বিবিধ প্রসঙ্গ
অগাস্ট ৯, ২০১৫
রবি করে জ্বালাতন !!
ভাস্কর বসু
আচ্ছা, রবীন্দ্রনাথের শিক্ষক সাতকড়ি দত্ত কি সত্য দ্রষ্টা ছিলেন? তা না হলে সেই কোন ছোটবেলাতেই কবিকে পাদপূরণের জন্য লিখতে দিয়েছিলেন – ‘রবিকরে জ্বালাতন আছিল সবাই’! তাঁর পরে যারাই সাহিত্য সৃষ্টি করতে যান, তুলনা এসে পড়ে তাঁর বিভিন্ন লেখার সঙ্গে। কবিদের তো আরো দুরবস্থা – কোন কোন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বলে বসতেন – ‘তাঁর কবিতার পর আর কবিতাই লেখা হয়নি’। আর সেই শুনে আধুনিক কবিরা খুব রেগে যেতেন আর বলতেন – ‘এমন কথা যারা বলেন, তাঁদের কবিতা পাঠ অপরিণত।’ সঙ্গে সঙ্গে এমনও হুমকি দেন - “অপরিণত র চেয়ে আরো কঠিনতর বিশেষণ ব্যবহারে আমরা বিরত রইলাম”।
তবে সবচেয়ে বিপদ হল তাঁদের যারা গীতিকার। সত্যি কথা বলতে কি ঠাকুর মশায় তাঁদের হাড় জ্বালিয়েছেন। সকলে, এমনকি আধুনিক কবিকুল ও নির্দ্বিধায় স্বীকার করে নেন যে গান লেখায় তাঁর জুড়ি মেলা ভার। আধুনিক কবিরাও তাঁর কবিতার প্রভাবকে অস্বীকার করেও তাঁর গান গেয়ে বেড়াতেন তাঁদের বিভিন্ন আড্ডায়। এমনকি এখনো কলকাতার যে কোন ভালো মিউজিক স্টোরে গেলে দেখা যাবে প্রায় অর্ধেক জায়গা দখল করে বসে আছে সেই আলখাল্লা পরা বুড়োর গানের ভাণ্ডার। সার্ধ শতবর্ষ ও তার পর তো আরো রমরমা। এমনকি বিভিন্ন নতুন প্রজন্মের শিল্পীরাও নেমে পড়েছেন তাদের ভাগ্য পরীক্ষায় ।
এ হেন রবীন্দ্রনাথ যে বাঙালী গীতিকারদের ভীষণভাবে প্রভাবিত করবেন তার আর আশ্চর্য কি! এ নিয়ে বিস্তর গুরুগম্ভীর গবেষণার অবকাশ আছে, কিন্তু তা আমাদের নাগালের বাইরে। আমরা ছোট খাটো আলোচনা করেই ক্ষান্ত দিই, কিছু নমুনা পেশ করেই ফেলা যাক। কিছুদিন আগে সলিল চৌধুরীর গানে রবীন্দ্রনাথের “উত্তরাধিকার” নিয়ে একটি এলবাম বের করেছিলেন সলিল শিষ্য অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, গান গেয়েছিলেন ও ভাষ্যপাঠ করেছিলেন প্রখ্যাত গায়ক শ্রীকান্ত আচার্য। তাতে বেশ সুন্দর করে বোঝা গিয়েছিল এই প্রভাবের ব্যাপারটি। সেই থেকে একটি গান নিয়ে আমরা আলোচনা করতে চাই – রবীন্দ্রনাথের এই গান যেন এক আহ্বান–
আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া
বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া।
এই যে বিপুল ঢেউ লেগেছে
তোর মাঝে তা উঠুক নেচে নেচে
সকল পরাণ দিক না নাড়া
বাইরে দাঁড়া।
আর সলিলের কাছে সে আহ্বান আদেশ এর মত শিরোধার্য –
এবার আমি আমার থেকে আমাকে বাদ দিয়ে
অনেক কিছু জীবনে যোগ দিলাম
ছোট যত আপন ছিল বাহির করে দিয়ে
ভুবনটারে আপন করে নিলাম।
নীচে ক্লিক করে গানটি শুনেই দেখা যেতে পারে -
কি অসাধারণ এক উত্তরসাধনা। “বিশ্বলোকের পাবি সাড়া” ই যেন সত্য হল কারণ “ভুবনটারে আপন করে নিলাম! অন্য একটি গানে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন –
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে
সার্থক জনম মাগো তোমায় ভালোবেসে।
শেষে –
আঁখি মেলে তোমার আলো
প্রথম আমার চোখ জুড়ালো,
ওই আলোতেই নয়ন রেখে
মুদব নয়ন শেষে
আর সলিলের গান –
ধন্য আমি জন্মেছি মা তোমার ধূলিতে
আমার জীবনে মরণে তোমায় চাইনা ভুলিতে
দেশ আমার মা - জীবনে ও মরণে সেই মা ই আমার প্রথম ও শেষ আশ্রয়।
এবার আসি একটু টলিউডের কথায়। বিখ্যাত ছবি ‘হারানো সুর’ – তার সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ঠিক করা হয়েছিল নায়কের স্মৃতিলোপ ও বিরহ উপলক্ষে ব্যবহার হবে বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত –
আমার এ পথ
তোমার পথের থেকে অনেক দূরে
গেছে বেঁকে গেছে বেঁকে
আমার ফুলে আর কি কবে
তোমার মালা গাঁথা হবে
তোমার বাঁশি কেঁদে হাওয়ায়
উড়ে বাজে কারে ডেকে
কোন কারণে (সম্ভবত: অনুমতি জনিত কোন ব্যাপার) তা হয়ে উঠছিল না, কিন্তু ঐ পরিবেশে ওরকম একটি গান যে দরকার! গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন ও সুরকার হেমন্তর মিলিত ফসল হল –
আজ দুজনার দুটি পথ ওগো
দুটি দিকে গেছে বেঁকে
তোমার ও পথ আলোয় ভরানো জানি
আমার এ পথ আঁধারে আছে যে ঢেকে
সেই শপথের মালা খুলে
আমারে গেছ যে ভুলে ।
নীচে ক্লিক করে গানটি শুনেই দেখা যেতে পারে -
‘দেয়া নেয়া’ ছবিতে যখন এই গৌরীপ্রসন্ন লেখেন – গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে / ভেবেছিল একটি পাখি তখন তিনি সম্ভবত: জানাতেই চেয়েছিলেন যে গানের ভিতর দিয়েই তাঁকে যিনি ভুবনখানি চিনিয়েছিলেন তিনি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আরো একজন গীতিকারকে অনুপ্রাণিত করে এইরকম আরো একটি গান লিখিয়েছিলেন –রবিঠাকুরের বিখ্যাত সেই গানটি হল –
আজি বিজন ঘরে নিশীথরাতে
আসবে যদি শূন্য হাতে –
আমি তাইতে কি ভয় মানি !
জানি জানি, বন্ধু, জানি –
তোমার আছে তো হাতখানি ।।
গীতিকার মিন্টু ঘোষের লেখা ‘অজানা শপথ’ ছবির সেই বিখ্যাত গানটি হল –
"ওগো বন্ধু আমার,
আঁধার রাতে যদি এলে/
হাতখানি রাখো মোর হাতে/
আমি নির্ভয়, নির্ভয়
ঠিক সেই রকম আরো একটি গান ‘নতুন জীবন’ ছবিতে, এটি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা –
এমন আমি ঘর বেঁধেছি
আহা রে যার ঠিকানা নাই
স্বপনের সিঁড়ি বেয়ে /
সেখানে পৌঁছে আমি যাই
এর অনুপ্রেরণা আবার –
স্বপন পারের ডাক শুনেছি
জেগে তাই তো ভাবি
কেউ কখনো খুঁজে কি পায়
স্বপ্নলোকের চাবি
স্বপনের সিঁড়ি বেয়ে যে ঘরে পৌঁছনো যাবে সেটাই তো স্বপ্নলোক! সেখানে গেলেই মলিনতা ধুয়ে নতুন জীবন পাওয়া যাবে। কিন্তু যাওয়া যায় কি করে, মনে সংশয় -
খুঁজে যারে বেড়াই গানে,
প্রাণের গভীর অতল-পানে
যে জন গেছে নাবি
সেই নিয়েছে চুরি করে স্বপ্নলোকের চাবি।
কিশোরকুমার এর গলায় গীতিকার মুকুল দত্তর আর একটি পুজোর গান ও ছিল খুব জনপ্রিয় –
“তারে আমি চোখে দেখিনি
তার অনেক গল্প শুনেছি
গল্প শুনে তারে আমি
অল্প অল্প ভালো বেসেছি”
এর মূল সুরটি যে গানে ছিল, তা হল, হল –
“এখনো তারে চোখে দেখি নি,
শুধু বাঁশি শুনেছি–
মন প্রাণ যাহা ছিল দিয়ে ফেলেছি"।
কিশোরকন্ঠে আরো একটি অতি বিখ্যাত গান হল –
“ওগো নিরুপমা,
করিও ক্ষমা,
তোমাকে আমার ঘরণী করিতে /
আমার মনের দোসর করিতে /
পারিলাম না/
পারিলাম না কিছুতেই
এখানেও গীতিকারের অনুপ্রেরণা ছিল রবীন্দ্রনাথের “অবিনয়” কবিতাটি – যেখানে বলা হয়েছে-
হে নিরুপমা,
গানে যদি লাগে বিহ্বল তান
করিয়ো ক্ষমা ॥ --
হে নিরুপমা,
চপলতা আজি যদি ঘটে তবে
করিয়ো ক্ষমা।
নিঃসন্দেহে ক্ষমা চাইবার কারণদুটি একেবারেই ভিন্ন, তবুও এই আধুনিক গানটির পিছনে রবিবাবুর একটু ‘হাত’ আছে মানতে হয়।
নীচে ক্লিক করে গানটি শুনেই দেখা যেতে পারে -
মান্না দে তাঁর স্মৃতি কথা ‘জীবনের জলসাঘরে’ তে সঙ্গীতস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে এক অন্য আলোয় দেখিয়েছেন আমাদের । তাঁর এই রবীন্দ্রভক্তির অনুপ্রেরণা যে তাঁর কাকা শ্রী কৃষ্ণচন্দ্র দে তাও জানাতে দ্বিধা করেননি। প্রসঙ্গত: কৃষ্ণচন্দ্র দেও তাঁর সময়কার গীতিকারদের অনুরোধ করতেন, ঐ আদলে গান লেখার জন্য। লিখছেন –
“কাকা রবীন্দ্রসঙ্গীত খুব ভালো বাসতেন। ---- বলতেন এত সুন্দর গানের কথা, এত সুন্দর গানের ভাষা ও সুরের মেল বন্ধন – এই গান গাইতে গেলে মনের সব পর্দা খুলে গাইতে হয়। নিজে তাই গাইতেন ও। তা ছাড়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের গানের কথায় বারবার আপ্লুত হয়ে সমসাময়িক গীতিকার শৈলেন রায়, হেমন্ত গুপ্ত, হেমেন্দ্রকুমার রায়, মোহিনী চৌধুরীদের বারবার বলতেন, আহা এই যে গানের এত সুন্দর ভাষা, শব্দ প্রয়োগ এত সুন্দর, উনি কি করে এরকম লেখেন বলো তো? তোমরা পারনা কেন এরকম লিখতে?”
মান্না ও তাঁর স্ত্রী আজীবন রবীন্দ্র ভক্ত, বাড়িতে আপনমনে দুজনে গাইতেন অজস্র রবীন্দ্রসঙ্গীত। পুলক বাবুকে একবার তো একটু অনুযোগের ভঙ্গিতেই মান্না দে বলে ফেলেছিলেন –
“আপনারা মশাই গান লেখেন, ভালোই লেখেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষা, কবিতার ভাষা একবার পড়ে দেখুন তো। সেই লেখার কয়েক লাইন পড়তে না পড়তেই চোখের সামনে দেখতে পাবেন সেই দৃশ্যটা। আমি যখনই গাই। ‘নাই রস নাই, দারুণ দহনবেলা’ – তখন যেন সেই রোদে পোড়া গরমের একটা হলকা হাওয়া এসে গায়ে লাগে। আবার যখন গাই বা শুনি, ‘শ্রাবণের গগনের গায়’, মনে হয় সে শ্রাবণের বাদলধারার একটা ভিজে বাতাসের ছোঁয়া পাচ্ছি দেহে মনে। এসব কিভাবে উনি লিখেছেন বলুন তো? ভেবে দেখেছেন – কীভাবে উনি শব্দ চয়ন করেছেন, কীভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন উনি একটি দৃশ্যের নিখুঁত ছবি ওঁর কবিতায়?”
পুলকবাবু বেশ অনুপ্রাণিত হয়ে লিখে ফেলেছিলেন – ছয় ঋতুর ছয়টি গান –তাতে বর্ষার গানে আমরা পাই –
“গহন মেঘের ছায়া ঘনায়ে
সে আসে ঐ আসে
বসে ছিলাম যার আশে
ঐ সে আসে সে আসে --
শুনি সাজ সাজ রবে
ভুবন সাজে মহোৎসবে
বিদ্যুতেরই চমক লাগা,
গহন মেঘের ছায়া ঘনায়ে সে আসে
নীচে ক্লিক করে গানটি শুনেই দেখা যেতে পারে -
বলাই বাহুল্য, এই গানগুলি পুলকবাবুর লেখা অন্যান্য গানের ধরন থেকে একেবারেই আলাদা। গানগুলি প্রবলভাবে সমাদৃত হয়েছিল। শেষে একদম সাম্প্রতিক একটি গান –
মেঘের পালক চাঁদের নোলক
কাগজের খেয়া ভাসছে –
বুক ধুক পুক্ চাঁদপানা মুখ
চিলেকোঠা থেকে হাসছে, --
এই গানটিতে হঠাৎ উদ্ধৃতির মত চলে আসে রবীন্দ্রনাথের একটি গান তার সুর কথা সমেত।
“আমি তুমি আজ একাকার হয়ে /
মিশেছি আলোর বৃত্তে /
মম চিত্তে নিতি নৃত্যে,
কে যে নাচে /
তাতা থৈ থৈ –
বিষয়টি বেশ অভিনব এবং খুবই শ্রবণসুখকর। আমরা আগে দেখেছি আধুনিক গানের কথায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের বাণীকে মূর্ত হয়ে উঠতে। কিন্তু সুর সমেত একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত হঠাৎ উদ্ধৃতির মত চলে আসবে একটি আধুনিক গানে, এমনটা কখনো আগে দেখা যায় নি। আমাদের সমস্ত সৃষ্টির নেপথ্যে রবীন্দ্রনাথের অনিবার্য উপস্থিতির একটি প্রমাণও বলা যেতে পারে ওই গানটিকে। একেবারে খুব আধুনিক গীতিকার ও সুরকাররাও তাঁর দ্বারা এমন অনুপ্রাণিত - কাজেই মনে হতেই পারে সেই আশ্চর্য, অফুরান রবীন্দ্রনাথ হয়তো ততখানি জ্বালাতন নন, যতখানি তিনি জাজ্বল্যমান পথনির্দেশক।
নীচে ক্লিক করে গানটি শুনেই দেখা যেতে পারে -
শিল্পী - নীলাদ্রি রায়
লেখক পরিচিতি - জন্ম কলকাতায়, বেড়ে ওঠা দক্ষিন চব্বিশ-পরগনার
রাজপুর-সোনারপুর অঞ্চলে। ১৯৮৩ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
ইলেক্ট্রনিক্স ও টেলিকম্যুনিকেশন ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে কর্মসূত্রে
ব্যাঙ্গালোরে। শখের মধ্যে অল্প-বিস্তর বাংলাতে লেখা - অল্প কিছু
লেখা রবিবাসরীয় আনন্দবাজার, উনিশ-কুড়ি, নির্ণয়, দেশ, ইত্যাদি পত্রিকায়।
শিল্পী পরিচিতি - পেশায় মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ার, কর্মসূত্রে বেঙ্গালুরু নিবাসী।
অবসর সময়ে ছবি (পেন্সিল স্কেচ ,জলরং) আঁকতে খুব ভালবাসেন।
অবসর পত্রিকায় এই প্রথম নিজের আঁকা ছবি ভাস্কর বসুর প্রবন্ধের সঙ্গে প্রকাশিত করলেন।
(আপনার
মন্তব্য জানানোর জন্যে ক্লিক করুন)
অবসর-এর লেখাগুলোর ওপর পাঠকদের মন্তব্য
অবসর নেট ব্লগ-এ প্রকাশিত হয়।