বিশেষ
সংখ্যাঃ রবি-স্মরণ - শ্রবণে, শ্রাবণে
বিজ্ঞানের
স্পর্শ –গানে, কবিতায়
সৌম্যকান্তি জানা
কবি-সাহিত্যিকদের লেখনীতে
ধরা পড়ে জীবন, প্রকৃতি ও পরিবেশের কথা। তাঁরা জীবনকে, এই চরাচরের
প্রাণ-অপ্রাণ সব কিছুকেই দেখেন দার্শনিকের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে।
তাঁদের লেখনীগুণে জীবন ও জগতের সমস্ত সত্য কাব্যসুষমামন্ডিত হয়ে
সৃষ্টির রূপ পায়।
বিজ্ঞানীরা সত্যের সন্ধানী, সত্যের পূজারী। এই মহাবিশ্বের যাবতীয়
চেতন ও অচেতন বস্তুর পেছনে ‘কী, কেন, কোথায় কীভাবে’ প্রশ্নমালা
নিয়ে নিরন্তর সত্যের সন্ধানে রত বিজ্ঞান। তাই বিজ্ঞান ও সাহিত্য
উভয়কেই সত্যসন্ধানী বললে একটুও অতিশয়োক্তি হবে না। বিজ্ঞান ও সাহিত্য
তাই পরস্পরবিরোধী তো নয়ই, বরং একে অন্যের পরিপূরক। এই প্রসঙ্গে
প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক জগদীশচন্দ্র বসু্র উক্তি স্মরণ করা যেতে পারে
–
“কবি এই বিশ্বজগতে তাঁহার
হৃদয়ের দৃষ্টি দিয়া একটি অরূপকে দেখিতে পান, তাহাকেই তিনি রূপের
মধ্যে প্রকাশ করিতে চেষ্টা করেন। অন্যের দেখা যেখানে ফুরাইয়া যায়
সেখানেও তাঁহার ভাবের দৃষ্টি অবরুদ্ধ হয় না। সেই অপরূপ দেশের বার্তা
তাঁহার কাব্যের ছন্দে ছন্দে নানা আভাষে বাজিয়া উঠিতে থাকে। বৈজ্ঞানিকের
পন্থা স্বতন্ত্র হইতে পারে, কিন্তু কবিত্ব-সাধনার সহিত তাঁহার
সাধনার ঐক্য আছে। দৃষ্টির আলোক যেখানে শেষ হইয়া যায় সেখানেও তিনি
আলোকের অনুসরণ করিতে থাকেন, শ্রুতির শক্তি যেখানে সুরের শেষ সীমায়
পৌঁছায় সেখান হইতেও তিনি কম্পমান বাণী আহরণ করিয়া আনেন ”। (কবিতা
ও বিজ্ঞান – অব্যক্ত)
সাহিত্য
যেমন সমাজের সব মানুষের মনন ও চেতনাকে রাঙায়, আলোড়িত করে, আলোর
পথ দেখায়, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও তা-ই। আর যে সাহিত্য-পূজারী দেশ-কালের
সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের আঙিনায় চিরভাস্বর, তিনি যে বিজ্ঞানের পূজারীও
হবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আর তাই বিজ্ঞানমনস্কতা, বিজ্ঞানভাবনার
অসংখ্য নমুনা ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের কবিগুরু, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের
অসংখ্য প্রবন্ধে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, গানে, চিঠিপত্রে। তিনি
বিজ্ঞানের সত্যকে সাহিত্যের মাধুরী মিশিয়ে হাজির করেছেন আমাদের
সামনে, আমাদের চেতনাকে সত্যের রঙে রাঙিয়ে দিতে। তাই তাঁর অসংখ্য
কবিতা ও গানে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও উপমার উল্লেখ পাই। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য
তাঁর লেখা ‘তিনসঙ্গী’ গল্পগ্রন্থের চরিত্রগুলি, এদের মধ্যে দেখি
বৈজ্ঞানিকদের ছড়াছড়ি, একটি গল্পের নামই ‘ল্যাবরেটরী’।
জ্যোতির্বিজ্ঞানের
প্রতি রবীন্দ্রনাথের আকর্ষণ ছিল আশৈশব। মাত্র বারো বছর বয়সে বাবা
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে ডালহৌসি পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে সন্ধেবেলা
ডাকবাংলোর আঙিনায় চৌকিতে বসে বাবার কাছে অন্ধকার আকাশে গ্রহ-নক্ষত্র
চিনতেন। জেনে নিতেন সূর্য থেকে বিভিন্ন গ্রহের কক্ষপথের দূরত্ব,
প্রদক্ষিণের সময় ও অন্যান্য বিবরণ। জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল
আসক্তি তাঁকে টেনে নিয়ে যায় আইনস্টাইনের কাছেও। জ্যোতির্বিজ্ঞানের
উপর সমসাময়িক বিদেশি লেখকদের বই তিনি প্রবল আগ্রহে পড়েছেন। আর
এ সবেরই ফল, জীবনের শেষপর্বে (১৯৩৭) তাঁর লেখা সহজবোধ্য বিজ্ঞানগ্রন্থ
“বিশ্বপরিচয়”। রবীন্দ্রনাথ তাই অনায়াসে মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ব
ও জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর গতিবিধিসংক্রান্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সূক্ষ্ম
হিসেব-নিকেশ ‘নবজাতক’ কাব্যগ্রন্থের ‘প্রশ্ন’ কবিতায় উত্থাপন করেছেন-
‘চতুর্দিকে
বহ্নিবাষ্প শূন্যাকাশে ধায় বহুদূরে,
কেন্দ্রে তার তারাপুঞ্জ মহাকাল চক্রপথ ঘুরে।
কত বেগ, কত তাপ, কত ভার, কত আয়তন,
সূক্ষ্ম অঙ্কে করেছে গণন
পণ্ডিতেরা লক্ষ কোটি ক্রোশ দূর হতে
দুর্লক্ষ্য-আলোতে।’
কবির
স্পষ্ট ধারণা ছিল মহাকাশের নীহারিকা (Galaxy) সম্বন্ধে। ‘সানাই’
কাব্যগ্রন্থে ‘জ্যোতির্বাষ্প’ কবিতায় স্পষ্টতই লিখেছেন যে নক্ষত্রকে
বেষ্টন করে থাকে নীহারিকা। কবি গানেও ঠাঁই দিয়েছেন নীহারিকাদের-
‘……..
ওই যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড় আকাশের নীড়,
ওই যারা দিনরাত্রি
আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী
গ্রহ তারা রবি……..’
রবীন্দ্রনাথ
যখন তাঁর গানে লেখেন, ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো/ সেই তো
তোমার আলো’, তখন তা আমাদের Black Hole তত্ত্বকে মনে করিয়ে দেয়।
আবার যখন ‘উৎসর্গ’ কাব্যগ্রন্থে লেখেন ‘বিশাল বিশ্বে চারিদিক হতে/
প্রতি কণা মোরে টানিছে’, তখন মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথাই মনে পড়ে।
খুব প্রচলিত গানেও অবাক হয়ে লক্ষ করি অসামান্য প্রয়োগ – “হাসিতে
হাসিতে আলোকসাগরে আকাশের তারা তেয়াগে কায়”!
অণু-পরমাণুদের মিলনেই যে গড়ে উঠেছে এই বিশ্বজগৎ, বিশ্বের জড়, সজীব
সব কিছু, তা-ও ধরা পড়েছে কবির নানা কবিতা ও গানে। যেমন ‘বিচিত্রিতা’-তে
তিনি লিখেছেন-
‘যত বাণী,
যত সুর
সৃষ্টিচিত শিখা,
আকাশে আকাশে লিখে
দিকে দিকে
অণু পরমাণুদের মিলনের ছবি।’
আবার
এই পরমাণু যখন মুক্ত হয়ে প্রচণ্ড বেগে ছুটে যায় তখন কবি-কল্পনায়
তা ‘বিদ্রোহী’।কিন্তু মুক্ত পরমাণুকে তরঙ্গরূপ দিলে তা যে শৃঙ্খলিত
হয়ে বাঁধা পড়ে তা ‘নটরাজ’ কাব্যগ্রন্থে চমৎকারভাবে উল্লেখ করেছেন-
‘নৃত্যের
বলে সুন্দর হল
বিদ্রোহী পরমাণু,
পদযুগ ঘিরে জ্যোতি-মঞ্জীরে
বাজিল চন্দ্রভানু।’
মহাকাশে
শুধু আমাদের সৌরজগৎ নয়, সৌরজগতের মতো আরও লক্ষ-কোটি নক্ষত্র তাদের
গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে যে ঘুরপাক খাচ্ছে তা উঠে এসেছে কবির গানে-
‘অসীম
আকাশে অগণ্য কিরণ, কত গ্রহ-উপগ্রহ
কত চন্দ্র তপন ফিরিছে বিচিত্র আলোক জ্বালায়ে-’
আমরা
আজও ছোটোদের বলি এবং বইতেও পড়াই- সূর্য স্থির, আর গ্রহরা তাকে
কেন্দ্র করে ঘুরছে। কিন্তু সূর্যসহ সমস্ত নক্ষত্রই যে গতিশীল এবং
নীহারিকাকে কেন্দ্র করে আবর্তনশীল, তা বলি না। কিন্তু কবি গানে
উল্লেখ করেছেন,”…. চন্দ্র ছুটে, সূর্য ছুটে, সে পথতলে পড়িব লুটে-/
সবার পানে রহিব শুধু চাহি রে।” কিংবা “…. আকাশে ধায় রবি-তারা ইন্দুতে।”
সূর্য থেকে আলো যে তরঙ্গের আকারে আসে তা-ও তিনি গানের মধ্যে উল্লেখ
করেছেন- “আমার সুরে লাগে তোমার হাসি,/ যেমন ঢেউয়ে ঢেউয়ে রবির কিরণ
দোলে আসি।”
চাঁদ নিয়ে কাব্য, গল্প-গাথায় সব দেশের সব সাহিত্যই উর্বর। আমাদের
বাসগ্রহের নিকটতম প্রতিবেশী চাঁদে নীল আর্মস্ট্রং আর এডউইন অলড্রিনের
পদার্পণের পর থেকে চাঁদের হাজারো কল্প-কথা সরে গিয়ে বৈজ্ঞানিক
বাস্তবতা উন্মুক্ত হচ্ছে। আমাদের এই নিকটতম মহাজাগতিক প্রতিবেশীটির
জন্মবৃত্তান্ত, জন্মকালীন ও তৎপরবর্তী পরিবেশ, কোটি কোটি বছর ধরে
তার বিবর্তন- এমনই অসংখ্য বৈজ্ঞানিক সত্য বিজ্ঞানীরা উন্মোচিত
করে চলেছেন। রবীন্দ্রনাথও চাঁদ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সম্পর্কে
ছিলেন ওয়াকিবহাল। চাঁদে প্রাণহীনতার আক্ষেপও তাঁর কম ছিল না।
“শুনেছি
একদিন চাঁদের দেহ ঘিরে
ছিল হাওয়ার আবর্ত।
…………………………..............
আজ শুধু তার মধ্যে আছে
আলো ছায়ার মৈত্রীবিহীন দ্বন্দ্ব-
ফোটে না ফুল
বহে না কলমুখর নির্ঝরিণী।” (পত্রপুট)
প্রাণের
উদ্ভব নিয়েও রবীন্দ্রনাথের ছিল প্রবল আগ্রহ। সমুদ্রের জলে যে প্রাণের
উদ্ভব, তা ‘খাপছাড়া’ কাব্যগ্রন্থে ছোটো ছড়াতে উল্লেখ করেছেন। আবার
ক্ষুদ্রতম প্রাণকণা যে কালক্রমে উন্নত জীবে রূপান্তরিত হয়ে চলেছে
তা ‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থে কবি ছুঁয়ে গেছেন-
“বহু লক্ষ
বর্ষ ধরে জ্বলে তারা,
ধীরমান অন্ধকার কালস্রোতে
অগ্নির আবর্ত বুকে ওঠে।
সেই স্রোতে এ ধরণীর মাটির বুদবুদ
তারই মধ্যে এই প্রাণ
অণুতম কালে
কণাতম শিখা লয়ে
অসীমের সে করে আরতি।”
রবীন্দ্রনাথ
ভাগ্যবান, বিশ শতকের যে সময়টা বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ, তা তিনি পেয়েছিলেন।
দেশ ও বিদেশের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীরা ছিলেন তাঁর সমসাময়িক। আচার্য
জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গতা ছিল সবচেয়ে বেশি। মেঘনাদ
সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, সি.ভি.রমন
প্রমুখ বিজ্ঞানীদের সাথেও ছিল তাঁর পরিচিতি। আইনস্টাইনের সাথে
রবীন্দ্রনাথের সখ্যতাও বহুচর্চিত বিষয়। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ,
উইলহেম রন্টজেন, লুই ভিক্টর ব্রগলি, এডুইন হাবল, ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক,
আরনেস্ট রাদারফোর্ড প্রমুখ বিজ্ঞানীদের কাজের সাথেও তাঁর যথেষ্ট
পরিচয় ছিল। ফলে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার ও অগ্রগতি
সম্পর্কে ছিলেন সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। বিজ্ঞানে তাঁর জ্ঞানকে তিনি
কবিতায় ও গানে ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। তাঁর সময়েই
বিজ্ঞানের বহু আবিষ্কার শিল্পে জোয়ার এনেছিল। এই সময়ই আবিষ্কৃত
হয় অশোধিত খনিজ তেল শোধনের ক্যাটালাইটিক পদ্ধতি, হাই ভোল্টেজ ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক
জেনারেটর, বক্সাইট থেকে অ্যালুমিনিয়াম নিষ্কাশন পদ্ধতি, কৃত্রিম
তন্তু, লো-প্রেশার ওয়াটার টারবাইন, পরমাণু বিভাজন পদ্ধতি, বেকেলাইট,
ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম, পোলোনিয়াম, পেনিসিলিন, ডিডিটি ইত্যাদি। শিল্প
প্রত্যাশী কবি তাই সাদরে আহ্বান করেছেন যন্ত্রকে তাঁর গানে-
“নমো যন্ত্র,
নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র!
তুমি চক্রমুখরমন্দ্রিত, তুমি বজ্রবহ্নিবন্দিত….”।
কবিতা
ও গানে বিজ্ঞানের এমন সার্থক প্রয়োগ বিশ্বে আর কেউ করতে পারেননি।
আজ মহাকাশ বিজ্ঞানে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের অনায়াস যাতায়াত দেখে আমাদের
মত রবীন্দ্র অনুরাগীদের মনে হতেই পারে, তিনি তো অনেক আগেই গেয়ে
রেখেছিলেন – ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে, আমি মানব একাকী ভ্রমি
বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে!” আর “অসীম রহস্যমাঝে” তাঁদের এ চলার শেষ
নেই।
লেখক
পরিচিতি - সৌম্যকান্তি
জানা - বেড়ে ওঠা, স্কুলের পড়াশুনা কাকদ্বীপে। লেখালেখি,গানবাজনার
চর্চা শৈশব থেকেই। ১৯৯২ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি।
বর্তমানে কাকদ্বীপের কাছে একটি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। পাশাপাশি
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের একজন সক্রিয় সংগঠক। ছড়া, কবিতা, গল্প,
নাটিকা, প্রবন্ধ নিয়মিত প্রকাশিত প্রথম সারির বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর
লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।