনি চিহ্নিত হয়ে রইলেন তাঁর পরিবারের
বিরুদ্ধতা করার জন্য। ঠিক এমনি ভাবে আমরা খুঁজে দেখছি এমন কিছু
‘নামী’ মানুষকে যাঁরা যুগান্তরেও অমর হয়ে আছেন তাঁদের নামের
মাধ্যমে।
বহু যুগ পূর্বে, ভারতের
উত্তরার্ধ ও দাক্ষিণাত্য পরস্পরের থেকে আলাদা ছিল যার মাধ্যমে
সে হল সু উচ্চ বিন্ধ্য পর্বত। তার ক্রম বর্ধমান উচ্চতার ফলে
দুই ভারতের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা ছিল খুব মুশকিল। পৌরাণিক
কাহিনী অনুযায়ী মুনি ঋষিরা শরণাপন্ন হলেন মহামুনি অগস্ত্যর।
মুনিবর ছিলেন চেহারায় ছোটখাটো, তিনি উত্তর ভারত থেকে দাক্ষিণাত্যে
যাত্রা করলেন। পথে বিন্ধ্য পর্বতের সঙ্গে দেখা হল – মুনি কে
দেখেই পর্বত শ্রদ্ধায়, সম্ভ্রমে মাথা নীচু করল। মুনি আশীর্বাদ
করে তাঁকে পার হলেন, অনুরোধ করলেন – তিনি অল্প কিছুদিনের মধ্যেই
ফিরবেন। ততদিন যেন বিন্ধ্য মাথা নীচু করেই থাকে। বিন্ধ্য সেই
আদেশ পালন করল। কিন্তু মুনি আর ফিরলেন না, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের
মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন হল। সেই যে যাত্রা করে অগস্ত্য আর ফিরলেন
না, সেই থেকে ‘অগস্ত্য যাত্রার’ অর্থ নির্ধারিত হল –‘যে যাত্রায়
যাত্রীদের প্রত্যাবর্তনের আশা নেই’!
শ্রীরামচন্দ্রের এক পূর্বপুরুষের
নাম ছিল ‘ত্রিশঙ্কু’। তাঁর শখ হল সশরীরে স্বর্গবাসের। দ্বারস্থ
হলেন কুলগুরু বশিষ্ঠের। বশিষ্ঠ চমকে উঠলেন – অসম্ভব, মানুষের
পক্ষে জীবন ধারণ করে স্বর্গবাস ‘নৈব নৈব চ’। কিন্তু ত্রিশঙ্কু
নাছোড়! বশিষ্ঠ ক্রোধান্বিত হয়ে শাপ দিলেন – ত্রিশঙ্কু রূপান্তরিত
হলেন চণ্ডালে। কিন্তু তা সত্বেও সশরীরে স্বর্গবাসের চিন্তা ছাড়লেন
না। এবার শরণাপন্ন হলেন বিশ্বামিত্রর – বিশেষ ক্ষমতাবলে তিনি
সশরীরে ত্রিশঙ্কুকে প্রেরণ করলেন স্বর্গে। কিন্তু বাদ সাধলেন
দেবরাজ ইন্দ্র – তিনি একদমই এই পছন্দ করলেন না, পুনরায় ফেরত
পাঠালেন মর্ত্যে – এই দুই দেবতার লড়াইয়ে ত্রিশঙ্কুর স্থান হল
– স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝে কোন এক জায়গায়। আজ ‘ত্রিশঙ্কু অবস্থা’
বলতে বোঝায় ঠিক তাই – ‘দুই স্থিতাবস্থার মধ্যে এক অনভিপ্রেত,
দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থা’।
এ ত গেল পুরাকালের কথা।
একালেই আমাদের একটি ভীষণ প্রিয় মিষ্টির মধ্যে লুকিয়ে আছেন বিখ্যাত
এক শাসকের স্ত্রী – লেডি ক্যানিং। পানতোয়া নামে পরিচিত মিষ্টিটি
যে লেডিকেনি নামে পরিচিত তার পিছনে ক্যানিং মহোদয়ার এই বিশেষ
মিষ্টির প্রতি অসম্ভব প্রীতি। আরো এগিয়ে এলে দেখতে পাবো আমাদের
পরিচিত ‘নক্সালপন্থী’ শব্দটি। এই তথাকথিত উগ্রপন্থী আন্দোলনের
ভারতবর্ষের শুরু যে জায়গাটি থেকে তার নাম – নক্সালবাড়ী। যে উগ্রপন্থীরা
এই জায়গার বাসিন্দা তারা চিহ্নিত হতে থাকল –‘নক্সাল’ নামে।
বাংলাতে কতিপয় হলেও ইংরাজীতে
এই ধরণের নামী শব্দের ছড়াছড়ি। নিকোলাস শভিন ছিলেন নেপোলিয়নের
সেনাবাহিনীর এক সদস্য। অসাধারণ সাহসী এই সৈনিকটির এক বড় দুর্বলতা
ছিল -“অন্ধ আনুগত্য” - নেপোলিয়নের প্রতি। সৈন্যবাহিনীতে তা রীতিমত
হাসির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরবর্তীকালে এই “অন্ধ আনুগত্য” জন্ম
দিল একটি নতুন শব্দের - ‘Chauvinism (শভিনিজম)’। একবিংশ শতাব্দীতে
ও এমন মানুষের সংখ্যা কম নয় যারা এখনও পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বে রীতিমত
বিশ্বাস রাখেন, এঁরা “Male-chauvinist” নামে উপহাস্য হন। এখন
প্রখ্যাত ধারাভাষ্যকার জিওফ বয়কটকে আমরা সকলেই চিনি। ইনি যখন
নিজে ক্রিকেট খেলতেন, তুমুল বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছিলেন। একবার
ভারত সফরের আগে শোনা গেল - ভারতের দাবী বয়কটকে ইংল্যান্ড টীম
বয়কট করুক কারণ তিনি দক্ষিণ আফ্রিকাতে ক্রিকেট খেলেছিলেন। দক্ষিণ
আফ্রিকা তখন তাদের বর্ণ বৈষম্য নীতির জন্য ক্রীড়া থেকে বঞ্চিত
হত। উনবিংশ শতাব্দীতে (১৮৮০ সালে), আইরিশ ল্যান্ড ও লীগ, আয়ারল্যান্ডের
জমিদার চার্লস বয়কট কে ‘সামাজিক বর্জন’ করার নীতি নিয়েছিল। তা
করুক, ইংরেজী অভিধান কিন্তু সাদরে ‘Boycott’ শব্দটিকে গ্রহণ
করল ‘সামাজিক বর্জন’ এর প্রতিশব্দ রূপে। আর এক খ্যাতনামা ব্যক্তি
জন মন্টাগু। ইনি ছিলেন সাংঘাতিক জুয়াড়ী। জুয়ার নেশাতে খাওয়া
দাওয়া মাথায় উঠত। জুয়াও চলবে সঙ্গে খাওয়াও, এই ভেবে তিনি উদ্ভাবন
করলেন চটজলদি খাওয়ার এক নতুন উপায় - বেয়ারাকে হুকুম করতেন দুটি
রুটির মধ্যে টুকরো টুকরো মাংস দিয়ে রাখতে যাতে সহজেই, খালি হাতে
কাঁটা চামচ ছাড়াই খাওয়া যায়। এই ভদ্রলোকের পরিচিতি হল, ইনি স্যান্ডুইচের
চতুর্থ আর্ল। আজও চটজলদি খাবার হিসেবে ‘স্যান্ডউইচ’ অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
প্রাচীন গ্রীসে দণ্ডদাতা ছিলেন ‘ড্রাকো’। তাঁর দণ্ডবিধি ছিল
অতীব কঠোর - প্রায় যে কোন অপরাধের সাজা ছিল ‘মৃত্যুদণ্ড’। আজ
‘Draconian Law’ বলতে খুব প্রাচীন এবং অসহনীয় কঠিন নিয়ম কানুন
যা আধুনিক যুগের সঙ্গে মানায় না। সম্মোহনের প্রতিশব্দ - “Mesmerism”
এর উৎপত্তি যে ব্যক্তিটির নাম থেকে তিনি হলেন ‘ফ্রানজ মেসমার’।
ইনি একজন অস্ট্রিয়ান ডাক্তার যিনি সম্মোহনের সাহায্যে রোগ সারানোর
চেষ্টা করে থাকেন। বিখ্যাত বক্তারা তাঁদের কথার যাদুতে শ্রোতাদের
মন্ত্রমুগ্ধ বা মেসমেরাইজড করে ফেলেন। একটি বিশেষ পদ্ধতিতে ইস্পাতকে
বাতাসের আর্দ্রতা থেকে রক্ষা করা হয়ে থাকে, একে বলে গ্যাল্ভ্যানিজেশন
যে কথাটির উদ্ভব প্রখ্যাত ইটালীয় বিজ্ঞানী লুইগি গ্যালভানির
নাম থেকে। ইনি ব্যাং এর ওপর বিদ্যুতের পরীক্ষা চালিয়েছিলেন-
দেখিয়েছিলেন শরীর থেকে ছিন্ন পা ও বিদ্যুতের প্রভাবে সাড়া দেয়।
এই কথাটি কিন্তু আলংকারিক অর্থেও ব্যবহৃত হয়, এর মানে - ‘To
stimulate by shock’। এটির ব্যাবহার সদর্থেই -‘The threat of
losing their jobs galvanized the men into action’।
শেষে খুব পরিচিত একটি শব্দ।
থিওডর রুসভেল্ট ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার
আগে তিনি ছিলেন ভালুক শিকারে সিদ্ধহস্ত। রাষ্ট্র প্রধান হওয়ার
পর যখন খেলনা ভালুকের প্রচলন হল, তখন সস্নেহে আমেরিকানরা নাম
দিল ‘টেডি বীয়ার’ যা আজ আমাদেরও খুব ই প্রিয়। ‘টেডি’ হল ‘থিওডর’
এর ভগ্নাংশ।
ভাস্কর
বসু
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।