প্রথম পাতা

শহরের তথ্য

বিনোদন

খবর

আইন/প্রশাসন

বিজ্ঞান/প্রযুক্তি

শিল্প/সাহিত্য

সমাজ/সংস্কৃতি

স্বাস্থ্য

নারী

পরিবেশ

অবসর

 

রবীন্দ্রসঙ্গীতের আধুনিকতা

রবীন্দ্রসঙ্গীত কি আধুনিক গান?

প্রশ্নটা অর্জুনের বাণের মত না ভীমের গদার মত ছুটে এল, বিমূঢ় উত্তরকৈশোর মেয়েটির তা বোঝার সাধ্যি ছিল না। প্রয়োজনও ছিল না! অভিজ্ঞ শিক্ষক তার বলে দিয়েছিলেন দুনিয়ায় সব প্রশ্ন উত্তরের আশায় করা হয় না, অনেক প্রশ্নের কোন উত্তরই হয় না, আবার কোন কোন প্রশ্নের উত্তর মানুষ পাঁচ হাজার বছর ধরে বই লিখেও যথেষ্টমত উত্তর দিয়ে উঠতে পারেনি। তাই প্রশ্ন শোনামাত্র উত্তর দিও না। এসব ক্ষেত্রে পরীক্ষার্থী মেষশাবককে বিচারক-নির্বাচক-পরীক্ষক জাতীয় নেকড়ের পাল নানা প্রকারে খেলিয়ে তবে তার ভবিষ্যতের ঘাড় মটকায়। চুপ করে থেকো। হয়তো এই অবসরে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে তর্কে প্রবৃত্ত হবেন। কেবল নিরুপায় হলেই উত্তর করো।

ক্ষেত্রটি ছিল বিশ্বভারতী শান্তিনিকেতনের জন্য সঙ্গীতশিক্ষায় বৃত্তিপ্রদান উপলক্ষ্যে নির্বাচনী পরীক্ষা। স্থান ঢাকা মহানগরীতে শিল্পকলা একাডেমি নামের এক ডিরেক্টরেট-জেনারেলের সুবিস্তৃত কমপ্লেক্সের কোন কক্ষ। চব্বিশ জন প্রার্থী এবারে, এক এক করে উপস্থিত হচ্ছে ডজনাধিক নির্বাচকের সামনে। নির্বাচকপালে জনা তিনেক গান জানেন, বাকি সকলে নানা মাপের সরকারি আমলা। এঁদের মধ্য থেকে হঠাৎ ঐ প্রশ্নটি কে করে বসলেন। মেয়েটি শিক্ষানুযায়ী চুপ করে বসে। কিন্তু সে নৈঃশব্দ্য যথেষ্টই সপ্রতিভ -- অপ্রতিভতার পালা বুঝি প্রশ্নকর্তার দিকেই যেতে থাকে। গুঞ্জন আরম্ভ হল বিচারকদের মধ্যে। ক্রমে বাদানুবাদের রোল হট্টগোলে পৌঁছবার আগেই কোনও বুদ্ধিমান তথাচ দয়াদ্র্র নেকড়ে মেয়েটিকে লক্ষ্য করে একটি সাপ্লিমেন্টারি ছোঁড়েন। "আধুনিক মানে ঐ ফেরদৌস ওয়াহিদ যে গান করে সেই রকম আধুনিক?" বিচারকমণ্ডলীর মধ্যে হাসির হররা ছুটল। ঘরের ভিড়ে জমে ওঠা ভূপাল-গ্যাসের কুণ্ডলী যেন হঠাৎ খোলা জানালাপথ গলে বেরিয়ে গেল। মেয়েটির ঈষৎকুঞ্চিত ভ্রুরেখা সরল হল, প্রশস্ত কপাল আবার হল বাংলার শ্যামসমতল।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করবার অল্পকালের মধ্যেই সেনাশিবিরের অধীনে চলে যায়। সেনারুচি উচ্চাসন থেকে সেনাকালচার ছিটোতে থাকে তোবাররকের মত - হরি লুটের মত। ফেরদৌস তাদের প্রাণের গায়ক। সুন্দর অবাঙালীমত মসৃণ ভরাট গলায় উর্দূতানের বাংলায় সে মঞ্চ জুড়ে নেচে নেচে গান গাইত -- টেলিভিশনের পর্দাকে কেবল নয়, সারাটা বাংলাদেশকেই সে ক্যাবারের আসরে পরিণত করত। যাঁরা আজ তার উল্লেখ করে রঙ্গ করলেন, মজা করলেন, তাদের স্ত্রীরা মেয়েরা ফেরদৌসের মধ্যে বাংলার এলভিসকে দেখেছিল, নিয়মিত মূর্ছা গিয়েছিল, এবং এই বিচারকদের অধিকাংশ তাতে সুস্মিত প্রশ্রয় দেননি তা নয়।

রবীন্দ্রসঙ্গীত আধুনিক গান কি না, এ প্রসঙ্গটাই প্রথম দৃষ্টিতে নির্বুদ্ধিতাসূচক বলে মনে হয়। 'আধুনিক গান' বলে বাঙ্গালী এক ধরণের গান বাজায়, গায় ও শোনে। এই জাতীয় গানের নাম হিসেবে এটি নামবাচক বিশেষ্য তথা প্রপার নাউন। এই ধরণের বিশেষ্যের অর্থে রবীন্দ্রসঙ্গীত অবশ্যই আধুনিক গান নয়, যেমন তা নয় ফেরদৌস ওয়াহিদের গানের সগোত্র। বাংলা গানের পঞ্চভাস্কর তথা রবীন্দ্র-নজরুল-অতুল-দ্বিজেন্দ্র-রজনীকান্ত যে সমস্ত গান বেঁধেছেন তার কোন একটিকেও কেউ সজ্ঞানে 'আধুনিক গান' নামক গানের জাতে ফেলেনা। অজ্ঞানে অনেক নজরুলগীতি 'আধুনিক গান' ও অনেক 'আধুনিক গান' নজরুলগীতি হিসেবে গাওয়া গয়েছে, হচ্ছে এবং আদরও পেয়েছে, পাচ্ছে। শতাব্দী আরম্ভের দিকটাতে কলের গানের জন্যে রেকর্ড বানানোর কারখানা বসল কলকাতায়, কলকাতায় তৈরী ছায়াছবি কথা কইল, গান গাইল, প্রতিষ্ঠিত হল বেতার সম্প্রচার কেন্দ্র ঐ কলকাতায়ই -- গান জিনিসটা হয়ে দাঁড়াতে থাকল উৎপাদনের পণ্য। এবং পণ্যোৎপাদনে শ্রমবিভাগের মত এখানেও গানের লেখক, সুরকার গায়ক, অনুষঙ্গী যন্ত্রীর দল সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন পেশার ও স্তরের মানুষ একত্র হয়ে তবে এক-একটা করে হাজার গানের জন্ম দিতে থাকল। এই উৎপাদনের একাংশ খুব সহজেই 'সিনেমার গান' নাম পেয়ে ঝামেলা কিছু কমালো। বায়োস্কোপ-সিনেমার প্রথম সবাক দশকে গান স্বভাবতই খেয়াল-ঠুমরি ও নানাতর প্রচলিত দেশীয় গানের ধারা -- এবং খুবই বৃহৎভাবে কীর্তনাশ্রয় থেকে এসেছে। এই সমস্তই তো রবীন্দ্রনাথ-নজরুলেরও গানের প্রধান উৎস এবং তাঁদের রচনা, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের, প্রচুর এসেছে ছায়াছবিতে। কিন্তু সিনেমায় ধ্রুপদ, খেয়াল, কীর্তন, রবীন্দ্রসঙ্গীত, যাই গাওয়া হয়েছে, তা নিজের জাত খুইয়ে সিনেমার গান হয়েছে। এ বাদ দিয়েই 'আধুনিক গান '।

সঙ্গীতপণ্যোৎপাদনের নতুন প্রক্রিয়ায় গ্রামোফোন কোম্পানির নিযুক্ত প্রথম যুগের প্রতিভাবান গুণীর দল কেবলই বাইরে থেকে সংগৃহীত রত্নের রেকর্ড করতেন না। নিজেরা বানাতেন -- তার মধ্যে সর্বাগ্রণী নজরুল, কিন্তু তাঁর লাইনে মেলা লোক। গানের একটা নতুন 'জেনর'ই বানিয়ে ফেলা হল কলের গানের কারখানায় -- হেড মিস্ত্রি নজরুল, কিন্তু কারিগররা অধিকাংশই ভাঁড়ানো নামে রেকর্ডের গায়ে উপস্থিত। আবুল কাসেম মল্লিক আবাসুদ্দীন গিরীন চক্রবর্তীর গাওয়া 'ইসলামি গান' অভীষ্ট মুনাফা তুললো সাহেবী কোম্পানির ঘরে। কে মল্লিক নামে যে অসামান্য গায়ক শ্যামাসঙ্গীত-কীর্তন থেকে তাবৎ বৈঠকি গানভাঙা বাংলা গান গাইতেন - এমন কি রবীন্দ্রসঙ্গীত-অতুলপ্রসাদও, নজরুল তো বটেই - তিনি স্বনামে গাইলেন 'ইসলামি গান' - নাম ভাঁড়াতে হল এ বেলায় অপূর্ব মুকুন্দদাস গাইয়ে গিরীন চক্রবর্তীকে। একটা যথোচিত গ্রাম্য মুসলিম নাম ধারণ করলেন তিনি।

কলের গানের কারখানায় তৈরী মালের প্রধান দুই প্রকার - প্রচলিত দিশি, আর বানানো আনকোরা। মাঝামাঝি হাফ-মাপের জিনিসও ছিল, যেমন জসিমউদ্দীনের কথায় কানাই শীলের সুরে পল্লীসঙ্গীত। এই একই ছবি কিন্তু নলিনীকান্ত, সুরেন্দ্রলাল, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ, সুরেশ চক্রবর্তীর রেডিওতেও। সিনেমার গান গেল বাদ, বাদ গেল প্রচলিত দিশি গান যাদের জন্যে নামের অভাব নেই, হাফ-মাপের নাম ব্যবস্থা দেওয়া গেল - এখন অজয় ভট্টাচার্যরা, শৈলেন রায়েরা যে নতুন জিনিস ছাড়ছে যা পঙ্কজ, কমল, সুবলের সুরে বাজার মাত্ করছে তার কী নাম? শোনা যায় রেডিয়োতে কেউ পরিহাসচ্ছলে এই নামহীন নতুন বাংলা গানকে বলেছিলেন আধুনিক গান। এক হিসেবে তো খুবই যুক্তিযুক্ত - এবং লাগসই, প্রকৃতই অধুনা প্রস্তুত, সর্বাংশেই।

গোল বাধালো সাহিত্যাঙ্গন। লেখাপড়ার জগৎ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আরম্ভ অষ্টাদশ শতকে। কিন্তু আধুনিক কবিতা কেবলি রবীন্দ্রনাথের পরের কিছু সাধারণ লক্ষণাক্রান্ত কবিতা -- দীপ্তি ত্রিপাঠীর নির্ঘন্ট দেখা যেতে পারে তার সন্ধান চাইলে। আধুনিকতা নামে একটি ঘটনা দাঁড়ালো যা কেবলই গুণবাচক বিশেষ্য নয় - এবং কেবলই কেন, হয়তো একেবারেই কালিক নয়। ভুল হোক, ঠিক হোক, ভালর জন্যেই হোক বা মন্দের, যারা নিজেদেরকে 'আধুনিক' বলে মনে করেন তাঁরা 'আধুনিকতা' বলে একটা মানসিকতা এবং রুচি - এবং পুরো কালচারই দাঁড় করাতে চাইলেন। এবং এলিয়ট থেকে আমাদের দেশী বুদ্ধদেব বসু পর্যন্ত সকলেই এই আধুনিকতার নির্মাণে নির্ধারণে প্রাণপণ করলেন। তার ফলস্বরূপ, আজ বাংলা আধুনিক কবিতা কিংবা আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলা যে অর্থে আধুনিক - 'আধুনিক বাংলা গান' মোটেই আধুনিক নয় সে অর্থে। গত দশবিশ বছরের গান হয়তো বড়জোর সমসাময়িক গান, আধুনিক নয় কোন বিচারে। রুচি, কৃৎকৌশল, শৈল্পিক দাঢ্য, সাঙ্গীতিক উৎকর্ষ, বাণীতে আধুনিক চিন্তনমননের সংস্থান, ভাষার আধুনিক প্রচলের উদার উপস্থিতি - কোন দিক দিয়েই 'আধুনিক বাংলা গান', আধুনিক কবিতা কিংবা চিত্রকলার অর্থে আধুনিক নয় আদৌ - এবং কোন কোন নির্দয় মানুষের মতে এর অধিকাংশ হয়তো আদৌ গানই নয় কোন মাপের।

হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথের গান, ঐ রকমের 'আধুনিক বাংলা গান' নয়। বড়-ছোট সবরকমের মানুষ মিলে -- কেবল রবীন্দ্রনাথ নয়, পঞ্চভাস্করের বাকি চারজনকে, এমন কি চল্লিশের দশক থেকে যে গণসঙ্গীত আরম্ভ হল, তাকেও ঐ আধুনিকগান পদবাচ্যতার থেকে নিষ্কৃতি দিয়েছেন নিজের থেকেই, ওঁদের কাউকে আবেদন করতে হয়নি তার জন্যে। আমরা যে ঘটনা দিয়ে প্রসঙ্গ আরম্ভ করেছি আজ, সেই বিচারসভায় যে কয়জন গানসংসৃষ্ট মানুষ ছিলেন তারা সকলেই 'আধুনিক গান' নামীয় নিতান্ত অনাধুনিক সমসাময়িক গানের লোক। তবু ঐ বিচারককুল থেকেই হঠাৎ কোন প্রহলাদ জোর দিয়ে বলে উঠলেন, বাংলায় কেন, ভারতবর্ষে রবীন্দ্রনাথের গানই প্রকৃত আধুনিক গান, প্রধানতম এবং প্রায় একমাত্র আধুনিক গান।

চমকে ওঠার মত কিছু দৈববাণী নয়। যাঁরা আধুনিকতা বোঝেন ঐ নতুন অর্থে, যাঁরা সঙ্গীতে প্রকৃতই অগ্রসর, এবং যাঁরা রবীন্দ্রনাথের কিঞ্চিৎ সন্ধান আপন তাগিদে সত্য করে জানেন, তাঁদের জানতে কোনই অসুবিধা নেই যে, বিশুদ্ধ সাঙ্গীতিক অর্থেই, নিজেকে কেবল গান নামের এক ধরণের দুই থেকে পাঁচ মিনিটের ভাষানির্ভর কণ্ঠসঙ্গীত নির্মিতির মধ্যে সীমিত রাখলেও, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কালের ভারতবর্ষীয় সঙ্গীতে অভিযাত্রী মানুষ, তাঁর চাইতে এগিয়ে কেউ ছিল না, এখনও নেই, অদূর ভবিষ্যতে হবার কোন ইঙ্গিত-ইশারা পাওয়া যাচ্ছে না।

অকালপ্রায়াত গুণী সাধক নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় ঐ তিন শর্ত পূরণ করে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতের মর্ম বুঝেছিলেন, কিন্তু কিমাশ্চর্যম, তাঁর গুরু আলাউদ্দিন আধুনিকতার ধার আদৌ না ধরে এবং রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গীতভিন্ন কোন দিক দিয়েই না জেনে রবীন্দ্রগীতির বিমুগ্ধ শ্রোতা ছিলেন আজীবন। যে যে গুণের জন্যে সঙ্গীতে রবীন্দ্রনাথের আভিযাত্রিক অবস্থানের ধারণা উচ্ছ্বাসমাত্র নয়, বরং যথাযোগ্য বিচারের বিষয় এবং ইতিমধ্যেই প্রকৃত রসিক অনুধাবকের মনে কথাটি হয় দাঁড়িয়েছে, তার মধ্যে একটি এই যে তাঁর গান সর্ববিচারে 'আধুনিক' -- আধুনিকতা যে পরিমার্জনা-পরিশীলন স্তরের নাম তার উচ্চতম মার্গে তার স্থান।

তাঁর সব গানই অমনিতর আধুনিক এমন অবশ্যই নয়। অবনীন্দ্রনাথের অত প্রিয় যে তাঁর রবিকার মায়ার খেলার গান তার অধিকাংশই পিরিয়ড পিস -- এবং তাতেই তার মজা। রবীন্দ্রনাথ কত যে রকোকো, কত যে বরোক খটপট পর্যঙ্ক বানিয়ে রেখেছেন তাঁর গান দিয়ে, তার দিকে চাইতে জানলে তাই দিয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায় -- যেমন বেরেনসন কাটিয়েছিলেন রেনেসাঁ ইতালির রূপময় প্রকাশকে নিয়ে। নিজেকে, নিজের সৃজনশীলতাকে তারিয়ে তারিয়ে চেখেছেন তিনি পুরাতনীর রং-ঢংকে ধরতে গিয়ে, নতুন করে সাজাতে গিয়ে। এবং অনভিজাত দিশি, প্রায়শ গ্রাম্য জিনিস নিয়ে খেলতে খেলতেও তার মধ্যে হঠাৎ ফুটে উঠেছে 'আমার পরাণ যাহা চায়' -- সর্বকালের আধুনিকতার প্রাণের কথাটি তারই প্রাণের ভাষায়।

কিন্তু তাঁর অজস্র ধ্রুপদ, এক দুই বা তিনশত বৎসরের পুরাতন সঙ্গীতরচনারই নতুন উপস্থাপনা হলেও ঐ মনমজানো পিরিয়ড পিস হয়নি আদৌ। এ এক আশ্চর্য যাদুর আসর এখানটায়। খানদানী ধ্রুপদ গানের কাঠামোটিকে প্রায় অক্ষত রেখে সেই ভেলায় একেবারে ভিন্ন -- এবং ভারি কনসেপ্টের বোঝা চাপালেন তিনি যার সবটা এমন শব্দ এবং এমন বিন্যাসে গড়া যে বেতিয়া-বিষুÎপুরের লুপ্ত গুপ্তধন যেন অনন্ত কালার্ণবে পাড়ি জামাবে এবার, যাদুঘরের সংরক্ষিত প্রদর্শরূপে নয়, জীবন্ত সঙ্গীত হিসেবে। তাঁর সব ধ্রুপদই কালোত্তীর্ণতা অর্জন করেছে, তা নয়, করেছে যারা তাদেরই কথা হচ্ছে এবং তারাও যে সংখ্যায় কত। 'জাতিতে হবে রে, এ মোহনিদ্রা কভু না রবে' -- ভারি শব্দে চৌতালে ওজনদার সুরচ্ছন্দবন্ধে এত ভার তার যে বাণীভেদে একই গান বজ্রসেন করেন চূড়ান্ত ঘৃণ্যময় প্রত্যাখ্যানকে পদাঘাতের ভাষা দান কালে -- শ্যামাকে চলে যেতেই হয়। সেই ধ্রুপদেরই এক পঙক্তি 'জাগে তাঁর রুদ্রনেত্র পাপতিমিরে' -- সুররিয়ালিস্ট রূপকল্পনার শেষ কথা যেন। ব্রহ্মময় দেবেন্দ্র ঠাকুরের এই পুত্রটি জীবনশেষের দিকে নানা কারণে ভিতর থেকে টলে গেলেও, নরময় নারায়ণ তথা বিশ্বসাথে যোগের ঈশ্বরতা তথা আবৃত-নিরীশ্বরতায় পৌঁছে যেতে থাকলেও, যতদিন তাঁকে তাঁর সকল সমর্পণ ছিল ততদিন তাঁকে তিনি পেয়েছেন, ধরেছেন তাঁর নিজেরই বাকগতি বিশ্বকবির মাপে। সেই পাওয়াটি রূপ পেয়েছে, বাণী পেয়েছে তাঁর ধ্রুপদ গানে -- এতই সকল-ধারণ সেই সুরছন্দবন্ধ যে ঈশ্বরনীনকে পর্যন্ত তা কাঁদায়। তাঁর যত ধ্রুপদ, অনাধুনিক তা নয় কোন মতে। তা হলে কি তারা আধুনিক? বৈশ্বিক উপাদানে কীর্ণ, কালোত্তীর্ণতার আলো তাকে স্পর্শ করেছে, তাকে তো আমাদের এই আধুনিকতার প্রায় বালখিল্য বিচারের বাইরেই রাখতে হয়। আধুনিকতায় যদি চিরন্তনেরও ইঙ্গিত থাকে, তাই দিয়ে ভাস্বর এই গানকে আমরা আধুনিক ছাপ মেরে আর কী করব? থাক সে একজনারই নামাঙ্কিত -- রবীন্দ্রসঙ্গীত। আধুনিক-অনাধুনিক বিচারের বাইরের আলতামিরা -- লাসকোর প্রচণ্ড প্রবল অক্ষয় শিববাহন -- মহাকালেরই বাহন।

সামনের জুলাইতে বুঝি তাঁর নবতিতম বর্ষ পূর্তি হবে। শতায়ু হোন বলে তাঁকে আর কী ভালবাসা জানান যাবে, গতশত হোন তিনি অনেক অনেক বৎসরে, থাকুন কর্মঠ এবং জেদী, সৎ এবং ধ্রুবপ্রায় অভিচল অবিকার রবীন্দ্রপ্রতিভূ। যেমনটা ছিলেন তিনি নেত্রকোণায় তাঁর রবীন্দ্র-উদ্ভাসের প্রথম আলোর দিন থেকে, যেমনটা আছেন তিনি আজও। আকাশবাণী প্রভাতী সংবাদে জানায় তাঁর ঘোর প্রতিবাদের কথা - রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষঅঙ্গী যন্ত্র হিসেবে কোন অবস্থাতেই তিনি হারমোনিয়মের অনুমোদনকে স্বীকার করবেন না, যুগের হাওয়ার ধুয়া তিন ই ভালো করেই জানেন, তবু। জয়তু শৈলজারঞ্জন।

রসায়ন শাস্ত্রের এই অসামান্য ছাত্রটির কাছে আমরা কতভাবেই না ঋণী। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কত দিলেন, তার তালিকাটি পর্যন্ত যেন নিঃশেষ হবার নয়, গরিষ্ঠাংশের অগোচরে তাঁর হাত থেকে পেলাম কাপড় ছোপানোর দ্বীপময় ভারতীয় শিল্প বাটিক, পেলাম ত্বকতক্ষণের কাজ, পেলাম জুজুৎসু ব্যায়াম, পেলাম মণিপুরি নাচ। পেয়েছিলাম তেমনি করেই, শৈলজারঞ্জনকেও -- তাঁরই হাত থেকে। শৈলজারঞ্জন থেকে কী পেলাম আমরা?

চলচ্চিত্র যূথকর্ম এ সকলেই জানে। চলচ্ছবিকে মাধ্যম করে একটা শিল্পই দাঁড়িয়ে যাবে, এমনটা গোড়ায় কে ভেবেছিল? এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথকের সংশয় থাকা সত্বেও, ফিল্ম এখন শিল্পের স্বীকৃতি পেল প্রায়। যূথশিল্প বলা হচ্ছে তাকে কিন্তু অনেক মানুষের কাজের সমাহার বলে নয়, অনেক শিল্পের যোগে তৈরী বলে। কোন শিল্পকর্মেরই একাধিক স্রষ্টা হয় না। ফিল্মের শিল্প সংজ্ঞা পাবার দাবী পাকা করেছে ফরাসীদের ঐ জেদ -- ধন্য 'ধাইয়ে দু সিনেমা' পত্রিকার আন্দোলন - যে কোন একটি সৎ ফিল্ম একজন মাত্র লোকের কাজ, তাতে নানা কাজে নানাতর ভাবে যতই লোক যুক্ত হোক না কেন। আরম্ভ হল ডিরেক্টর্স পিকচার ধারণা। চলচ্চিত্র অন্যমতও হতে পারে বৈ কি। কিন্তু আইজেনস্টাইন, ডভ্‌ঝেনকো, পুদভকিনের আগে থেকেই, বই যেমন লেখকেরই, মুদ্রকের নয়, নয় প্রকাশকের, কিংবা বিক্রেতার বা পাঠকের, তেমনি ফিল্মও নিতান্তই অথরের, যার নাম কোথাও পরিচালক, কোথাও নির্দেশক। ফরাসীরা বুঝি রূপকার কথাটিই বেশী লেখে।

শৈলজারঞ্জন সারা জীবনের সাধনায় একটিমাত্র কথা দাঁড় করাতে চাইলেন -- সেও খুব যে তাঁর নিজের কথা তা নয়, রবীন্দ্রনাথেরই কথা -- রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন অথর্স মিউজিক বেঁধেছেন, তাঁর নিজের গান বেঁধেছেন তিনি -- পার্ফর্মারের নয়। প্রবন্ধকারের, সমালোচকের, রসিক অরসিক কোন প্রকার শ্রোতার, রেডিয়ো, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, গ্রামোফোন প্রভৃতি বৈষয়িক - ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কোন মানুষের অপেক্ষায় এ গান রচিত হয়নি। ভয়ঙ্কর সমস্ত সাঙ্গীতিক প্রতিভা উত্তরকালে এর যথাযোগ্য সংস্কার করতে থাকবেন এমন আশ্বাসের ওপর ভরসা রেখেও এ গান রচিত হয়নি। এর ভালো, এর মন্দ, যত ত্রুটি, যত সার্থকতা সব নিয়ে এ রবীন্দ্রনাথের একান্তের, তাঁর চিত্তের ও সঙ্গীতের সীমাবদ্ধতা, তাঁর ব্যক্তিত্বের ও কালের ও সমাজের সব বৈশিষ্ট্যের ছাপ, এই সবকে ছপিয়ে যাবার তাঁর ক্ষমতা ও প্রয়াসের সাক্ষ্য,সমস্ত নিয়ে এ নিতান্তই তাঁর গান।

এই মামুলি সত্যটি সমস্ত জীবনের সাধনা দিয়ে প্রতিষ্ঠার বিষয় হয়ে উঠে সঙ্গীতশিল্পের দ্বিজতাঘটিত বৈশিষ্ট্যের কারণে। গায়ক গাইলে তবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকৃতি রূপ পায়, সঙ্গীত-নামের সময়শিল্পের সত্য রূপ পায়। নইলে রইল পড়ে বইচাপা সঙ্গীত নয়, আদৌ কেবল তার সঙ্কেত। খেয়ালগায়ক কেবলই গায়ক নন, তিনিও স্রষ্টা, গায়নকালেই তিনি স্রষ্টা, বস্তুত তিনিই স্রষ্টা। ঘটনা হত তবে তা বড়জোর ঐতিহাসিক অভিমানী আবদারের এক চিত্তাকর্ষক নজীর হয়ে থাকত আমাদের ইতিহাস। তাঁর মনের ঐ ইউরোপীয় অথর্স মিউজিকের আদর্শ এবং তাঁর কণ্ঠে ধ্রুপদ আদর্শের গান -- এই দুইয়ের মিলে রবীন্দ্রনাথের গান রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ে উঠেছে যা মূলগতভাবে অতুলপ্রসাদ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রজনীকান্ত এবং অতি অবশ্যই নজরুলের অমিত সম্ভারের থকে পৃথক। এ কথা নারায়ণ চৌধুরী খুব ভাল জানেন যে নজরুলের গান অবিকল অর্থাৎ কোন রেকর্ডের হুবহু কপি করে কিংবা স্বরলিখনের অনিষ্ঠ উদ্ধার করে গাইলে তা গানপদবাচ্য হবার প্রায় সকল সম্ভাবনা হারায়। খেয়াল ঠুমরী উৎসনির্গত গানের শিল্পটি স্বাধীন তাৎক্ষণিক নির্মাণের উপর বৃহৎভাবে নির্ভরশীল। পঞ্চভাস্করের চারজনই খেয়াল ঠুমরী নিয়েছেন আকর হিসেবে -- প্রভূত ব্যবহার করেছেন দেশে-বিদেশে বয়ে আসা যুগযুগের পুরনো মেলডি। রবীন্দ্রনাথই কেবলই রবীন্দ্রসুর ব্যবহর করেছেন, রবীন্দ্রছন্দে, এমন কি রবীন্দ্রতালে গেঁথে। এবং পাঁচজনের মধ্যে তিনিই জ্যেষ্ঠ বলে বাকিদের কারো কাটা পথে চলবার সুযোগ তিনি পাননি -- তাঁর চলবার পথের সবটাই তাঁর নিজের কাটা। সেই যে একান্তের পথটি -- কেবলই রবীন্দ্রনাথের পথটি -- হে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সেই পথে তুমি হাঁটবে? দ্যাখো, কোন চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথের ছবি আঁকতে পারবে না, কোন কবি রবীন্দ্রনাথের কবিতা লিখতে পারবে না, কোন গল্পকার-ঔপন্যাসিক-মনীষী রবীন্দ্রনাথের কাটা পথটিকে তার নিজের পথ করে চলতে পারবে না। কেবলি তুমি জগতের নির্জনত আশ্চর্যতম সেই একজনের জন্য নির্দিষ্ট সবচাইতে এক্সক্লুসিভ পথঠিতে চলবার অধিকারটি নিজে নিজেকে অর্পণ করেছ। এক দায়দায়িত্ব সব বুঝে নিয়েছ তো?

ঐ অসঙঘনীয়তার আধুনিক এবং ইউরোপীয় আদর্শের প্রসঙ্গে সহজেই চলে আসে যাত্রা ও স্বরের সঠিক উদ্ধার ও প্রয়োগের প্রশ্নটি। এবং এই প্রশ্নটি ধ্রুপদী আদর্শের সঙ্গীতরচনারও মূলের সঙ্গে জড়িযে। ধ্রুপদ অদ্যাবধি বর্তমান সকল গানের শিরোমণি এই কারণে যে এ গান খুব একটা টিউনফুল কিছু নয় -- কোন মেলডি এখানে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অর্থাৎ লোকসুরের ধুন বা রঞ্জকতাসম্পন্ন বিশিষ্ট স্বরবন্ধ এর কোন নির্ভর নয় আদৌ, প্রতিটি স্বর তার ওজন ও অবস্থান নিয়ে যেন স্বরাট সম্রাট - আমরা সবাই রাজার সকল রাজা একে অপরের সঙ্গে লীলায় মেতেছে তো বটেই -- এবং সেটাই মূল ব্যাপার হলেও, স্বর গুরুত্ব পাচ্ছে ষড়জের সঙ্গে তার সম্পর্কের জোরে -- তার অঙ্গে পারস্পরিক অবস্থানঘটিত টেনশন কিংবা তার নিরাকরণের পরিমাণ এবং সংস্থানের উপর গড়ে ওঠা ছন্দিত গতিময়তার জোরে। এবং ঐ ওজন এবং সংস্থান শব্দগুলো যে ঘটনার উপর দাঁড়াচ্ছে সে হল যাত্রা। এই সঙ্গীতাদর্শের পরাকাষ্ঠা রবীন্দ্রসঙ্গীতে -- যদিও রবীন্দ্রনাথ কোনমতেই মেলডিদরিদ্র নন বরং কোথা থেকে তারা তাঁর কাছে চলে আসতে থাকে তিনিই তা জানেন না -- এবং এত আনকোরা নতুন মেলডি আর কোন সঙ্গীতরচয়িতা, সমস্ত পৃথিবীতেই, এত সহজ আনন্দে বিলিয়ে গেছেন বলে জানা নেই। কিন্তু তাঁর অপূর্ব -- আক্ষরিক অর্থেই -- মেলডির গানগুলোর অনেক বড় বৈশিষ্ট্য ও সার্থকতা এই যে তাতে কোথায় কখন যে এক-একটা স্বর তারার মত ফুটে ওঠে -- একেক মাপে এককটি বিরাম কেমন বিশ্বের সকল না-বলা বাণীর মুখরতাকে ধারণ করে অবিচল বসে থাকে।

বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, না না ক্ষতি করবে কেন, তার কোন উপকার করনি তো তুমি। শৈলজারঞ্জনের ওপর বিস্তর গুরুভার মানুষের প্রভূত রাগ দেখে তাঁর করা উপকারের পরিমাপ করার চেষ্টা করা যেতে পারে বৈ কি। প্রমথনাথ বিশীর বই শান্তিনিকেতন জীবনের ওপর লেখা তাবৎ গ্রন্থের মধ্যে ক্লাসিক মর্যাদা পাবার যোগ্যতম দাবীদার। তাতে নামোল্লেখ না করেও তিনি শৈলজারঞ্জনকে তাঁর বইটির মতই অমর করেছেন। শান্তিনিকেতনের আকাশে বাতাসে সঙ্গীত ভেসে বেড়াত। রবীন্দ্রসঙ্গীত অবশ্যই। ত্রিশের দশকের গোড়ার দিকে প্রবেশ এক ভিলেনের। তিনি আসবামাত্র শান্তিনিকেতনের সঙ্গীতময়তার সকল অবসান। কোন এক গুরুমশায়ের মারের ভয়ে ফুল পাখি মানুষ সব গান ছেড়ে দিল। এই ভিলেন শৈলজারঞ্জন। বাঙালীর সবচাইতে প্রভাবশালী সাময়িক পত্রের পঞ্চাশ বছরের নিরবিচ্ছিন্ন অভিযান ঐ ভিলেনটির বিরুদ্ধে। তা সত্বেও তিনি টিঁকে থাকলেন। এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এখনকার লোকসঙ্গীতের দশায় পর্যবসিত হবার দুর্নীতি থেকে উদ্ধার করে ভারতবর্ষের আধুনিকতম ও সর্বাপেক্ষা সুনিবদ্ধ সঙ্গীত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার সংগ্রামে নিয়ত নিরত রইলেন। এ যেন মঙ্গলকাব্যের প্রাদেশিকতা থেকে বঙ্কিম মাইকেল বিদ্যাসাগর -- সর্বোপরি রবীন্দ্রনাথ -- যেমন বাংলা সাহিত্যকে নাগরিকতার বৈশ্বিকতার উদার অঙ্গনে এনে ফেলেছিলেন -- সেই মতই একটা ঘটনা ঘটল। সুর, স্বর, মাত্রার ওপর তাঁর অতিরিক্ত নজর পূর্ববঙ্গ থেকে আগত কোন জেদী বাঙালের বৃদ্ধ বয়সের বাতিক মাত্র নয়। তিনিই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত শিল্পের সুনিবদ্ধতা এবং চূড়ান্ত পরিশীলনের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফিরিয়েছেন।

তাঁর উননবতিতম জন্মতিথি উপলক্ষ্যে সমাগত গুণিজনের সঙ্গে আলাপে তাঁর চেষ্টার নিরতিশয় ব্যর্থতার কথা উঠেই পড়েছিল। অশোকতরু আমাকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, শৈলজাদার আসল জিৎ তিনি শিক্ষক। তাকিয়ে দেখুন চারদিকে -- কত কত ইস্কুলে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখানো হচ্ছে। সবই কিন্তু শৈলজাদার মডেলে। কেবল গ্রামোফোন ডিস্ক দেখবেন না -- রেডিও শুনুন ঢাকা কলকাতার এ-বাংলা ও-বাংলা ছোটবড় স্টেশনে যারাই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে, এ গানে নতুন আসছে, বারো আনারও বেশী শৈলজাদার আদর্শে গানটিকে গাইতে চেষ্টা করছে।

শৈলজারঞ্জন রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদকে বলেন অর্ধ-রবীন্দ্রসঙ্গীত। এই জাতীয় গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ কম। ভাবেন ঐ গানগুলো রবীন্দ্রনাথের অ্যাপ্রেনটিসশিপ কালের অনুশীলনী গান মাত্র, মহামানুষ বলে তাই হয়ে দাঁড়িয়েছে অপূর্ব গানসৃষ্টি। কিন্তু ওতে পুরোপুরি রবীন্দ্রনাথ নেই, অনেকটাই আনন্দকিশোর যদুভট্ট অছেন। তের বছর থেকে আশি বছর বয়স পর্যন্ত একটি মানুষ ক্রমাগত সঙ্গীত রচনা করে গেছেন -- এবং কেবলই পরিণতির পথে, বিকাশের দিকে এগিয়ে গেছেন থেমে যাননি বা পিছিয়ে অসেননি কখনই। এই সাতাত্তর বছর ধরে তিনি কেবলই নিজেকে আবিষ্কার করেছেন, কেবলই রবীন্দ্রনাথ থেকে আরো সত্য আরো বিশুদ্ধ রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠতে থেকেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর গানও তাঁরই গান কেবলই তাঁর গান হয়ে উঠতে থেকেছে। যত কাল গেছে, রবীন্দ্রসঙ্গীত পূর্ণতার দিকে এগিয়েছে সর্ব অর্থে।

সেই গান তাঁর সঙ্গীতসৃষ্টির শেষ পর্যায়ের গান প্রকৃতই আধুনিক -- সবচাইতে আধুনিক গান -- ভারতবর্ষের পৃথিবীর। এ কথা এত নিপাট সরলতায় বলতে পারার কথা নয় -- কারণ তাঁর গানে নানা সমস্যাও আছে -- এবং আছে আধুনিকতার সমস্যা। কিন্তু সে সব বিষয় বারান্তরে।

ওয়াহিদুল হক

লেখক পরিচিতি - লেখক, গবেষক ও সংগঠক। ওঁর রচিত বইগুলির মধ্যে রয়েছে গানের ভেতর দিয়ে, চেতনা ধারায় এসো, সংস্কৃত জাগরণের প্রথম সূর্য এবং বাংলা উচ্চারণবিধি। ঢাকার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট-এর প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদ, আনন্দধবনি, ইত্যাদি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য। ১৯৬১ সালে বাংলাদেশে রবীন্দ্রশতবার্ষিকী উদ্যাপনের ব্যাপারে ওঁর বিশেষ ভূমিকা ছিলো। ২০০৭ সালে চুয়াত্তর বছর বয়সে ওঁর মৃত্যু হয়।

রচনাটি ১৯৮৯ সালে নিউ জার্সিতে অনুষ্ঠিত রবীন্দ্রমেলার স্মারকগ্রন্থ রবিবর্ণালী থেকে নেওয়া। কৃতজ্ঞতা স্বীকার - শ্রীমতী বনানী ঘোষ।

 

(আপনার মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)

অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।

 

Copyright © 2014 Abasar.net. All rights reserved.


অবসর-এ প্রকাশিত পুরনো লেখাগুলি 'হরফ' সংস্করণে পাওয়া যাবে।