নির্ভয়ার
আত্মদান কি ভারতীয় সমাজে পরিবর্তন আনতে পেরেছে?
২০১২ সালের ১৬-ই ডিসেম্বর
সন্ধ্যেয় তেইশ বছরের এক ছাত্রী তার পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে নতুন
দিল্লীর শহরতলীতে 'লাইফ অফ পাই' নামে একটি জনপ্রিয় সিনেমা দেখতে
গিয়েছিল । সিনেমা শেষে দুই বন্ধুর বাসে করে ফেরার ভয়ঙ্কর বৃত্তান্ত
শুধু ভারতীয়দের নয়, সারা পৃথিবীর জনসমাজকে নাড়িয়ে দিয়েছে । চলতি
বাসের মধ্যে ছজন যুবক মিলে মেয়েটিকে বীভৎসভাবে ধর্ষণ করে এবং
তার বন্ধুকে লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয় । সেই পৈশাচিক
গণধর্ষণের ফলে বারো দিনের মাথায় মেয়েটি মারা যায় ।
ধর্ষণ ভারতবর্ষে নতুন সমস্যা
নয়; এমনকি ধর্ষিতার মৃত্যুও অভিনব ঘটনা নয় । কিন্তু এই একটি
মৃত্যু ভারতের যুবসমাজে আগুন জ্বালিয়ে দিল । ভারতের প্রায় প্রতিটি
ছোট বড় শহরে জনতা রোষে ফুঁসে উঠল । ভারতের রাজধানীতে পুলিশ ও
প্রতিবাদীদের খণ্ডযুদ্ধ চলল প্রায় মাসখানেক । অন্যত্র চলল শোক
মিছিল, দৈনন্দিন জীবনে মহিলাদের সুরক্ষার প্রতি সরকারের অবহেলার
বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ । সরকারের কাছে নাগরিকেরা দাবী করল
সমাজের প্রতি স্তরে মেয়েদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে, দেশের
আইন শৃঙ্খলা আরো পোক্ত করতে হবে । ভারতের সঙ্গে সমকণ্ঠে প্রতিবাদ
গড়ে উঠল সারা বিশ্বে । নতুন দিল্লীর বাসের সেই ধর্ষিতা হয়ে দাঁড়াল
নারীর ওপর যৌন অত্যাচারের এক আন্তর্জাতিক প্রতিক । তার নতুন
নামকরণ হল ঐনির্ভয়া ।
নির্ভয়াকে কেন্দ্র করে
ভারতীয় সমাজে যে নজীরবিহীন আলোচনার সূচনা ঘটল তার সামান্য তুলনা
করা যায় সত্তর দশকের পুলিশের হেফাজতে মথুরা ধর্ষণকাণ্ডের সঙ্গে
। সেদিনের সেই আলোচনার ফলে ভারতীয় দণ্ডবিধি কিছুটা পাল্টেছিল
ঠিকই, কিন্তু সমাজে বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটে নি । থানায় আদিবাসী
কিশোরী মথুরাকে ধর্ষণ করেছিল দুই পুলিশ কনস্টেবল । এর পর থেকে
সরকারী ও বেসরকারী দায়িত্বশীল পদে নিযুক্ত ধর্ষণকারী কর্মীদের
শাস্তি সুকঠিন করা হল । কিন্তু সত্যি বলতে কি এই আইনী পরিবর্তন
সমাজের চিন্তাধারা বা ব্যবহারে খুব একটা তারতম্য ঘটায় নি । সেই
তুলনায় নির্ভয়ার আত্মদান সমাজের প্রতি স্তরে যৌন অত্যাচার সম্পর্কে
অনেক বেশী সচেতনতা গড়ে তুলেছে, সেই সঙ্গে বেশ কিছু আইনী পরিবর্তনও
এনেছে ।
প্রশ্ন জাগে হঠাৎ এই সচেতনতার
কারণ কি? বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ভারতের প্রতিটি অঞ্চলে ধর্ষণ এবং
ধর্ষণের পরে খুন সাধারণ লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায় । যেটুকু
প্রতিবাদ ওঠে তা নারী সংগঠন এবং ধর্ষিতার পরিবার কাছ থেকে ।
এ সব তুচ্ছ কারণে সরকারকে বড় একটা বিচলিত হতে দেখা যায় না ।
তাহলে এহেন চরিত্র বিরোধী কর্মতৎপরতা কেন? নির্ভয়ার গণধর্ষণের
পরে শুধুই জনরোষ কেন্দ্রিয় সরকারকে আইন পরিবর্তনের দিকে ঠেলে
নিয়ে গেছে মনে করলে ভুল হবে । এর পেছনে বেশ কিছু অন্য অনুপ্রেরণাও
কাজ করেছে ।
১৯৮০ সালে জুলাই মাসের
৩০ তারিখে ভারত রাষ্ট্রপুঞ্জের Convention on the Elimination
of All Forms of Discrimination against Women (CEDAW) এই চুক্তিটিতে
সই করে এবং তা কার্যকারী করে ৯ জুলাই ১৯৯৩ সালে । এই চুক্তির
জোরেই ভারতের নারীবাদী সংস্থাগুলি পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ
আইন-২০০৫ পাশ করতে কেন্দ্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করে ও সফল হয় ।
CEDAW-এর পাশাপাশি ১৯৯৩ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জ Declaration on the
Elimination of Violence against Women (DEVAW) চুক্তিটি প্রকাশ
করে । রাষ্ট্রপুঞ্জের চুক্তিগুলি আইনগত ভাবে বাধ্যকর না হলেও
এর বক্তব্য নারী প্রতিরক্ষার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক নৈতিক মান
নির্ধারণ করে । শুধু তাই নয়, ২০০৮ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা
পরিষদ ধর্ষণকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে স্বীকার করে নেয় । ২০১২
সালের ক্রান্তিক্ষণে ভারতের জনরোষ রাষ্ট্রপুঞ্জের এই চুক্তিগুলির
সঙ্গে মিলিত হয়ে তৈরী করল এক বিশাল ঝড়, যা ভারতে যৌন অত্যাচার
ও ধর্ষণ সংক্রান্ত দণ্ডবিধিতে গভীর পরিবর্তন এনেছে ।
পুরোনো
কথা
ভারতে এক জনপ্রিয় বিশ্বাস
ধর্ষণ আধুনিকতা, ঔপনিবেশিক পশ্চিমী সভ্যতা, আর আগ্রাসী সংবাদ
মাধ্যমের হাত ধরে আমাদের মধ্যে উপস্থিত হয়েছে । কিন্তু বাস্তব
হল এ সব কিছুর বহু আগে থেকে আমাদের সমাজে ধর্ষণ কিছু কম ছিল
না । সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের দেশের বহু সমাজব্যব্স্থা ও সংস্কৃতির
মধ্যে মেয়েদের যৌন অত্যাচারের সম্ভাবনার স্বীকৃতি রয়েছে । উদাহরণ
হিসেবে বলা যায় মেয়েদের চার দেওয়ালের ভেতরে বন্দী রাখার রেওয়াজের
মূলে রয়েছে মেয়েরা বাইরের জগতে বেরোলে ধর্ষিত হবে সেই ভীতি;
পরিবারের মধ্যে কুমারী মেয়ের যৌন অত্যাচার ঠেকাতে করা হয়েছে
গৌরী দানের বন্দোবস্ত । দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে জমিদারের
রোষ ঠেকাতে চাষীবাড়ীর নতুন বৌকে প্রথম রাত কাটাতে হত সেই জমিদারের
অঙ্কশায়িনী হয়ে । দক্ষিণে গরীব বাড়ির সুশ্রী মেয়েদের ধর্ষণ অনিবার্য
জেনেও মন্দিরের দেবদাসী হিসেবে বিক্রী করে দেওয়া হত । রাজস্থান
ও উত্তরপ্রদেশের কিছু অঞ্চলে নট, বেডিয়া, বনcছরা, ও কঞ্জর সম্প্রদায়ের
মেয়েদের যৌন সম্ভোগ করার পূর্ণ অধিকার উঁচু জাতের পুরুষদের এখনও
রয়েছে । এ ব্যাপারে মেয়েদের সম্মতি গ্রহণের কোন প্রশ্নই ওঠে
না । নারীর প্রতি যৌন অত্যাচারের গল্প প্রায় প্রতি আঞ্চলিক সাহিত্যে
রয়েছে । চম্বলের ডাকাতরানী ফুলন দেবীর জীবনী পড়লে যৌন অত্যাচারের
গভীরতা সম্পর্কে আঁচ পাওয়া যায় ।
সরকারী পরিসংখ্যান ব্যবস্থা
চালু হওয়ার পর থেকেই দেখা যায় ভারতে ধর্ষণের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান
। সরকারী তথ্য অনুসারে ২০১২ সালে ২৪,৯২৩টি ধর্ষণের কেস নথীবদ্ধ
করা হয়েছে । ১৯৭১ সালের তুলনায় এই বৃদ্ধি শতকরা ৮৭৩ শতাংশ ।
কিন্তু ভারতের জনসংখ্যা অনুপাতে হিসেব করলে সংখ্যাটি সামান্যই,
১০০,০০০ মানুষের মধ্যে মাত্র দুটি । সংখ্যাটি হাস্যকর রকমের
কম। পরিসংখ্যান দফ্তরের নির্দেশকের মতে এর কারণ বেশীর ভাগ ধর্ষণের
ঘটণা পুলিশের অগোচরে থেকে যায় । অন্য দিকে বেসরকারী গণনা অনুসারে
ভারতে প্রতি ২১ মিনিটে একটি ধর্ষণ ঘটে । একটি সমীক্ষা অনুসারে
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এক থেকে চার শতাংশ নারী স্বীকার করেছেন
যে তাঁরা ধর্ষণের শিকার, কিন্তু সিংহভাগই বলেন পুলিশকে জানানো
তাঁরা বাঞ্ছনীয় মনে করেন নি । কেন করেন নি, সে উত্তর হেলাফেলার
নয় । এই মহিলাদের মতে পুলিশকে বিশ্বাস করা চলে না । সত্যিই কি
তাই?
জাতীয় মানবিক অধিকার কমিশনের
আধিকারিক, জাস্টিস জে এস ভার্মার মতে ভারতে মানবিক অধিকার ভঙ্গের
ব্যাপারে পুলিশ এবং সেনাবাহিনীই অগ্রনী । পুলিশের হেফাজতে ধর্ষণ,
বন্দী নিগ্রহ, অত্যাচারের ফলে মৃত্যু, এবং সাহায্যপ্রার্থীর
অবমাননা আকছার ঘটে । ভারতীয় সেনা অধ্যুষিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলে
প্রধান ধর্ষণকারী হল সেনাবাহিনী । এ ধরণের ব্যবহারের ফলে আইন
সংরক্ষণকারীদের প্রতি সাধারণ নাগরিকের আস্থা না থাকাই স্বাভাবিক
। একবার জানাজানি হয়ে গেলে ধর্ষিতার প্রতি সাধারণ মানুষের সন্দেহ
ও ঘৃণা এবং ভবিষতে নিগ্রহের আশঙ্কা পুলিশের প্রতি অনাস্থা আরও
জোরদার করে তোলে; তৈরী হয় জনসাধারণ ও পুলিশের মধ্যে এক বিরাট
পাঁচিল । ফলে সরকারী গুনতিতে ধর্ষণের সংখ্যা অবাস্তব রকমের কম
হয়ে দেখা দেয় ।
পরিসংখ্যানের এই সমস্যা
অবশ্য আরম্ভ হয় অপরাধের আইনগত সংজ্ঞা থেকে । ভারতীয় দণ্ডবিধি
৩৭৫ ধারা অনুসারে কোন পুরুষের সঙ্গে যখন কোন নারীর যৌন সংসর্গ
ঘটে (ক) মহিলার অনুমতির বিরুদ্ধে; (খ) মহিলার সম্মতি ছাড়া; এবং
(গ) ভয় দেখিয়ে মহিলার সম্মতি আদায় করে, তখন তা ধর্ষণের পর্যায়ে
পড়ে । (ধর্ষণের সম্পূর্ণ আইনী সংজ্ঞার জন্যে এখানে
ক্লিক করুন) আইনগত ভাবে নারীর শরীরে পুরুষাঙ্গ প্রবেশ করলেই
ধর্ষণ হয়েছে ধরা হয় । কিন্তু পুরুষের যৌনাঙ্গ না হয়ে যদি আঙুল
বা অন্য কোন বস্তু শরীরে ঢোকানো হয়, অথবা শরীরে অনুপ্রবেশ না
করিয়ে যৌন অত্যাচার চলে, তাহলে তা কি ধর্ষণ ঘটেছে বলা চলবে?
আইনে ব্যাপারটা খুব পরিষ্কার নয় ।
এছাড়া পরিসংখ্যান সংগ্রহের
সময়ে ধর্ষিতার মৃত্যু ঘটলে তা গোনা হয় খুন হিসেবে, ধর্ষণ হিসেবে
নয় । অর্থাৎ যাকে নিয়ে এত আন্তর্জাতিক হৈ চৈ, সেই নির্ভয়াকে
ধর্ষণ নয়, হত্যা হিসেবে গণনা করা হয়েছে ।
শুধু তাই নয়, ভারতে বিবাহ
পরবর্তী ধর্ষণের স্বীকৃতি না থাকায় ধরে নেওয়া হয় স্বামী স্ত্রীকে
ধর্ষণ করতে পারে না । ফলে দাম্পত্য ধর্ষণ পরিসংখ্যানে গোনা হয়
না । এর ব্যতিক্রম ঘটে একমাত্র স্ত্রীর বয়স পনেরো বছরের কম হলে
। এই সমস্ত সমস্যার ফলে ভারতে ধর্ষণের সরকারী পরিসংখ্যান খুব
একটা বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করা যায় না ।
স্বাধীন ভারতে বেশ কিছু
ধর্ষণের কেস কুখ্যাত হয়েছে । যেমন ১৯৭২ সালে মহারাষ্ট্রের পুলিশ
থানায় আদিবাসী মেয়ে মথুরার ধর্ষণ - ধর্ষণকারী দুই কনস্টেবল;
১৯৭৩ সালে মুম্বাইয়ের হাসপাতালের মধ্যে নার্স অরুণা শানবাগের
বীভৎস ধর্ষণ - ধর্ষণকারী এক সহকর্মী; ১৯৯১ সালে কাশ্মিরে প্রায়
৫১ জন মহিলার গণধর্ষণ - ধর্ষণকারী ভারতীয় সৈন্যবাহিনী; ১৯৯২
সালে রাজস্থানে সমাজসেবী ভঁয়োরী দেবীর গণধর্ষণ - ধর্ষণকারী গ্রামের
মুরুব্বী স্থানীয় ব্যক্তিরা; ১৯৯৬ সালে কেরালায় ষোল বছরের মেয়েকে
চল্লিশ দিন বন্দী অবস্থায় রেখে গণধর্ষণ; ১৯৯৮ সালে কলকাতায় বাংলাদেশী
পর্যটক হানুফা খাতুনের গণধর্ষণ; ২০১২ সালে কলকাতায় সুজেট জর্ডনের
গণধর্ষণ, ইত্যাদি । এঁরা ছাড়াও বহু বিদেশী মহিলা ভারতে পর্যটনে
এসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন । এই ভয়াবহ তালিকার শেষ নেই।
ধর্ষণের ঘটনাগুলি ভয়ঙ্কর
নিঃসন্দেহে, কিন্তু এর চেয়েও ভয়াবহ ধর্ষণ সম্পর্কে সরকারী কর্মচারী,
আইনজীবি, এবং সাধারণ মানুষের মনোভাব । ধর্ষিত হওয়ার জন্যে অনেক
সময়ে ধর্ষিতাকেই এরা দোষী সাব্যস্ত করে । ধর্ষণের কারণ হিসেবে
তাঁরা ধর্ষিতার জীবনযাত্রার দিকে আঙুল তোলেন - তার পরিচ্ছদ,
দিন বা রাতের কোন সময়ে সে বাড়ীর বাইরে গিয়েছিল, তার চাকরী বা
কাজ, বিবাহিত কি না, তার যৌন অভিজ্ঞতা রয়েছে কিনা, এবং সে কার
সঙ্গে সময় কাটিয়েছে, বিশেষ করে সঙ্গী যদি পুরুষ হয় । অন্ধ্র
প্রদেশের এক কংগ্রেস নেতা, সত্যনারায়নের মতে, "ভারতবর্ষ
মধ্য রাত্রে স্বাধীনতা পেয়েছে বলে মহিলারা সন্ধ্যের পর বাড়ীর
বাইরে বেরোবে তা তো আর মানা যায় না!" ২০০৯ সালে গোয়াতে
কর্মরতা এক রাশিয়ান যুবতী কংগ্রেসের এক কর্মীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের
অভিযোগ আনার পরে সেই নেতা মন্তব্য করে, "যে মহিলা অপরিচিত
পুরুষের সঙ্গে মাঝ রাত অবধি ঘোরাফেরা করে, তিনি ধর্ষণের অভিযোগ
করলে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে তা বিচার করা উচিত ।" ভঁয়োরী
দেবীর ধর্ষণকারীদের বিচারের সময় আদালতে বিচারক বলেন, "একজন
মধ্যবয়স্ক পুরুষের পক্ষে নিজের ভাইপোর উপস্থিতিতে ধর্ষণ করা
অসম্ভব ।"
জামাকাপড়, হাবভাব, পশ্চিমী
চিন্তাধারা, ইত্যাদির দোহাই দিয়ে ভারতের বহু মন্ত্রী, প্রখ্যাত
লেখক, ও ধর্মগুরুই যৌন অত্যাচারের দায়িত্ব সরাসরি মহিলাদের ঘাড়ে
চাপিয়ে দেয় । নির্ভয়ার ধর্ষণ এবং মৃত্যুর পর রাজস্থানের এক সাংসদ
দাবী জানায় যে মেয়েদের স্কুল ইউনিফর্ম স্কার্ট হওয়া চলবে না
। মধ্য প্রদেশের এক মন্ত্রী ধর্ষণের জন্যে জিনস এবং টি শার্টকে
দায়ী করে দুটিই প্রকাশ্যে আগুনে পোড়ান । পশ্চিমবঙ্গের মূখ্য
মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির মতে দেশে ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার কারণ ছেলেমেয়েদের
মধ্যে মেলামেশার আধিক্য । এগুলো সবই সংবাদপত্র/টিভি-র খবর –
ধরে নিচ্ছি সত্য। বলা বাহুল্য রাজনৈতিক নেতাদের এই ভ্রান্ত ধারণা
পুলিশ ও জনসাধারণের মধ্যেও সংক্রমিত হয় । ফলে পুলিশ যৌন অত্যাচার
সংক্রান্ত এফ আই আর নিতে চায় না এবং বেশীর ভাগ সময়েই মহিলাদের
মিথ্যেবাদী সাব্যস্ত করে তাদের চরিত্রের প্রতি কটাক্ষপাত করে
। প্রসঙ্গত বলতে হয় মহিলাদের প্রতি যৌন অত্যাচারে দেশের মধ্যে
পশ্চিমবঙ্গের স্থান সর্বোচ্চ ।
শিশু ধর্ষণ
জনমতে প্রাপ্তবয়স্ক ধর্ষিতা
দোষী সাব্যস্ত হলেও প্রশ্ন জাগে যখন শিশুরা ধর্ষিত হয় তাদের
কি দোষী ভাবা যায়? ২০১৩ সালের ১৪-ই ফেব্রুয়ারি মহারাষ্ট্রে ছয়
থেকে এগারো বছরের তিন বোনকে কেউ বা কারা ধর্ষণ করে হত্যা করে;
নির্ভয়ার ধর্ষণের পরেপরেই জনবহুল এক ট্রেনের বাথরুমে সাত বছরের
একটি মেয়েকে ধর্ষণ করে ধর্ষণকারী তাকে ছত্তিসগঢ় রেলস্টেশনে ছুঁড়ে
ফেলে দেয়; নাগপুরে ছত্রিশ বছরের এক ধর্ষণকারীর যৌন অত্যাচারে
চার বছরের একটি মেয়ের মৃত্যু ঘটে; দিল্লীর রাস্তায় দুজন প্রাপ্তবয়স্ক
পুরুষ একটি পাঁচ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করে তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায়
ফেলে পালিয়ে যায় । এই ঘটনাগুলি ভারতে শিশু ধর্ষণের কয়েকটি মাত্র
উদাহরণ ।
রাষ্ট্রপুঞ্জের শিশু প্রতিরক্ষা
চুক্তিতে সই করেও যৌন অত্যাচার থেকে শিশুদের বাঁচাতে ভারতে আইন
পাশ করা হয়েছে মাত্র ২০১২ সালে । তার আগে শিশুদের ওপর যৌন অত্যাচারের
স্বীকৃতি ভারতে ছিল না বললেই চলে । শিশু ধর্ষণের অপরাধ প্রাপ্তবয়স্কদের
জন্যে তৈরী ধর্ষণের দণ্ডবিধির আওতায় ফেলা হত । ২০১২ সালের আইন
পাস হবার পরে শিশুদের যৌন অত্যাচারের বিচার হয় বিশেষ দণ্ডবিধি
অনুসারে । এছাড়া শিশু যৌন অত্যাচারের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্কদের
নিয়ে তৈরী পর্নোগ্রাফিও ধরা হয় । কিন্তু এ পর্যন্ত শিশু যৌন
অত্যাচার বন্ধ করার জন্যে সামগ্রিক কোন প্রয়াস ভারতে হয় নি ।
২০১৩ সালে প্রকাশিত মানব
অধিকার সংস্থার একটি সমীক্ষায় পাওয়া গেছে যে ভারতে বছরে প্রায়
৭২০০-টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয় । অবশ্য এই সংখ্যার অনেক বেশী
শিশু-ধর্ষণের ঘটনা পুলিশের কাছে নিঃসন্দেহে অজানাই রয়ে যায় ।
২০০৭ সালে তেরোটি রাজ্য ঘিরে ভারত সরকারের এক সমীক্ষায় দেখা
যায় যে ৫৩.২২ শতাংশ শিশু যৌন অত্যাচারের শিকার হয়েছে । কিন্তু
বেশীর ভাগ ঘটনাই পুলিশকে জানানো হয় নি । তবে শিশু যৌন অত্যাচারের
বেশীর ভাগ ঘটনাই ঘটে পরিবারের মধ্যে, নিকট আত্মীয়দের হাতে ।
দিল্লীর জনসেবী সংস্থা , সাক্ষী , ৩৫০ জন স্কুল ছাত্রীকে সমীক্ষা
করে দেখে যে শতকরা ৬৩ শতাংশই পরিবারের মধ্যে বাবা, দাদু, এবং
অন্যান্য আত্মীয়ের হাতে নির্যাতিত হয়েছে । দিল্লীর আর একটি স্বেচ্ছাসেবী
সংঘ, রাহি, পাঁচটি রাজ্যে ১০০০ জন ইংরেজী স্কুলে পড়া শিক্ষিত
মহিলাকে সমীক্ষা করে দেখে শতকরা ৭৬ শতাংশ ছেলেবেলায় যৌন অত্যাচারের
শিকার হয়েছে এবং এদের মধ্যে ৩১ শতাংশের সঙ্গে অত্যাচারীর বিশ্বাসের
সম্পর্ক ছিল, আর ৪০ শতাংশের অত্যাচারী তাদের নিকট আত্মীয় । রাহির
গবেষণা অনুসারে শতকরা ৪২ শতাংশ মহিলার যৌন অত্যাচারী তাদের কাকা,
মামা, বা জ্যাঠা, ৪২ শতাংশের অত্যাচারী জ্যাঠতুত, খুড়তুত, বা
মামাত ভাই, ৪ শতাংশের অত্যাচারী বাবা, ৪ শতাংশ নিজের ভাই, এবং
৮ শতাংশ সংসারের ঘনিষ্ঠ বিশ্বাসভাজন মানুষ ।
গবেষকদের মতে ভারতে শিশু
যৌন অত্যাচারের এই সাংঘাতিক পরিস্থিতির মূলে রয়েছে আমাদের দেশের
যৌথ পারিবার ব্যবস্থা । সত্যি বলতে কি যৌথ পরিবার, যেখানে বহু
আত্মীয় পরিজন একসঙ্গে বসবাস করে, সেটি হয়ে দাঁড়ায় শিশুদের ওপর
যৌন অত্যাচারের উর্বর ক্ষেত্র । যে বিশ্বাসের ওপর ভর করে যৌথ
পরিবার চলে, সেই বিশ্বাসেরই সুযোগ নিয়ে একই পরিবারভুক্ত বহু
পরিজন শিশুদের ওপর যৌন অত্যাচার করে ।
মহিলারা অনেক সময় ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও অশান্তি বা দুর্নামের
ভয়ে চুপ করে থাকেন । বাড়ির কাকা, জ্যাঠা, মামা, দাদা, বন্ধুবর্গ,
পরিচারক, যারা স্বাধীন ভাবে যত্রতত্র ঘোরাফেরা করতে পারে, তারাই
হয়ে দাঁড়ায় ভক্ষক । ছোটরা অনুযোগ করলে বড়রা হয় তা বিশ্বাস করে
না অথবা তাদের চুপ করে থাকতে নির্দেশ দেয় । পুলিশে রিপোর্ট করা
বা অত্যাচারীকে আইনগত ভাবে শাস্তি দেওয়ার কোন বন্দোবস্ত কেউ
করে না । ফলে শিশুরাও চটপট শিখে যায় এ সব ব্যাপারে উচ্চবাচ্চ
না করাই ভাল । যৌন আগ্রাসের শিকার হওয়া তাদের দৈনন্দিন জীবনে
স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায় ।
শিশু যৌন
অত্যাচার স্বীকৃতিতে বাধা
ভারতীয় সমাজে শিশু যৌন
অত্যাচার স্বীকৃতিতে কিছু বাধা রয়েছে । এর মধ্যে প্রধান হল শিশু
চরিত্র সম্পর্কে সমাজের মতামত । আমরা ধরে নিই শিশুদের নিষ্পাপ
রাখতে তাদের মধ্যে যৌন চেতনা জাগানো চলবে না । বিশেষতঃ কুমারী
মেয়েরা যেন প্রাক বিবাহ যৌনতা বিষয়ে সচেতন না হয় । সমাজে ধরে
নেওয়া হয় কুমারিত্ব মেয়েদের অলঙ্কার; এ হারালে মেয়ের আর কোন
দামই নেই । সমাজে 'ভালো' মেয়েরা যৌন বিষয়ে অনভিজ্ঞ ও অজ্ঞ হয়
। ভালো মেয়ের যৌন চেতনা জাগে বিয়ের পরে তার স্বামীর চেষ্টায়
। ভারতীয় সমাজে কম বয়সেই মেয়েরা এই নীতি বুঝে যায় । এর কুফল
হল যৌন আগ্রাস বুঝতে ও ঠেকাতে মেয়েরা অক্ষম হয়ে পড়ে; যৌন আক্রমণের
শিকার হলে তা সঠিকভাবে কাউকে জানাতে পারে না ।
ভারতীয় সমাজে সব যৌন ক্রিয়াকেই
মনে করা হয় স্বেচ্ছায় ঘটিত যৌন সম্পর্ক, সে ধর্ষণই হোক বা যৌন
অত্যাচারই হোক । মনে করা হয় এতে দু পক্ষেরই সম্মতি রয়েছে । ধরে
নেওয়া হয় যৌন আগ্রাসের শিকার শিশুরাও নৈতিক ভাবে দোষী । তার
ওপর আমাদের দেশে মেয়েদের সামাজিক পরিস্থান নির্ভর করে তাদের
চরিত্রের সুখ্যাতির ওপর । ফলে কোন মেয়ে বা শিশু যৌন অত্যাচারের
শিকার হলেও নিকট আত্মীয় স্বজনেরা তা লুকিয়ে রাখেন যাতে শিশু
বা মেয়েটির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত থাকে ।
দাম্পত্য
ধর্ষণ
ভারতে ধর্ষণ সম্পর্কীত
সব আলোচনায় ধরে নেওয়া হয় ধর্ষণকারী ও ধর্ষিতা পরস্পরের অচেনা
এবং ধর্ষণ ঘটেছে বাড়ির বাইরে । এই বিশ্বাসের খোলা বার্তা হল
একমাত্র অজানা ধর্ষণকারী আক্রমণ করলেই তাকে সত্যিকারের ধর্ষণ
ধরতে হবে, এবং সেই সব কেসই আইনের চোখে বিচার্য্য । কিন্তু জাতীয়
অপরাধ সংসদের পরিসংখ্যান অনুসারে ২০১২ সালে বিচারাধীন ৩৮, ১৪৪
ধর্ষণের কেসের মধ্যে শুধুমাত্র ১.৮ শতাংশ পরিস্থিতিতে ধর্ষিতা
ধর্ষণকারীকে চিনত না । অর্থাৎ সিংহভাগ কেসেই ধর্ষণকারী ধর্ষিতার
বিশ্বাসভাজন বা স্বজন । এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে
ভারতে দাম্পত্য ধর্ষণের কোন স্বীকৃতি নেই কেন? প্রশ্নটির উত্তর
পেতে হলে বিবাহ সম্পর্কে ভারতীয় মনোভাব খুঁটিয়ে দেখা দরকার ।
জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক, শ্রী মৃণাল সতীশের মতে, ভারতের আদালতে ধর্ষিতা যদি
কুমারী হয় তবে ধর্ষণের গুরুত্ব বাড়ে । বিবাহিত মহিলা ধর্ষিত
হলে আইন ব্যাপারটা খুব একটা গুরুত্ব দিতে চায় না; কারণ মহিলার
যৌন অভিজ্ঞতা রয়েছে, ফলে ধর্ষণের সত্যতা যাচাই করা যায় না ।
অর্থাৎ সমাজে ধর্ষণের সত্যতা এবং গুরুত্ব নির্ভর করে কৌমার্য্য
হারানোর ওপর । বিবাহ যোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হলে ধর্ষণের গুরুত্ব বেড়ে
যায় ।
বিয়ের সঙ্গে ধর্ষণের এই
অদ্ভুত যোগ ভারতীয় সমাজে স্পষ্ট দেখা যায় । এই বছর রাজস্থানের
এক গ্রামে পঞ্চায়ত ছয় বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অপরাধে ধর্ষণকারীকে
তার দোষ স্খালনের জন্যে নিজের আট বছরের ছেলের সঙ্গে মেয়েটির
বিয়ে দিতে আদেশ দেয়। দেশের প্রায় প্রতিটি রাজ্যে পুলিশ এফ আই
আর না নিয়ে ধর্ষিতাকে আদেশ দেয় ধর্ষণকারীকে বিয়ে করে ফেলতে ।
পুলিশের সঙ্গে ধর্ষিতার পরিবার ও আঞ্চলিক মুরুব্বিরাও মনে করে
ধর্ষণের উপযুক্ত খেসারত হল বিয়ে । জোরদার প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও
তারা ধর্ষণকারীকে পুলিশে না দিয়ে তাকে বাধ্য করে ধর্ষিতাকে বিয়ে
করতে । অনেক সময়ে আইনী বিচার এড়াবার জন্যে ধর্ষণকারীর পরিবার
ধর্ষিতার অভিভাবকদের আশ্বাস দেয় দুজনের বিয়ে দেওয়া হবে । এতে
ধর্ষিতার পরিবারও সন্তুষ্ট থাকে । আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার
পরেও অনেক ধর্ষণকারী জেল এড়াতে ধর্ষিতাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়
। নির্ভয়ার গণধর্ষণের পর ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারক, জাস্টিস
জি পি মাথুর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এক মিটিংয়ে গিয়ে বলে বসেন
ধর্ষণের একমাত্র সমাধান হল ধর্ষিতার সঙ্গে জোর করে ধর্ষণকারীর
বিয়ে দিয়ে দেওয়া ।
তবে আমাদের দেশে ধর্ষণের
অভিযোগ সব সময়ে অবিমিশ্র সত্য হয় না । নিজের ইচ্ছেয় প্রেমিকের
সঙ্গে সহবাস করার পর সেই পুরুষ প্রেমিক বিয়ে করতে অস্বীকার করলে
অনেক মহিলাই ধর্ষণের অনুযোগ আনে । মেয়ের প্রেমিককে পছন্দ না
হলে, বা সে নিচু জাতের হলে, কনের বাবা মাও অনেক সময়ে ছেলের বিরুদ্ধে
ধর্ষণের অভিযোগ আনেন ।
বিবাহে
শান্তি?
বিবাহ ধর্ষণদোষ নাশা মনে
করার সমস্যা অনেক । এই বিশ্বাসের ফলে মনে হতে পারে (ক) নারীর
মূল্য শুধুমাত্র বিবাহেই । অতএব ধর্ষণের মত জঘন্য অপরাধও লাঘব
হয় যদি ধর্ষণকারী ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে সম্মত হয়; (খ) কৌমার্য
হারালে নারীর মূল্য কমে যায়; অর্থাৎ ধর্ষনের ফলে সমাজে ধর্ষিতার
স্থান হারিয়ে যায়; (গ) বিয়ে হলেই নারী সুরক্ষিত; বিয়ের পর যৌন
অত্যাচারের কোন ভয় তার আর থাকে না । দুঃখের বিষয় ভারত সরকারের
উদ্যোগে ২০১২ সালের জাতীয় পারিবারিক স্বাস্থ্য সমীক্ষায় দেশের
এক তৃতীয়াংশ বিবাহিত মহিলা বলেন তাঁদের স্বামী প্রায়ই তাঁদের
চড় থাপ্পড় মারেন; শতকরা ১২ থেকে ১৫ শতাংশ স্বীকার করেন তাঁদের
স্বামী তাঁদের হাত মুচড়ে দিয়েছেন; এছাড়া ধাক্কা মারা, লাথি মারা,
কিছু ছুঁড়ে মারা ইত্যাদি স্বামীরা করে থাকেন । দশ শতাংশ বলেন
তাঁদের স্বামী তাঁদের ধর্ষণ করেছে । ২০১৩ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থার সমীক্ষায় দেখা যায় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিতে প্রায় ৪২ শতাংশ
মহিলাকেই তাঁদের স্বামীরা শারীরিক নির্যাতন এবং যৌন অত্যাচার
করেছে ।
দুঃখের বিষয় আমদের দেশে
এখনও দাম্পত্য ধর্ষণের কোন আইনী স্বীকৃতি নেই । বস্তুতঃ ধরে
নেওয়া হয় স্ত্রীর শরীর উপভোগের পূর্ণ অধিকার স্বামীর রয়েছে ।
তাই আইনগত ভাবে কোন স্বামী কখনই স্ত্রীকে ধর্ষণ করতে পারে না
। স্ত্রী হল স্বামীর সম্পূর্ণ অধীন । অতএব এক অধীনের নিজের শরীর
বা মন, কোন কিছুর ওপরে অধিকার থাকতে পারে না । যৌন সংসর্গে সম্মতি
দেওয়ার কোন প্রশ্নই সেখানে নেই । এছাড়া বিবাহিত জীবনে স্ত্রীর
প্রধান দায়িত্ব হল পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়া । তার শরীর এই পুত্রসন্তানের
ধারক মাত্র । সেই সন্তান জন্মের ব্যাপারে স্বামী তার নিজের মতামত
স্ত্রীর ওপর সম্পূর্ণ খাটাতে পারে ।
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের
দেশে বিয়ে করা মানে স্ত্রীকে ধর্ষণ করার অপরাধ থেকে সারা জীবনের
মত মুক্তি পাওয়া । সামাজিক নিয়ম অনুসারে বিয়েতে অলিখিত ভাবে
মেয়েরা স্বামীকে সর্বক্ষণের জন্যে যৌন সংসর্গের সম্মতি দান করে
। তারপর অসম্মতি জানানোর তার আর কোন অধিকার নেই । যৌন বিষয়ে
সম্পূর্ণ অচেতন একটি মেয়েকে যখন এক অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে বিয়ে
দেওয়া হয়, যৌন অত্যাচার বোঝা বা সে সম্পর্কে অভিযোগ করার জ্ঞান
বা সাহস তার থাকে না । বেশীর ভাগ সময় তার যৌন জীবন শুরু হয় ধর্ষণের
মাধ্যমে । আমাদের দেশের তীব্র পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায়
লালিত পুরুষেরা তাদের স্ত্রীর যৌন অনিচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধাশীল
বা সংবেদনশীল হবে তা মনে করা যায় কি? সম্বন্ধ করে বিয়ের ব্যবস্থা
সমাজে চালু থাকাকালীন দাম্পত্য ধর্ষণের আইনী স্বীকৃতি দেওয়া
কঠিন ।
রাজনীতির
হাতিয়ার
মাত্র কয়েকবছর আগে রাষ্ট্রপুঞ্জ
স্বীকার করে ধর্ষণ যুদ্ধক্ষেত্রে রাজনৈতিক হাতিয়ার । ইতিহাসে
দেখা যায় বিজিত গোষ্ঠীর নারীদের গণধর্ষণ করে জয়ী সৈন্যেরা সেই
সমাজ ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দিত । ধর্ষণের মাধ্যমে বিজয়ী দল বুঝিয়ে
দিত যে নিজেদের সম্পত্তি রক্ষা করার মত ক্ষমতা পরাজিতদের নেই
। এর নিদর্শন দেখি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ, রোয়াণ্ডায় অন্তর্দ্বন্দ্ব,
এবং যুগোস্লাভিয়া ভাগ হওয়ার সময়ে । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের
সময়ে ভারত ও পাকিস্তান, দুপক্ষের অগুনতি মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন
। ২০০২ সালে গুজরাত রায়টে আগ্রাসী হিন্দু দলগুলো মেয়েদের বিশেষভাবে
লক্ষ্য করে বীভৎস যৌন আগ্রাস চালিয়েছিল ।
যুদ্ধ ছাড়াই ভারতের রাজনৈতিক
দলগুলি ইদানিং নিজেদের দাপট জাহির করতে ধর্ষণকে হাতিয়ার হিসেবে
বেছে নিয়েছে । উদ্দেশ্য সেই অঞ্চলে দখলদারী বাড়ানো, ধর্ষিতার
আত্মীয় পুরুষদের অপমান করা, এবং প্রতিবাদী মেয়েদের নিঃশেষ করা
। ২০১১ সালে উত্তরপ্রদেশে ধর্ষিতাদের মধ্যে শতকরা ৫৮.৮ শতাংশ
মহিলা ছিলেন দলিত সমাজভুক্ত । ধর্ষণের মাধ্যমে সেখানে শ্রেণী
ও বর্ণ বৈষম্য দুটোই দৃঢ়তর হয়েছে । নট, বেদিয়া, ও বন্ছারা গোষ্ঠীর
মেয়েদের বেশ্যাবৃত্তিতে বাধ্য করার মূলেও রয়েছে উচ্চ বর্ণের
পুরুষদের দখলদারীর প্রচেষ্টা । অনেক সমাজসেবী মহিলা ধর্ষিত হয়েছেন
তাঁদের লক্ষ্য থেকে নিরস্ত করার উদ্দেশ্যে । এর প্রধান উদাহরণ
রাজস্থানে ভঁয়োরী দেবীর ধর্ষণ । ১৯৯২ সালে শিশু বিবাহ রোধ করতে
নামার পর স্থানীয় কর্তাব্যক্তিরা তাঁকে গণধর্ষণ করে । এ রকম
ঘটনা পশ্চিমবঙ্গেও ঘটে চলেছে । প্রতিপক্ষ দলের মহিলাদের সংগঠিতভাবে
ধর্ষণ করার ব্যপারে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলির কুখ্যাতি
রয়েছে । সাম্প্রতিককালে সিঙ্গুর, খেজুরি, ও নন্দিগ্রামে কৃষক
আন্দোলনের সময়ে গ্রামাঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্যে রাজনৈতিক
দলগুলি নিজেদের মধ্যে শুধু মারামারিই করে নি, গণধর্ষণও সংগ্রামের
অঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেছে ।
হারানো
পুরুষত্ব ফিরে পাওয়া?
ভারতে গণধর্ষণ বৃদ্ধির
সঙ্গে বাংলাদেশে মেয়েদের মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার প্রচলনকে গবেষকেরা
তুলনা করেন । ১৯৬০-এর দশক থেকে ২০০০ সাল অবধি বাংলাদেশে কমবয়সী
মেয়েদের মুখে অ্যাসিড ছোঁড়ার ঘটনা খুব বেড়ে গিয়েছিল । গণধর্ষণের
মত অ্যাসিডের শিকার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ছিল নিম্নবিত্ত পরিবারের
মেয়েরা । বিশ্বায়নের ফলে পশ্চিমের বহু বস্ত্র শিল্পই বাংলাদেশে
কারখানা খুলেছে, এবং তারা কমবয়সী মেয়েদের চাকরি দিতে পছন্দ করে
। ফলে বহু পরিবারেই মেয়েরা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান উপার্জনকারী;
তাদের টাকাতেই সংসার চলে । ফলে মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষতান্ত্রিকতার
নিয়মকানুন মানতে চাইছে না এবং প্রাচীন সমাজব্যবস্থার কায়েমী
পুরুষপ্রাধান্য চ্যালেঞ্জ করছে । কিছু সমীক্ষকের মতে এতে পুরুষ
আর্থসামাজিক পদবিচ্যুত হয়ে আত্মবিশ্বাস হারাচ্ছে । এর ফলে বিধ্বংসী
আগ্রাসের মাধ্যমে ছেলেরা জানিয়ে দিচ্ছে সমাজে মেয়েদের স্থান
কোথায় ।
মেক্সিকো আর টেক্সাসের
সীমার কাছে হুয়ারেজ শহরে নারী গণহত্যার ব্যাপারে গবেষকেরা এই
একই বিশ্লেষণ করেছেন । এক দশক ধরে প্রায় ৪০০ কমবয়সী মেয়ে হুয়ারেজে
খুন হয়েছে কিন্তু এখন অবধি কোন হত্যারই সমাধান হয় নি । বেশীর
ভাগ মেয়েই সেই শহরের মাল্টিন্যাশনাল শিল্পগুলির কর্মচারী ছিলেন
। এ ক্ষেত্রেও মনে করা হয় সেখানকার পুরুষেরা সমাজে নিজেদের হারানো
পদাধিকার খুঁজে পেতে মেয়েদের শিক্ষা দিচ্ছে ।
ইদানিংকালে ভারতেও মেয়েরা
অনেক বেশী রাস্তায় নেমেছে, চাকরী বাকরী করছে, প্রচীন সামাজিক
নিয়ম আর মানতে চাইছে না । আর্থসামাজিক এই পরিবর্তনের ফলে পুরুষের
আদি ভূমিকা খানিকটা টলটলায়মান । তারই ফলে বেড়ে চলেছে নারী ধর্ষণ
- পুরুষ প্রাধান্য জমাট রাখার নব উদ্যম । অর্থাৎ নারীকে বার্তা
দেওয়া যে তাদের সনাতনী ভূমিকায় ফিরে না গেলে ফল ভালো হবে না
।
কিন্তু এই বিশ্লেষণ মেনে
নেওয়া মানে নারী নির্যাতনের দায়িত্ব থেকে পুরুষকে ছাড় দেওয়া
। শুধু তাই নয়, এতে ধর্ষণের নৈতিক দায়িত্ব নারীর ওপরেই বর্তায়
। ধর্ষণ সম্পর্কে পুরুষদের নিয়ে গোয়ার একটি সমীক্ষায় এক যুবকের
বক্তব্য এ বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করে । তার মতে মেয়েদের সন্ধ্যে
ছটার পর বাড়ি থেকে বের হওয়া উচিত নয়, কারণ ধর্ষণ, অপহরণ, অনেক
কিছুই ঘটতে পারে । সেখানে এক দল যুবকের মতে আধুনিক মেয়েরা যৌন
উত্তেজক জামা কাপড় পরে বলেই তারা ধর্ষিত হয় । অর্থাৎ যে মেয়ে
ছটার পর বাড়ি থেকে বের হয় বা যৌন উত্তেজক জামা কাপড় পরে, সে
ধর্ষিত হলে নৈতিক দায়িত্ব তারই । ধর্ষণকারীর দায়িত্ব এখানে উহ্য
থেকে যায় । এমন কি কোন জামাকাপড় যৌন উত্তেজক ধরা হবে সে সম্বন্ধেও
কোন নির্দেশ নেই । মোদ্দা সংরক্ষণশীল ব্যবহার না করলে এই হল
মেয়েদের শাস্তি ।
শেষ কথা
হালকা টিটকিরি থেকে ধর্ষণ
ও খুন, যৌন অত্যাচারের বীভৎস ছায়া মেয়েদের জীবনের ওপর সবসময়
বর্তমান । পুরুষপ্রধান সমাজে শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত মেয়েদের
জীবনে যৌন অত্যাচার যে কোন সময়েই ঘটতে পারে । ঘরে, বাইরে, কর্মক্ষেত্রে,
কোন জায়গাতেই মেয়েরা সুরক্ষিত নয় । ধর্ষণকারীর রূপও বিভিন্ন
হয় - রাজনৈতিক কর্মী, অচেনা পুরুষ, বন্ধু, সহকর্মী, আত্মীয়স্বজন,
ও প্রিয়জন ।
নির্ভয়ার মৃত্যুর পরে ধর্ষণ
সম্পর্কে যে বাকবিতণ্ডা সমাজে চলছে তা সময়োপোযোগী হতে পারে কিন্তু
খুবই সীমিত । এই আলোচনার গণ্ডী অপরিচিত ধর্ষণকারীতেই শেষ হয়ে
যায়; শিশু যৌন নির্যাতন, দাম্পত্য ধর্ষণ, বা পরিবারের মধ্যে
যৌন অত্যাচার অবধি এগোয় না । দৈনন্দিন জীবনে মেয়েদের যে কি অপরিসীম
যৌন অত্যাচারের মোকাবিলা করতে হয় সে ব্যাপারে কোন বিতর্কই এখনও
ঘটছে না ।
নির্ভয়ার মৃত্যুর পরে ভারত
সরকার ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন সংশোধনের জন্যে একটি কমিশন তৈরী করে
। জাস্টিস ভার্মার নেতৃত্ব্যে সেই কমিশন দাম্পত্য ধর্ষণকে স্বীকৃতি
দিতে সরকারকে অনুরোধ করেছে । এছাড়া দু আঙুল যোনীতে দিয়ে ধর্ষণের
সত্যতা যাচাই করার মত লজ্জাকর পরীক্ষা অবিলম্বে বন্ধ করতেও অনুমোদন
করেছে । এই দুটি অনুমোদন আদৌ কর্যকরী করা হবে কিনা এখনও তা বোঝা
যাচ্ছে না ।
নিজের মৃত্যু দিয়ে নির্ভয়া
আমাদের সমাজকে কতগুলি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়ে
গেছে । বড় প্রশ্ন, আমরা ছেলেদের কি ভাবে বড় করছি যে তারা নারীকে
চরম অসম্মান করতে, ধর্ষণ করতে, বিন্দুমাত্র বিচলিত হচ্ছে না?
সব চেয়ে বড় কথা অত্যাচার লুকিয়ে রাখার যে প্রবণতা আমাদের সমাজে
প্রচলিত, যৌন নির্যাতন সম্পর্কে যে নিস্তব্ধতা আমাদের চিরকালের
সঙ্গী, তা ভাঙতে নির্ভয়া আমাদের শিখিয়ে গেছে ।
শমীতা
দাশ দাশগুপ্ত
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।