প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

দিল্লীর নির্ভয়া ও নারী নির্যাতন

এই বছরটা সপ্তদশ শতক নয়। অষ্টাদশ, উনবিংশ, বা বিংশ শতকও নয়। শতক একবিংশ - বছরটা ২০১২, প্রায় ২০১৩ ছুঁই ছুঁই। বছরের শেষ মাস, ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে সন্ধ্যে সাড়ে ন'টা নাগাদ ভারতবর্ষের রাজধানীতে চলতি বাসের মধ্যে ছ'জন পুরুষ মিলে একটি তেইশ বছরের মেয়েকে গণধর্ষণ করে। মেয়েটি সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরছিল। তারপরে মেয়েটিকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে লোকগুলো বাস থেকে তাকে রাস্তায় ফেলে দেয়। মেয়েটি একা ছিল না। তার সঙ্গে ছিল আঠাশ বছরের চাকুরিরত একজন পুরুষ বন্ধু। বাসের আততায়ীরা মেয়েটির সঙ্গীকে প্রথমেই রড দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞান অবস্থায় রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। রক্তাক্ত অবস্থায় পরে দুজনকে লোকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মেয়েটির তখন জীবন সংশয়।

খবরটা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে দিল্লী শহর ফেটে পড়ল ক্রোধে। শহরের যুব সম্প্রদায় শৈত্য প্রবাহ উপেক্ষা করে দলে দলে নেমে পড়ল রাস্তায় - দাবী ন্যায় বিচার চাই; ধর্ষণকারীদের ফাঁসী দেওয়া হোক; সরকার দেশে মেয়েদের সুরক্ষা নিশ্চিত করুক। প্রথম দিকের শান্তিপূর্ণ মিছিল কয়েকদিনের মধ্যেই পরিণত হল আক্রোশের হাউইয়ে। দেশের লোক দূরদর্শনের মাধ্যমে দেখল পুলিশের সঙ্গে দিল্লীর ছাত্র সমাজের খণ্ডযুদ্ধ - ইঁট ছোঁড়া, লাঠি চার্জ; জল-কামান। ভারতের প্রায় প্রতিটি শহরে আরম্ভ হল প্রতিবাদ মিছিল - মুখে কাল কাপড় বেঁধে এবং মোমবাতি হাতে নাগরিকের সারি। এই লেখার মুহূর্তেও অগুন্তি নারী পুরুষের প্রতিবাদ মিছিল চলছে। সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে সংবাদটি জেনে যাওয়ার পরে সেই মিছিল এখন শোক মিছিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের মানুষ মেয়েটির নামকরণ করেছে "নির্ভয়া।" সে নিজের জীবন দিয়ে ভারতের সমাজ ব্যবস্থাকে কিছু কঠিন প্রশ্নের সম্মুখে দাঁড় করিয়ে বিদায় নিয়েছে। তার সঙ্গী পুরুষটির শারীরিক অবস্থা এখন কি রকম আমরা জানি না। আশা করি লোক চক্ষুর অন্তরালে সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে।

এই গণধর্ষণ ও হত্যা অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং নিন্দার্হ তাতে সন্দেহ নেই। শুধু লজ্জাজনক বা নিন্দার্হ বলা আমার ভাষার দারিদ্রের প্রতীক; শব্দদুটি এই অপরাধকে বর্ণনা করে না। কিন্তু প্রশ্ন জাগে নির্ভয়ার ধর্ষণ মানুষকে কেন এত বিচলিত করেছে? চারদিকে এত হৈ চৈ কেন? ভারতের সর্বত্র ধর্ষণ বেড়ে চলেছে - সরকারী পরিসংখ্যানের দিকে একবার নজর বোলালেই ব্যাপারটার গুরুত্ব সম্পর্কে সামান্য সংকেত পাওয়া যায়।

জাতীয় অপরাধ সংস্থার (ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো) হিসেব অনুসারে ২০১১ সালে ভারতে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ২৪২০৬, অন্যান্য সব অপরাধের চেয়ে বেশী। ঐ সালে মধ্যপ্রদেশে নথিভুক্ত ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৩৪০৬; পশ্চিম বঙ্গে ২৩৬৩; উত্তরপ্রদেশে ২০৪২; এবং রাজস্থানে ১৮০০। ২০১১ সালে ৫৬৮ ধর্ষণের ঘটনা শুধু দিল্লীতেই নথিভুক্ত করা হয়েছিল। নারী নির্যাতনের মামলার ঝটিত নিষ্পত্তি হবে আশ্বাস দেওয়া সত্বেও ২০১১ সালের খতিয়ান অনুসারে তামিলনাডুতে শতকরা ৮২.৯ ধর্ষণের মামলার নিষ্পত্তি হয় নি। অন্যান্য রাজ্যের অবস্থা জানা নেই। সব চেয়ে বড় কথা এই সব পরিসংখ্যান শুধু নথিভুক্ত ধর্ষণ ভিত্তিক। ধরে নেওয়া যায় সামাজিক অবস্থার জন্যে খুব কম করে হলেও অন্ততঃ শতকরা ৭০ জন ধর্ষিতা পুলিশের কাছে অভিযোগ করা নিরাপদ মনে করেন না। অর্থাৎ ধর্ষণের তিনটি ঘটনা পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হলে আরও সাতটি অদৃশ্যই থেকে যায়।

ধর্ষণ দিল্লীতে বা দেশের অন্যান্য রাজ্যে অচেনা অপরাধ নয়। প্রায় প্রতিদিনই তা ঘটে চলেছে এবং হাঁটার পথে এঁটো শালপাতা পড়ে থাকার মত মানুষ এ সব এড়িয়ে চলতে শিখে গেছে। তাহলে নির্ভয়ার ধর্ষণ নিয়ে এত চাঞ্চল্য কেন? নির্ভয়া ছাত্রী বলে; না কি এই ধর্ষণের নৃশংসতা মানুষের সহ্যের বাইরে; অথবা উটের পিঠের মত জমে থাকা পুঞ্জিভূত অসন্তোষের ওপর এ হল শেষ একটি খড়কুটো; না কি নারীর সামাজিক নিরাপত্তার প্রতি পুলিশ ও সরকারী মহলের ক্রমাগত অবজ্ঞার প্রতি জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ?

এ সব প্রশ্ন তুলে নির্ভয়াকে কোন অসম্মান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি সারা জীবন নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে এবং নারী মুক্তির জন্যে কাজ করেছি, সংগঠন চালিয়েছি। জীবনের বাকি সময়টুকুও তাতেই ব্যয় করব জানি। সুতরাং নির্ভয়ার ধর্ষণ ও খুন আমার কাছে কোন নতুনত্ব বয়ে না আনলেও নিজের অক্ষমতা সম্পর্কে দুঃখ বাড়ায়। তবে নির্ভয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমি বলতে চাই যে তার ধর্ষণ নতুন কিছু নয়। তার ধর্ষণ ভারতীয় সমাজে নারীর ক্রম নিম্নগামী অবস্থানের প্রতীক। যার সংকেত দিনে রাতে আমাদের চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে।

এই সময়ে রাজনীতিবিদ, সংবাদ মাধ্যম, বুদ্ধিজীবি, সাধারণ মানুষ, সকলের বক্তব্যের কলরবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা আমি শুনতে পেয়েছি নির্ভয়ার এক ধর্ষণকারীর মুখে। ধর্ষণের পর সে অমন নিষ্ঠুর ভাবে মেয়েটিকে কেন পিটিয়েছিল জানতে চাওয়ায় লোকটি বলে আক্রমণের সময়ে তাকে বাধা দিতে মেয়েটি তাকে থাপ্পড় মারে, হাত কামড়ে দেয়। উচিত 'শিক্ষা' দিতে লোকটি তাকে মারে। এই শিক্ষাদানও নতুন কিছু নয়। এই ধরণের 'শিক্ষা' সমাজ মেয়েদের প্রায়ই দেয়। যে মেয়েরা সাড়ি ছেড়ে সালোয়ার কামিজ পরে কলেজে যেতে সাহস করে, যারা সন্তানের জননী হয়েও একা একা ‘পাব’-এ যায়, যারা বাবা এবং দাদাদের নির্দেশ না মেনে নিজের জীবনসঙ্গী বেছে নেয়, একা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে, বা রাত সাড়ে নটার সময়ে সিনেমা দেখে বাসে চড়ে বাড়ী ফেরে, তাদের 'শিক্ষা' দিতে সমাজ জোর কদমে এগিয়ে আসে। কখনও এই 'শিক্ষাদাতারা' কলেজের অধ্যক্ষ; কখনও বন্ধু, প্রতিবেশী, বা আত্মীয়স্বজন; কখনও নিজের বাবা ও ভাই; আবার কখনও সম্পূর্ণ অপরিচিত পুরুষ। অনেক সময়ই ধরে নেওয়া হয় এই শিক্ষকেরা নির্দোষ; কারণ এই সব মেয়েরা নিজেদের ব্যবহারে, পোষাকে, এবং অ-নারীসুলভ হাবেভাবে পুরুষদের প্রলুব্ধ করেছে, উত্তেজিত করেছে। অতএব সমাজের নিয়ম ভাঙার অপরাধে এই মেয়েরা দোষী; নিজেদের নির্যাতনের দায়িত্ব তাদের নিজেদেরই নিতে হবে।

দিল্লীর অসংগঠিত যুব প্রতিবাদের ছায়া আজ সর্বত্র। দেশের মানুষ ন্যায় বিচার চাইছে নিশ্চয়ই । কিন্তু এক্ষেত্রে ন্যায় কি? ন্যায়ের রূপ কি? লোকেদের দাবী শুনে মনে হয় আদালত নির্ভয়ার ধর্ষণকারীদের প্রাণদণ্ড দিলে সাধারণ মানুষ হয়ত তাকে ন্যায় বিচার বলবে। নির্ভয়ার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ধর্ষণের মামলা এখন ধর্ষণ ও হত্যার মামলায় পরিণত হয়েছে । দেশের আইন অনুসারে অবশ্যই উপযুক্ত শাস্তি দোষীকে পেতেই হবে। কিন্তু অনেকেই এখন দাবী করছে আইনী পরিবর্তন আনা প্রয়োজন; ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদন্ড করা হোক। এতে কি সত্যিই ধর্ষণের প্রবণতা কমবে?

বস্তুতঃ এখন অবধি বিশ্বের বহু দেশেই দেখা গেছে শাস্তির কাঠিন্যের সঙ্গে অপরাধ কমার বিশেষ কোন সম্পর্ক নেই। শুনেছি মধ্যপ্রাচ্যের কিছু রাজ্যে চুরি করলে হাত কেটে দেওয়া হয়, তাই সেখানে চোর নেই। কিন্তু সত্যিই কি আমরা সেই ধরণের সমাজে বাস করতে চাই যেখানে নিজের ক্ষুধার্ত সন্তানকে খাওয়ানোর জন্যেও একটি রুটি চুরি করলে হাত কেটে দেওয়া হবে? তাহলে ট্যাক্স রিটার্নে কারচুপি করলে কি হবে? এ বিষয়ে খুব বেশী তর্কবিতর্কে না গিয়ে বলা যায় আমাদের সমাজ সেই বর্বর আইনী অবস্থান থেকে অনেক দূরে সরে এসেছে। সেখানে আর ফিরে যাওয়া চলে না।

কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড বাধ্যতামূলক করা এর চেয়েও বিপজ্জনক । এর ফলে ধর্ষিতার মৃত্যুর পরোয়ানা সই করাই সার হবে। ধর্ষণ এবং খুনের শাস্তি যদি এক হয়, ধর্ষিতাকে বাঁচতে দেওয়ার পক্ষে কোন যুক্তিই তখন আর ধর্ষণকারীর থাকে না। বরং এই অপরাধের প্রধান সাক্ষীকে সরিয়ে ফেলে নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ সে নিতে চাইবে। যে সমস্ত দেশে নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠিন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে সেখানেও খুন এবং ধর্ষণের শাস্তি ভিন্ন রাখা হয়েছে এই একই কারণে। যে সমস্ত ক্ষেত্রে ধর্ষণের সঙ্গে ধর্ষিতাকে মারধর করা হয়, সেখানে ধর্ষণ এবং খুনের প্রচেষ্টার জন্যে মামলা রুজু করা হয়।

আমাদের দেশে ধর্ষণের জন্যে মৃত্যুদণ্ড বহাল করার আরও কিছু সমস্যা রয়েছে। সর্বভারতীয় এক নিরীক্ষায় দেখা গেছে শতকরা ৯৫টি ঘটনায় ধর্ষক ধর্ষিতার পরিচিত। এই অবস্থায়, সে যতই ঘৃণ্য হোক না কেন, মেয়েরা অভিযোগ করতে ইচ্ছুক নাও হতে পারে। এছাড়া বিবাহের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সহবাসের পরে বিয়ে না করলে এখনও অনেক মেয়েরা ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করে। এ ক্ষেত্রে কি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সত্যি যুক্তিযুক্ত? শুধু তাই নয়, দেশের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্যে বহু নির্দোষের বিরুদ্ধেও ধর্ষণের মামলা রুজু করা হয়। সেখানে কি করা হবে? তাহলে কোন অবস্থায় মৃত্যুদণ্ড দেবে আদালত? শুধু মাত্র গণধর্ষণের শিকার হলে, না কি ধর্ষণকারী অপরিচিত হলে? কে দায়িত্ব নেবে এই আইনের সঠিক প্রয়োগ হচ্ছে কিনা দেখতে? আমার মনে হয় আজ যাঁরা মৃত্যুদণ্ডের জন্যে আন্দোলন করছেন তাঁরাই এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবেন যখন দোষ নির্বিচারে গ্রেপ্তার চলবে এবং পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্যে ঘুষের পরিমান বাড়াতে থাকবে।

কড়া শাস্তিতে ধর্ষণকারী নিবৃত্ত হবে না। আবার আন্দোলনকারীদের সামাল দিতে সরকার যে চটজলদি ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে তাও খুব ফলপ্রসূ হবে মনে হয় না। তাঁদের মতে দিল্লীর যানবাহনের কর্মীদের এখন থেকে পরিচয়পত্র সঙ্গে নিতে হবে। আমার সাধারণ বুদ্ধিতে এতে কি করে ধর্ষণ ঠেকানো যাবে ধরতে পারলাম না। ডিসেম্বরের ১৬ তারিখের পর থেকে এত গণ আন্দোলনের মধ্যেও ধর্ষণের সংখ্যা কিছু মাত্র থমকে থাকে নি। পত্রপত্রিকার রিপোর্ট অনুসারে শুধু পশ্চিমবঙ্গেই প্রতিদিন দু তিনটি ধর্ষণ ঘটে চলেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ ধর্ষিতার বয়স দু বছর। তাহলে উপায় কি?

নারী বিষয়ক গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে ধর্ষণের মূলে রয়েছে নারীর প্রতি আগ্রাস, তাকে দমন করার ইচ্ছা; যৌন আকাঙ্ক্ষা নয়। অল্প কথায় সুসান ব্রাউনমিলার চমৎকার করে বলেছেন 'রেপ ইজ এ্যাবাউট ভায়োলেন্স, নট সেক্স।' সেই জন্যেই প্রাচীনকালে যুদ্ধে বিজয়ী সৈন্য বিজিত দেশের নারীদের যথেচ্ছ ধর্ষণ করত। এর কারণ শুধু নারীকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া নয়, সেই দেশের পুরুষদের দেখিয়ে দেওয়া তাদের সম্পত্তি সম্পূর্ণভাবে অন্যের পদানত। সেই ট্র্যাডিশন এখনও সমানে চলছে। সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ, প্রাক্তন চেকোস্লোভাকিয়া, রোয়াণ্ডা, কঙ্গো, ও অন্যান্য অনেক দেশে এ রকম উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি পাওয়া যাবে। এই বিশ্লেষণ মেনে নিয়ে ২০০৮ সালে রাষ্ট্রসংঘ ধর্ষণকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। শুধু বৃহৎ যুদ্ধে নয়, গোষ্ঠী দ্বন্দ্বেও ধর্ষণ অবাধে ব্যবহৃত হয়। যেমন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক বিবাদের ফলে এক দলের মহিলাকে অন্য দলের পৃষ্ঠপোষকেরা বহু ক্ষেত্রে পরিকল্পিত ভাবে ধর্ষণ করে।

অর্থাৎ ধর্ষণ নারী নির্যাতনের একটি প্রকাশ, অন্য কিছু নয়। সাধারণ ঈভ টিজিং ও মৌখিক যৌন নির্যাতন থেকে আরম্ভ করে পারিবারিক নির্যাতন ও ধর্ষণ সব কিছুই কম থেকে বেশী একটি লাইনে পড়ে। অর্থাৎ এ সবই আপেক্ষিকভাবে অনবচ্ছেদ্য অত্যাচার। এর মূলে রয়েছে সমাজে নারীর গৌণ অবস্থান যা প্রকাশিত হয় কন্যা ভ্রূণ হত্যা, মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ না দেওয়া, সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা, সব কিছুর মধ্যেই। এর জন্যেই রাতের বেলায় বেড়াতে গিয়ে একটি মেয়ে ধর্ষিতা হলে আমরা জিজ্ঞেস করি সে কেন এত রাতে বাড়ির বাইরে গিয়েছিল? জিজ্ঞেস করি না ধর্ষণকারীর এমন জঘন্য ব্যবহার কেন? কোন স্বামী তার স্ত্রীকে মারধর করলে প্রশ্ন করি স্ত্রী কি দোষ করেছিল? কখনও ভাবি না মহিলা যত দোষই করুক না কেন, তাকে শারীরিক আঘাত হানার অধিকার তার স্বামীর নেই।

সুতরাং ধর্ষণ বন্ধ করতে হলে দরকার সমাজে সব রকমের নারী নির্যাতনে ইতি টানা। তাই বা ঘটে কি করে? তার জন্যে অবশ্যই প্রযোজন নারীর গৌণ অবস্থানের অবসান ঘটানো। আর সে জন্যে দরকার আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরের, প্রতিটি কোনা কুঠুরী থেকে নারীকে ছোট করার বীজ সমূলে উৎপাটন করা। একটু ভাল করে দেখলেই বোঝা যায় কি ভাবে আমাদের জীবনের প্রতিটি মোড়ে আমরা নারীকে পুরুষের চেয়ে নিচু করার ব্যবস্থা করে রেখেছি। ভ্রূণ নষ্ট করা থেকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুযোগ, ইত্যাদি সব কিছু থেকে প্রতিপদেই আমরা মেয়েদের বঞ্চিত করি, ছোট করি। আমাদের জীবনের একটি আনন্দ মুহূর্ত, বিয়ে নিয়েই একটু ভাবা যাক।

আমাদের বিয়ের একটি বিশেষ অঙ্গ কন্যাদান। কন্যার পিতা হবু জামাইয়ের পা ধরে (এখন সেটা প্রতীকী হিসেবে হাঁটু হয়েছে) অনুরোধ করেন তাঁর সালঙ্কারা, সুবেশী মেয়েকে গ্রহণ করতে। সে রাজী হলে পিতা কন্যাকে সম্প্রদান করেন পুরুষটির হাতে। কেন এই ব্যবস্থা? কন্যা কি একটা সামগ্রী যে এক হাত থেকে অন্য হাতে ট্র্যান্সফার করা চলবে? সে কি তার পিতার সম্পত্তি মাত্র - এখন স্বামীর সম্পত্তি হল? কন্যাদান নিয়ে প্রশ্ন তুললে অনেকেই আমাদের সংস্কার ও সংস্কৃতির দোহাই তোলেন। তাঁরা ভুলে যান সহমরণও আমাদের ট্র্যাডিশন, শাস্ত্রে লেখা; বহু বিবাহ, গৌরী দানও সংস্কার। সংস্কৃতি পাল্টানো চলে, সংস্কার সব সময় শুভ হয় না। পাণিগ্রহণের বেলাতেও সেই একই সমস্যা। বিবাহ পদ্ধতিতে পুরুষ নারীকে গ্রহণ করে কিন্তু নারীর সে অধিকার নেই। তাহলে সে কি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় নি, না কি তার মতামতের কোন মূল্য আমরা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে দিতে নারাজ?

অনেকেই বলেন এ তো বিশাল কর্মকাণ্ড - আমি একজন ব্যক্তি মাত্র, কি এসে যাবে আমার সামান্য কাজে? মুস্কিলটা সেখানেই। কর্মকাণ্ড বিশাল সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা সকলেই যদি নিজেকে ক্ষুদ্র ব্যক্তিমাত্র জেনে পেছিয়ে যাই তাহলে পরিবর্তন আসবে কেমন করে? শুধু সরকারের প্রণীত আইনী ব্যবস্থায় সমাজে পরিবর্তন কার্যকরী হবে তা মনে করা হাস্যকর। কারণ সেই আইনও আমরা ব্যক্তিবিশেষে মানব অথবা মানব না। আমরা কি সত্যিই সব ক্ষেত্রে আইন মানি? আজ যাঁরা আইনের কড়াকড়ি হোক বলে চেঁচামেচি করছেন, তাঁদের কতজন দেশের পণ বিরোধী আইনটি মেনে চলেন? কতজন রাস্তায় নেমে ট্র্যাফিক আইন সর্বদা মানেন? আইনের প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে; এবং সেই আইন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রয়োগ করাও অত্যন্ত জরুরী। সে নিয়ে কাজ করছে অনেকে। কিন্তু নাগরিক এবং মানুষ হিসেবে আমাদেরও কিছু করার দায়িত্ব রয়েছে। আমাদের প্রতিদিনের কাজে কর্মে আমরা সেই সমস্ত পরিবর্তন আনতে পারি যা নারীকে এক উন্নততর অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে।

চলুন বাবা মা হিসেবে নির্ভয়ার নামে আমরা শপথ করি বিবাহ পদ্ধতি থেকে কন্যাদান আমরা বাদ দেব। পাণিগ্রহণের সময়ে আমাদের ছেলেমেয়েরা , নারী এবং পুরুষ, দুজনে দুজনকে গ্রহণ করবে। আর এ ব্যপারে নিজেদের মতামত আমরা সকলকে জানাব। ছাত্র ছাত্রীদের বলি, নির্ভয়ার নামে তোমরা স্কুলে কলেজে মেয়েদের সুরক্ষা গোষ্ঠী গড়ে তোল। কোন মহিলা বিপদে পড়লে এগিয়ে এসে তাকে সাহায্য কর। সেই সঙ্গে প্রতিজ্ঞা কর তোমরা কখনও কোন মেয়েকে ছোট করবে না; ঈভ টিজিং করবে না; সব সময়েই মহিলাদের সম্মান তোমরা নিশ্চিত করবে।

অন্যান্য অনেকের মত আমি এটুকু বুঝি যে নির্ভয়ার যুদ্ধ তার একার নয়। এ বিশ্বের সমস্ত নারী সমাজের লড়াই, সব শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের লড়াই। এ ব্যাপারে সামিল হওয়া আমাদের সকলের অঙ্গীকার।

শমীতা দাশ দাশগুপ্ত

1 Jagran Josh. (2012, July 5). National crime record bureau released the crime statistics for 2011. Available: http://www.jagranjosh.com/current-affairs/national-crime-record-bureau-released-the-crime-statistics-for-2011-1341490766-1
2 FP Staff. (2012, June 4). Delhi remains India's rape capital; 'safe' Mumbai is a close second. First Post.Life. Available: http://www.firstpost.com/living/delhi-remains-indias-rape-capital-safe-mumbai-is-close-second-331060.html
3 Vasundara, R. (2012, December 29). Huge caseload of pending rape cases. The Times of India. Available: http://timesofindia.indiatimes.com/city/chennai/Huge-caseload-of-pending-rape-cases/articleshow/17801681.cms
4 TNN. (2012, December 27). In 95% of cases, rapists known to victims. The Times of India. Available: http://timesofindia.indiatimes.com/city/mumbai/In-95-cases-rapists-known-to-victims/articleshow/17775519.cms

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।